৬ই জানুয়ারি ১৯৫০ সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে বসে বেতারে ঘোষণা শুনলামঃ "বিশ্ববিখ্যাত যাদুকর পি. সি. সরকার আজ সকালবেলা জাপানে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেছেন।"
যে টেবিলের ওপর বেতার-যন্ত্রটি মর্মান্তিক দুঃসংবাদ ঘোষণা করল, সেই টেবিলের ধারে বসে কতবার সেফটিপিন, ছুরি, রুমাল, তাস, টাকা, ফিতা ইত্যাদি ছোটোখাটো জিনিস দিয়ে অবিশ্বাস্য অদ্ভুত ম্যাজিক দেখিয়ে আমাদের তাক লাগিয়ে গেছেন যাদু-জগতের সম্রাট পি. সি. সরকার। সেই টেবিলটি তাঁর স্মৃতি বহন করে আজও বর্তমান, কিন্তু তিনি আর নেই, তাঁর সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা হবে না!
পরদিনই সন্ধ্যায় কলকাতা আকাশবাণীর আহ্বানে বেতারে বন্ধুবর পি. সি. সরকারের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে বললামঃ "গত বছর 'রবিবাসর'-এর একটি বিশেষ অধিবেশনে আমরা যাদুসম্রাট পি. সি. সরকারকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেছিলাম। সেদিন তাঁর মুখ থেকেই শুনলাম রক্তে চাপ আর চিনির আধিক্যের দরুন তাঁর শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। একবার ম্যাজিক দেখাবার সময় স্টেজেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমি চিন্তিত হয়ে বললাম, "আপনি যাদু-জগতের সম্রাট তো হয়েইছেন, অর্থ, খ্যাতি, জনপ্রিয়তাও প্রচুর লাভ করেছেন। এখন এই পরিণত বয়সে অসুস্থ দেহে যাদু প্রদর্শনের পরিশ্রমে নিজের জীবনকে আর বিপন্ন করবেন না আমাদের কাছে যা অমূল্য। আপনার পুত্র প্রদীপ তো তৈরী হয়েই গেছে। এখন তাকেই পাদপ্রদীপের সামনে রেখে আপনি তাকে পিছন থেকে মদত দিন, আপনি নিজে মঞ্চের বাইরে থেকেই যাদুর সেবা করুন।" তিনি বললেন, "না। যাদু প্রদর্শন থেকে অবসর নেবার কথা আমি ভাবতেই পারি না। জীবনের শেষ পর্যন্ত যাদু প্রদর্শন করে যাব। একদিন হয়তো শুনবেন যাদু দেখাতে দেখাতেই আপনাদের পি. সি. সরকার পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে গেছে।" তাঁর সেই ভবিষ্যদ্বাণীই মর্মান্তিকভাবে সত্য হল। জাপানে যাদু দেখাতে গিয়ে সেখান থেকেই চিরবিদায় নিলেন যাদুসম্রাট পি. সি. সরকার।"
