প্রবন্ধ ও নিবন্ধ

অর্জুনের পত্নীগণ (প্রথম পর্ব)



লক্ষ্মী নারায়ণ হাজরা


বুদ্ধদের বসু তাঁর 'মহাভারতের কথা' গ্রন্থে অর্জুন সম্বন্ধে একটা বিশেষণ প্রয়োগ করেছেন — 'বহুনারীশোভিত'। বস্তুতপক্ষে বিভিন্ন সময়ে অর্জুন একাধিক পত্নী লাভ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে দ্রৌপদীই প্রথম, যদিও ঘটনাচক্রে তিনি পঞ্চপান্ডবের পত্নী হয়েছিলেন। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা ছিলেন সর্বাঙ্গসুন্দরী, কমলনয়না, ঘন কুঞ্চিত কেশদামবিশিষ্টা। তিনি ছিলেন শ্যামবর্ণা এবং তাঁর শরীর থেকে নীলপদ্মের সুগন্ধ একক্রোশ দূর থেকেও পাওয়া যেত। ওই কন্যা কৃষ্ণবর্ণের ছিল বলেই তাঁর নাম হয় কৃষ্ণা।

সীতার মতোই দ্রৌপদী ছিলেন অযোনিসম্ভবা। রাজা দ্রুপদ একটা যজ্ঞ করেছিলেন। সেই যজ্ঞবেদিস্থিত অগ্নি থেকেই দ্রৌপদীর উদ্ভব হয়েছিল। আবার সীতার মতোই তিনি ছিলেন বীর্যশুল্কা। হরধনু ভঙ্গ করে যেমন রাম সীতাকে লাভ করেছিলেন, তেমনি বিশেষভাবে নির্মিত এক ধনুকে শর যোজনা করে অনেক উপরে অবস্থিত একটি ঘূর্ণায়মান যন্ত্রের মধ্যস্থিত ছিদ্র দিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু ভেদ করে অর্জুন দ্রৌপদীকে লাভ করেছিলেন। অবশ্য সীতা শুধু রামেরই পত্নী হয়েছিলেন, দ্রৌপদীর মতো বহুস্বামিকতা বরণ করতে হয়নি। কালো মেয়ে কত সুন্দরী ও যৌন আবেদনবিশিষ্টা হতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমাণ ছিলেন এই দ্রৌপদী।

দ্রৌপদীকে দেখলে মনে হতো যেন কোনও দেবী মানবীর মূর্তি ধারণ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং তাঁর সৌন্দর্যের এমন একটা আকর্ষণ ছিল যে তাঁকে দেখলে দেব, দানব ও গন্ধর্বের মনও মোহিত হয়ে যেত। রাজা দ্রুপদের বাসনা ছিল যেন তাঁর কন্যা দ্রৌপদীর বিবাহ পাণ্ডুপুত্র অর্জুনের সঙ্গে হয়, কিন্তু তাঁর এই ইচ্ছা তিনি কারও কাছে প্রকাশ করেননি। অর্জুনকে চেনার জন্য তিনি এমন একটি ধনুক তৈরি করিয়েছিলেন যাতে অর্জুন ছাড়া অন্য কারওর দ্বারাই এই ধনুকের গুণ পরানো সম্ভব না হয়। এদিকে কুন্তীসহ পঞ্চপাণ্ডব ব্রাহ্মণদের মতো জটাবল্কল ধারণ করে একচক্রা নগরীতে এক ব্রাহ্মণের গৃহে অবস্থান করছিলেন। ওই স্থানে বসবাস কালেই তাঁরা দ্রৌপদীর জন্মের কথা ও তাঁর স্বয়ংবরের কথা শুনলেন। তাঁদের মধ্যে একটা ব্যাকুলতা লক্ষ করে কুন্তী সহ সকলে মিলে পাঞ্চালদেশে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন এবং পঞ্চপাণ্ডব তাতে রাজি হয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে তাঁরা কয়েকজন ব্রাহ্মণের সাক্ষাৎ পেলেন যাঁরা দ্রৌপদীর স্বয়ংবর দেখবার জন্য দ্রুপদের রাজধানীতে যাচ্ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে একসঙ্গে মাতাসহ পাণ্ডবগণ দ্রুপদের রাজধানীতে উপস্থিত হলেন এবং এক কুম্ভকারের গৃহে আশ্রয় নিলেন। সেই গৃহে থেকে তাঁরা ব্রাহ্মণের মতোই ভিক্ষাবৃত্তির দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন।

