ভ্রমণ

স্মৃতিতে গোমুখ ও তপোবন



প্রবীর ধর


ছোটোবেলায় মনে পড়ে বাড়ির কোনো কাকা, জ্যাঠা, ঠাকুরদা বা ঠাকুমা তীর্থে গেলে তাকিয়ে থাকতাম তাঁদের ঘরে ফেরার দিনটির অপেক্ষায়। এর মধ্যে বাড়ির লেটারবক্সে দেখা মিলত একটি কি দুটি হলুদ পোস্টকার্ড বা নীল রঙের ইনল্যান্ড লেটারের। তাতে তাঁদের পৌঁছানোর সংবাদ বা শারীরিক অবস্থার একটা বিবরণ মিলত। যেহেতু তাঁদের কেউই সাহিত্যিক ছিলেন না তাই এর অধিক বিবরণের প্রত্যাশা তাতে থাকত না। তবে এই সামান্যটুকুও সময় মতো মেলা ছিল ডাক বিভাগের দয়া-দাক্ষিণ্য নির্ভর। মাঝে মাঝে পত্রপ্রেরক ও পত্র একই সঙ্গে ঘরে ফিরত। তীর্থযাত্রী ফিরলেই সর্বপ্রথম বাড়ির সকলকে দেখতাম তীর্থযাত্রীর পুণ্যের ভাগিদার হওয়ার লোভে জল দিয়ে তাঁর পা ধুইয়ে আহার ও বিশ্রামের আয়োজনে ব্যস্ত হতে। আর আমরা বাড়ির ছোটোরা, আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকতাম। প্রথমত তাঁদের বাক্সপ্যাটরা হাতড়ে একবার দেখে নেওয়া যদি কিছু আমাদের জন্য এনে থাকেন আর দ্বিতীয়ত তাঁদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার রসাস্বাদন করা। অনেক অপেক্ষার পরেই মিলত সেসব। তবে যাই মিলত আর যতটুকুই মিলত তাই'ই ছিল অনেক। কারণ সেসময় এখনকার মতো এত প্রাচুর্য সর্বসাধারণের 'হাতের মুঠোয়' ছিল না। স্বপ্ন দেখতাম বড় হলে আমিও একদিন ওদের মতো তীর্থযাত্রা করব। বেশ মজা হবে।

ছোটোবেলার সেই দিন আজ আর নেই। এখন দিন বদলেছে। আজকাল ইউটিউবের যুগে ট্রাভেল ভ্লগাররা তাঁদের অভিজ্ঞতা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ট্যুর চলাকালীনই আপলোড করে দিচ্ছেন। যদি দিন কয়েক পরে কেউ কোথাও যেতে চান তবে ইউটিউবে সার্চ করলে কোনো না কোনো ভ্লগার মিলবেই যিনি অতিসম্প্রতি জায়গাটি ঘুরে এসেছেন বা এই মুহুর্তে স্পটেই আছেন। তাঁদের চ্যানেলে স্পটটির সচিত্র বর্ণনা তথা বর্তমান পরিস্থিতির হালহকিকত সহজেই উপলব্ধ। অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই তাই এই গতির যুগে আজ এক বৃহৎ সংখ্যক মানুষের ভীড় জমেছে ইউটিউবের দুনিয়ায়। ডিজিটাল দুনিয়াও এভাবেই এক শ্রেণীর মানুষকে প্রতিনিয়ত তাদের জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে অভ্যস্ত করে তুলছে তার নিজস্ব মাধ্যমে। এমনতর পরিস্থিতিতে যখন কেউ কোনো ভ্রমন বিষয়ক ব্যাপারে কিছু লিখতে বলে তখন কাজটা বেশ দুঃসাধ্য মনে হয়।

আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগের একটা অভিজ্ঞতা মনে পড়ছে। সালটা ২০০৩, মে মাস। হঠাৎ করে একদিন স্থির হল উত্তরাঞ্চল চারধামের যমুনোত্রী ও গঙ্গোত্রী যাত্রা এবং সঙ্গে গোমুখ (১৩,২০০ ফুট) পেরিয়ে তপোবন (১৪,৬০০ ফুট) ট্রেকিং। আর সময় বাঁচলে কেদারনাথ দর্শন। তবে দলে মাত্র তিনজন। আমি, আমার স্কুল জীবনের বন্ধু পলাশ ঘটক ও পলাশের পার্মানেন্ট ট্যুর পার্টনার বোলপুরের সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ওরফে বাবুদা। ওদের সঙ্গে এটি অবশ্য আমার প্রথম ট্যুর। যতদূর মনে পড়ে যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী ও কেদারনাথ দর্শনের পরিকল্পনা বাবুদাদার উৎসাহে স্থির হলেও তাতে তপোবনের অর্ন্তভুক্তি মূলত আমাদের বাকি দুজনের উৎসাহেই হয়েছিল। কারন যতদুর তথ্য আমাদের হাতে ছিল তাতে এটাই বুঝেছিলাম যে তপোবনের পথ মোটেই সুগম নয়। হিমালয়ের দুর্গম সে পথে রয়েছে জীবনের ঝুঁকি। অথচ পৌছাতে পারলে হিমালয়ের এক স্বর্গীয় রূপের দেখা সেখানে মিলবে। তখনও জানতাম না তপোবনের পথে কি ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে চলেছি। চোখ বুজলে সেদিনের মুহূর্তগুলো আজও ভেসে ওঠে। এখনকার সময় গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। পথে পড়ে চিরবাসা (৯ কিলোমিটার) ও ভুজবাসা (১৪ কিলোমিটার)। ভুজবাসা থেকে গোমুখের দূরত্ব ৪ কিলোমিটার। গোমুখের দু' কিলোমিটার আগে হাতে টানা ট্রলিতে ভাগীরথী আড়াআড়ি পার হয়ে পূর্ব পাড় থেকে গোমুখ দর্শন হয়। তবে সে সময় গোমুখ দর্শনে ভুজবাসা থেকে যেতে হতো ভাগীরথীর পশ্চিম পাড় ধরে। সেক্ষেত্রে আরও কিছুটা দূরত্ব বেশি অতিক্রম করে পশ্চিম পাড় থেকে গোমুখ দর্শন হতো। এরপর গোমুখ থেকে তপোবন ৫ কিলোমিটার।