পি. সি. সরকার বড় ম্যাজিশিয়ান ছিলেন, শুধু এইটুকু বললে যথেষ্ট হয় না; তাঁর প্রতিভা ছিল বহুমুখী, ম্যাজিক যার একটি অংশমাত্র। সাহিত্য রচনাতেও তিনি তাঁর প্রতিভার যে স্বাক্ষর রেখে গেছেন তাঁর লেখা কয়েকটি বইতে, এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর অসংখ্য রচনায়, তা থেকে বোঝা যায় যাদুতে একান্তভাবে মনোনিবেশ না করে সাহিত্য সাধনায় একাগ্র হলে তিনি সাহিত্য-জগতেও অসাধারণ হতে পারতেন। অর্থাৎ এক কথায় বলতে গেলে পি. সি. সরকার শুধু একজন আশ্চর্য 'ম্যাজিশিয়ান' মাত্র ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন আশ্চর্য 'মানুষ'।
১৯৬৪ সালে 'পদ্মশ্রী' সম্মানে সম্মানিত প্রতুল চন্দ্র সরকার।
যাদুসম্রাট প্রতুলচন্দ্রের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে সেইদিনই আকাশপথে কলকাতা থেকে জাপান রওনা হয়ে গিয়েছিল তাঁর দ্বিতীয় পুত্র, যাদুকর প্রদীপচন্দ্র, যার মঞ্চ-নাম 'পি. সি. সরকার (জুনিয়র)।' জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রফুল্লচন্দ্র চলে গিয়েছিল আমেরিকা থেকে। ৯ই জানুয়ারি রাত্রে একটি বিশেষ প্লেনে লোকান্তরিত যাদুসম্রাটের নশ্বর দেহ নিয়ে দমদম বিমানবন্দরে এসে পৌছাল শোকবিহ্বল প্রফুল্লচন্দ্র। যাদুসম্রাটের যাদুকর পুত্র প্রদীপচন্দ্র জাপানে রয়ে গেল কঠোর কর্তব্যের আহ্বানে, পিতার অসমাপ্ত কাজ তাকে সমাপ্ত করে আসতে হবে। চুক্তির মাত্র সাতটি প্রদর্শনীর পরই মহাপ্রয়াণ করলেন যাদুসম্রাট, চুক্তির বাকি প্রদর্শনীগুলি পরিচালনা করতে হবে তাঁর 'ইন্দ্রজাল'-এর উত্তরাধিকারী প্রদীপচন্দ্রকে।
কঠোর বাস্তবের কাছ থেকে মুক্তি দেয় রূপকথা, ম্যাজিক এবং কল্প-সাহিত্য। সেই কল্পনা, রূপকথা এবং ম্যাজিকও যখন মানুষের হারিয়ে যায়, তখনই মানুষ বোধহয় সত্যিকারের সর্বহারা হয়ে যায়। সমস্ত বিশ্বের জাদু-প্রেমীদের সঙ্গে কলকাতার মানুষ ভেঙে পড়েছেন, তাদের গর্ব, তাদের কল্পনার নায়ককে হারিয়ে। বুকভাঙা হাহাকার নিয়ে শবানুগমণে বেরিয়েছেন, দিশেহারা সব শ্রেণীর মানুষ।
বালিগঞ্জ স্টেশনের সন্নিকটে 'ইন্দ্রজাল ভবন' থেকে কেওড়াতলা শ্মশান অভিমুখে শবযাত্রা শুরু হল সকাল সওয়া নটায়, রবিবার ১০ই জানুয়ারি, ১৯৫০। যাদুসম্রাট সরকারের মরদেহ বহন করে নিয়ে যাবার জন্য গাড়ি পাঠিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সেই গাড়িতে বহু পুষ্পে এবং মাল্যে সুশোভিত হয়ে শবাধার ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল, আমরা পদব্রজে তার অনুসরণ করলাম। পথে আর পথের দু'ধারে বাড়ির জানালায়, ছাদে, বারান্দায় বহু নরনারী। সবাই বিষন্ন - চিরদিনের জন্য আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন আমাদের প্রিয় সদাহাস্যময় যাদুসম্রাট!
