মানবেন্দ্র মজুমদার
['কথা রইল' শ্রী মানবেন্দ্র মজুমদার রচিত একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক। ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ তারিখে নাটকটি লেখা সম্পূর্ণ হয়েছিল। এই সংখ্যায় সেটির প্রথম পর্ব প্রকাশিত হল।]
যাদের নিয়ে - অবিনাশ, অনির্বাণ, অংশু, অদিতি এবং অটবি/অনুসূয়া।
[পর্দা খুললে দেখা যায় যে পাঁচজন মঞ্চে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা টেবিলকে ঘিরে। আবছা আলোতে তাদের কারোর মুখ দেখা যায় না। অবয়ব দেখে বোঝা যায় যে দুইজন মেয়ে ও তিনজন ছেলে। একটু দূরে মঞ্চের পিছন দিকে একটা লম্বা স্ট্যান্ডে একটা ক্যালেন্ডার। সালটা আলোয় জ্বলজ্বল করছে। যে দিন নাটকটি মঞ্চস্থ হবে তার ঠিক চল্লিশ বছর আগেকার সাল ও দিন। সেই স্ট্যান্ডের সামনে দর্শকের দিকে পিছন করে একজন দাঁড়িয়ে আছে। আবছা আলোতে বোঝা যায় যে এরা সবাই একটা রেস্টুরেন্টে রয়েছে।]
অবিনাশ ।। তাহলে কথা রইল...
সবাই ।। ইয়েস...
অবিনাশ ।। আমরা আজ থেকে...
অদিতি ।। ঠিক চল্লিশ বছর পরে...
অনির্বাণ ।। এই আজকের দিনে (যেদিন নাটকটা মঞ্চস্থ হয়, সে দিনের তারিখটা বলে)...
অটবি ।। সন্ধ্যে ছ'টায়...
অংশু ।। অখিলদার রেস্টুরেন্ট 'Transit Lounge'-এ...
সবাই ।। উপস্থিত হব।
অবিনাশ ।। আর চল্লিশ বছর পরে সেদিন যে সবার শেষে উপস্থিত হবে...
অদিতি ।। সে সেদিনকার সব খরচ বহন করবে।
অবিনাশ ।। আমি অবিনাশ এই প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করছি।
অদিতি ।। আমি অদিতি এই প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করছি।
অনির্বাণ ।। আমি অনির্বাণ এই প্রস্তাবে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে কোনোরকম প্ররোচনা ছাড়া সম্পূর্ণ সম্মতি জ্ঞাপন করছি।
অটবি ।। আমি অটবি এই প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করছি।
অংশু ।। আমি অংশু এই প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করছি। অখিলদা আমাদের এই অঙ্গীকারের সাক্ষী রইলে তুমি।
অখিল ।। আর আমি যদি ততদিন না থাকি?
অবিনাশ ।। তাহলে আমরা আমাদের উত্তরসুরির কাছে দায়িত্ব দিয়ে যাব সেদিন উপস্থিত থাকার। তুমিও তাই করবে অখিলদা। সবাই রাজি?
সবাই ।। রাজি-ই-ই...
অবিনাশ ।। কারো কোনো জিজ্ঞাস্য আছে?
সবাই ।। না-আ-আ...
অবিনাশ ।। তাহলে...
সবাই ।। কথা রইল...
[সবাই হাতে হাত মিলিয়ে হাতগুলো উপরে তুলে ধরে। ক্যালেন্ডার স্ট্যান্ডের কাছ থেকে অখিলও এসে হাতে হাত মেলায়। মঞ্চের সব আলো নিভে যায়। সবাই বেরিয়ে যায়। শুধু ক্যালেন্ডারের উপরের আলোটা জ্বলতে থাকে। ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো ওল্টাতে থাকে এবং সাল পরিবর্তন হতে থাকে। সাথে মঞ্চসজ্জাও পরিবর্তন হতে থাকে। চল্লিশ বছর পরে যখন আজকের দিন আসে তখন মঞ্চের আলো জ্বলে ওঠে। দেখা যায় একটা আধুনিক রেস্তোরাঁ। হাল্কা নিয়নে দেখা যায় রেস্তোরাঁর নাম লেখা - 'Transit Lounge'. একটা টেবিলে বড় করে লেখা রয়েছে - 'Reserved for 5A'. প্রায় প্রৌঢ় অখিল ধোপদুরস্ত পোশাক পরে সবকিছুর তদারকি করছে। একটা টেবিলে ফুল রাখছিল এমন সময় অদিতি প্রবেশ করে।]
অদিতি ।। অখিলদা...
