আগেই বলা হয়েছে এক পত্নীর পঞ্চপতি থাকায় তাঁদের মধ্যে একটা নিয়ম চালু করা হয়েছিল এবং ঠিক হয়েছিল যে যদি কেউ সেই নিয়ম ভাঙ্গে, তাহলে তাকে ব্রহ্মচারী হয়ে বারো বছর বনে বাস করতে হবে। ঘটনাচক্রে অর্জুনই সেই নিয়মভঙ্গের শিকার হলেন। খান্ডবপ্রস্থে তাঁরা যখন রাজত্ব করছিলেন সেই সময় একদিন কতকগুলো ডাকাত এক ব্রাহ্মণের অনেকগুলি গরু ছিনিয়ে চলে যাচ্ছিল। তখন ওই ব্রাহ্মণ পাণ্ডবগণের প্রাসাদের কাছে এসে উচ্চৈঃস্বরে তাঁর বিপদের কথা জানিয়ে তাঁর গরুগুলো উদ্ধার করার জন্য কাতর আবেদন জানাচ্ছিলেন। অর্জুন ওই আবেদন শুনে ওই ব্রাহ্মণের গরু উদ্ধারের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র যে ঘরে রক্ষিত থাকে, ওই সময় যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদী ওই ঘরেই একান্তে কাল কাটাচ্ছিলেন, অতএব ওই ঘরে অন্য কোনও ভাইয়ের তখন প্রবেশ নিষেধ। অর্জুন পড়ে গেলেন দোটানায়, একদিকে নিয়ম পালন, অপর দিকে বিপন্ন ব্রাহ্মনের গোধন ফিরিয়ে আনার রাজকর্তব্য। তিনি দ্বিতীয় কর্তব্য পালনটাকেই জোর দিলেন, তাতে বনবাসে যেতে হলেও যাবেন ঠিক করলেন। তিনি দ্রুত অস্ত্রাগারে গমন করলেন এবং যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে তিরধনুক নিয়ে ব্রাহ্মণের গোধন উদ্ধার করলেন। তারপর তিনি প্রাসাদে ফিরে এসে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের জন্য যুধিষ্ঠিরের কাছে বনগমনের অনুমতি চাইলেন। যুধিষ্ঠির ব্যাকুল হয়ে বললেন অর্জুন ব্রাহ্মণের গোধন উদ্ধার করে খুব প্রশংসনীয় কাজ করেছেন, তাছাড়া বড় ভাই পত্নীর কাছে থাকলে সেখানে ছোট ভাইয়ের যাওয়াতে কোনও অপরাধ হয় না এবং তিনিও তাতে কিছু মনে করেননি। কিন্তু সত্যপালনে অটল অর্জুন বারো বছর বনবাসে কাটানোর জন্য বেরিয়ে পড়লেন। বহু পন্ডিত ব্রাহ্মণ, পুরাণকথক, ভিক্ষাজীবী প্রভৃতি অর্জুনের সঙ্গে চললেন এবং তাঁরা বহু বন, নদী, দেশ, পুণ্যতীর্থ, সমুদ্র ইত্যাদি দর্শন করতে করতে ঘুরতে লাগলেন। এইভাবে তিনি শেষ পর্যন্ত গঙ্গাদ্বারে গিয়ে আশ্রম স্থাপন করলেন এবং অর্জুনের সঙ্গী ব্রাহ্মণগণ সেখানে যাগযজ্ঞ করতে লাগলেন।
একদিন অর্জুন গঙ্গায় স্নান ও পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করার পর অগ্নিকার্য করার জন্য জল থেকে উঠে আসছিলেন, এমন সময় নাগরাজকন্যা উলূপী তাঁর রূপে আকৃষ্ট ও কামাসক্ত হয়ে তাঁকে জলমধ্যে টেনে নিয়ে তাঁদের ভবনে নিয়ে গেলেন, অর্জুন দেখলেন সেখানে যজ্ঞাগ্নি রয়েছে। তিনি ধীরেসুস্থে অগ্নিকার্য সমাধা করে উলূপীর পরিচয় এবং তাঁকে কেন সেখানে আনা হল তার কারণ জানতে চাইলেন। উলূপী বললেন যে তিনি ঐরাবত বংশের কৌরব্য নাগের কন্যা, তিনি অর্জুনকে দেখেই অত্যন্ত ভালোবেসে ফেলেছেন, সুতরাং তাঁকে তাঁর কামনা পরিতৃপ্তি করতে হবে। অর্জুন