সংস্কৃতি ও বিনোদন

  • কথা রইল (দ্বিতীয় পর্ব)

মানবেন্দ্র মজুমদার

['কথা রইল' শ্রী মানবেন্দ্র মজুমদার রচিত একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক। ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ তারিখে নাটকটি লেখা সম্পূর্ণ হয়েছিল। এই সংখ্যায় সেটির দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হল।]

যাদের নিয়ে - অবিনাশ, অনির্বাণ, অংশু, অদিতি এবং অটবি/অনুসূয়া।


 

অনির্বাণ ।। জানিনা রে - আমি জানিনা - কিচ্ছু জানিনা। কিন্তু এটা জানি যে আমি এক সর্বগ্রাসী রাক্ষুসে খিদে নিয়ে জন্মেছি। যেহেতু সন্ধ্যেবেলায় আমি আমার বাবা-মা দুজনকেই খেয়ে ফেলেছি তাই আমার ভর সন্ধ্যেবেলায় খিদে পাওয়ার আইনসম্মত অধিকার আছে। সুতরাং -

অংশু ।। [চিৎকার করে] - অখিলদা-আ-আ...

[অখিল ট্রে-তে করে কিছু খাওয়ার নিয়ে প্রবেশ করে।]

অখিল ।। হাজির-র-র... - [প্লেট নামিয়ে রাখে টেবিলে।]

অংশু ।। অখিলদা তোমার সেই স্পেশাল চা কি এখন আর বানাও না?

অখিল ।। কেবলমাত্র তোমাদের জন্য স্পেশাল চায়ের স্পেশাল ব্যবস্থা রেখেছি। নিয়ে আসছি।

অদিতি ।। অখিলদা তোমার রেস্তোরাঁতে আর অন্য কোনো কাস্টমার দেখছি না কেন?

অখিল ।। আজ পুরো রেস্তঝরাঁটাই রিজার্ভ করে রাখা হয়েছে কেবলমাত্র তোমাদের জন্য।

অদিতি ।। তুমি আমাদের আরও আষ্টেপৃষ্ঠে মায়ার জালে আটকে ফেললে। যত ভাবি যে এই বয়সে এসে আর কোনো মায়ায় নতুন করে জড়িয়ে পড়ব না - তত বেশি করে জড়িয়ে পড়ি। কেন বলো তো অখিলদা?

অখিল ।। ভালোবাসার নিয়মই এই - আটকে রাখা আর আটকে পড়া - এর থেকে মুক্তি নেই - আমিও এই মায়ায় জড়ানো সন্ধ্যেটা আর কাউকে ভাগ দেব না বলে এই ব্যবস্থা করেছি।

অদিতি ।। খুব ভালো করেছ অখিলদা। তাহলে আজ অনির গান শোনা যাবে -

অংশু ।। Yes-s-s... কতদিন অনির গান শুনি না। শুরু কর অনি -

অখিল ।। [অনির্বানের কাছে গিয়ে ওর পিঠে হাত দিয়ে] গান ধর - মন প্রাণ খুলে গান গাও - সুরের মূর্ছনায় ধুয়ে যাক অন্তরে জমে থাকা সব দুঃখ যন্ত্রণা - আমি স্পেশাল চা নিয়ে আসছি -

[অখিল বেরিয়ে যায়।]

অদিতি ।। গা অনি -

অনির্বাণ ।। [গান ধরে] ও তুই বসে আছিস কিসের আসায়
তোর মন কি বলে না
দিনের আলো নিভে গেল
কেন বুঝিস না।
ও তুই সন্ধ্যেবেলায় ভজন করিস
ভোরের বন্দনা
ও মন রাত্রি এসে কড়া নাড়ে
কেন শুনিস না -

[গানের রেশ মিলিয়ে যায়। সবাই চুপচাপ বসে থাকে। নেপথ্যে একতারার টুংটাং শব্দ ভেসে আসে হাল্কাভাবে। অদিতি চোখ থেকে চশমাটা খোলে। কাঁচ দুটো মুছে নেয়। আস্তে আস্তে বলে -]

