প্রতুলবাবু প্রৌঢ় মানুষ, বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই, বছর দুয়েক হলো বিপত্নীক হয়েছেন, নিঃসন্তান - নিজের বলতে আপাতত আর কেউ নেই। স্ত্রী গত হবার পর নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছেন। সরকারি চাকরি করতেন, এখন রিটায়ার্ড, তাই অবসর জীবনটা দৈনন্দিন কাজের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেন, বই পড়ে, গাছের পরিচর্যা করে, মাঝে মাঝে কাছাকাছি ঘুরে এসে - তবুও কোথাও যেন বড়ো একা হয়ে পড়েছেন। আসলে নিজের অনুভূতিগুলো ভাগ করে নেওয়ার মতো কাছের কেউ নেই তাঁর। মাঝে মাঝে কিছু অফিস কলিগকে ফোন করে কুশল বিনিময় করা আর দু'একজন পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে পথচলতি সময়ে নিয়মমাফিক দু'চার কথা,... ব্যাস ঐ অবধিই।
রোজ সকালে প্রাতঃভ্রমণ, প্রতুলবাবুর নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাস। বাড়ি থেকে মিনিট দশেক হাঁটা পথে একটা বড়ো লেক রয়েছে, লেকের চারপাশে সবুজে ঘেরা পার্ক। প্রতুলবাবু রোজ নিয়ম করে পার্কটাকে পাঁচ পাক দিয়ে লেকের পাশে উত্তমদার চায়ের দোকানে চা বিস্কুট খেয়ে তারপর বাজার করে বাড়ি ফেরেন... এভাবেই চলে আসছে। সেদিন হাঁটা পর্ব শেষ করে উত্তমদার চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে চায়ের ভাড়ে চুমুক দিয়েছেন সবে, হঠাৎ ডান পায়ের গোড়ালিতে একটু সুড়সুড়ি অনুভব করলেন প্রতুলবাবু। নিচে তাকিয়ে দেখেন ওমা! এ তো একটা ছোট্ট নেড়ি কুকুর, কেমন প্যাটপ্যাট করে তার দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়ছে। প্রতুলবাবু এক টুকরো বিস্কুট ওর দিকে ছুঁড়ে দিলেন। কুকুরটা নিমেষে বিস্কুটটা খেয়ে আবার প্রতুলবাবুর দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়তে লাগলো। বোধহয় কিছু খাবারদাবার জোটেনি অনেকক্ষন এই ভেবে প্রতুলবাবু দুটো গোটা বিস্কুটই দিলেন খেতে। সেগুলোও যথারীতি শেষ করে প্রতুলবাবুর পায়ের কাছে এসে ঘ্রান নিয়ে দু'বার ঘেউ ঘেউ আওয়াজ করে আবার লেজ নাড়তে থাকলো, যেন অবহেলিত এই ছোট্ট প্রাণিটার ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছে। চা খাওয়া শেষ করে প্রতুলবাবু উঠে পড়লেন, কুকুরটির মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি গন্তব্যের দিকে চললেন... কিন্তু একি! কুকুরটিও তার পিছু নিয়েছে যে। তিনি চললে সে চলে, তিনি থামলে ও থামে। প্রতুলবাবু দু'তিনবার হুস হুস করলে ও কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে আবার তার পদাঙ্ক অনুসরন করে, এ যেন এক মজার খেলায় মেতেছে! প্রতুলবাবু এবার আর বিলম্ব না করে পিছনে না তাকিয়ে হাঁটা দিলেন, পার্ক থেকে বেরিয়ে, ফুটপাথ থেকে নেমে, রাস্তা পার হয়ে হাঁটতে উদ্যত হলেন। কিন্তু কি জানি কি মনে হলো একবার থামলেন - কুকুরটি আবার পেছন পেছন আসছে না তো। পেছন ফিরে তো তিনি অবাক, আরে হ্যাঁ ঐ তো রাস্তার ওপারে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে নেড়ি কুকুরটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে! বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে প্রতুলবাবুর মন একটু