জানালেন যে তাঁদের মধ্যে প্রচলিত নিয়ম অনুসারে তিনি বারো বছর ব্রহ্মচর্য পালনে রত আছেন। উলূপী বললেন যে তিনি দ্রৌপদীর ব্যাপারটা জানেন এবং ওই নিয়মটাও দ্রৌপদীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। নাগলোকে তাঁর ক্ষেত্রে ওই নিয়ম পালন করার কোনও প্রয়োজন নেই, তাছাড়া আর্তকে রক্ষা করাও তো অর্জুনের কর্তব্য। উলূপী আরও বললেন তিনি অর্জুনের প্রতি অনুরক্ত এবং তিনি যদি তাঁর কামনাপরিতৃপ্তি না করেন, তাহলে তিনি প্রাণ হারাবেন। তাঁর প্রাণরক্ষা করলে অর্জুনের ধর্মলোপ হবেনা, বরং আর্তকে রক্ষা করার জন্য তাঁর পুণ্যই হবে। নাগরাজকন্যা উলূপীর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করাকে ধর্মসম্মত কাজ মনে করে তাঁর সঙ্গে এক রাত্রি যাপন করলেন এবং পরের দিন সকালে তিনি আবার গঙ্গাদ্বারে ফিরে এলেন। আসার সময় পতিব্রতা উলূপী পরিতৃপ্ত চিত্তে অর্জুনকে বর দিলেন যে কোনও জলচর প্রাণী থেকে তাঁর কোনও ভয় থাকবে না। উলূপীর এই বরের জোরেই পরবর্তী সময়ে কুমিরের রূপধারিণী অপ্সরা বর্গা ও তার চার সহচরী তাঁর কোনও ক্ষতি করতে পারেনি, বরং তিনি তাদের ডাঙায় তুলতে তাঁরা পূর্বরূপ ফিরে পেয়েছিল।
বারো বছরের বনবাসে অর্জুন তাঁর সহচরগণ সহ নানা পুণ্যস্থানে ভ্রমণ করতে লাগলেন। গঙ্গাদ্বার অর্থাৎ হরিদ্বার থেকে নেমে হিমালয়ের তরাই অঞ্চলে অগস্ত্যবট, বশিষ্ঠ পর্বত, ভৃগুশৃঙ্গ প্রভৃতি পুণ্যতীর্থ দর্শন ও সেখানে স্নান করে পবিত্র হলেন। এরপর তিনি পূর্বদিক ধরে অগ্রসর হতে লাগলেন। পথিমধ্যে নন্দা, কৌশিকী, গঙ্গা প্রভৃতি নদী এবং গয়া প্রভৃতি পুণ্যতীর্থ দর্শন করলেন। তারপর তিনি অঙ্গ, বঙ্গ ও কলিঙ্গের তীর্থস্থানসমূহ দর্শন করলেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গী ব্রাহ্মণগণ কলিঙ্গরাজ্যের দ্বারদেশ পর্যন্ত এসে তাঁর অনুমতি নিয়ে ফিরে গেলেন। কলিঙ্গরাজ্যে (এখনকার উড়িষ্যা) তাঁরা কেন ঢুকলেন না, সেটা মহাভারতকার ব্যাখ্যা করে যাননি। অর্জুন কিন্তু সামান্য সহায়সম্বল নিয়েই এগিয়ে চললেন। তিনি কলিঙ্গ দেশের নানা তীর্থস্থান দেখে মহেন্দ্র পর্বত হয়ে সমুদ্রের ধার দিয়ে চলতে চলতে মণিপুরে পৌঁছলেন। সেখানে নানা দেবালয় ও পুণ্যস্থান দেখে শেষ পর্যন্ত রাজধানীতে উপস্থিত হলেন। সেখানে একটি অত্যন্ত সুন্দরী যুবতীকে স্বেচ্ছাক্রমে ভ্রমণ করতে দেখে তিনি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলেন এবং জানতে পারলেন যে তিনি মণিপুরের রাজার কন্যা চিত্রাঙ্গদা। ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে বারো বছর বনবাস যাপন করার কথা ছিল। বনবাস যাপন তো হচ্ছিল না, পরিবর্তে চুটিয়ে দেশভ্রমণ চলছিল। আবার রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে দেখেই অর্জুনের ব্রহ্মচর্য মাথায় উঠল। তিনি তাকে বিবাহ করতে কৃতসংকল্প হলেন। রাজকন্যা উলূপীর ক্ষেত্রে তবু একটা যুক্তি ছিল। অর্জুনের রূপ দেখে তিনি কামশরে জর্জরিত হয়ে তাঁকে একান্তভাবে কামনা করেছিলেন এবং তাঁর আকুলতাপূর্ণ কামনার পরিতৃপ্তির জন্যই অর্জুন তাঁর সঙ্গে এক রাত সহবাস করেছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তিনি চিত্রাঙ্গদাকে লাভ করার জন্যই সোজা মণিপুররাজের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদা। শিল্পীঃ গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই মণিপুর সম্বন্ধে দু-একটা কথা বলে নেওয়া যাক। বর্তমানে ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মণিপুর নামে একটা রাজ্য আছে। এই মণিপুর কিন্তু সেই মণিপুর নয়। মহাভারতের বিবরণ থেকে মোটামুটি বোঝা যায়, ওই মণিপুর ছিল বর্তমান উড়িষ্যার সমুদ্রতীরস্থ কোনও একটা অঞ্চল। অর্জুন যখন মণিপুরে যান, তখন ওখানকার রাজা ছিলেন চিত্রবাহন। তিনি সোজাসুজি চিত্রবাহনের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে তাঁকে তাঁর কন্যা সম্প্রদান করতে অনুরোধ করলেন। তখন পরম ধার্মিক মণিপুররাজ অর্জুনকে তাঁর বংশের একটা ইতিহাস শোনালেন। প্রভঞ্জন নামে তাঁর এক পূর্বপুরুষ ছিলেন। তিনি নিঃসন্তান থাকায় কঠোর তপস্যা করে ভগবান শঙ্করকে প্রসন্ন করেন। দেবাদিদেব শঙ্কর তাঁকে বর দেন যে তাঁদের বংশে সকলেরই এক একটি পুত্র হবে। সেই সময় থেকে সেটাই হয়ে আসছিল, কিন্তু বর্তমান রাজার ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম হয়েছে, পুত্রের বদলে তাঁর কন্যাসন্তান হয়েছে, তবে তিনি তাকে পুত্রের মতোই মনে করেন। মণিপুররাজ আরও জানালেন যে তিনি পুত্রিবগধর্ম অনুসারে তাঁর কন্যার বিবাহ দেবেন, যাতে ওই কন্যার পুত্র তাঁর দত্তকপুত্র হয়ে তাঁর বংশরক্ষা করে। অর্জুন রাজার শর্ত মেনে নিলে চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে তাঁর বিবাহ হল এবং সেখানে তিনি তিন বছর বাস করলেন। পরে পুত্রের জন্ম হলে অর্জুন চিত্রাঙ্গদাকে আলিঙ্গন করে এবং রাজার কাছে অনুমতি নিয়ে আবার তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে পড়লেন। কিছুদিন পরে অর্জুন আবার একবার চিত্রাঙ্গদার কাছে ফিরে এসেছিলেন। চিত্রাঙ্গদা-গর্ভজাত পুত্র বভ্রুবাহনকে মণিপুররাজের হস্তে-সমর্পণ করে এবং চিত্রাঙ্গদাকে পুত্রের দেখাশোনার ভার দিয়ে তিনি গোকর্ণ তীর্থক্ষেত্রে চলে গেলেন।