বন্ধুর উদ্দেশে আরেকবার শ্রদ্ধা জানিয়ে শোকার্ত হৃদয়ে বাড়ি ফিরলাম। বন্ধুর আত্মা চলে গেছে অমৃতলোকে, জীর্ণ বসনের মতো নশ্বর দেহটিকে বর্জন করে। আমার স্মৃতিতে চিরন্তন হয়ে থাক তাঁর হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবিটি, যার সঙ্গে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষ পরিচিত।
সরকার এই শেষবার জাপান যাত্রার আগে জাপানে তাঁর দশম অভিযানে গিয়েছিলেন ১৯৫০ সালের শেষ দিকে। সেখানকার রাজধানী টোকিও শহর থেকে তিনি ১০ই অক্টোবর, ১৯৫০ তারিখে আমাকে লিখেছিলেনঃ
"প্রিয় অ. কৃ. ব.,
জাপান থেকে প্রীতি সম্ভাষণ জানাচ্ছি। এখানে চার মাসের সফরে এসেছি ১৮ জনের দল আর ৩০ (ত্রিশ) টন মাল নিয়ে। এই নিয়ে জাপানে আমার দশবার আসা হল। আপনার চিঠি পেয়েছি। আমার 'দেশে দেশে' বইখানা আপনার ভাল লেগেছে জেনে খুশী হয়েছি। হ্যাঁ, আপনি আমার জীবন কাহিনী লিখতে পারেন, যদি আপনি সত্যিই লিখতে চান। এটা বাস্তবিকই আমার মনের কথা।
আপনার বন্ধু
পি. সি. সরকার"
এর কয়েক বছর আগে সরকারের আমন্ত্রণে কলকাতায় নিউ এম্পায়ার থিয়েটারে তাঁর ইন্দ্রজাল প্রদর্শনী দেখে এসে আমার সমালোচনা সহ তাঁকে যে চিঠি লিখেছিলাম, তাব জবাবে তিনি পত্রপাঠ ৪.১০. ৫৯ তারিখে লিখেছিলেনঃ
"আমার প্রদর্শনী আরো ভালো করবার জন্য আপনি যে গঠনমূলক সমালোচনা পাঠিয়েছেন, সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমার ব্ল্যাক-আর্ট প্রদর্শন একটি কাহিনীকে কেন্দ্র করে কিভাবে একটি নাটকের রূপ দেওয়া যায়, এ বিষয়ে আপনার কার্যকরী পরামর্শ সাদরে গ্রহণ করব।
যাদুজগৎ নিয়ে আপনি একটি উপন্যাস লেখার কথা ভেবেছেন আমার নাম তার অন্তর্ভুক্ত করে, এতে আমি সম্মানিত বোধ করছি। নানা দেশে যাদুকর রূপে সফরের বিবরণ নিয়ে আমাকে একটি আত্মজীবনী লিখতে বলেছেন; আপনার পরামর্শটি খুব ভালো লাগছে, আমি তা করব ভেবেছি। কিন্তু আপনার সক্রিয় সহযোগিতা না পেলে আমার চেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হবে না। আপনি আমার জন্য যা কিছু করবেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞের চাইতেও বেশী হবো।"
ভারতীয় মহারাজার বেশে জাদুসম্রাট পি. সি. সরকার-এর সেই বিখ্যাত ছবি। ১৯৬০ সালে লেবানন-এর বেইরুট-এ ইউনেস্কো থিয়েটার (Unesco Theatre)-এ শো চলাকালীন তোলা ছবি। লন্ডনের 'ডেইলি মিরর' পত্রিকায় ১১ আগস্ট, ১৯৬০ সালে প্রকাশিত।
এরপর দেখা হতে সরকার বললেন, "আমি তো লেখক নই, তাছাড়া লেখার জন্য যে পরিশ্রম আর সময় দেওয়া দরকার, তা দেওয়া আমার পক্ষে এখন সম্ভব নয়। আপনি লেখক, এবং ম্যাজিক-পাগল। সুতরাং আপনার ভাষায় বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ 'যাদুকরের আত্মজীবনী' শুধু তাহলেই লেখা হতে পারে, যদি লেখার দায়িত্বটা আপনি নেন, আমি শুধু আপনাকে মুখে মুখে বলে গেলে আর আপনার দরকার মতো মাল মশলা দিলেই চলে।"
