বিবিধ

বটুক নন্দীঃ ভারতের গিটার কিংবদন্তী




সুদীর্ঘ ব্রিটিশরাজের পর স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের সংগীতজগৎ দেশীয় গুণী শিল্পীদের হাত ধরে ধীরে ধীরে বিকাশলাভ করছে। সেইসময় মূলত দেশাত্মবোধক গানেরই প্রাধান্য ছিল বেশি। পরে এই বাংলায় কবিগুরুর গানের মধ্যে দিয়ে বাঙালি তার নিজস্বতা নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে এমনকি বিদেশেও এক বিশেষ স্থান করে নেয়। ধ্রুপদী গান যাঁরা গাইতেন তাঁদের স্থান ছিল আরও উঁচুতে। তখন জনসাধারণের মধ্যে বিশিষ্ট গুণী সংগীতশিল্পীদের খুবই কদর ছিল। কিন্তু যন্ত্রসংগীত শিল্পীদের খুব একটা কদর ছিল না। স্বভাবতই তখনকার দিনে গিটার যাঁরা বাজাতেন তাঁরাও বেশি সম্মান পেতেন না। গিটার কলকাতাতে প্রথম প্রচলন করেছিলেন দুজন মানুষ একজন হচ্ছেন কিরীটি রায়, যিনি শ্যামবাজারে 'দর্পনা' সিনেমা হলের পাশে 'বঙ্গীয় কলালয়' বলে একটি স্কুলে গিটার শেখাতেন ১৯৪৮ সালে। আরেকজন হলেন সুজিত নাথ (তিনিও উত্তর কলকাতার বাসিন্দা)। পরবর্তী সময়ে যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ক্লাসিক্যাল গিটার বাজাতে আরম্ভ করলেন তখন এক জায়গায় তাঁর বাজনা শুনে বড়ে গুলাম আলী খাঁ তারিফ করে বললেন, "আপনে বহুত আচ্ছা বাজায়া..."। সেই থেকেই কলকাতায় মানুষের মধ্যে গিটার শেখার প্রবল আগ্রহ দেখা দিল। সেই সময়ে কলকাতায় ঘরে ঘরে সংগীতশিক্ষার ক্লাস হতো। একসময় সেই জায়গাটা দখল করলো যন্ত্রসংগীত। অনেকেই হারমোনিয়াম, তবলার পাশাপাশি শিখতে লাগলেন গিটার, মাউথ অর্গান, বাঁশি, বেহালা ইত্যাদি। বটুক নন্দীর সমবয়সী যাঁরা সেই সময় বাজাতেন তাঁরা হলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, রজত নন্দী, কাজী অনিরুদ্ধ প্রমুখ। পরে গিটারের এই পরম্পরা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে জনমানসে আরও জনপ্রিয় করেছিলেন বটুক নন্দী। কলকাতায় তখন ঘরে ঘরে ছোট বড় সকলের মধ্যে গিটার শেখার ধুম পড়ে গিয়েছিল।

বটুক নন্দী ১৯২৮ সালের ১লা জানুয়ারি, কলকাতায় ওয়েলিংটন স্কোয়্যারের কাছে তাঁর পৈতৃক বাড়ি 'দেবেন্দ্র ভবন'-এ জন্মগ্রহণ করেন। বটুকের পিতামহ ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ নন্দী যিনি ১৮৪৫ সালে কর্মসূত্রে বর্ধমান থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। পরবর্তীকালে ব্যবসাসূত্রে এখানেই তিনি পরিবারসমেত থিতু হন। বটুকের পিতা প্রসাদ দাস নন্দী।

ক্রমে তাঁরা চার ভাই ও এক বোন, দুর্গার সাথে জীবন ভাগ করে নিয়ে একটি যৌথ পারিবারিক বাতাবরণে বেড়ে ওঠেন। কিন্তু আকস্মিক বজ্রপাতের মতো তাঁর আদরের বোন দুর্গা মাত্র ২৫ বছর বয়সে মারা যান।