মায়ায় সিক্ত হলো। হয়তো কুকুরটি মাতৃহারা, অসহায়, একা - মিনিটখানেক দুজনেই এইভাবে মুখোমুখি তাকিয়ে থাকল ফুটপাথের দুই পারে। রাস্তা দিয়ে একটা গাড়ি হর্ন বাজিয়ে চলে গেলো। প্রতুলবাবুর মন ক্ষনিকের জন্য একটু ভাবুক হয়ে গিয়েছিল। হাত ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলেন ন'টা দশ বাজে, মাথা ঘুরিয়ে তিনি বাজারের দিকে এগোলেন। পথ চলতে চলতে তার এটাই মনে হলো - মানুষ হোক বা কোনো জীব, ভগবান সবাইকেই জীবন দিয়েছেন, অনুভূতিও দিয়েছেন - হয়তো বহিঃপ্রকাশের রকমফের আছে।
প্রতুলবাবু ও এই ছোট্ট কুকুরটির সম্পর্কটা এখানেই শেষ হলো না। পরের দিন আবার একই জায়গায় কুকুরটা চায়ের দোকানের বেঞ্চের ধারে বসে ছিলো, প্রতুলবাবুকে দেখেই লেজ নাড়তে লাগলো - যেন বলছে আমি তো তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। গতকাল সারাদিন সচেতনভাবেই হোক বা অচেতনেই হোক কুকুরটার ছবি বার বার প্রতুলবাবুর মনে ভেসে উঠেছে, একটা নামও তো ভেবেছেন উনি - ভুলু!
- কিরে ভুলু বিস্কুট খাবি?
- ঘেউ ঘেউ করে ভুলু জবাব দিল - হাঁ খাবো...
বেশ কিছুদিন এমনি করেই ভাবের আদান-প্রদানে ভুলু আর প্রতুলবাবু এক মায়ার টানে ক্রমে আবদ্ধ হতে থাকছিলেন। মাঝে মাঝে প্রতুলবাবু বাড়ি থেকে মাছ-ভাত এনে খাওয়াতেন ভুলুকে। পার্কে গেলেই ভুলু প্রতুলবাবুকে নানাভাবে তার উপস্থিতি জানান দিত। নির্বান্ধব জীবনে ছোট্ট এই প্রাণীটির ক্ষণিক উপস্থিতি তাঁর একাকীত্বের ভাব অনেকটা দূর করে দিয়েছিল।
প্রতুলবাবু মানুষ হিসেবে একটু সাদামাটা প্রকৃতির, টাকাপয়সার তেমন অভাব না থাকলেও তিনি অনাড়ম্বর জীবনযাপনই পছন্দ করেন, তুচ্ছ অনেক জিনিসই, যার হয়তো বস্তুগত মূল্য নিতান্তই কম কিন্তু স্মৃতির মাপকাঠিতে যা অমূল্য - প্রতুলবাবুর কাছে সেটাই খুব আপন মনে হয়। মায়ের ব্যবহার করা চশমা, বাবার কলম, স্ত্রীর পানের ডিবে, এই সবকিছুই তিনি অতি যত্নে রেখেছেন। কেননা এগুলিকে ছুঁয়ে তিনি স্মৃতি রোমন্থন করেন। এমনই একটা জিনিস হলো তাঁর হাত ঘড়ি, যা তাঁর বাবা তাঁকে কিনে দিয়েছিলেন ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময়। ছাত্রজীবন কাটিয়ে কর্মজীবন, তারপর সংসারিক জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও তিনি এই ঘড়িকে হাতছাড়া করেননি অনেকের হাসি, ব্যঙ্গ উপেক্ষা করেও।
সেদিন প্রাতঃভ্রমণ সেরে বাজার করে বাড়িতে এসে জামাকাপড় পাল্টানোর সময় তিনি আবিষ্কার করলেন ঘড়িটি তাঁর হাতে নেই! সাময়িক বিষন্নতা কাটিয়ে মনে করার চেষ্টা করলেন কোথায় হারালো ঘড়িটা? কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। ঘড়িটা যে তাঁর কাছে অমূল্য, জীবনের পার হয়ে আসা প্রতিটি মুহূর্তগুলোরও যে সাক্ষী। কয়েকদিন ধরেই ঘড়ির চামড়ার ব্যান্ডটা একটু অপলকা হয়ে আসছিল, ভেবেছিলেন সরিয়ে নেবেন, নাহ্ দেরি হয়ে গেলো। জীবনের কত স্মৃতিই না জড়িয়ে আছে ঐ ঘড়ির সাথে, কত আনন্দের ক্ষণ, কত বিষন্নতার মুহূর্ত, কত অপেক্ষার সেকেন্ড, সব কিছুকে সাক্ষী করে বাম হাতের কবজিতে ধমনির স্পন্দনের সাথে টিক টিক করে আসছিল। পার্কে? রাস্তায়? নাকি বাজারে কোথায় পড়ে গেলো? এখনো খুব বেশি দেরি হয়নি একবার বেরিয়ে খুঁজে দেখব নাকি!
