বহুভাষিক এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র সম্পন্ন সমাজ বিকশিত হওয়ার প্রাথমিক শর্ত বিভিন্ন ভাষার যথাযথ সংরক্ষণ ও বিকাশ কেননা এই ভাষাগুলোর মাধ্যমেই চিরাচরিত সংস্কৃতি এবং জ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হয় এবং নতুন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের নির্মাণ হয়। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে ভাষাগত বৈচিত্র্য প্রতিমুহূর্তে বিপন্ন হচ্ছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের হিসেব অনুযায়ী বিশ্বের ৪০ শতাংশ মানুষ তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। কোনো কোনো জায়গায় এমন মানুষের সংখ্যা ৯০ শতাংশ। অথচ এই কথা আমরা সকলেই জানি যে শিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষা মাতৃ দুগ্ধের সমতুল্য। বিভিন্ন গবেষণায় এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে শিক্ষাক্ষেত্রে মাতৃভাষা ব্যবহৃত হলে ছাত্র-ছাত্রীদের জ্ঞান অর্জন কেবলমাত্র ত্বরান্বিত হয় তাই নয় তাদের আত্মমর্যাদা এবং গভীর চিন্তা ও বিশ্লেষণের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। সমাজে প্রত্যেক মানুষের যথাযথ স্থান সুনিশ্চিত করবার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার যে একটি বিশেষ ভূমিকা আছে তা ১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে রাষ্ট্রসংঘের স্বীকৃতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিষয়বস্তু হিসেবে 'বহুভাষিক শিক্ষা - শিখন এবং আন্তঃপ্রজন্ম শিখনের একটি স্তম্ভ'কে বেছে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রসংঘ স্পষ্টভাবে এই বার্তাই দিয়েছে যে শিশুর শিক্ষা মাতৃভাষাতে শুরু হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং পরবর্তীকালে অন্যান্য ভাষা শিক্ষার বিষয়টিকে যুক্ত করা দরকার। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জ্ঞানের ধারা অক্ষুন্ন রাখার ক্ষেত্রে বহুভাষিক শিক্ষা ভীষণ জরুরী। এভাবে শিশুর বাড়ি এবং বিদ্যালয়ের মধ্যে দূরত্ব ঘুচে যায় যা কিনা যথাযথভাবে শিক্ষা গ্রহণে সহায়তা করে। বহুভাষিক শিক্ষা কেবলমাত্র অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তুলতেই সহায়তা করেনা, এর মাধ্যমে সমাজের সেই অংশের মানুষ যারা নানাভাবে প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছেন তারা সহজেই শিক্ষার আঙিনায় প্রবেশ করতে পারেন এবং সারা জীবন ধরে সকলের জন্য শিক্ষা গ্রহণের উপযোগী অবস্থার সৃষ্টি করা যায়। যে ভাষাগুলি নানা কারণে অস্তিত্বের সংকটের সম্মুখীন সেগুলিকেও সংরক্ষণ করবার ক্ষেত্রে এই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।
আমরা সকলেই জানি ভাষা ভাব প্রকাশের বাহন। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। মানুষের ভাষা তার নিজের পরিচিতিকে গড়ে তোলে। ভাষার মাধ্যমে আরেকজন মানুষের সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সুদৃঢ় হয় সামাজিক বন্ধন। প্রত্যেকটি ভাষা দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধারণ করে থাকে। তাই কোনো একটি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ পরস্পরের প্রতি যে আত্মিক সম্পর্কে আবদ্ধ থাকে, তা প্রতিনিয়ত সেই ভাষা চর্চা এবং তাকে জীবনের নানা ক্ষেত্রে ব্যবহারের মাধ্যমে পরিপুষ্ট হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষাতত্ত্ববিদ জার্মানির ভন হামবোল্টের কথায় - "ভাষা হচ্ছে একটি জাতির চেতনার অভিব্যক্তি, অভ্যন্তরীণ রূপের বাহ্যিক প্রকাশ। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে ঐ জাতির ধারণার প্রকাশ রূপ। একটি ভাষার বিবর্তনের বিভিন্ন স্তর ঐ জাতির মানস-সংস্কৃতি ও সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। সুতরাং ভাষা ও জাতীয় ইতিহাস অচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত।" বিশ্বায়নের ফলে বিশ্বের নানা প্রান্তে বিভিন্ন মানুষের মাতৃভাষা প্রতিনিয়ত নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বহু মানুষের মুখের ভাষা। আর তার সাথে সাথে ক্রমাগত মুছে যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। কার্যত প্রতি দু' সপ্তাহে একটি করে ভাষার মৃত্যু ঘটছে। পৃথিবীতে আনুমানিক যে ৭ হাজার ভাষা রয়েছে তার প্রায় ৪৫ শতাংশ এভাবে অস্তিত্বের সংকটের সম্মুখীন। মাত্র কয়েকশো ভাষায় পৃথিবীতে নানারকম ব্যবহারিক কাজ হচ্ছে। একদিকে যখন ভাষার মৃত্যু বিশ্বায়িত পৃথিবীর এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা, তেমনি কয়েকটি ভাষার ক্রমাগত শক্তি বৃদ্ধি সমসাময়িক বিশ্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এইজন্যই বহুভাষিক শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে বিশ্বের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে জোরদার করা এবং বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের ক্ষমতায়ন করা একটি জরুরী কাজ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষার বাহন হিসেবে মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে নিঃসংশয় ছিলেন। 