ভুজবাসায় লালবাবার আশ্রম ও GMVN-এর লজ। পিছনে ভাগীরথী গ্রুপ অফ পিকস।

নির্দিষ্ট দিনে দুন এক্সপ্রেসে হরিদ্বার পৌঁছে সেখান থেকে হনুমান চটিতে রাত কাটিয়ে পরদিন যমুনোত্রী ধাম দর্শন সেরে গঙ্গোত্রী (১০,২০০ ফুট) পৌঁছে যাই তার পরদিন। এরপর কালিকমলি আশ্রমে রাত কাটিয়ে পরদিন গোমুখের পথে এসে পৌঁছই ভুজবাসার (১২,৫০০ ফুট) লালবাবার আশ্রমে। এখান থেকেই পথ গিয়েছে গোমুখ হয়ে তপোবনের দিকে। লালবাবার আশ্রমের দেখাশোনার ভার ছিল তখন গোপালদার হাতে। গোপাল মুখার্জী, সারা জীবনে হিমালয়ের বহু দুর্গম স্থানে ভ্রমন করার পর অবশেষে বেছে নিয়েছেন গোমুখের এই কঠিন পথে যাত্রীসেবার ব্রত। রাতে খেতে বসে খাওয়া শুরুর আগে গোপালদার মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে দ্রুতলয়ে পদচারণা আজও মনে পড়ে। সেদিন ওই বারো হাজার ফিট উচ্চতার প্রবল ঠান্ডায় মিলেছিল গরম গরম রুটি, ভাত, একটি সবজি আর ভাল। সারাদিনের পথশ্রমে ক্ষুধার্ত শরীরে তা অমৃতের মতো মনে হয়েছিল। রাতে মিলল একটি দশ বাই দশের ডর্মেটরি। তাতে আমরা তিনজন বাদে আরও তিনজনের ব্যবস্থা হল। এই তিনজনের গ্রুপটিতে ছিল চন্দননগরের বাচ্চু, কলকাতার গৌরীবাড়ির পার্থ আর মহারাষ্ট্রের হৃষিকেশ তাম্বে। এদের সঙ্গে এইদিন বিকেলে ভুজবাসায় পৌঁছেই চা খাওয়ার সময় আলাপ হয়েছিল। ওরাও আমাদেরই বয়সি। ওদের প্রত্যেকেই অবশ্য অভিজ্ঞ ট্রেকার। সম্প্রতি ওরা কেদারতাল ট্রেক করে ফিরেছে। সেদিনের ওই ছয়জনের মধ্যে আমিই ছিলাম একমাত্র অনভিজ্ঞ ট্রেকার। তাই মনে ভয় আর উৎসাহ দুইই কাজ করছে। সেদিন রাতে ওই ছোটো ঘরে একরকম গাদাগাদি করেই আমরা শুয়ে পড়েছিলাম। মনে পড়ে মাঝরাতে একবার বাবুদার প্রবল নাসিকা গর্জনে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। চোখ খুলে হ্যারিকেনের স্বল্পালোকে দেখি পাশে পলাশও জেগে উঠেছে। ওর স্থান আমার আর বাবুদার মাঝে হওয়ার কারণে বাবুদার এহেন উৎপাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ওই-ই। অগত্যা উঠে বসি। আমায় উঠে বসতে দেখে পলাশ মহাখুশি। ভাবটা আমি একা মরি কেনো তুমিও মরো। যাই হোক এই প্রবল শব্দে আর ঘুম আসবার আশু সম্ভাবনা দেখি না। ঘরের বন্ধ পরিবেশে একটু দমবন্ধও লাগছিল। তাই পলাশকে সঙ্গে নিয়ে মাথা ভালো করে চাদর দিয়ে মুড়ে বেড়িয়ে আসি আশ্রমের বাইরে। হুহু করে ঠান্ডা বাতাস শরীরে তীরের মতো বিঁধতে থাকে। দূর থেকে ভেসে আসে ভাগীরথীর প্রবল গর্জন। মাথার ওপর আকাশজুড়ে অসংখ্য নক্ষত্র ঝিকমিক করছে। সামনের প্রান্তরে যেদিকে তাকাই সর্বত্র এক মায়াবী স্তিমিত আলোকে ভেসে যাচ্ছে। হঠাৎই চোখ চলে যায় অদূরে এক শ্বেতশুভ্র চূড়ায়। গতকাল বিকেলে আকাশ পরিষ্কার ছিল না বলে খেয়াল করিনি। বহুক্ষণের জন্য চোখ আটকে রইল ভাগীরথী 'গ্রুপ অফ পিকস'-এর দিকে। একসময়ে পলাশের তাড়ায় সন্বিত ফেরে। সৃষ্টিকর্তার এক অসামান্য কীর্তি প্রত্যক্ষ করলাম এ জীবনে! চর্মচক্ষু সার্থক হল। রাত পেরোলেই তৈরি হতে হবে এই ট্যুরের কঠিনতম পথের জন্য। আশ্রমে ফিরে আসি। এভাবে ঘুম না ভেঙে গেলে জীবনে প্রকৃতির এমন একটা সুন্দর দৃশ্য অদেখাই থেকে যেত।