ছোট থেকেই তাঁর সঙ্গীত, কবিতা, অভিনয়ে অনেক বেশি আগ্রহ ছিল। বিশেষত বটুকের মায়ের সংগীতপ্রীতির কারণেই বটুক সঙ্গীতচর্চা করতেন।

অভিনয়েও তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। বটুক যখন কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন, তখন থেকেই তিনি মঞ্চে অভিনয় করেন এবং অহীন্দ্র চৌধুরী, মলিনা দেবী, নীতীশ মুখার্জি, বিপিন গুপ্ত, কমল মিত্র প্রমুখ দিকপাল এবং কিংবদন্তী অভিনেতাদের সাথে মঞ্চাভিনয়ে স্থান করে নেন।

ব্রিটিশ ভারতে মোহনবাগান ক্লাবের ফুটবল আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে একসময় তিনি ফুটবল খেলার প্রতি আকৃষ্ট হন। যৌবনে তিনি মহঃ ইসমাইলের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়ে মোহনবাগান ক্লাবের হয়ে প্রথম ডিভিশন ফুটবল খেলতেন। ওদিকে বটুকের পিতা তাঁর ছেলেকে নিয়ে বেশ হতাশ ছিলেন। পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা করার পরিবর্তে বটুক শুধুই ফুটবল খেলুক এটা তিনি চাইতেন না।

একসময় বটুক গুরুতর একটি দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন। সেযাত্রায় ভাগ্য তাঁর সহায় ছিল। কিংবদন্তি চিকিৎসক ও পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায় অসুস্থ বটুকের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। কিন্তু তিনি বটুকের শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে দুর্ভাগ্যবশত কলকাতা ময়দানে মোহনবাগানের ফুটবলার হিসাবে বটুকের খেলোয়াড় জীবনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। ডক্টর রায়-ই বটুকের অসুস্থতার সময় তাঁকে সঙ্গীত, বিশেষ করে স্টিল গিটারকে শখ হিসাবে গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, যা অবশেষে একদিন বটুক নামের এক তরুণ ফুটবলারকে কিংবদন্তী গিটারবাদক বটুক নন্দী হিসাবে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দেয়।

তাঁর মিউজিক কেরিয়ারে বটুক নন্দী ৬০টিরও বেশি অ্যালবাম সহ লং প্লেয়িং রেকর্ডস, মিউজিক ক্যাসেট এবং সিডি প্রকাশ করেন। ৭৮ আরপিএম-ও রয়েছে তাঁর কৃতিত্বে। গিটার বাজানোর পাশাপাশি ৬০ থেকে ৮০-র দশকে তিনি অনেক বাংলা ছায়াছবিতে নেপথ্যসংগীত বা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও দিয়েছেন।

১৯৫৮ সালের ৮ মে বটুক তাঁর শৈশবের বান্ধবী নীলার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের একমাত্র পুত্র নীলাঞ্জন ১৯৬৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে নীলাঞ্জন নন্দী একজন প্রথম সারির সংগীতশিল্পী।

বটুক নন্দী নিজের জন্য একটি 'custom built' গিটার তৈরি করিয়েছিলেন যার পিক-আপগুলি তিনি নিজেই আমেরিকা থেকে এনেছিলেন। গিটারটি ছিল পাইন কাঠ নির্মিত যা তিনি সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে কুয়ালালামপুর থেকে আনিয়েছিলেন। এই গিটারটির সুর ছিল অনন্য, যেটি তিনি এবং তাঁর গিটার নির্মাতা বন্ধু তন্ময় (প্রয়াত হয়েছেন) মিলে তৈরি করতে এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল।

স্টিল ল্যাপ গিটার বাজানোর ক্ষেত্রে বটুক নন্দী তাঁর নিজস্ব শৈলী গড়ে তুলেছিলেন। অচিরেই গিটারে রবীন্দ্রসংগীত বাজানোর ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন এবং যন্ত্রসংগীত পরিবেশনের মানকে এক অনন্য উচ্চতায় উন্নীত করেছিলেন।