প্রথমেই উপক্রমণিকা অংশ লেখা শুরু করবার জন্য সরকারের সঙ্গে কয়েকটি বৈঠক দরকার - তিনি বলবেন, আমি শুনে মনে মনে (আর দরকার মতো কাগজে) নোট করে নেবো; আর আমার দরকার মতো প্রশ্ন করে তাঁর কাছ থেকে জবাব জেনে নেবো। সরকারের আমন্ত্রণে গেলাম বালিগঞ্জ স্টেশনের অনতি দূরে রেল লাইনের ধারে জামির লেনে তাঁর ইন্দ্রজাল ভবনে। লেনে ঢুকে কিছু দূর গিয়ে মুখোমুখি দুটি বাড়ি - বাঁ দিকের বাড়িটি প্রাইভেট বা পারিবারিক, আর ডান দিকের বাড়িটি পুরোপুরি ম্যাজিকের কাজে উৎসর্গ করা।
আগে শুধু সরকারের ম্যাজিক দেখেই মুগ্ধ হয়েছি, কিন্তু ইন্দ্রজাল-ভবন পরিদর্শন করে এই আশ্চর্য মানুষটির যে পরিচয় পেলাম, শুধু বাইরে ম্যাজিক দেখে তা পাওয়া যায় না। আসবাব, সাজসজ্জা সব-কিছুতে তাঁর শিল্পীমনের ছাপ; সব-কিছু সুবিন্যস্ত, গোছালো, পরিপাটি। ম্যাজিক লাইব্রেরিতে ম্যাজিকের বিভিন্ন শাখা সংক্রান্ত গ্রন্থ আর পত্র-পত্রিকা সুশৃঙ্খলভাবে রক্ষিত। দেখলাম পৃথিবীর নানা দেশ থেকে - যেখানেই ম্যাজিকের চর্চা আছে - ম্যাজিক বিষয়ক পত্রিকা সরকারের কাছে নিয়মিত আসে, আর আসে বিভিন্ন ম্যাজিক কোম্পানির ক্যাটালগ, বুলেটিন ইত্যাদি। সারা পৃথিবীতে ম্যাজিকের বিভিন্ন বিভাগে কোথায় কি অগ্রগতি হচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি সর্বদা ওয়াকিবহাল।
রেফারেন্স বিভাগে ফাইলের পর ফাইল এমনভাবে রাখা, যে পৃথিবীর যে-কোনো দেশের যে-কোনো যাদুকর সম্বন্ধে বা যাদু সংক্রান্ত যে-কোনো তথ্য জানতে চাইলে চট করে তা জানতে পারা যাবে। দেশ-বিদেশের যাদুকরদের ফোটোগ্রাফ আর যাদু সংক্রান্ত অসংখ্য ফোটোগ্রাফ রয়েছে এই বিভাগে।
দেখলাম বিদেশ থেকে একাধিক বিদেশী যাদুকর তাঁদের দেশেরই কোনো পুরোনো ব্যাপার সম্বন্ধে জানতে চেয়েছেন ভারতের পি. সি. সরকারের কাছে। ম্যাজিক সম্বন্ধে পৃথিবীর কোথায় কি হয়েছে, কোথায় কি হচ্ছে তার অতি-সাম্প্রতিক, আপ-টু-ডেট খবর পাওয়া যাবে পি. সি. সরকারের কাছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ম্যাজিক জগতের দিকপালদের চিঠির পর চিঠি দেখলাম পি. সি. সরকারকে লেখা - ব্ল্যাকস্টোন, ওকিটো, জন মুলহোল্যাণ্ড, মেলবোর্ন ক্রিস্টোফার, জ্যাক গুইন প্রভৃতি। চিঠিগুলো পড়লেই বোঝা যায় এঁরা কি প্রীতি, বিশ্বাস আর শ্রদ্ধার চোখে দেখেন আমাদের পি. সি. সরকারকে। পি. সি. সরকার তাঁদের একান্ত আপনজন। কোনো কোনো চিঠিতে তাঁরা ম্যাজিকের কোনো কোনো খেলা সম্বন্ধে পি. সি. সরকারের পরামর্শও চেয়ে পাঠিয়েছেন। দেখে মনটা খুশী হয়ে উঠল। একটু বিস্ময়ও বোধ হল। এই সব বিরাট গুণী সাদা আদমি একজন কালা আদমির এমন ভীষণ ভক্ত হয়ে উঠলেন কি করে?
বন্ধুবরকে প্রশ্ন করলাম তিনি এঁদের এত ভালবাসা কি করে পেলেন।
এটাও কি তাঁর ম্যাজিক? না হিপনোটিজম?
সরকার হেসে বললেন, "ভালবাসা পাবার আমি শুধু একটি উপায় মাত্র জানি।"
"কি সেটা?"