অখিল ।। [ফ্লাওয়ারভাসে ফুল রাখতে রাখতে বলে] আসুন...
অদিতি ।। অখিলদা তোমার কাছেও 'আপনি' হয়ে গেলাম?
অখিল ।। [এগিয়ে এসে] অ-দি-তি...
অদিতি ।। হ্যাঁ, অদিতি।
অখিল ।। অ-দি-তি... অবশেষে সেই দিনটা এসেই গেল তাই না?
অদিতি ।। হুঁ - আর কেউ আসেনি অখিলদা?
অখিল ।। এখনও তো ৬টা বাজেনি - তোমাদের তো ৬টায় আসার কথা।
অদিতি ।। আসলে আমি আর ধৈর্য্য রাখতে পারছিলাম না জানো। আমি ভেবেছিলাম যে অবিনাশ ঠিক এসে উপস্থিত হবে সব্বার আগে।
অখিল ।। দেখ - সব এলো বলে।
অদিতি ।। তোমার রেস্তোরাঁটা কিন্তু খুব সুন্দর দেখতে হয়েছে এখন।
[অংশু ঢুকে দাঁড়ায়। এরা কেউ খেয়াল করে না।
অখিল ।। 'Transit Lounge' - ক্ষণিকের আশ্রয়স্থল - নামটা তোমরাই রেখেছিলে। মনে পড়ে?
অংশু ।। পড়ে না আবার! এই নাম নির্বাচন নিয়ে কত তর্কের ঝড়। অবশেষে এই অংশু যখন বলল যে এটা তো আমাদের ক্ষণিকের আশ্রয়স্থল - সাথেসাথেই সেটাকে লুফে নিয়ে অবিনাশ নাম রেখে দিল - 'Transit Lounge'.
অদিতি ।। অং-শু...
অংশু ।। অ-দি-তি...
অখিল ।। তোমরা কথা বল, আমি একটু ওদিকটা সামলে আসি
[ওরা মাথা নাড়ে। অখিল বেরিয়ে যায়।]
অংশু ।। যাক, খুব একটা বেশি দেরি করিনি - কি বলিস?
অদিতি ।। মাত্র চল্লিশটা বছর।
অংশু ।। কেমন দেখতে দেখতে কাটিয়ে দিলাম বল?
অদিতি ।। কাটিয়ে দিলাম না কেটে গেল - কে জানে!
অংশু ।। আচ্ছা, তুই এত তাড়াতাড়ি এলি কিভাবে? আগে তো তুই সবচেয়ে দেরীতে আসতিস।
অদিতি ।। দেখ - সময় তাহলে আমাকে কিছুটা হলেও বদলে দিয়েছে।
অংশু ।। হ্যাঁ, অখিলদার রেস্টুরেন্টের মতো।
অদিতি ।। আমার গায়েও কি এরকম আধুনিকতার কর্পোরেট কর্পোরেট ছাপ পড়েছে না কি?
অংশু ।। দাঁড়া ভালো করে দেখি - হুঁ-হুঁ-হুঁ - না সেরকম কোনো ছাপ পড়েনি - সামান্য উজ্জ্বল হয়েছিস।
অদিতি ।। অভিজ্ঞতায় উজ্জ্বল -
অংশু ।। অদিতি...
অদিতি ।। বল...
অংশু ।। কোথায় থাকিস এখন তুই?
অদিতি ।। রাজকুটীরে।
অংশু ।। মানে?
অদিতি ।। হোটেল রাজকুটীরে। গতকাল রাত ১১টায় পৌঁছেছি ওখানে।
অংশু ।। কোথা থেকে পৌঁছলি?