অদিতি ।। সেদিন আমারও মনে হয়েছিল জানিস - যে আমার জীবনে ভোরবেলাতেই গভীর রাতের রাগিণী বেজে উঠেছে। রাত্রি এসে সকালবেলাতেই কড়া নাড়ছে আমার ঘরের দরজায়। চারদিকে নিকষ কালো আঁধার ছাড়া কোথাও এক বিন্দু আশার আলো নেই - এত অন্ধকার চারিদিকে। বিদেশ বিভুঁইতে একা আমি - সম্বল বলতে আমার হাতে শ' দুয়েক ডলার। শৈবাল অফিসের কাজে ক্যালিফোর্নিয়াতে যাবার ঠিক ছ' দিনের মাথায় House Rent Agency-র লোকেরা লিগ্যাল নোটিশ নিয়ে হাজির হল - ৭২ ঘন্টার মধ্যে বাসা ছেড়ে দিতে হবে। কারণ Agency-র সাথে মিস্টার শৈবাল মিটারের agreement cancel হয়ে গিয়েছে। বললাম - সেটা কি করে সম্ভব? ওরা জানাল যে ওদের ক্লায়েন্ট মিস্টার শৈবাল মিটার কারণ হিসেবে জানিয়েছেন যে উনি ওঁনার স্ত্রীকে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়াতে সেটল করেছেন। আমি বললাম - এ অসম্ভব হতেই পারে না, শৈবাল তো অফিসের কাজে ক্যালিফোর্নিয়াতে গিয়েছে - আর আমি - শৈবালের স্ত্রী - এই যে এখানে রয়েছি - অবশ্য হ্যাঁ - এবার বেশ কিছুদিন ক্যালিফোর্নিয়াতে থাকতে হবে সে'কথা বলে গিয়েছে শৈবাল, মাঝে এসে আমায় নিয়ে যাবে বলেছে। আমি শৈবালকে ফোন করলাম - ও প্রান্ত থেকে জানাল যে এই নাম্বারের কোনো অস্তিত্ব নেই - আশ্চর্য হয়ে গেলাম - গতকাল সন্ধ্যেবেলাতেও আমি কথা বলেছি এই নাম্বারে - আবার ফোন করলাম - this number does not exist - বারবার একই জবাব ভেসে আসতে থাকল - আমি বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম যারা নোটিশ দিতে এসেছিল তাদের দিকে - আমি কোথায় যাবো - কার কাছে যাবো - কি করব এখন - দেশে ফিরব? কার কাছে? একমাত্র ভাই রয়েছে দেশে - কিন্তু সেও তো বাবা-মা মারা যাবার পর থেকে আর কোনো সম্পর্ক রাখে না - কলকাতার বাড়ি বেচে দিয়ে চলে গিয়েছে হায়দ্রাবাদে না ব্যাঙ্গালোর কোথায় যেন জানায়ওনি আমাকে - কার কাছে যাবো আমি - কি করেই বা যাবো - দেশে ফেরার পয়সাও তো আমার কাছে নেই। যারা নোটিশ দিতে এসেছিল তাদেরকেই জিজ্ঞাসা করলাম যে আমি কোথায় যাব এখন? - তারা নিজেরা কিছু বলাবলি করল নিজেদের মধ্যে নিচুস্বরে - একজন বাইরে গিয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলল - ঘরে এসে আমাকে বলল যে যেহেতু এই বাড়িতে পরের ভাড়াটে ১৫ দিন পরে আসবে - আর ওদের বাড়িটা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করতে দিন সাতেক সময় লাগবে - তাই ওরা আমাকে আর সাত দিন এই বাসায় থাকার অনুমতি দিতে পারে - কিন্তু সাত দিন পরে আমাকে ছেড়ে দিতেই হবে - ওরা চলে গেল - আমি স্থাণুবৎ বসে রইলাম -

[অনির্বাণ এক গ্লাস জল এগিয়ে দেয় অদিতির দিকে। অদিতি এক ঢোক জল খায়। আবার বলতে শুরু করে]