"ভালবাসা। আমি ওঁদের ভালবেসেছি, কারণ ওরা ম্যাজিককে ভালবাসেন। ভালবাসা পেতে হলে ভালবাসতে হয়।"
কথাটি সুন্দর লাগল। মনে পড়ে গেল এই ধরনেরই একটি ইংরাজী উক্তিঃ "টু বি ইন্টারেস্টিং, ইউ মাস্ট বি ইন্টারেস্টেড।"
"তাছাড়া" - সরকার বললেন, "ম্যাজিক এমন একটি জগৎ, যেখানে সাদা-কালোর তফাত মুছে যায়। আমেরিকা কখনো আমাদের ওপর প্রভুত্ব করেনি, কিন্তু ইংরেজরা এই সেইদিন পর্যন্ত তা করে গেছে। আমরা ভারতীয়রা ওদের দাস ছিলাম, ওরা আমাদের প্রভু ছিল, ইংরেজ জাত এখনো সেটা ভুলতে পারেনি। তাই আমি যে একজন কালা আদমি, সে বিষয়ে আমেরিকানদের চাইতে ইংরেজদের অনেক বেশী খেয়াল থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের রাজধানী লণ্ডন শহরে আমি যখন একটি মেয়েকে করাত দিয়ে দু'টুকরো করে আবার জোড়া লাগাবার খেলাটি দেখিয়েছিলাম, তখন ইংরেজ দর্শকরা আমার কম তারিফ করেনি। এবং একজন ইংরেজ যাদুকর লেখক তাঁর বইতে আমার খেলাটির উল্লেখ করেছেন বিশেষভাবেই।"
আলমারি থেকে একখানা বই (This is Magic) - খুলে আমার হাতে দিয়ে তিনি একটি পৃষ্ঠার নীচের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। লেখক উইল ডেক্সটার (Will Dexter) লিখেছেনঃ
"Sorcar, the Indian illusionist, performed it with such zest when he brought his show to London, that the audience really thought he had sawn the girl in half !"
অর্থাৎঃ "ভারতীয় যাদুকর সরকার যখন তাঁর যাদু প্রদর্শনী নিয়ে লন্ডনে এসেছিলেন, তখন তিনি এই খেলাটি এমন দাপটের সঙ্গে দেখিয়েছিলেন যে দর্শকেরা ভেবেছিল তিনি করাত দিয়ে মেয়েটিকে সত্যিই কেটে দু'টুকরো করে ফেলেছেন!"
লণ্ডনের যাদুকর সমিতি 'ম্যাজিক সার্কল্'-এর একটি বৈঠকে বিশিষ্ট যাদুকর সদস্যরা দুঃখ করছিলেন সিনেমা, টেলিভিশন ইত্যাদির প্রসারের ফলে এখন আর ম্যাজিক দেখিয়ে ভালো রোজগার করা সম্ভব নয়। তখন একজন সদস্য বললেন, "কিন্তু সরকারের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন। তিনি এখনও ম্যাজিক দেখিয়ে প্রচুর টাকা উপার্জন করছেন।"
সবাই একবাক্যে সায় দিয়ে এদিক দিয়ে সরকারের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করলেন।
এ কাহিনীটি আমাকে বলেছেন উক্ত সমিতির একজন ভারতীয় সদস্য, কলকাতার বিশিষ্ট অপেশাদার যাদুকর 'সূ ভন' (Soo Von), ব্যক্তিগত জীবনে যিনি এঞ্জিনিয়ার শ্রী সুচারু ভট্টাচার্য। [১]
"আমার পড়া যে ম্যাজিক বিষয়েই সীমাবদ্ধ, তা নয় কিন্তু।" বললেন পি. সি. সরকার। "সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত, ইতিহাস, বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব, রাজনীতি প্রভৃতি নানা বিষয়ে আমার আগ্রহ। কিন্তু তাদের নিজের জন্যে নয়, ম্যাজিকের জন্যে। ম্যাজিকের ব্যাপারে তাদের কাছ থেকে কিছু কিছু সাহায্য পাওয়া যাবে বলে। আমার ম্যাজিকে যা প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে কোনোরকম সাহায্য করবে না, এমন বিষয়ে আমি উৎসাহী নই।"
অর্থাৎ ইংরেজীতে যেমন একটা কথা আছে 'অল রোডস্ লীড টু রোম' (সব রাস্তাই রোমে পৌঁছে দেয়), তেমনি পি. সি. সরকারের ক্ষেত্রে 'অল সাবজেক্ট্স্ লীড টু ম্যাজিক' (সব বিষয়ই পৌঁছে দেয় ম্যাজিকে)।
সেদিন কিন্তু সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসে বেশী দূর অগ্রসর হওয়া গেল না। ফোনের পর ফোন, আগন্তুকের পর আগন্তুক।
জরুরী না হলেও কাউকে তিনি বাতিল করতে পারেন না। সবাইকে খুশী করতে হবে, সবাইকে কিছু কিছু করে সময় দিতে হবে। অথচ বাড়িতে থেকেও 'বাড়িতে নেই' বলে কাউকে ধাপ্পা দিতে চান না, হলেনই বা ম্যাজিশিয়ান।
তাই ঠিক হল এর পর তিনিই আমার বাড়িতে (টালিগঞ্জে) এসে পড়বেন, যাতে বিনা বাধায় বেশ কিছুক্ষণ আমাদের দুজনের কথোপকথন চলতে পারে। বললাম সকাল সকাল আসবেন, যাতে দশটার ভেতর বাড়ি ফিরতে পারেন।
"কত সকালে আপনি আমার জন্য তৈরী হয়ে থাকতে পারবেন?" প্রশ্ন করলেন তিনি।
"আপনি কত সকালে এসে পৌঁছতে পারবেন?"