অদিতি ।। রিভার্স রান ড্রাইভ, নিস্কায়ুনা, নিউইয়র্ক। আসলে আমি এখন আর এদেশের কেউ নই।
অংশু ।। তোদের পাইকপাড়ার বাড়ি?
অদিতি ।। বাবা মা মারা যাবার পরে ভাই বেচে দিয়ে সাউথ ইন্ডিয়াতে ওর শ্বশুরবাড়ির কাছে সেটল করেছে আজ থেকে প্রায় ১৬/১৭ বছর আগে। তুই?
অংশু ।। আমি এখান থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে এক পাড়াগাঁতে বাস করি।
অদিতি ।। তুই তো বরাবরই ভালোবাসতিস বাংলার গ্রাম। নিজের পছন্দের সাথে থাকতে পারার আনন্দই আলাদা।
অংশু ।। ঠিক বলেছিস।
অদিতি ।। একবার তুই আর অনির্বাণ একটা গ্রাম ঘুরে আসার পরে অনির্বাণ একটা সুন্দর কবিতা লিখেছিল। তুই দারুণ আবৃত্তি করেছিলি। মনে আছে তোর?
অংশু ।। সাদা বালির গ্রাম্য পথে, বিদ্যাধরীর বাঁকে -
সজনে ফুলের মিষ্টি সুবাস বাতাস জুড়ে থাকে।
জ্যোৎস্না রাতে রূপোয় মোড়া, পথটি ধরে গেলে
বিদ্যাধরী বলত হেসে - কতদিন পর এলে।
দুই দিকেতে দেখতে পেতাম, সবুজ ধানের মাঠ
মাথার উপর হাজার তারা, জীবন সহজপাঠ।
ঐ পাড়েতে লাল আবীরের, পলাশ শিমুল বন
আমের মুকুল সঙ্গী তাদের, করছে আলাপন।
বিদ্যাধরীর বুকের মাঝে টিমটিমিয়ে জ্বলে
আবুল চাচার ডিঙি নৌকোর লম্ফ ছইয়ের তলে।
আবুল চাচা আড় বাঁশিতে তুলত সুরের ঢেউ
জ্যোৎস্না চাচার সঙ্গী শুধু - ত্রিভূবনে নেই কেউ।
সুরের তালে জ্যোৎস্না নাচে, নাচে বিদ্যাধরী
আম পলাশ আর শিমুল নাচে তারা'য় সঙ্গী করি।
অদিতি ।। অপূর্ব অংশু... আগের থেকে এবার কিন্তু শুনতে আরও ভালো লাগল। কি আবেগ... কি অনুভূতি...
অংশু ।। হ্যাঁ রে - আর কেউ আসবে তো? তা না হলে যে বিলটা - আমাকেই দিতে হবে।
অদিতি ।। অংশু - তুই চিরটাকাল সেই একইরকম রয়ে গেলি হাড় কিপটে...
অংশু।। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে - সবচেয়ে বেশি বোধহয় আমিই খরচ করে ফেলেছি জানিস।
অদিতি ।। কিপটেরা ওরকমই বলে। এক পয়সা খরচ হলে ভাবে যে সে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় খরুচে লোক। এখনও তো অটবি, অবিনাশ আর অনির্বাণ আসেনি।
অংশু ।। হ্যাঁ, কিন্তু অবিনাশ তো দেরী করার পাত্র না। সব সময় সব কাজে তো ও প্রথম সারিতে থাকত - উদ্যোগ নিত। আজ কি হল?
অদিতি ।। ঠিক আসবে। আর অনির্বাণ তো শিল্পী মানুষ। বরঞ্চ ওর আসাটাই অনিশ্চিত। [অদিতি টেবিলে রাখা 'Reserved for 5A' লেখাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। তারপরে গভীর স্বরে বলে...] মনে আছে - কলেজে আমাদের সবাই 5A বলে ডাকত?
অংশু ।। সেটা কি ভোলা যায়?