সেদিনই বিকেলবেলায় একজন উকিল এলেন। শৈবাল ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে। আসলে সব দুঃখই সাথে উত্তরাধিকারী নিয়ে আসে। জানিনা কি মনে হল - ভাবলাম গাফিলতি তো আমার - সম্পর্কের সুন্দর বন্ধনে যাকে বাঁধতে পারিনি তাকে আইনের কোন ধারায় বেঁধে রাখতে পারব? - সই করে দিলাম। সেই উকিল ভদ্রলোকও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে - তারপরে জিজ্ঞাসা করলেন যে আমি আর একবার ভাবব কি না - দরকার হলে উনি দু'দিন পরে আসতে পারেন - বললাম - না, তার দরকার নেই। বয়স্ক মানুষ - কি যেন ভাবলেন বেরিয়ে যাবার আগে - কাছে এসে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন - ভগবান তোমায় রক্ষা করুক। নিজের ভিজিটিং কার্ডটা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন জীবনে কোনোদিন কোনো প্রয়োজন হলে আমি যেন নিঃশঙ্কোচে ওঁনার সাথে দেখা করি। চলে গেলেন উনি। কেন জানিনা আমার তখন কান্নাও আসছিল না। শুধু ভয় আর ভয়। - কখন যে রাত কেটে গিয়ে ভোর হয়ে গেল বুঝতে পারিনি। সুস্থিরভাবে সারারাত ধরে কিছু চিন্তাও করতে পারিনি। পাগলের মতো শুধু ফোন করে গিয়েছি অস্তিত্ববিহীন শৈবালের ফোন নাম্বারে। সকাল হতেই মনে পড়ল হাতে আর মাত্র ছ' দিন। এই শহরে আমরা মাত্র মাস আটেক হল এসেছি। বিশেষ কারো সাথে পরিচয়ও হয়নি। ঘর গোছাতে আর মেকি আহ্লাদে ভেসেই কাটিয়ে দিয়েছি সময়টা। নিজেকে নিয়ে ভাববার সময়ই ছিল না হাতে। আমার পরিচিত বলতে এই বাসার কাছে এক দোকানের এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা মার্গারেট বেনেডিক - তিনি। এছাড়া আর কেউ নেই। আর যারা আছে তাদের সাথে পরিচয়ের সূত্র শৈবাল। ইচ্ছে হল না তাদের কারো সাথে যোগাযোগ করতে। ম্যাডাম বেনেডিকের সাথে দেখা করলাম একটু বেলার দিকে। ওঁনাকে সবকিছু বললাম। শুনলেন সবকিছু - তারপরে বললেন যে এখন বাড়ি যাও - একটু বিশ্রাম নাও - আমি একটু ভেবে দেখি যে কি উপায় বের করা যায়। চলে এলাম বিফল মনোরথ হয়ে। ভাবতে বসলাম এবার কি হবে - সম্বল মাত্র দু'শো ডলার। আর বাসায় যা আছে তাতে দিন তিনেক দোকানপাট না করলেও চলবে - কিন্তু তারপরে তো খিদের জ্বালায় দোকানপাট করতেই হবে - তখন কি করে চলবে -

[অখিল চা নিয়ে ঢোকে। সবাইকে চা দেয়। কোনো কথা বলে না। নিঃশব্দে চলে যায়। অদিতি চায়ের কাপে হাল্কা করে চুমুক দেয়। আবার বলতে শুরু করে -]

তারপরে সব ইতিহাস। সেই বৃদ্ধা - ম্যাডাম মার্গারেট বেনেডিক ওঁনার দোকানে আমায় কাজ দিলেন - সেখানেই রাত্রিবাস - পড়াশুনো - ডক্টরেট শেষ করা - আরও দশ বারো বছর পেরিয়ে গেল এক অনিশ্চিত উৎকণ্ঠা নিয়ে - অবশেষে ধীরে ধীরে পায়ের তলায় শক্ত মাটি খুঁজে পেলাম। এখন ডঃ অদিতি - সর্বংসহা অদিতি - না, আমার কোনো পদবী নেই - আমার স্বামীর পদবী আমাকে দিয়েছে অপমান - আর আমার বাবার পদবী আমাকে প্রথমে দিয়েছে অবলম্বন এবং পরে অবহেলা - তাই আমি শুধু 'অদিতি' - খুব ভালো আছি এখন একজন মানুষ হিসেবে - আমার মতো নিপীড়িত অসহায় অদিতিদের আশ্রয় দিই - তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্য সাহায্য করি - তারাও স্বাবলম্বী হয়ে এই একই কাজ করে - এখন আমার জীবনে কোনো একাকিত্ব নেই, অবসাদ নেই, অতীতের জন্য হাহুতাশ নেই - আনন্দে খুশিতে - অনেক অনেক অদিতিদের নিয়ে খুব ভালো আছি আমি।

অংশু ।। বুঝতে পারছি সেটা - আসলে স্মৃতির মন্থনে সবসময় দুঃখ থাকে না, কিছু মগ্নতা থাকে। মগ্নতা যার ভালো লাগে তার জন্য স্মৃতি রোমন্থন ভালো।