উলূপী, চিত্রাঙ্গদা ও বভ্রুবাহন সম্বন্ধে আরও কিছু বলার আছে এবং সেজন্য আমাদের অশ্বমেধিক পর্বে চলে যেতে হবে। কুরুক্ষেত্রের লোকক্ষয়কারী মহাসমরের শেষে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের রাজা হলেন এবং তিনি এক অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন। এই যজ্ঞাশ্ব রক্ষার ভার পড়ল অর্জুনের উপর। যজ্ঞাশ্ব স্বাধীনভাবে যে যে দেশের উপর দিয়ে যেতে লাগল, সেই সেই দেশের রাজাকে পরাজিত করে অর্জুন অশ্বকে অনুসরণ করে চললেন। একদিন ওই অশ্ব মণিপুরে প্রবেশ করল। মণিপুরের রাজা বভ্রুবাহন তাঁর পিতা অর্জুনের আসার সংবাদ পেয়ে ব্রাহ্মণগণ সহ বহু ধনরত্ন নিয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। অর্জুন কিন্তু এতে মোটেই সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি বললেন যে তিনি রাজা যুধিষ্ঠিরের অশ্ব রক্ষায় নিযুক্ত হয়ে যুদ্ধকামনায় মণিপুরে এসেছেন, অতএব পুত্র বভ্রুবাহনের তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করাই ক্ষত্রিয়োচিত কাজ হবে। ঠিক এই সময়ে বভ্রুবাহনের বিমাতা নাগরাজকন্যা উলূপী মাটি ভেদ করে উঠে নিজের পরিচয় দিয়ে সপত্নীপুত্র বভ্রুবাহনকে অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উত্তেজিত করতে লাগলেন, কারণ পিতার সঙ্গে যুদ্ধ করলেই তিনি পুত্রের প্রতি অধিকতর প্রীত হবেন। উলূপীর কথা শুনে বভ্রুবাহন অশ্বশিক্ষায় পারদর্শী লোকদের দিয়ে অশ্বটিকে বন্দী করলেন এবং অর্জুনের সঙ্গে তাঁর তুমুল যুদ্ধ বেধে গেল। সুদীর্ঘ যুদ্ধশেষে অর্জুন বীর বভ্রুবাহনের দ্বারা বাণাহত হয়ে মোহগ্রস্ত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন এবং অর্জুনের নিক্ষিপ্ত অস্ত্রের দ্বারা ক্ষতবিক্ষত বভ্রুবাহনও অচৈতন্য হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। সংবাদ পেয়ে চিত্রাঙ্গদা রণস্থলে প্রবেশ করে পতি ও পুত্র দুজনকেই ধরাশায়ী দেখলেন এবং দেখে বুঝতে পারলেন যে অর্জুন নিহত হয়েছেন। তিনি ওই দৃশ্য দেখে বিলাপ করতে করতে মূর্ছিত হয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে চিত্রাঙ্গদা নাগরাজদুহিতা উলূপীকে সামনে দেখতে পেয়ে বুঝতে পারলেন যে তাঁর জন্যই এই দুর্দৈব ঘটেছে। তিনি উলূপীকে অনুরোধ করলেন তাঁর পুত্রের জীবন ফিরিয়ে না দিলেও চলবে, কিন্তু তাঁর স্বামী অর্জুনের জীবন যেন উলূপী ফিরিয়ে দেন। এই বলে শোককাতরা চিত্রাঙ্গদা বিলাপ করতে করতে আমরণ উপবাসে বসলেন। ইতিমধ্যে বভ্রুবাহন চেতনা ফিরে পেলেন এবং পিতাকে নিহত ও মাতাকে প্রায়োপবেশনে অবস্থান করতে দেখে এবং পিতৃহত্যার পাপ থেকে মুক্তির কোনও পথ নেই জেনে তিনিও আমৃত্যু অনশনে বসলেন। এই দেখে উলূপী তাঁদের নাগলোকে অবস্থিত সঞ্জীবনমণিকে স্মরণ করলেন এবং নাগেদের জীবনের মূলীভূত ওই মণি সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে এসে উপস্থিত হল। ওই মণির স্পর্শেই মৃত নাগগণ পুনর্জীবিত হয়ে উঠত। উলূপী বললেন যে তাঁর প্রিয় পতি অর্জুনের প্রিয়কার্য সাধনের জন্যই তিনি মোহিনী মায়া বিস্তার করে তাঁকে মৃতবৎ করে রেখেছেন, নতুবা অর্জুনকে পরাস্ত বা বধ করা - বভ্রুবাহন তো কোন ছার, স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রের পক্ষেও অসাধ্য। এরপর তিনি ওই অদ্ভুত মণিটিকে বভ্রুবাহনকে দিলেন এবং বভ্রুবাহন মণিটিকে অর্জুনের বুকে রাখতেই অর্জুন পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠলেন।