"ছ'টা।”
তখন ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি তাঁর মতো এত বড়, এত বিখ্যাত মানুষ অত সকালে তৈরী হয়ে এসে পৌঁছবেন। মনে মনে হেসে বললাম "বেশ। আমি তৈরী থাকব।"
নির্দিষ্ট তারিখে সকালবেলা পাঁচটা বেজে আটান্ন মিনিটে আমাদের বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় এসে একটি গাড়ি দাঁড়াল। হাসিমুখে গাড়ি থেকে নামলেন পি, সি. সরকার! তারপর দোতলায় উঠে আমার ঘরে ঢুকলেন ঠিক সকাল ছ'টায়; এমনি চমৎকার সময়নিষ্ঠা ছিল তাঁর। কথার আর সময়ের মূল্য বুঝতেন তিনি। সেই কারণেই অত বড় হয়েছিলেন। বড় গুণ না থাকলে অমনি অমনি বড় হওয়া যায় না। এরপর একাধিক দিন তাঁকে আমার গৃহে পাবার সৌভাগ্য হয়েছে। তিনি প্রতিবারই এসে পৌঁছেছেন আমার ঘরে ঠিক নির্দিষ্ট সময়ের আগেও নয়, পরেও নয়।
* * * * * *
'আমেরিকার টেলিভিশনে 'পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যাদুকরদের বিশেষ প্রদর্শনী'তে চক্রকরাত দিয়ে একটি মেয়েকে কেটে আবার জোড়া লাগানোর খেলা দেখিয়ে সরকার আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত শিহরণ জাগিয়েছিলেন। আমেরিকার বিখ্যাত যাদুপত্রিকা 'জেনিয়াই' (GENII)-এর সম্পাদক তাঁর বিবরণীতে জানুয়ারি, ১৯৫০ সংখ্যায় লিখেছিলেনঃ
"We were treated to one of the rare appearances on U. S. television of 'the World's Greatest Illusionist, Sorcar'... Gasps from live audience were heard coast-to-coast... Sorcar is truly one of the all time great illusionists."