প্রাথমিকভাবে বটুক নন্দী ডঃ পি. চক্রবর্তী এবং সুজিত নাথের অধীনে কিছু সময়ের জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তিনি কিংবদন্তী সংগীতশিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের কাছ থেকেও রবীন্দ্রসংগীতের তালিম নিয়েছিলেন।

সমসাময়িক ও সমমনস্ক কয়েকজনকে নিয়ে বটুক নন্দী ৬০-এর দশকে 'SABS' নামে একটি মিউজিক গ্রুপ গঠন করেছিলেন এবং শীঘ্রই এটি শহরের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ড হয়ে ওঠে। এস.এ.বি.এস.-এর চারটি অক্ষর ছিল সুজিত নাথের জন্য S, A-এর জন্য অনিরুদ্ধ কাজী (বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছেলে), B বটুক নন্দীর জন্য আর আবার শিবনাথ নন্দীর জন্য S।

স্যাক্সোফোনে মনোহরি সিং এবং চেলোতে বাসু চক্রবর্তীর মতো জাতীয়স্তরে প্রশংসিত সঙ্গীতশিল্পীরা (পরবর্তীকালে দুজনেই আর. ডি. বর্মনের সঙ্গীতায়োজনকারী হয়েছিলেন) এস.এ.বি.এস.-এর সাথে যুক্ত ছিলেন। পরে মনোহরি সিং এবং বাসু চক্রবর্তী উভয়েই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে মিউজিকের কাজের সূত্রে বম্বে (বর্তমানে মুম্বাই) চলে যান।

যাইহোক, মনোহরি সিং বটুক নন্দীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় তারা একে অপরের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন এবং বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে বটুক নন্দী তাঁর বন্ধুর সাথে গান-রেকর্ডিং সেশনে যোগ দিতে বম্বের ফিল্ম সেন্টার, রেডিও জেমস এবং ফিল্মিস্তান স্টুডিওতে গিয়েছিলেন।

বটুক নন্দীর অনেক ছাত্র-ছাত্রী পরবর্তীকালে পেশাদার সঙ্গীত ব্যবস্থাপক এবং গিটারিস্ট হয়ে ওঠেন। যাঁরা ৭০ এবং ৮০-র দশকে বাংলা সঙ্গীত জগতে অসাধারণ সব কাজের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

১৯৬৮ থেকে ১৯৯৫ এই দীর্ঘ সময়কালে সারা ভারতে বটুক নন্দী সম্ভবত স্টিল ল্যাপ গিটার বাজানোর ক্ষেত্রে একমাত্র নাম ছিল যা এক্সপ্রেশন, টোন, মডিউলেশন এবং বাম হাতের নড়াচড়ার ক্ষেত্রে মানুষের কণ্ঠের সবচেয়ে কাছাকাছি ছিল!

তিনি পাম হারমোনিক্স, ডায়াগোনালস এবং জটিল স্লাইড কৌশলগুলির সাথে বিদেশি 'staff notation' স্বরলিপি অনুসরণ করে হাওয়াইয়ান মেলোডিতে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ওয়েস্টার্ন স্টাইল প্লেয়িংয়ে গার্নি নাইস (Garni Nice)-এর অধীনে প্রশিক্ষণ নেন। দীর্ঘদিন তিনি আকাশবাণী (All India Radio)-তে বিচারকের পদ অলংকৃত করেছিলেন।

৭০-এর দশকের মাঝামাঝি এবং তারপর ৮০-র দশকে তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ ইয়র্ক সিটি এবং কানাডা সহ সমগ্র ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে পারফর্ম করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৮৫-৮৬ সালে বাংলাদেশের চট্টগ্রামেও অনুষ্ঠান করেছিলেন। বাংলাদেশেও তাঁর যন্ত্রসংগীতের অনুষ্ঠান খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