অর্জুন যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলেন, চোখের সামনে যুদ্ধস্থলে পুত্র বভ্রুবাহন ও পত্নীদ্বয় চিত্রাঙ্গদা ও উলূপীকে দেখে বিস্মিত হলেন। তাঁর এইটুকু মনে পড়ল যে তিনি বভ্রুবাহনের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন, কিন্তু সমরাঙ্গনে চিত্রাঙ্গদা ও উলূপীকে কেন দেখা যাচ্ছে? তখন উলূপী সমস্ত রহস্যের মীমাংসা করে দিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শিখণ্ডীকে সামনে রেখে শঠতার আশ্রয় নিয়ে অর্জুন পিতামহ ভীষ্মকে বধ করেছিলেন। এইজন্য বসুগণ ক্রুদ্ধ হয়ে ভীষ্মজননী ভাগীরথীকে ওই দুঃসংবাদ জানিয়েছিলেন এবং অর্জুনকে শাপ দেওয়ার জন্য গঙ্গার অনুমোদন চেয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে ওইস্থানে উলূপী উপস্থিত ছিলেন। বসুগণ অর্জুনকে শাপ দিচ্ছেন দেখে উলূপী দ্রুত পিতার কাছে এসে সেই সংবাদ দিলেন। নাগরাজ খুবই বিষণ্ণচিত্তে বসুগণের কাছে গিয়ে অর্জুনের শাপমুক্তির প্রার্থনা করলেন। তখন বসুগণ বলেছিলেন যে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজপুত্র মণিপুররাজ বভ্রুবাহনের হস্তে অর্জুন শরবিদ্ধ হয়ে ভূতলে নিপতিত হলেই তাঁর শাপমুক্তি হবে। এ সবই উলূপী জানতেন, তাই তিনিই বভ্রুবাহনকে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে উত্তেজিত করেছিলেন, আবার তিনিই সঞ্জীবনমণির দ্বারা অর্জুনকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন। এতে অর্জুনেরই মঙ্গল হয়েছিল, কারণ পুত্রের হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে হতচেতন না হলে ভীষ্মবধজনিত পাপের ফলে তাঁকে নরক গমন করতে হতো। এরপর উলূপী অর্জুনকে বললেন যে পুত্রের হাতে পরাজিত হয়েছেন বলে তিনি যেন লজ্জিত না হন, কারণ পুত্র হল আত্মস্বরূপ এবং তার সাহায্যেই তিনি নরকভোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। উলূপীর সব কথা শুনে অর্জুন তাঁর প্রতি খুব প্রসন্ন হলেন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। তারপর তিনি উলূপী, চিত্রাঙ্গদা ও বভ্রুবাহনকে মন্ত্রিগণসহ আগামী চৈত্র পূর্ণিমায় মহারাজ যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞে যোগদান করার নিমন্ত্রণ জানিয়ে এবং তাঁদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আবার যজ্ঞাশ্বের পশ্চাদনুসরণ করতে লাগলেন।