অদিতি ।। অবিনাশ, অনির্বাণ, অদিতি, অটবি ও অংশু।
[অনির্বাণ ঢুকে কথাটা শোনে, তারপরে বলতে বলতে টেবিলে এসে বসে]
অনির্বাণ ।। অদিতির অটবিতে অংশু, অনির্বাণ ও অবিনাশ। কি সুন্দর কথা! পৃথিবীর অরণ্যতে সূর্য্যরশ্মি চিরদীপ্ত এবং চিরকালীন। আমি অনির্বাণ -
এখনও এ ধরার বুকে দীপ্তমান
সেটা তুষের আগুনের মতও হতে পারে -
হতে পারে প্রদীপ শিখার মতো কম্পমান -
অদিতি ।। অনি...
অনির্বাণ ।। তাহলে বল অংশু... শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আমরা এখনও অদিতির বুকে... মানে ধরার মাঝে বিদ্যমান।
অদিতি ।। অনি... এখনও তোর সেই ছন্দ মিলিয়ে হেঁয়ালি করে কথা বলাটা যায়নি তাহলে?
অনির্বাণ ।। বলতে পারিস বেড়েছে সামান্য। আসলে যত দিন যাচ্ছে ততই বুঝতে পারছি যে জীবনটাই কেমন যেন হেঁয়ালিতে ভরা।
অদিতি ।। বিয়ে করিসনি বোধহয়।
অনির্বাণ ।। আমাদের মধ্যে তুইই ছিলি সবচেয়ে বুদ্ধিমতী।
অদিতি ।। মানে?
অনির্বাণ ।। এই যে আমি বিয়ে করিনি সেটা কি সুন্দর ধরে ফেললি - তার জন্য বললাম।
অদিতি ।। এর সাথে বুদ্ধির কি সম্পর্ক?
অনির্বাণ ।। বিয়ে করলে হয়ত অনেক আগেই বুঝতে পারতাম যে জীবনটা পুরোটাই হেঁয়ালি। বিয়ে করিনি বলেই না বুঝতে এত দেরি হল।
অদিতি ।। অনি - কি করে তুই একই রকম রয়ে গেলি বলত?
অনির্বাণ ।। মস্তিষ্কের শিক্ষিকা জোটেনি যে - তাই।
অদিতি ।। মানে?
অনির্বাণ ।। মানে মাথার উপরে ছড়ি ঘোরাবার মানুষ নেই। আর যারা আছে তারা ছড়ি ধরতেই শেখেনি এখনও।
অদিতি ।। আবার সেই হেঁয়ালি করে কথা বলা। যারা আছে মানে কারা?
অনির্বাণ ।। জামুরিয়া, অন্ডাল, কালাপাহাড়ি, কুল্টি, সালানপুর প্রভৃতি জায়গায় কোলিয়ারিতে কাজ করা কুলি-কামিনদের ছোটো ছোটো বাচ্চারা। তাদের সাথে জীবন কাটাই - তারা এখনও মস্তিষ্কের ব্যবহার শেখেনি - হৃদয়ের ব্যবহারটাই জানে কেবল।
অংশু ।। বাঃ অনি - দারুণ কথাটা বললি তো - মস্তিষ্কের শিক্ষিকা...
অনির্বাণ ।। হ্যাঁরে অংশু অখিলদা বেঁচে আছে তো?
অদিতি ।। [অনির্বাণের হাতে একটা চড় মেরে] ধ্যাৎ... অসভ্য কোথাকার - বেঁচে আছে।
অনির্বাণ ।। [চিৎকার করে] | অখিলদা - আমি অনির্বাণ - এক পেট সর্বগ্রাসী খিদে নিয়ে তোমার এই ক্ষণিকের আশ্রয়স্থলে বসে আছি - আহার্য দাও -
[অখিল হাসতে হাসতে প্রবেশ করে খাওয়ার ডিশ নিয়ে]
অখিল ।। এই যে - আমি হাজির - তুমি এটা দিয়ে শুরু কর - আরও আসছে...
অনির্বাণ ।। সহস্রায়ু হও...
অখিল ।। ফাজলামি হচ্ছে?