চক্রকরাত দিয়ে মনুষ্যদেহ কেটে দ্বিখণ্ডিত করে পুনরায় জোড়া লাগানোর খেলা দেখানোর প্রাক-মুহূর্তে মঞ্চে সম্মোহনরত পি. সি. সরকার। সামনে সম্মোহীত অবস্থায় সহকারীরূপে দাঁড়িয়ে আছেন সহধর্মিণী বাসন্তী সরকার।
অর্থাৎ “পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যাদুকর সরকারের এক দুর্লভ আবির্ভাব আমরা দেখেছিলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেলিভিশনে।... (আমেরিকার) এক উপকূল থেকে অন্য উপকূল পর্যন্ত শোনা গিয়েছিল জীবন্ত দর্শকদের বিস্ময়ের দীর্ঘশ্বাস।... সরকার বাস্তবিকই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ যাদুকরদের একজন।"
যেমন স্টেজের বড় বড় খেলায়, তেমনি ঘরোয়া ছোট খেলাতেও সরকার ছিলেন সিদ্ধহস্ত। যাদুকরদের মধ্যে দেখা যায় এই সব বড় বড় খেলায় (ইংরাজিতে যার নাম 'ইলিউশন') যাঁরা ওস্তাদ, তাঁরা হস্তকৌশল-প্রধান ছোট ছোট খেলা ভাল দেখাতে পারেন না। পি. সি. সরকার কিন্তু ছিলেন দুই রকম খেলাতেই ওস্তাদ, কারণ তিনি খুব ছোট থেকে শুরু করে অনেক সাধনা, অনেক অসুবিধা, অনেক বিভিন্ন স্তরের মধ্যে দিয়ে ক্রমে ক্রমে বড় হয়ে চৌকস হয়ে উঠেছিলেন।
স্টেজে পি. সি. সরকার ম্যাজিক (অথবা 'ইন্দ্রজাল', তাঁর প্রদর্শনীকে তিনি যে ভারতীয় নাম দিয়েছিলেন) দেখাতেন উষ্ণীষধারী মহারাজার বেশে। সে ছিল এক জগৎ। কিন্তু আমাদের ঘরে বসে অত্যন্ত সহজ ঘরোয়াভাবে - জমকালো মহারাজার বেশে নয়, সাধারণ বাঙালীর মতো ধুতি পাঞ্জাবি পরে - ছোট ছোট জিনিস নিয়ে ছোট ছোট খেলা দেখিয়ে তিনি যখন বড় বিস্ময়ের সৃষ্টি করতেন, তখন সে ছিল এক আলাদা জগৎ, এবং তিনি তখন এক আলাদা পি. সি. সরকার।
১৮ই অক্টোবর, ১৯৫৯ তারিখটি বিশেষভাবে আমার মনে গেঁথে আছে। সেদিন এসেই তিনি আমার কন্যা রূপলেখাকে তাঁর 'ইন্দ্রজাল' (ম্যাজিকের বই) একখণ্ড উপহার দিলেন। রূপলেখার তখন এগারো বছর বয়স, সে ইংরাজী মাধ্যমের স্কুলের ছাত্রী। সরকার তাকে বললেন, "খুব ভাল করে ইংরাজী শেখো। কিন্তু সর্বদা মনে রেখো সবার ওপরে মাতৃভাষা, আর মাতৃভূমি।"
তারপরই কৌতুকের সুরে বললেন, "অবশ্য আমাকে ডাকতে তোমার ইংরাজীতেই সুবিধা। কাকা বলবে, না মামা বলবে, ভেবে পাচ্ছ না। 'আংকল্' বলো, দুই-ই বোঝাবে।"
রূপলেখা বিশ্ববিখ্যাত যাদুকরের স্বাক্ষরিত উপহার পেয়ে মহা খুশী। "কিন্তু আমি তো ম্যাজিশিয়ান হবো না।" বলল সে।
সরকার বললেন, “তবু এ বই পড়লে তোমার উপকার হবে। ম্যাজিকের মতো এমন বুদ্ধি বাড়ানো হবি আর নেই।"
সেদিন রূপলেখাকে তিনি একটি আশ্চর্য উপদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন; সেটি তাঁর নিজের জীবনে অর্জিত অসামান্য সাফল্যের মূলমন্ত্র। তিনি বলেছিলেনঃ "তোমরা তোমাদের ইংরাজী বইতে উপদেশ পড়েছ - Aim high - উচ্চ লক্ষ্য রাখ। কিন্তু আমি বলছি তা যথেষ্ট নয়। Aim highest - লক্ষ্য রাখবে একেবারে চূড়ায় উঠবার।”
যে কয়েকটি দিন সরকার এসে আমার গৃহ ধন্য করেছিলেন, সেই কয়েক দিনের একান্ত বৈঠকে সাধারণভাবে ম্যাজিক সম্বন্ধে এবং বিশেষভাবে তাঁর নিজের যাদুজীবন সম্বন্ধে অনেক কথা আর অনেক কাহিনী শুনেছি, সে সবের মূল্য আমার কাছে অসীম।