এদিকে দ্রৌপদীর স্বয়ংবরের দিন উপস্থিত হল। রাজা দ্রুপদ শুধু একটি অত্যাশ্চর্য ধনুকই তৈরি করাননি, অনেক উপরে বিদ্ধ করার জন্য একটি লক্ষ্য স্থাপন করা ছিল। দ্রুপদের ঘোষণা ছিল, যে বীর ধনুকে জ্যা আরোপ করে ঘূর্ণায়মান যন্ত্রের ছিদ্রমধ্য দিয়ে লক্ষ্যবস্তুকে বিদ্ধ করতে সক্ষম হবেন, তাঁকেই তিনি কন্যা সম্প্রদান করবেন। রাজা দ্রুপদের আমন্ত্রিত অনেক নরপতি ও রাজকুমারগণ সভায় উপস্থিত ছিলেন।

তাঁদের মধ্যে দুর্যোধনসহ একশো ভাই, শিশুপাল, জরাসন্ধ প্রভৃতি বীর উপস্থিত ছিলেন। যুধিষ্ঠিরও তাঁর ভাইদের নিয়ে ব্রাহ্মণদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে উপবেশন করেছিলেন। সমবেত বীরগণের মধ্যে একমাত্র কর্ণই ওই ধনুক হাতে নিয়ে তাতে গুণ লাগাতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি লক্ষ্য স্থির করতে যাচ্ছেন এমন সময় দ্রৌপদী বলে উঠলেন যে তিনি সূতপুত্রকে পতিত্বে বরণ করবেন না। চরম অপমানিত হয়ে কর্ণ ধনুক নামিয়ে রাখলেন।

সভায় উপস্থিত সব বড় বড় বীরই লক্ষ্যভেদে অপারগ হলেন এবং সভা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। এমন সময়ে ব্রাহ্মণদের মধ্য থেকে অর্জুন উঠে দাঁড়ালেন। তিনি প্রথমে ধনুকটিকে প্রদক্ষিণ করলেন, তারপর মনে মনে মহাদেব ও কৃষ্ণকে প্রণাম করে ধনুক তুলে নিলেন। কর্ণ ছাড়া অন্য বীরগণ গুণ চড়ানো তো দূরের কথা, ধনুকই তুলতে পারেননি। অর্জুন অনায়াসে ধনুক গ্রহণ করে তাতে জ্যা আরোপ করলেন এবং পাঁচটি বাণ তুলে নিলেন। তিনি একটি বাণ নিক্ষেপ করেই অনবরত ঘুরতে থাকা যন্ত্রের ছিদ্রের মধ্য দিয়ে লক্ষ্যভেদ করলেন। দ্রৌপদী বরমাল্য হাতে নিয়ে আনন্দিত চিত্তে অর্জুনের গলায় পরিয়ে দিলেন। এইসব ক্ষেত্রে সাধারণত ব্যর্থ রাজারা সমবেতভাবে একটা যুদ্ধ বাধিয়ে দিত। এক্ষেত্রে তাঁরা রাজা দ্রুপদকে আক্রমণ করলেন, কিন্তু ভীম ও অর্জুন তাঁদের ভয়ঙ্কর যুদ্ধে পরাস্ত করে দ্রুপদকে বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিলেন।

ভীম ও অর্জুন ব্রাহ্মণগণ পরিবৃত হয়ে দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের আশ্রয়স্থল কুম্ভকারের গৃহে উপস্থিত হলেন এবং মাকে সম্বোধন করে বললেন যে তাঁরা ওইদিন একটা ভালো জিনিস ভিক্ষা করে নিয়ে এসেছেন। কুন্তী সেই সময় ঘরের মধ্যে ছিলেন, সেখান থেকেই তিনি বললেন যে, যে ভালো জিনিস তাঁরা এনেছেন, তা যেন তাঁরা পাঁচভাই মিলে ভোগ করেন। তারপর তিনি বাইরে বেরিয়ে যখন দেখলেন যে ওই ভিক্ষা অন্য কিছু নয়, স্বয়ং রাজকন্যা দ্রৌপদী, তখন তিনি অনুতপ্ত হয়ে জ্যেষ্ঠপুত্র যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে সব কথা বললেন। যুধিষ্ঠির বললেন অর্জুন স্বীয় বীর্যবলে দ্রৌপদীকে লাভ করেছেন। অতত্রব অর্জুনেরই তাঁকে বিবাহ করা উচিত। অর্জুন বললেন জ্যেষ্ঠ অবিবাহিত থাকতে তিনি বিবাহ করবেন না, সুতরাং যুধিষ্ঠিরেরই দ্রৌপদীকে বিবাহ করা উচিত। কিন্তু যুধিষ্ঠির লক্ষ্য করলেন দ্রৌপদীর অপরূপ রূপলাবণ্য দেখে সব ভাই-ই কামমোহিত হয়ে গিয়েছেন। তখন ভেদভয়ে ভীত হয়ে যুধিষ্ঠির ঘোষণা করলেন যে দ্রৌপদী তাঁদের পাঁচ ভাইয়েরই পত্নী হবেন। দ্রৌপদীর শুধু অর্জুনেরই পত্নী হওয়ারই কথা ছিল, কিন্তু সৌভাগ্যই হোক আর দুর্ভাগ্যই হোক, তিনি পঞ্চপতির ভার্যা হয়ে গেলেন। কথায় আছে অতি বড় সুন্দরী না পায় বর। দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে ঠিক সেটা হল না একটি বরের বদলে পাঁচ পাঁচটা বরের সঙ্গে তাঁর বৈবাহিক জীবন কাটাতে হয়েছিল। দ্রৌপদী পূর্বজন্মে কঠোর তপস্যা করে দেবাদিদেব মহাদেবকে সম্ভ্রষ্ট করেন এবং মহাদেব তাঁকে কাম্য বর দিকে চাইলে তিনি বার বার বলেছিলেন যে তাঁর সর্বগুণ-সম্পন্ন স্বামী চাই। মহাদেব বলেছিলেন যে যেহেতু তিনি তাঁর কাছে পাঁচবার পতির জন্য প্রার্থনা করেছেন, সেইজন্য পরের জন্মে তিনি পঞ্চপতি লাভ করবেন।