[অংশু একটা সিগারেটও জ্বালায়। অনির্বাণ গান ধরে -]

অনির্বাণ ।। আমার ভীনদেশী তারা

একা রাতেরই আকাশে

তুমি বাজালে একতারা

আমার চিলেকোঠার পাশে

ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে

তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে

মুখ লুকিয়ে কার বুকে

তোমার গল্প বল কাকে

আমার রাত জাগা তারা

তোমার অন্য পাড়ায় বাড়ি

আমার ভয় পাওয়া চেহারা

আমি আদতে আনাড়ি

 

আমার আকাশ দেখা ঘুড়ি

কিছু মিথ্যে বাহাদুরি

আমার চোখ বেঁধে দাও আলো

দাও শান্ত শীতলপাটি

তুমি মায়ের মতই ভালো

আমি একলাটি পথ হাঁটি

আমার বিচ্ছিরি এক তারা

তুমি নাও না কথা কানে

তোমার কিসের এত তাড়া

সে রাস্তা পার হবে সাবধানে

 

তোমার গা'য় লাগে না ধুলো

আমার দু'মুঠো চালচুলো

রাখো শরীরে হাত যদি

আর জল মাখো দুই হাতে

প্লিজ ঘুম হয়ে যাও চোখে

আমার মন খারাপের রাতে

আমার রাত জাগা তারা

তোমার আকাশ ছোঁয়া বাড়ি

আমি পাইনা ছুঁতে তোমায়

আমার একলা লাগে ভারি।

[অনির্বাণের গান শেষ হয়।]

অদিতি ।। অপূর্ব অনি। কিন্তু তোর নিজের লেখা একটা গান শোনালে আরও ভালো লাগত।

অংশু ।। ঠিক বলেছিস। প্রথমটা যেমন শোনালি - ও তুই বসে আছিস কিসের আশায় -

অনির্বাণ ।। আসলে অদিতির কথাগুলো শুনতে শুনতে কেন জানিনা এই গানটা মনের মধ্যে গুনগুন করছিল - তাই গেয়ে ফেললাম।

অংশু ।। খুব ভালো করেছিস। কিন্তু অবিনাশটা এখনও এলো না কেন - অথচ আমি ভেবেছিলাম যে ও-ই সবার আগে আসবে।

অদিতি ।। আমিও সেটাই ভেবেছিলাম।

অনির্বাণ ।। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ভাবনার সাথে বাস্তবের বিস্তর ফারাক।

অদিতি ।। একদম ঠিক বলেছিস। অনেক সময় একজন মানুষকে দেখেই আমরা অনেক কিছু ভেবে নিই। কিন্তু পরে দেখা যায় যে বাস্তবে সেই মানুষটার সাথে আমাদের ভাবনার কোনো মিলই নেই।

অংশু ।। একদম ঠিক বলেছিস। তাই কাউকে নিয়ে ভাববার বিশেষ একটা দরকার নেই। আসলে আমাদের সবাইকার সাথে সবাইকার সম্পর্কের কিন্তু একটাই নাম - পরিচিত। কেউ কম পরিচিত - কেউ বেশি পরিচিত। আবার আজকে যে খুব বেশি পরিচিত - খুব ঘনিষ্ঠ, সে-ই হয়ত দু'দিন পরে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একজন সাধারণ পরিচিততে পরিণত হবে আমাদের কাছে।

অনির্বাণ ।। এটা ঠিক বলেছিস, এককালে খুব ঘনিষ্ঠ পরিচিত অনেকের নাম এখন মাঝে মাঝে মনেও করতে পারি না।

অংশু ।। হ্যাঁ, কিন্তু আবার এমন কিছু ঘনিষ্ঠ মানুষ থাকে যাদের নাম - চেহারা - ভালোলাগা - ভালোবাসা সব মনে থাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ, কিন্তু মানুষটার সাথে সম্পর্কটা হয়ে যায় একজন সাধারণ পরিচিতের মত। ওই যে রে - ওই পরিচিত লোকগুলোর মতো - যারা রাস্তায় দেখা হলে চলতে চলতেই জিজ্ঞাসা করেন "কেমন আছেন?" দাঁড়িয়ে উত্তর শোনার ফুরসৎ থাকে না যাদের।

অদিতি ।। ঠিক বলেছিস।

অংশু ।। আর যখন নিজের খুব কাছের - অন্তঃস্হলের কেউ এরকম সাধারণ পরিচিততে পরিণত হয় - তখন প্রথম ধাক্কাটা খুব জোরে লাগে।