গোমুখ থেকে শিবলিঙ্গের চূড়া।

পরদিন খুব সকালে ঘুম ভাঙে বাচ্চুদের হাঁকডাকে। ওরা তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়তে চায়। কারণ এ অঞ্চলে আবহাওয়া যেকোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে। সেক্ষেত্রে এ পথে বিপদের আশঙ্কা আছে। আমরা তাড়াতাড়ি প্রাতকৃত্য সেরে সারাদিনের মতো তৈরী হয়ে নিয়ে খাওয়ার ঘরে চলে যাই। এত সকালে এরই মধ্যে গোপালদা সকালের জলখাবার রেডি করে ফেলেছে। আমরাও রুটি আর আলুর তরকারি খেয়ে নিয়ে গোপালদার অনুমতি নিয়ে শুরু করি সেদিনের যাত্রা। আমাদের প্রথম গন্তব্য গোমুখ। এর পর যাব তপোবন। ভাগীরথীকে ডান হাতে রেখে উত্তর দিকে ঘন্টা তিনেক পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে অবশষে পৌঁছই গোমুখ। সামনে দেখা যায় একটি গ্লেসিয়ারের বৃহৎ গহ্বর। গহ্বরের মুখটা অনেকটা গরুর মুখাকৃতির। তাই নাম গোমুখ। এর থেকে নির্গত নদীটির নাম ভাগীরথী, যে জলধারা নিচে আমাদের সমতলের মানব সভ্যতাকে সচল রেখেছে। গ্লেসিয়ারের ওপর দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে দূরে শ্বেতশুভ্র শিবলিঙ্গ পর্বত চূড়া (২১,৪৬৭ ফুট)। মন আর চোখ দুই-ই জুড়িয়ে যায়। পরবর্তীকালে পিন্ডারী জিরো পয়েন্টে (১২,৩০০ ফুট) পিন্ডারী নদের উৎস মুখও দেখেছি। সেটিও এই একই রকম দেখতে। কিছু যাত্রীকে দেখি এই বরফ গলা জলে নেমে ডুব দিতে। মূল পথ থেকে নিচে নেমে আমরাও গোমুখের বরফ গলা জল স্পর্শ করি। এরপর সেখানে কিছু সময় থেকে এক সময় বাচ্চুর তাড়ায় আবার শুরু হয় এই ট্যুরের সব থেকে কঠিনতম পথ চলা। আবার মূল পথে উঠে উত্তরে অগ্রসর হই। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে ডান হাতে গোমুখ পার করতেই উঠে আসি গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ারে। এরপর গ্লেসিয়ারের বামপাশ চেপে আরও উত্তরে অগ্রসর হই। ভুজবাসা থেকে গোমুখ অবধি আসার সময় সঙ্গে বেশ কিছু তীর্থযাত্রী এসেছিল। তারা গোমুখ থেকেই ফিরে গিয়েছে। তীর্থযাত্রীর পথ ঐ অবধি এসেই শেষ হয়েছে। এরপর থেকে ট্রেকারদের পথ। এখন এ পথে কেবল আমরা কয়জন ট্রেকার। এবার পথে বোল্ডার। এর নিচে রয়েছে গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ারের মোটা বরফের চাদর। বরফের ব্রীজের ওপর ভারী বোল্ডারের এহেন অবস্থানে বরফের বহন ক্ষমতা দেখে অবাক হই। ঘন্টাখানেক এভাবে চলার পর গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ারকে আড়াআড়ি পেরিয়ে একটি চড়াইয়ের সামনে এসে দাঁড়াই। এটি সোজা পশ্চিমদিকে ওপরে উঠে গেছে তপোবনের দিকে। প্রথম থেকেই চড়াইয়ের শুরু। প্রথমে চল্লিশ ডিগ্রী, পরে কোথাও ষাট, কোথাও সত্তর ডিগ্রীতে ওপরে উঠে গেছে। পায়ের তলার মাটি ঝুরঝুরে। পুরো পথটাই ল্যান্ডস্লাইড জোন। বৃক্ষশূন্য এ অঞ্চলে এই চড়াই পথে হাতে ধরার কোনো অবলম্বন আশেপাশে নেই। পা পিছলে গেলে সোজা নিচে হিমশীতল গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ার। গুরুতর জখম বা মৃত্যু সেক্ষেত্রে অনিবার্য। আগের বছরে শুনেছিলাম কলকাতার একটি গ্রুপের প্রায় সকলেই ঝড়ের দাপটে মাঝপথে নিচে পড়ে প্রাণ হারায়। পথে নিশানা বলতে কোথাও কোথাও পাথর একটার ওপর একটা সাজিয়ে চিহ্ন বানানো আছে। তবে কোথাও কোথাও তাও অদৃশ্য। শিবলিঙ্গের চূড়া লক্ষ করে এগিয়ে যাওয়া। তাও কখনও দৃশ্যমান হয় তো পরমূহুর্তে পাহাড়ের আড়ালে চলে যায়। সামনে মাথা তোলার সুযোগ পাই না। চার হাত-পায়ে মাটি আঁকড়ে ধরে পথ চলেছি। চড়াই এখন প্রায় সত্তর ডিগ্রী। পায়ের নিচের মাটি ঝুরঝুরে। শরীরের ভারসাম্য রেখে কখনও ওপরের দিকে অগ্রসর হই তো কখনও ডাইনে বা বামে। এক সময় খেয়াল করি দলের সকলেই একে একে দৃষ্টির অগোচরে চলে গেছে। পড়ে কেবল আমি আর আমার নীচে ৯৭ কেজি দৈহিক ওজনের ভারে কাহিল বাবুদা। পথে কোনো ট্রেকার বা অভিযাত্রী দল চোখে পড়ে না। অন্তত একজন অভিজ্ঞ কেউ পাশে থাকলেও মনে জোর পেতাম। হঠাৎই নীচ থেকে বাবুদার ডাক শুনতে পাই। আমায় দাঁড়াতে বলছে। আমি ওর দিকে ফিরে তাকাতেই আমার চোখ চলে যায় নিচে। এ আমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছি! আমার বাঁদিকে পাহাড়ের খাড়া ঢাল সোজা নিচে নেমে গেছে প্রায় হাজার ফিট নিচে গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ার অবধি। অর্থাৎ পা পিছলে গেলে নিচে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ারের হিমশীতল শয্যা। আমার বুকটা কেঁপে ওঠে। এখানে অধিক উচ্চতায় এমনিতেই বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কম। রাত্রে ভাল ঘুম হয়নি। শরীর অবসন্ন। মনের মধ্যে উল্টোপাল্টা চিন্তা উঁকি দিতে শুরু করে। মনে হয় পিছন দিকে একটু হেলে গেলেই নীচে পড়ে যাব। আশেপাশে কোনো অবলম্বন পাইনা। একসময় মনে হয় এভাবে কিছুক্ষণ কাটলে এ যাত্রায় আর বাড়ি ফেরা হল না। জীবনে অনেককেই সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার কথা বলতে শুনেছি। সেদিনের কিছুক্ষনের এই অনুভুতি তার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। পরবর্তিকালে অনেকবারই হিমালয়ের বিভিন্ন জায়গায় ট্রেকিং-এর অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু এই ক'টি মুহুর্ত আজও মনে সতেজ হয়ে রয়ে গেছে। দ্বিতীয়বারের জন্য নীচ থেকে বাবুদার গলা শুনতে পাই, "আমার শরীরটা কেমন করছে"। এবার গলার স্বর কিছুটা অস্বাভাবিক। কি করব বুঝতে পারি না। ওপরে দলের কাউকেই দেখতে পাই না। ওরা অনেকটা এগিয়ে গেছে। অর্থাৎ কারো কোনো সাহায্য পাওয়ার আশা নেই। ত্রিসীমানায় জনমানবের চিহ্ন নেই। প্রাণে বাঁচতে যা করতে হবে তা নিজেকেই করতে হবে। তার ওপর নিচে সাহায্যপ্রার্থী বাবুদা। ওরও সাহায্য প্রয়োজন। জানি না আর কয়েক মুহুর্ত পরে ভাগ্যে কি লেখা আছে! এখানে মনোসংযোগ হারালে চরম বিপদ ঘটে যাবে। নিজেকে সামলে নিই। পায়ে ডাকব্যাক কোম্পানীর হান্টার। নুড়ি পাথর বিছানো পর্বতগাত্রে তাও পা পিছলে যাচ্ছে। আসবার আগে পড়েছিলাম তপোবনের পথে শেষ ২ কিলোমিটারে ১,৫০০ ফুট চড়াই পার করতে হয়। স্বভাবতই পাহাড়ের ঢাল এখানে প্রায় ৭০ ডিগ্রী। হাত ও পা দুটোই কাজে লাগাতে হচ্ছে। কঠিন পরীক্ষা। অনেক প্রচেষ্টার পর অবশেষে পাহাড়ের এক খাঁজে একটু সোজা হয়ে দাঁড়াবার জায়গা পাই। মনে হয় এ যাত্রায় প্রাণ বাঁচল।