পরবর্তীকালে বটুক নন্দী তাঁর ছেলে নীলাঞ্জনকে সঙ্গীত জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি নীলাঞ্জনকে তাঁর বেশিরভাগ অনুষ্ঠানেই সাথে নিয়ে যেতেন, যা নীলাঞ্জনকে খুবই প্রভাবিত করেছিল এবং সেও অনেক পারিবারিক বাক-বিতন্ডা সত্ত্বেও পিতার পথ অনুসরণ করে সঙ্গীতকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিল।

পিতার বেশিরভাগ অনুষ্ঠানের লাইভ রেকর্ডিং তাঁর ছেলে নীলাঞ্জন আর্কাইভ করেছেন।

বটুক নীলাঞ্জনকে ওস্তাদ সগিরুদ্দিন আলি খান সাহেব, পণ্ডিত সুকুমার মিত্র, পণ্ডিত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য (সরোদ), টনি মেনেজেস (পিয়ানো), সৌমেন্দ্র দেব (পিয়ানো), কার্লটন কিট্টো এবং আর্থার গ্রাসিয়াস (গিটার) এবং সবশেষে গুলাম আলীর (গজল) কাছে নিয়ে যান। রামকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর (পুরাতনি ও শ্যামাসঙ্গীত) কাছে শ্যামাসঙ্গীত শেখান। বটুক নন্দী ছিলেন একজন পূর্ণমানব তাই তিনি সর্বদা পরিপূর্ণতার সন্ধান করতেন।

তিনি তাঁর দীর্ঘ সঙ্গীত-জীবনে কিশোর কুমার, মুকেশ, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বাপ্পি লাহিড়ী এবং আরও অনেক কিংবদন্তীর গায়কদের সাথে সরাসরি অনুষ্ঠানের মঞ্চ ভাগ করেছেন। এছাড়াও তিনি অভিনেতা উত্তমকুমার, বিশ্বজিৎ, দিলীপ কুমার, সায়রা বানু, ভ্যান শিপলে প্রমুখের লাইভ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী তাঁর ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৭,০০০টিরও বেশি শো হয়েছে।

তাঁর ৬৫টিরও বেশি বড় অ্যালবাম রিলিজ হয়েছে 33 rpm Long Play (LP) Records, 45 rpm EP (Extended Play) Records, 78 rpm Standard Play (SP) Records, Vinyl LP নিয়ে গঠিত রেকর্ডে। পরবর্তী সময়ে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ক্যাসেট এবং সিডি আকারেও তাঁর যন্ত্রসংগীতের অ্যালবাম বের হয়েছে।

২০০১ সালের ১২ই জানুয়ারি ছন্দপতন ঘটে। বটুক নন্দী সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, যা তাঁকে পরবর্তী নয় মাস বা তারও বেশি সময় ধরে সম্পূর্ণভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত (paralysis) করে রেখেছিল। উনি অচেতনাবস্থায় (coma) ছিলেন প্রায় তিন মাস।

তাঁর স্ত্রী নীলা ১০ সেপ্টেম্বর ২০০১-এ আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হওয়ার ঠিক পরবর্তী ১৪তম দিনে ২৩শে সেপ্টেম্বর ২০০১-এ বটুক নন্দী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ওঁনার দাহকার্য্য বাগবাজারের কাশী মিত্র ঘাট-এ সম্পন্ন হয়। বিদায়কালে ওঁনার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। ভারতবর্ষ তথা গোটা বিশ্ব মাতিয়ে রাখা গিটারের ঝংকার থেমে যায়। সংগীত ও যন্ত্রসংগীত জগতের বহু খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব তাঁর প্রয়াণ সংবাদ পেয়ে শোকবার্তা পাঠান।

বটুক নন্দী আজও বেঁচে আছেন তাঁর উত্তরসূরীদের মধ্যে। আসুন আজকে আমরা স্মরণ করি বাংলা তথা ভারতের যন্ত্রসংগীতের এই শ্রুতকীর্তি কিংবদন্তীকে।

বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ নীলাঞ্জন নন্দী