অদিতি ।। তুই তো প্রকৃতির কোলে - নদীর ধারে - শস্যশ্যামলা গ্রাম বাংলায় বাস করিস সত্যিকারের মানুষদের সাথে - তোর নিশ্চয়ই সেরকম ধাক্কা লাগেনি।

অংশু ।। না, তাদের কাছ থেকে লাগেনি। বরঞ্চ যাতে আমি যে কোনো ধাক্কা সামলাতে পারি সেই জন্য তারা আমায় বুকে করে আগলে রেখেছিল। আসলে কাকলির খুব পছন্দ ছিল আমাদের গ্রামের বাড়িটা। একবেলার জন্যও বাড়ি ছেড়ে বের হতে চাইত না। ভীষণ ভালবাসত গাছগাছালি। নিজে যে কতরকম সব্জি ফলাত তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সারাদিন ব্যাস্ত। অর্ণব হওয়ার আগে কোথা থেকে এক সাদা রঙের দুধেল গাই জোগাড় করে নিয়ে এলো বাড়িতে। সাদা গরুর দুধ খেলে নাকি সন্তানের মতিগতি স্বচ্ছ এবং সুন্দর হবে - মেধাবী হবে - তাই। আর হলও তাই। প্রচন্ড মেধাবী হল আমার আর কাকলির সন্তান - একমাত্র সন্তান - অর্ণব।গ্রামের স্কুলেই ভর্তি করা হল। গেঁয়ো স্কুলে গ্রাম্য বন্ধুবান্ধবদের সাথে পড়াশুনো - খেলাধূলো - ওঠাবসা। কিন্তু ওর প্রতিটি পরীক্ষার রেজাল্ট সবাইকে চমকে দিত। মাধ্যমিকে প্রথম কুড়ি জনের মধ্যে স্থান - উচ্চমাধ্যমিকে পনেরো জনের মধ্যে - সবই সেই গ্রামের স্কুল থেকে। কাকলি কিন্তু কোনওদিন ছেলের সাফল্যে অহংকার করেনি। মাঝেমাঝে শুধু বলত যে সাদা গরুর দুধ খাওয়ানোতেই অর্ণবের এত মেধা হয়েছে। আর ছেলেকে বলত - খোকন, যারা ভালো রেজাল্ট করতে পারেনি তাদের কোনওদিন অবজ্ঞা করিস না - পারলে তাদের পড়াশুনোতে একটু সাহায্য করিস। অর্ণব তার মায়ের কথা শুনত চুপ করে। তারপরে - উচ্চতর শিক্ষার জন্য চলে গেল গ্রাম ছেড়ে - সেখানে গিয়ে আরও বড়বড় সাফল্য পেতে থাকল - নাম্বার পেতে থাকল - প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম কিম্বা দ্বিতীয় - একদিন সেই নাম্বার প্লেট গলায় ঝুলিয়ে চলে গেল বিদেশে - আরও উচ্চতর বিদ্যার্জনের জন্য - বাবা-মা কি বাধা দিতে পারে সন্তানের জ্ঞানার্জনের ইচ্ছেতে - পারে না - আমি আর কাকলিও পারিনি - আর পারিনি বলেই আমি আর কাকলি এক রাতে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে এলাম ছেলেকে - অর্ণব বিদেশে গিয়ে আরও বড়বড় নাম্বার প্লেট পেতে শুরু করল - পেতে শুরু করল পজিশন - পেতে শুরু করল সম্মান - পেতে শুরু করল অর্থ - প্রচুর প্রচুর অর্থ - দামি গাড়ি - ছবির মতো এক শহরে নিজের বাড়ি - আর প্রচুর প্রচুর ব্যস্ততা আজ জার্মানি - কাল কানাডা - পরশু ইংল্যান্ড - মাঝেমাঝে উইকএন্ডে একটু রিল্যাক্স করতে লাসভেগাস নয়তো মিয়ামি। বা কখনও কখনও একটু নায়াগ্রার জলোচ্ছ্বাস দেখা। 'গ্রীণ কার্ড' পেয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি - আসলে ওদেশের খুব দরকার অর্ণবকে। একের পর এক বড়বড় কোম্পানি লুফে নেয় তাকে - আরও অর্থ - আরও স্বাচ্ছন্দ্য - আরও সুখ। আর সুখে থাকতে থাকতে ভুলে যেতে থাকে দেশের কথা - গাঁয়ের কথা - ছেলেবেলার স্কুলের কথা গ্রামের বন্ধুদের কথা - ভুলে গেল অসফল ভাইবোন বা আত্মীয়স্বজনের কথা। মনে রাখতে পারেনা যে শেষ কবে দেশের মাটিতে পা রেখেছিল। আসলে মেধাবী তো - মেধাবীদের জগতে বোধহয় ইমোশন নেই - আছে শুধু প্রমোশন, পজিশন আর পাওয়ার। তাদের অতীত নেই - আছে কেবল ভবিষ্যৎ। এক চেয়ার থেকে অন্য চেয়ার - ছোটো চেয়ার থেকে বড়ো চেয়ার - আরও বড়ো চেয়ার - আরও বড়ো এই বড়োর কোনো শেষ দেখা যায় না। হ্যাঁ, মাঝেমাঝে আমাদের টাকা পাঠাত - তার মায়ের জন্য - অ-নে-ক টাকা। আর টাকা এলেই কাকলি কান্নাকাটি করত আমাকে লুকিয়ে - আসলে কাকলি তো টাকা চাইত না - ওর চাওয়ার কিছু ছিল না - জীবনে আমার কাছে যে একটা টিপ কিনে দেবার কথা বলেনি মুখ ফুটে - সে ছেলের কাছে টাকা চাইতে পারে? পারে না - চাইত শুধু একবার তার খোকনকে দেখতে - আর কাকলির খোকন যখন তার মায়ের এই চাওয়াটাকে টাকা দিয়ে পূরণ করে দিতে চাইত তখন কাকলির চোখের জল বাঁধ মানত না - আমি ওকে কাঁদতে দেখলে পালিয়ে যেতাম - যদি আমায় দেখে লজ্জা পায় - আর ওকে সান্ত্বনা দেবার মতো কোনো ভাষাও তো আমার জানা ছিল না। আমি জানি এসব তথ্য - এসব ছবি কাকলির খোকনের ল্যাপটপে নেই - কোনোদিন ছিল বলে মনে হয় না। তার ল্যাপটপে আমাজনের রেইনি-ফরেস্টের ছবি আছে - কিন্তু গ্রামের বর্ষার ছবি নেই।