বাবুদার দিকে আমার লম্বা মাফলারটা গলা থেকে খুলে এগিয়ে দিই। ও ওটা ধরে উঠে আসে। ওর তখন গা গুলোচ্ছে। এটা ওর আগের রাত্রে অপরিমিত আহার ও সকালে আশ্রমে জলখাবারে (গোপালদার বারণ উপেক্ষা করে) রামদানার হালুয়া খাওয়ার পরিনাম হবে ভেবে পকেট হাতড়ে ওকে একটা অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট দিই। এই ঠান্ডাতেও ঘামে ভিজে গেছি। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিই। আকাশ মেঘলা। বেশী অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। দলের সকলেই এতক্ষণে ওপরে পৌঁছে গিয়ে থাকবে। বাবুদাকে নিয়ে যেকোনোভাবেই হোক ওদের কাছে পৌঁছতেই হবে। নাহলে বাবুদার ঐ ভারী শরীর যদি আরও খারাপের দিকে যায় তবে এই পথে আমার একার পক্ষে তা সামলানো সম্ভব হবে না। কিছু আগে এ যাত্রায় প্রাণে বাঁচলেও সেক্ষেত্রে কি হবে জানি না। আবার চলা শুরু করি। ওপরে তাকালে একসময় দেখা যায় এক জায়গায় পাহাড়টা শেষ হয়েছে। ওটাই সম্ভবত তপোবন হবে। তবে ঠিক কতটা পথ চলতে হবে তা অনুমান করা এ পথে মুশকিল। এবার আগের থেকে অনেক বেশী সতর্ক হয়ে চলি। সামলে চলতে হয় অসুস্থ বাবুদাকে। ও কাতর অনুরোধ জানায় আজ তপোবনে না রাত কাটিয়ে যেন ভুজবাসায় ফিরে যাই। ওর শারীরিক অবস্থাতে তাতেই মত দিতে হয়।