অনির্বাণ ।। একদম না। মন থেকে চাইছি। তুমি হাজার বছর বেঁচে থেকে আমাদের মুখে সুস্বাদু আহার্য জুগিয়ে যাও।
অখিল ।। আর তোমরাও হাজার বছর ধরে তোমাদের এই 'Transit Lounge'-এর শোভা বর্ধন কর।
অংশু ।। আমরা আবার নিয়মিত আসা শুরু করলে কিন্তু তোমার আবার সেই আগের মতো খাতা চালু করতে হবে অখিলদা।
অনির্বাণ ।। আর তোমার এই 'Transit Lounge'-এর চেহারাটাও সেই আগের মতো হয়ে যাবে আবার।
অখিল ।। তোমাদের জন্য আমি তাতেও রাজি। সবচেয়ে বড় কথা তোমরা না থাকলে 'Transit Lounge' নিয়ে আমি কোনোদিন শক্তভাবে মাটিতে দাঁড়াতেই পারতাম না। হারিয়ে যেতাম সময়ের স্রোতে। তোমরা তোমাদের এই অখিলদার পায়ের তলায় শক্ত মাটি জুগিয়েছ তার নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্য। তোমাদের জন্য খাতা চালু করতে পারলে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব।
অদিতি ।। কিন্তু অখিলদা আমাদের নিজেদের জীবনের খাতাতেই যে এখন লাল কালির অঙ্ক বেশি? জমার ঘর শূন্য - সব যে হাতের ফাঁক গলে খরচ হয়ে গিয়েছে - সেটাতো তুমি জানো না অখিলদা।
অখিল ।। এইতো খুঁজে পেয়েছ আবার রত্ন ভান্ডার। এবার জমার অঙ্কে ভরিয়ে তোলো সবাই জীবনের হিসেবনিকেসের খাতা। যতটা পার সেই রত্ন ভান্ডার থেকে মণি-মাণিক্য নিয়ে যাও সবাই।
অনির্বাণ ।। বলতে পারিস বেড়েছে সামান্য। আসলে যতদিন যাচ্ছে ততই বুঝতে পারছি যে জীবনটাই কেমন যেন হেঁয়ালিতে ভরা।
অদিতি ।। বিয়ে করিসনি বোধহয়।
অনির্বাণ ।। আমাদের মধ্যে তুইই ছিলি সবচেয়ে বুদ্ধিমতী।
অদিতি ।। মানে?
অনির্বাণ ।। এই যে আমি বিয়ে করিনি সেটা কি সুন্দর ধরে ফেললি তার জন্য বললাম।
অদিতি ।। এর সাথে বুদ্ধির কি সম্পর্ক?
অনির্বাণ ।। বিয়ে করলে হয়ত অনেক আগেই বুঝতে পারতাম যে জীবনটা পুরোটাই হেঁয়ালি। বিয়ে করিনি বলেই না বুঝতে এত দেরি হল।
অদিতি ।। অনি - কি করে তুই একই রকম রয়ে গেলি বলত?
অনির্বাণ ।। মস্তিষ্কের শিক্ষিকা জোটেনি যে - তাই।
অদিতি ।। মানে?
অনির্বাণ ।। মানে মাথার উপরে ছড়ি ঘোরাবার মানুষ নেই। আর যারা আছে তারা ছড়ি ধরতেই শেখেনি এখনও।
অদিতি ।। আবার সেই হেঁয়ালি করে কথা বলা। যারা আছে মানে কারা?
অনির্বাণ ।। জামুরিয়া, অন্ডাল, কালাপাহাড়ি, কুল্টি, সালানপুর প্রভৃতি জায়গায় কোলিয়ারিতে কাজ করা কুলি-কামিনদের ছোটো ছোটো বাচ্চারা। তাদের সাথে জীবন কাটাই তারা এখনও মস্তিষ্কের ব্যবহার শেখেনি হৃদয়ের ব্যবহারটাই জানে কেবল।
অংশু ।। বাঃ অনি - দারুণ কথাটা বললি তো মস্তিষ্কের শিক্ষিকা-
অনির্বাণ ।। হ্যাঁরে অংশু অখিলদা বেঁচে আছে তো?