তিলোত্তমা নামে এক পরমাসুন্দরী নারীকে কেন্দ্র করে সুন্দ-উপসুন্দ নামে দুই দানবভ্রাতার দ্বন্দ্বযুদ্ধ বেধে ছিল এবং তার ফলে তারা দুজনেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পাণ্ডবগণের মধ্যেও এক পত্নীকে কেন্দ্র করে যাতে ওইরূপ কোনও বিরোধ বা ভেদবুদ্ধি জাগ্রত না হয় সেইজন্য তাঁরা এক নিয়ম করে নিয়েছিলেন। নিয়মটা হল এই যে এক এক ভাই একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দ্রৌপদীর কাছে থাকবেন। কোনও এক ভাই যখন দ্রৌপদীর কাছে থাকবেন, সেই সময় অন্য কোনও ভাই সেইখানে যাবেন না। কোনও ভাই যদি অন্য ভাইয়ের সঙ্গে দ্রৌপদীর একান্ত বাসের সময় সেখানে যান, তাহলে তাঁকে ব্রহ্মচারী হয়ে বারো বছর বনবাসে থাকতে হবে। পাণ্ডবগণ এই নিয়ম মেনে চলতেন বলে দ্রৌপদীকে নিয়ে কোনও মনোমালিন্য হয়নি। দ্রৌপদীও সর্বান্তঃকরণে পঞ্চপতিকে সমানভাবে ভালোবাসতেন ও সঙ্গদান করতেন এবং পঞ্চপতির ঔরসে পঞ্চপুত্রের জন্ম দেন। যুধিষ্ঠিরের ঔরসে জাত তাঁর পুত্রের নাম ছিল প্রতিবিন্ধ্য। সেইরূপ ভীমের ঔরসে সুতসোম, অর্জুনের ঔরসে শ্রুতকর্মা, নকুলের ঔরসে শতানীক ও সহদেবের ঔরসে শ্রুতসেন — দ্রৌপদীর অপর চার পুত্র জন্মেছিল। সুখে-দুঃখে এই দ্রৌপদী সারা জীবন পঞ্চপান্ডবের জীবনসঙ্গিনী হয়েছিলেন এবং অত বড় পাঁচ বীরের পত্নী হওয়া সত্ত্বেও অদৃষ্টের দোষে মাঝে মাঝেই তিনি পরপুরুষের দ্বারা নির্যাতিতা হয়েছিলেন। তাঁর আরও দুর্ভাগ্য, তিনি পাঁচ বীর পুত্রের জননী ছিলেন, কিন্তু পাঁচজনই দ্রোণপুত্র অশ্বথ্বামার অতর্কিত আক্রমণে নিহত হন।

দ্রৌপদীসহ পাণ্ডবগণ যখন মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করেছিলেন তখন সকলের পিছনে ছিলেন দ্রৌপদী। দুর্গম বন্ধুর পথে যেতে যেতে এক সময় দ্রৌপদী মাটিতে পড়ে গিয়ে মারা গেলেন। তাঁর ওই অবস্থা দেখে ভীম যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করলেন রাজকুমারী দ্রৌপদী তো কখনও কোনও পাপ করেননি, তাহলে তিনি স্বর্গারোহণের পথে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারলেন না কেন। যুধিষ্ঠির নিরাসক্তভাবে বললেন যে দ্রৌপদীর মনে অর্জুনের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব ছিল, সেই দোষেই তিনি ওই ফল ভোগ করেছেন। মহাভারতকারের কী সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ! দ্রৌপদী আপাতদৃষ্টিতে সব স্বামীকে সমান চোখে দেখতেন। কিন্তু মনের গভীর মণিকোঠায় তাঁর অর্জুনের প্রতি একটু বিশেষ ভালোবাসা থাকা স্বাভাবিক নয় কী? অর্জুনই তো তাঁকে নিজ বীর্যবলে অর্জন করেছিলেন।

(ক্রমশ)


চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।