তপোবনে দেখা চোখ পাখি।

অবশেষে পৌঁছই তপোবন। আমাদের দেখেই চা আর বিস্কুটের প্যাকেট হাতে এগিয়ে আসে পলাশ আর বাচ্চুরা। বাবুদার অবস্থা ওদের জানিয়ে চা নিয়ে বসে পড়ি বিশ্রাম নিতে। এ চা দুধ ও চিনি ছাড়া। তবে এই শারীরিক ধকলের পর তাও অমৃত। গতকাল বিকেলে ভুজবাসায় পৌঁছে আশ্রমে এক ধরনের পাহাড়ি জড়িবুটি দেওয়া চা মিলেছিল। তাতে এক চুমুকেই দেখেছিলাম অদ্ভুতভাবে পথশ্রমের ক্লান্তি ধুয়ে গিয়েছিল। বাবুদাকে ওরা নিয়ে গিয়ে সামনের একটা টেন্টে শুইয়ে দেয়। শোওয়ামাত্র শুরু হয় বমি। জানতে পারি এটা হাই অল্টিচ্যুড সিকনেস। এ অবস্থায় ট্রেকারকে যত দ্রুত সম্ভব কম উচ্চতায় নামিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।

তপোবনে আমাদের টিমের সদস্যরা। বাম দিক থেকে বাচ্চু, পলাশ, হৃষিকেশ, লেখক, বাবুদা ও পার্থ।