[অংশু থামে। রুমাল বের করে চোখ মোছে। অদিতি একটা ওয়েট টিশু ওর হাতে দিয়ে বলে -]

অদিতি ।। তারপর -

অংশু ।। অকাল বৃষ্টি নেমেছে আকাশ ভেঙে সেদিন রাতে। একজন মৃত্যু শয্যায় - আমি চেয়ার নিয়ে বসে আছি বারান্দায় - শূন্য চোখে - কিছুই স্থিরভাবে ভাবতে পারছি না - বাড়ি ভর্তি লোকজন - গ্রামের সবাই খুব ভালোবাসত কাকলিকে - প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে সবাই হাজির হয়েছে - ডাক্তারবাবুও বসে আছেন শেষ সময়টার জন্য - উনিও খুব ভালোবাসতেন কাকলিকে - মাঝরাতে একবার কাঁপাকাঁপা স্বরে কাকলি জিজ্ঞাসা করে, "খোকন এলো, খোকন..."। সবাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে একে অপরের মুখের দিকে - সবাই নিরুত্তর - গোটা বাড়িতে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা - প্রবল বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। সময় যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কাকলি তার শরীরের সমস্ত শক্তি নিংড়ে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ভোরের দিকে আর একবার জিজ্ঞাসা করে, "খোকন এলি..."। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে ডাক্তারবাবু উত্তর দেন, "এই তো, এই তো এলো বলে"। আমাদের মেধাবী সন্তান তখন নতুন কোম্পানির সাথে নতুন ডিলে ব্যস্ত জেনিভায় - একটু পরেই তাকে চলে যেতে হবে সানফ্রানসিসকো - তারপরে আবু ধাবি - সন্তানকে দেখতে না পাওয়ার কষ্ট কাকলির মুখে এক অব্যাক্ত যন্ত্রণার চিহ্ন এঁকে দিল। ঠিক ভোরবেলায় ডাক্তারবাবু বললেন, "এ মৃত্যুযন্ত্রণার চিহ্ন নয় - এ অন্য যন্ত্রণার চিহ্ন - অন্য কিছু"।