অদিতি ।। [অনির্বাণের হাতে একটা চড় মেরে] ধ্যাৎ অসভ্য কোথাকার - বেঁচে আছে।
অনির্বাণ ।। [চিৎকার করে] | অখিলদা - আমি অনির্বাণ - এক পেট সর্বগ্রাসী খিদে নিয়ে। তোমার এই ক্ষণিকের আশ্রয়স্থলে বসে আছি- আহার্য দাও -
[অখিল হাসতে হাসতে প্রবেশ করে খাওয়ার ডিশ নিয়ে]
অখিল ।। এই যে - আমি হাজির তুমি এটা দিয়ে শুরু কর - আরো আসছে -
অনির্বাণ ।। সহস্রায়ু হও
অখিল ।। ফাজলামি হচ্ছে?
অনির্বাণ ।। একদম না। মন থেকে চাইছি। তুমি হাজার বছর বেঁচে থেকে আমাদের মুখে সুস্বাদু আহার্য জুগিয়ে যাও।
অখিল ।। আর তোমরাও হাজার বছর ধরে তোমাদের এই Transit Lounge-এর শোভা বর্ধন কর।
অংশু ।। আমরা আবার নিয়মিত আসা শুরু করলে কিন্তু তোমার আবার সেই আগের মত খাতা চালু করতে হবে অখিলদা।
অনির্বাণ ।। আর তোমার এই Transit Lounge-এর চেহারাটাও সেই আগের মত হয়ে যাবে আবার।
অখিল ।। তোমাদের জন্য আমি তাতেও রাজি। সবচেয়ে বড় কথা তোমরা না থাকলে Transit Lounge নিয়ে আমি কোনোদিন শক্ত ভাবে মাটিতে দাঁড়াতেই পারতাম না। হারিয়ে যেতাম সময়ের স্রোতে। তোমরা তোমাদের এই অখিলদার পায়ের তলায় শক্ত মাটি জুগিয়েছ তার নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্য। তোমাদের জন্য খাতা চালু করতে পারলে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব।
অদিতি ।। কিন্তু অখিলদা আমাদের নিজেদের জীবনের খাতাতেই যে এখন লাল কালির অঙ্ক বেশি? জমার ঘর শূন্য - সব যে হাতের ফাঁক গলে খরচ হয়ে গিয়েছে সেটাতো তুমি জানো না অখিলদা।
অখিল ।। এইতো খুঁজে পেয়েছ আবার রত্ন ভান্ডার। এবার জমার অঙ্কে ভরিয়ে তোলো সবাই জীবনের হিসেব নিকেসের খাতা। যতটা পার সেই রত্ন ভান্ডার থেকে মণি মাণিক্য নিয়ে যাও সবাই।
অনির্বাণ ।। ঠিক বলেছ অখিলদা। এই মণি-মাণিক্যের মধ্যে কিন্তু ভালো ভালো খাওয়ারও পড়ে। সুতরাং তুমি আরও কিছু খেতে দাও আমায়।
অখিল ।। এক্ষুনি আনছি। [অখিল বেরিয়ে যায়]
অংশু ।। এই সন্ধ্যেবেলাতে তোর পেটে এত খিদে কেন রে অনি?
অনির্বাণ ।। জানিস না? রাক্ষসেরা তো সন্ধ্যেবেলাতেই খাওয়া দাওয়া সেরে নেয়। রাক্ষুসে খিদে তো সন্ধ্যেবেলাতেই বাড়ে।
অদিতি ।। তুই কি রাক্ষস নাকি?