প্রায় ১৪,৬০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত উত্তরাঞ্চলের গাড়োয়াল হিমালয়ের এই ক্ষেত্রটি মুনি ঋষিদের তপস্যার স্থল। গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ারের পূর্ব কোলে অবস্থিত এই তপোভূমির পূর্ব পাড় বেষ্টন করে রয়েছে গঙ্গোত্রী [গঙ্গোত্রী ১ (২১,৮৯০ ফুট), গঙ্গোত্রী ২ (২১,৬২১ ফুট), গঙ্গোত্রী ৩ (২১,৫৭৮ ফুট)], ভৃগুপন্থ (২২,২১৮ ফুট), থলয় সাগর (২২,৬৫১ ফুট), মেরু পর্বত [দক্ষিণ (২১,৮৫০ ফুট), মধ্য (২০,৭০০ ফুট) ও উত্তর (২১,১৬০ ফুট)], শিবলিঙ্গ (২১,৪৬৭ ফুট), কেদারনাথ (২২,৭৬৯ ফুট) প্রভৃতি পর্বত শ্রেণী। গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ারের পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত পর্বত চূড়াগুলির মধ্যে রয়েছে জাহ্নকূট (২২,৩২৬ ফুট), সতোপন্থ (২৩,২১২ ফুট), ভাগীরথী পর্বত [ভাগীরথী ১ (২২,৪৯৩ ফুট), ভাগীরথী ২ (২১৩৬৫ ফুট), ভাগীরথী ৩ (২১,১৭৫ ফুট), ভাগীরথী ৪ (২০,৩১৮ ফুট)], চন্দ্র পর্বত [চন্দ্র পর্বত ১ (২২, ১১০ ফুট), চন্দ্র পর্বত ২ (২২,০৭৩ ফুট), চন্দ্র পর্বত দক্ষিণ (২১,৫১২ ফুট)], পিলাপানি (২২,২৯৭ ফুট) ও সুদর্শণ (২১.৩৪৮ ফুট) প্রভৃতি পর্বতশ্রেণী। উত্তরে রয়েছে চৌখাম্বা [চৌখাম্বা ১ (২৩,৪১৯ ফুট), চৌখাম্বা ২ (২৩, ১৫৬ ফুট), চৌখাম্বা ৩ (২২,৮৮১ ফুট), চৌখাম্বা ৪ (২২,৪৮৭ ফুট)]। নীচে তপোবনের পাদদেশে চারিদিকে ২৫৮.৫৬ বর্গ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিস্তৃত একাধিক মোটা হিমবাহের আবরণ। তপোবনের পাদদেশে পূর্বে গঙ্গোত্রী হিমবাহ (১০৯.০৩ বর্গ কিলোমিটার) দক্ষিণে গোমুখ থেকে উত্তর-পশ্চিমে চৌখাম্বা পর্বতের পাদদেশ অবধি প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ২ থেকে ৬ কিলোমিটার প্রশস্ত। পশ্চিমে রয়েছে ভৃগুপন্থ হিমবাহ (১৪৯৫ বর্গ কিলোমিটার), পূর্বে চতুরঙ্গী হিমবাহ (৭২.৯১ বর্গ কিলোমিটার) আর দক্ষিণ পশ্চিমে রক্তবরণ হিমবাহ (৪৫.৩৪ বর্গ কিলোমিটার)। তবে ক্ষয়িষ্ণু এই হিমবাহের স্তর নিয়ে পরিবেশবিদেরা আতঙ্কিত। বিগত দিনের তুলনায় এর পরিমান যে গতিতে হ্রাস পেয়ে চলেছে তাতে মানুষ সচেতন না হলে এই প্রাচুর্য হয়ত আর আগামী প্রজন্ম দেখতে পাবে না [১]। দু' একটি কুটির এখানে রয়েছে। সেখানে সাধুরা থাকেন। দুপুরে খাওয়ার জন্য বা থাকতে হলে তাঁরাই ভরসা। একসময় চোখ চলে যায় সামনের শিবলিঙ্গের চূড়ায়। সকালে গোমুখ থেকেও দেখা গিয়েছিল শিবলিঙ্গ। দেখে বহুক্ষণ চোখ ফেরাতে পারিনি। এখানে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে মনে হয় শিবলিঙ্গ যেন এক স্বর্গীয় রূপ নিয়ে এই তপোস্হল আগলে দাঁড়িয়ে। এই তপোবন শিবলিঙ্গ পর্বত অভিযানের বেস ক্যাম্প। একে একে দৃষ্টিগোচর হয় ভৃগুপন্থ, মেরু ও ভাগীরথী গ্রুপ অফ পিকস। সামনে মৃদু গতিতে বয়ে চলেছে আকাশ গঙ্গা। আশ্চর্য লাগে এত উচ্চতায়ও নদীপাড়ে গজিয়ে উঠেছে কিছু গুল্ম। গরম চায়ের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতেই আশেপাশে হলুদ ঠোঁট বিশিষ্ট কৃষবর্ণের দু' একটি পাখি ঘোরাঘুরি করতে দেখি। এদের কথা আগে শুনেছিলাম। স্থানীয় ভাষায় এরা 'চোখ পাখি' নামেই পরিচিত। এরা বিস্কুট বা খাবার দিলে হাত থেকে নিয়ে খায়। একটি দিন এখানে থাকার খুব ইচ্ছা হয়। এখানে একদিন থেকে তারপর যাওয়া যায় নীল তাল ও বাসুকী তাল। কিন্তু বাবুদা অসুস্থ। তাই সে যাত্রায় আর তপোবনে থাকা হয়নি। দুপুরে সেদিন তপোবনে বাঙালীবাবার আশ্রমে গলা ভাত আর আধসেদ্ধ মুগ খেয়ে লাঞ্চ পর্ব সেরে ফেরার আয়োজনে ব্যস্ত হতে হয়। বাচ্চু আর পার্থ আমাদের সঙ্গেই ফেরার পথ ধরে। সেবার ফেরার সময় সাধুদের দেখানো অন্য একটি পথে আমরা এসেছিলাম। সে পথে বড় বড় বোন্ডার থাকলেও আসার পথের মত ততটা ভয়াবহ ছিল না। পরে বুঝেছিলাম আসার সময় শর্টকাট পথ নির্বাচনই আমার মতো অনভিজ্ঞের বিপদের কারণ হয়েছিল।

গুগল ম্যাপে গোমুখ ও তপোবনের অবস্থান, বর্তমান পথ (সাদা পথরেখা) ও অতীতের পথ (লাল পথরেখা)।