[অংশু চোখ মোছে] ...আমিই সব কাজ করলাম কাকলির - আমাদের মেধাবী সন্তান আসতে পারেনি - নিজের কোম্পানির উদ্বোধন নিয়ে সে তখন চূড়ান্ত ব্যস্ত - নাওয়া খাওয়ার ফুরসৎ নেই - ফোন করেছিল আমায় - না, আমি ভেঙে পরিনি ড. অর্ণবের কাছে - উল্টে তাকে বলেছিলাম যে ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসার কোনো দরকার নেই - যা হবার ছিল হয়েছে - তুমি সাবধানে থেকো - নিজের যত্ন নিও। তারপরে মায়ের বাৎসরিক কাজ করতে আসবে বলেছিল - আমি সরাসরি না করে দিয়েছিলাম।

[একটু থেমে] অদিতি, তুই আমায় বলেছিলি না যে আমি হাড় কিপটে - না রে আমি তা না - দেখেছিস আমি কত খরচ করে ফেলেছি - আমি এত খরচ করেছি যে এখন আমি রিক্ত নিঃস্ব - মুক্তপুরুষ...

অদিতি ।। আচ্ছা কেন এমন হয়? কেন আমরা শিকড়ের কথা ভুলে যাই?

অনির্বাণ ।। সহজলভ্য বলে।

অদিতি ।। মানে?

অনির্বাণ ।। মানে সহজলভ্য বলে। যদি শিকড়ের জন্য আমাদের কোনো মূল্য দিতে হতো - তাহলে আমরা কিছুতেই ভুলে যেতাম না। ছিন্নমূল হয়ে বেঁচে থাকলে তবেই বোধহয় মূলের মূল্য সঠিক বোঝা যায়।

অদিতি ।। তাই হবে হয়তো।

অনির্বাণ ।। ছেলে আর আসে না?

অংশু ।। ছেলের আসা যাওয়া তো অনেক দিন আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে - কাকলি চলে যাবার অনেক আগে থেকেই। এখন যে আসে সে ড. অর্ণব - আমার একজন পরিচিত। এক সময়ে যার সাথে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল - কিন্তু এখন একজন পরিচিত মাত্র। ওর সম্বন্ধে আমি বিশদে কিছু জানি না - আর সেও আমার সম্পর্কে জানে কিনা সেটা আমার জানা নেই। গত মাসে এসেছিল দিন সাতেকের জন্য। ব্যাঙ্গালোর না হায়দ্রাবাদ কোথায় এক প্রোজেক্ট উদ্বোধন করতে এসেছিল - সেখান থেকে সে তার দেশে ফেরার পথে দিন সাতেক আগে গ্রামে ঘুরে গেল।

অনির্বাণ ।। তোর কি কষ্ট হয় তার জন্য?

অংশু ।। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো জানিস। সবসময়ে গলার কাছে কেমন যেন একটা দলা আটকে থাকত। কিন্তু এখন আর তা হয় না।

অদিতি ।। খালি খালি লাগে না?

অংশু ।। না রে। বরঞ্চ এখন ড. অর্ণব এখানে এলে আমি কেমন অ-স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমার পরিচিত গ্রামের সাধারণ মানুষেরা - যারা সারা বছর ধরে আমায় ঘিরে থাকে - তারাও কেমন যেন সঙ্কোচ বোধ করে - কমে যায় তাদের আসা যাওয়া।

অদিতি ।। আসলে তারা তো সহজ সরল মানুষ - সহজ সরল চিন্তা ভাবনা তাদের। তারা হয়তো মায়ের মৃত্যুর সময় সন্তানের উপস্থিত না থাকাটা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। তোকে আর কাকলিকে ভালোবাসে বলে অর্ণবকে সে কথা হয়তো মুখ ফুটে বলতেও পারে না তারা - তাই ও এলে সবাই একটু দূরেদূরে থাকে।

অংশু ।। তাই হবে হয়তো। তবে আমি একটা কথা বিশ্বাস করি - যে হারিয়ে গেছে, তাকে হারিয়ে ফেলাই ভালো। ইচ্ছে করে কেউ হারিয়ে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না, আর তাকে খুঁজে বের করতেও নেই। যাই হোক আমি খুব ভালো আছি এখন। কিন্তু একটা বিষয় আমার কাছে পরিস্কার না যে কেউ মেধাবী হলেই কি সে শিকড়ের টান ভুলে যায়?

(ক্রমশ)