ভাবামাত্রই রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন প্রতুলবাবু, হন্হন্ করে। যে পথ দিয়ে রোজ পার্কে যান সেই রাস্তারই এদিক-ওদিক খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে এগোলেন, নাহ্ কোথাও পেলেন না। অবশেষে হাঁটতে হাঁটতে পার্কে এসে পৌঁছলেন, পার্কে আপাতত সকালের ভিড় খানিক কমে এসেছে। পার্কের গেট থেকে শুরু করে প্রতিটি ঝোপঝাড়, রাস্তা সব খুঁজলেন, কোথাও না পেয়ে অবশেষে ক্লান্ত হয়ে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে এসে বসলেন। উত্তমদা দোকান বন্ধ করে বাড়ি গেছে। কটা বাজে এখন - ওহ্ ঘড়িটাই তো নেই সময় দেখবেন কি করে। একেই বলে বুড়ো হবার জ্বালা। আচ্ছা বাজারে গেলে হয় না একবার, এরকমই ভাবছিলেন প্রতুলবাবু এমন সময় ভুলুর ডাক, কোথায় ছিলো কে জানে তাকে দেখেই ছুটতে ছুটতে এসেই লেজ নাড়তে নাড়তে তার পাজামার খুঁট ধরে টানতে থাকলো। কিরে ভুলু খিদে পেয়েছে নাকি? উত্তমদার দোকান তো বন্ধ। কিন্তু ভুলু একটু অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকলো। কিছু যেন বলতে চায় ও। একবার প্রতুলবাবুর দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে পার্কের গেটের দিকে দৌড়ে চলে গেলো কিন্তু ফিরে এলো ক্ষনিকের মধ্যেই। কিন্তু ওর মুখে ওটা কি? আরে এ তো প্রতুলবাবুর রিস্টওয়াচ! কিরে! এটা তুই কোথায় পেলি ভুলু? ঘেউ ঘেউ করে প্রত্যুত্তর দিয়ে লেজ নাড়তে লাগলো ও। আনন্দে প্রতুলবাবুর চোখে জল চলে এলো, কি বলে ধন্যবাদ জানাবেন এই অবলা জীবটাকে ভেবে পেলেন না। কুকুরদের ঘ্রানশক্তি বেশি, হয়তো ঐ ঘড়িতে ভুলু প্রতুলবাবুর শরীরের গন্ধ পেয়েছে বা ঘড়িটা যখন পড়ে গিয়েছিল ও সেটা লক্ষ্য করেছিল - তা সে যাই হোক কোন বোধশক্তি থেকে ভুলু এই ঘড়িটার গুরুত্ব অনুধাবন করেছে তা স্বয়ং ভগবানই জানেন। প্রতুলবাবু ভুলুর কাছে কৃতজ্ঞ।
বেলা এখন বেড়েছে, মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে, প্রতুলবাবু গাছের ছায়ায় বেঞ্চিতে বসে, পাশে ভুলু আপনমনে থাবা চাটছে। প্রতুলবাবুর আজ আর নতুন করে কিছু পাবার বা হারাবার নেই, প্রয়োজন শুধু একজন বন্ধুর - যা তিনি পেয়ে গেছেন।
অঙ্কনঃ লেখকের নিজের।