অনির্বাণ ।। অবশ্যই। আমি তো আর্য নই। অনার্য। ভূমিপুত্র। ভূমিপুত্ররা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে সূর্য ডোবার সাথে সাথে পেট ভরে খেয়ে দেয়ে বিশ্রামে চলে যেত। আর্যরা এই ভূমিপুত্রদের নাম দিয়েছিল রাক্ষস। বিশেষত যেসব ভূমিপুত্ররা পাহাড়ে বা জঙ্গলে বসবাস করত - তাদের। কারণ এরা রাতের অন্ধকারে পাহাড়ে বা জঙ্গলে সাচ্ছন্দে বিচরণ করত।
অদিতি ।। তা যদি হয়ও তাহলে সেটাও তো অনেকদিন আগেকার ঘটনা। এখন তো সেই আর্য-অনার্যের অস্তিত্ব নেই। তাহলে তুই যে রাক্ষস সেটা প্রমাণ হল কিভাবে?
অনির্বাণ ।। আমার মধ্যে সেই জিনটা চলে এসেছে। আমি বুঝতে পারি। দেখ না - তাইতো আমি আমার রাক্ষুসে খিদে নিয়ে সবকিছু খেয়ে ফেলেছি। [শূন্য প্লেটটা দেখায়]
অদিতি ।। তুই পারিসও বটে।
অনির্বাণ ।। [খালি প্লেটটা হাতে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে। যখন ক্লাস ফোরে পড়ি তখন এক সন্ধ্যেবেলায় খিদের জ্বালায় আমি আমার বাবাকে খেয়ে ফেলেছিলাম।
অদিতি ।। [একটা গ্লাসে জল ঢেলে অনির্বাণের হাতে দিয়ে বলে -] এটা খা -
অনির্বাণ ।। [ঢক ঢক করে জলটা খেয়ে নেয়] আঃ... প্রাণ পেলাম -
অংশু ।। অখিলদাকে কিছু আনতে বলি?
অনির্বাণ ।। [হাতের ইশারায় অংশুকে থামতে বলে। শূন্য গ্লাসটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলে -] প্রাণ পেলাম পাত্র শূন্য করে। ঠিক ভর সন্ধ্যেতে জন্মালাম রাক্ষুসে খিদে নিয়ে। যে আধারে জীবনসুধা ছিল সেই আধারটাকেই খেয়ে ফেললাম।
অদিতি ।। অনি -
অনির্বাণ ।। আমি শুনেছি যে আমি জন্মাবার ঠিক দশ মিনিট পরে আমার মা মারা গিয়েছিল। আচ্ছা তোরা কেউ বলতে পারবি - ওই দশ মিনিটের মধ্যে আমার মা কি আমায় দেখে যেতে পেরেছিল? মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করতে করতেও কি আমার মায়ের মনে হয়েছিল যে আমাকে একবার অন্তত বুকে জড়িয়ে ধরে - কপালে একটা ছোট্ট চুমু খায় - কানে কানে বলে - ভালো থাকিস?
অদিতি ।। হ্যাঁ পেরেছিল রে - পেরেছিল - তিনি তোকে বুকে জড়িয়ে ধরে এত শাস্তি পেয়েছিলেন যে মৃত্যু যন্ত্রণা তখন ওঁনার কাছে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। উনি মৃত্যুর কোনো যন্ত্রণাই উপলব্ধি করেননি। মায়েরা সদ্যোজাত সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরলে পৃথিবীর সব যন্ত্রণা ভুলে যায়।
অনির্বাণ ।। জানিস বড় হওয়ার পরে আমি একথা শুনেছি যে আমার মায়ের মুখে না কি কোনো মৃত্যু যন্ত্রণার চিহ্ন ছিল না। কিন্তু মা আমায় কোলে নিয়ে দেখেছিলেন কিনা - সেটা আমায় কেউ বলতে পারেনি। অনেককে জিজ্ঞাসা করেছি - কেউ বলতে পারেনি।
অংশু ।। অবশ্যই তিনি তোকে দেখে গিয়েছেন - সন্তানকে না দেখে মা চলে গেলে মায়ের সারা মুখে সন্তানকে না দেখতে পাবার মানসিক কষ্টের ছাপ ফুটে ওঠে। তোর মায়ের ক্ষেত্রেও সেটাই হতো রে অনি - সেটাই হতো। কিন্তু তা হয়নি - তার মানে তিনি তোকে প্রাণভরে দেখে গিয়েছেন -
(ক্রমশ)