যথাসময়ে বভ্রুবাহন দুই মাতা চিত্রাঙ্গদা ও উলূপীকে নিয়ে যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের মহোৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। উলূপী ও চিত্রাঙ্গদা রাজ-অন্তঃপুরে কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা ও অন্যান্য রাজবধূগণের দ্বারা সমাদৃতা ও আপ্যায়িতা হয়েছিলেন। বভ্রুবাহনও মণিপুরে ফিরে আসার সময় যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে প্রচুর ধনরত্ন উপহার পেয়েছিলেন। সকলেই সব কিছু পেলেন কিন্তু নাগরাজদুহিতা উলূপীর জন্য মনটা বড় আকুল হয়ে ওঠে। উলূপীকে মনে হয় যেন কাব্যে উপেক্ষিতা। দ্রৌপদী পঞ্চপান্ডবের সর্বক্ষণের সঙ্গিনী হয়েছিলেন, সুভদ্রার (একটু পরেই তাঁর কথা বলা হবে) পৌত্র পরীক্ষিৎ যুধিষ্ঠিরের পর পাণ্ডব-কৌরব বংশের রাজা হয়েছিলেন এবং তিনি পাণ্ডবদের মহাপ্রস্থানের পরও রাজ-অন্তঃপুরে থেকে গিয়েছিলেন। চিত্রাঙ্গদার সঙ্গেও অর্জুন তিন বছর বাস করেছিলেন এবং তাঁরই ঔরসে চিত্রাঙ্গদা বীরপুত্র মণিপুরবাজ বভ্রুবাহনের জননী হয়েছিলেন। কিন্তু উলূপী? তিনি অনেক অনুনয় বিনয় করে অর্জুনকে মাত্র এক রাত্রি পেয়েছিলেন, কিন্তু তারপর সারা জীবন তিনি পতিব্রতা স্ত্রীর কর্তব্যপালন করেছিলেন। স্বামীসঙ্গের রাত্রির পরদিন প্রভাতেই তিনি অর্জুনকে নিরাপদে তীরে পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং বর দিয়েছিলেন যে কোনও জলচর জীবের থেকে অর্জুনের কোনও ভয় থাকবে না। এই বরের জন্যই তিনি কুম্ভীররূপিণী বর্গা ও তার সহচরীদের হাত থেকে বেঁচেছিলেন। তারপর ভীষ্মকে অন্যায়ভাবে বধ করার জন্য বসুগণ যখন তাঁকে শাপ দিতে উদ্যত হয়েছিলেন, তখন উলূপীই ছুটে এসে ওই শাপের কথা পিতাকে জানান এবং নাগরাজ বসুগণকে অনুরোধ করে অর্জনের শাপমুক্তির একটা ব্যবস্থা করে দেন। আবার এই উলূপীই চিত্রাঙ্গদাতনয় বভ্রুবাহনকে উত্তেজিত করে পিতার সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করেছিলেন। যেটা শেষ বিচারে অর্জুনকে নরকবাস থেকে মুক্তি দিয়ে তাঁর ইষ্টসাধনই করেছিল। এই এতকিছুর বিনিময়ে অর্জন উলূপীর উপর শুধু প্রসন্ন হয়েছিলেন এবং স্বীকার করেছিলেন যে উলূপী তাঁর মহোপকার করেছেন। অর্জুনের অন্য পত্নীগণ সন্তান পেয়েছিলেন কিন্তু উলূপীর সে সৌভাগ্য হয়নি। বিবাহের পর থেকে উলূপী শুধু পতিব্রতা স্ত্রীর কর্তব্যই পালন করে গেলেন, কিন্তু প্রতিদানে তিনি কিছুই গেলেন না। অবশ্য যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় বভ্রুবাহন ও চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে হস্তিনাপুরের প্রাসাদে আগমন থেকে দ্রৌপদী সহ পঞ্চপাণ্ডবের মহাপ্রস্থানের সময় পর্যন্ত উলূপী হয়তো কিছুটা স্বামীসঙ্গ পেয়েছিলেন। পঞ্চপাণ্ডবের মহাপ্রস্থানের পর উলূপী গঙ্গায় প্রবেশ করেছিলেন এবং চিত্রাঙ্গদা মণিপুরে ফিরে গিয়েছিলেন।
(ক্রমশ)