তপোবন থেকে এক বোল্ডার জোনের মধ্য দিয়ে ঢালু উৎরাই বেয়ে অবশেষে নীচে নেমে আসি। এরপর আবার গঙ্গোত্রী হিমবাহের বরফের ব্রীজ পার করে যখন পশ্চিম পাড়ে পৌঁছই তখন বেলা গড়িয়ে বিকেল চারটে। মৃদু বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে গেছে। আমরা গোমুখের দিকে কিছুটা অগ্রসর হতে আমাদের পথের ডান পাশে একটা পরিত্যক্ত ছাউনি দেখে সেখানে আশ্রয় নিই। এদিকে বাবুদার অবস্থা কাহিল। ভুজবাসা আশ্রমে আগে গিয়ে খবর না দিলে সেখানে রাত্রে থাকার জায়গা মিলবে না। পলাশ আর পার্থ থেকে যায় বাবুদার সঙ্গে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায়। আমি আর বাচ্চু নিচে আশ্রমে রাত্রে আশ্রয়ের বন্দোবস্তের উদ্দেশে বেড়িয়ে পড়ি। পথে ক্রমেই বৃষ্টি বাড়তে থাকে। সঙ্গে শুরু হয় তুষারপাত। এরপর ভুজবাসার পথে মাঝে আর কোনো আশ্রয় নেই। আমরাও পা চালাই। একসময় ক্লান্ত হয়ে দাঁড়াতে হয়। পাহাড়ের গা বেয়ে বৃষ্টির জলের ধারা পথে নেমেছে। দূরে বৃষ্টি ভেজা গাড়োয়ালের নেড়া পর্বতগাত্র গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ। এই ক্ষণিকের তুষারপাতে স্থানে স্থানে সাদা চাদর মুড়ে দিয়েছে। চারিদিকে প্রগাঢ় নৈশব্দ। কান পাতলে শোনা যায় কেবল পাহাড় বেয়ে নেমে আসা বৃষ্টির জলের বয়ে চলার শব্দ। এক সময় দূর থেকে ভেসে আসে টুং টাং শব্দ। দূরে দেখা মেলে একদল পোর্টারের। এ আওয়াজ তাদের খচ্চরের গলায় বাঁধা ঘন্টার। দূরে পাহাড়ের গায়ে তার প্রতিধ্বনি শোনা যায় টুংটাং টুংটাং... কত সাধারণ, কিন্তু সব মিলিয়ে কি অপূর্ব এই দৃশ্য ও পরিবেশ! ক্ষণিকের জন্য সম্মোহিত করে ফেলে। কিছুসময় আগে পাহাড়ের খাদের ধারে দাঁড়িয়ে হিমালয়ের ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ দেখেছিলাম। প্রায় হাজার ফুট নিচে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত এক গ্লেসিয়ারের বিস্তার, কোথাও কমলা কোথাও বা তা হলুদ বর্ণের। হিমালয়ের ভয়ঙ্কর সুন্দর সে রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলাম জীবন হাতে নিয়ে। ভয় হয়েছিল নিচে যে কোনো মুহুর্তে আছড়ে পড়ে হয়ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। আর এ দৃশ্য যেন ক্লান্ত পথিককে হিমালয়ের সস্নেহ উপহার। সেদিন মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম আবার আসব। কিন্তু বিগত বিশ বছরে হিমালয়ের আনাচে কানাচে বার বার ছুটে গেলেও ওপথে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তবে ইচ্ছে আছে কখনও যদি কালিন্দী পাশ (১৯,৪৯৫ ফুট) পেরিয়ে বদ্রীনারায়ণ যাওয়ার রুটে যাই তবে পথে এক রাত তপোবনে থেকে যাব।

সে রাত্রে ভুজবাসায় লালবাবার আশ্রমে রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে সবাই বসি গল্প করতে। দিনের হিসাব মেলাতে বসে তারিখটা নজরে পড়তে চমকে উঠি। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগের এই দিনটা মনে পড়ে। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আজ ঠিক এক বছর পূর্ণ হল। অর্থাৎ আগামীকাল মৃত্যুবার্ষিকী। শুনেছি অনেকেই মানে যে এই একটা বছর সন্তানদের নাকি সাবধানে চলাফেরা করা উচিত। সত্যাসত্য কখনও ভেবে দেখিনি। আজ হয়ত তারই কঠিনতম এক পরীক্ষা দিতে হল। পাশ না ফেল তা তো জানি না। তবে সেদিনের সেই মুহুর্তটার খোঁজ পরবর্তীকালে বারংবার তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে হিমালয়ের নানান অন্দরে। আর প্রতিবারই নিত্যনতুন রূপে তার দর্শন মিলেছে।


ছবি সৌজন্যঃ পলাশ ঘটক।


তথ্যসূত্রঃ

[১] Gyan Marwah. "Ganges - A River of No Return?". the-south-asian.com. Archived from the original on 16 September 2013. Retrieved 24 June 2007.