'জীবনস্মৃতি'তে এক জায়গায় তিনি লিখেছেন - "ছেলেবেলায় বাংলা পড়িতে ছিলাম বলিয়াই সমস্ত মনটার চালনা সম্ভব হইয়াছিল। শিক্ষা জিনিসটা যথাসম্ভব আহার ব্যাপারের মতো হওয়া উচিত। খাদ্যদ্রব্যে প্রথম কামড়টা দিবামাত্রেই তাহার স্বাদের সুখ আরম্ভ হয়, পেট ভরিবার পূর্ব হইতেই পেটটি খুশি হইয়া জাগিয়া উঠে - তাহাতে তাহার জারক রসগুলির আলস্য দূর হইয়া যায়। বাঙালির পক্ষে ইংরাজি শিক্ষায় এটি হইবার জো নাই। তাহার প্রথম কামড়েই দুপাটি দাঁত আগাগোড়া নড়িয়া উঠে - মুখবিবরের মধ্যে একটা ছোটখাটো ভূমিকম্পের অবতারণা হয়। তার পরে সেটা যে লোষ্ট্রজাতীয় পদার্থ নহে, সেটা যে রসে পাক করা মোদকবস্তু, তাহা বুঝিতে বয়স অর্ধেক পার হইয়া যায়। বানানে ব্যাকরণে বিষম লাগিয়া নাক চোখ দিয়া যখন অজস্র জলধারা বহিয়া যাইতেছে অন্তরটা তখন একেবারেই উপবাসী হইয়া আছে। অবশেষে বহুকষ্টে অনেক দেরিতে খাবারের সঙ্গে যখন পরিচয় ঘটে তখন ক্ষুধাটাই যায় মরিয়া। প্রথম হইতেই মনটা চালনা করিবার সুযোগ না পাইলে মনের চলৎ শক্তিতেই মন্দা পড়িয়া যায়।" জীবনের অভিজ্ঞতায় রবীন্দ্র ভাবনার সারবত্তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। তবে বাজার যত বেশী সমাজ ও রাষ্ট্রের চালিকাশক্তিতে পরিণত হচ্ছে তত ভাষাগত বৈচিত্র্য সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। ভারতের উচ্চশিক্ষায় ইংরেজীর প্রবল প্রতিপত্তি ঔপনিবেশিক শাসনকাল থেকে শুরু হয়ে স্বাধীনতার পৌনে আট দশক বাদেও বহমান। এক্ষেত্রে অন্যান্য কারণের সাথে একটি অন্যতম প্রধান কারণ রাষ্ট্র পরিচালনার পুঁজিবাদী নীতি। 'জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণ বলতে কী বোঝায়’ নামক প্রবন্ধে লেনিন লিখেছেন - "পণ্য উৎপাদনে পরিপূর্ণ বিজয়ের জন্য বুর্জোয়াদের আভ্যন্তরীণ বাজার দখল করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ ভূ-খণ্ড, যার অধিবাসীরা একই ভাষায় কথা বলে,...আধুনিক পুঁজিবাদের পক্ষে অবাধ ও ব্যাপক বাণিজ্যের জন্য বাজারের সাথে ছোট-বড় প্রতিটি মালিকের এবং ক্রেতা ও বিক্রেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হল ভাষার ঐক্য ও তার বাধাহীন বিকাশ।" ভাষার ক্ষেত্রে একমুখীনতাকে উৎসাহিত করে পুঁজিবাদ। জাতীয় সংহতির নামে, প্রশাসনিক সুবিধার কথা বলে ভাষাগত বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করা হয় সুপরিকল্পিতভাবে। ভারতের মতো দেশ যেখানে শক্তিশালী ও ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষা রয়েছে সেখানে হিন্দি ভাষার প্রতি রাষ্ট্রীয় পক্ষপাত এক উদ্বেগজনক প্রবণতা। একদিকে ইংরেজী ভাষা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে কেননা অনুবাদ ও পরিভাষা সৃষ্টির কাজে অবহেলা চলছে ধারাবাহিকভাবে, আর অন্যদিকে প্রশাসনিক স্তরে হিন্দিকে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে আবশ্যিক করার উদ্যোগ ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে । এই দু'য়ের জাঁতাকলে পড়ে পিষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষাভাষী মানুষ। আবার আমাদের দেশে ভাষার সাথে ধর্মকে জুড়ে দেওয়ার বিপজ্জনক প্রবণতাও রয়েছে। এই ধরণের মনোভাবের সুবাদে উর্দুকে মুসলমানের ভাষা ও হিন্দিকে হিন্দুদের ভাষা বলে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই ভাবনার কোনও ভিত্তি নেই। ভাষাকে ঘিরে এই ক্ষমতার রাজনীতির আবর্তে হারিয়ে যায় মানুষের আত্মপরিচয়, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার। ভাষা নিছক আবেগের বিষয় নয়, একে ঘিরে মানুষের সত্তার যে নির্মাণ হয় তা যাতে বিপন্ন না হয়ে যায় তা নিশ্চিত করা এই সময়ের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
একুশে ফেব্রুয়ারি যে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের কথা প্রতিনিয়ত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় তা ভাষাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতা জাহির করা ও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করার বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদের অনন্য নজির। পৃথিবীর বুকে যতদিন ক্ষমতার আস্ফালন থাকবে, ততদিন একুশে ফেব্রুয়ারি জেগে থাকবে উজ্জ্বল দীপশিখা হয়ে।
অঙ্কনঃ মনীষ দেব