কিন্তু নানা বিভিন্ন কারণে তারপর বন্ধুবর যাদুসম্রাটের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ রচনার পরিকল্পনা কার্যতঃ অগ্রসর হতে পারল না। সুতরাং সেটা ভবিষ্যতের জন্য মুলতুবী রেখে প্রকাশকের এবং আমার যুক্ত আগ্রহে যাদুবিদ্যার ইতিহাস, যাদু সম্পর্কিত বিবিধ আলোচনা আর দেশ-বিদেশের যাদুকরদের বিচিত্র জীবনকাহিনী নিয়ে 'যাদু-কাহিনী' বইটি লিখে দিয়েছিলাম। তাতে আমাদের দেশে যাদুচর্চার বর্তমান যুগকে 'সরকার যুগ' নামে অভিহিত করেছিলাম, এবং বইটির উপসংহারে ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলাম ভারত সরকার সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য প্রভৃতিকে যেমন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত করেছেন, যাদুবিদ্যাকেও যেন তেমনি মর্যাদা দেন। আনন্দের বিষয়, তারপর ১৯৬৪ সালে ভারত সরকার যাদুকে সম্মান দিয়েছিলেন, ভারতের শ্রেষ্ঠ যাদুকর পি. সি. সরকারকে 'পদ্মশ্রী' উপাধি দিয়ে। এবং সেই বছরই দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় আমার 'যাদু-কাহিনী' গ্রন্থটিকে 'নরসিং দাস পুরস্কার' (এক হাজার টাকা) দিয়ে যাদু-সাহিত্যকে মর্যাদা দিয়েছিলেন। যাদু-সাহিত্য প্রসঙ্গে বলি, সারা পৃথিবীর যাদু-সাহিত্যে (অর্থাৎ যাদু সম্পর্কিত বা যাদুকরদের রচিত সাহিত্যে) যাদুকর পি. সি. সরকারের 'দেশে দেশে' বইটির তুলনা নেই। এতে 'ইন্দ্রজাল' প্রদর্শনী নিয়ে আফ্রিকা, মিশর, ইরান, ফ্রানস, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান, বর্মা আর স্কটল্যান্ড ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অনবদ্যভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি। যাদুকরের চোখ আমাদের সাধারণ চোখের চাইতে কত বেশী অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন, আর সেইসঙ্গে সাহিত্য-সৃষ্টির প্রতিভা থাকলে সেই মণি-কাঞ্চন যোগের ফল কি অপরূপ হতে পারে, তার সার্থক উদাহরণ এই আশ্চর্য গ্রন্থটি। আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এর ভূমিকায় বলেছেনঃ "তিনি (পি. সি. সরকার) ঐন্দ্রজালিক। কথায় আর কাজে অদ্ভুত জিনিস দেখানোই তাঁর ব্যবসা। তিনি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঐন্দ্রজালিক।"
সেকালের প্রখ্যাত ইংরাজ যাদুকর - যাদুপ্রিয় ইংলণ্ডেশ্বর সপ্তম এডোআর্ডের প্রিয় বন্ধু - চার্লস্ বারট্রামের (Charles Bertram) লেখা 'বহু দেশে একজন যাদুকরের ভ্রমণবৃত্তান্ত' (A Magician in Many Lands) বইটি আমি পড়েছি বলেই আরো বেশী করে বুঝেছি যাদু-সম্রাট সরকারের 'দেশে দেশে' গ্রন্থের তুলনা নেই। সবাইকে আমি এ বই পড়ে' দেখতে বলি; পড়লেই বুঝতে পারবেন তিনি শুধু ইন্দ্রজালের যাদুকরই ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভাব আর ভাষারও যাদুকর।
আমি ম্যাজিকে মগ্ন হয়েছিলাম স্কুল জীবনেই। কলেজ জীবনে (১৯৩২) লন্ডনের যাদুকর সমিতির 'ম্যাজিশিয়ান' মাসিকপত্রে ম্যাজিক সম্বন্ধে লিখতেও শুরু করেছিলাম, তারপর অন্যান্য কাগজে। ডাকযোগ রেখেছি আমেরিকা আর ইংল্যাণ্ডের ম্যাজিকের জগতের সঙ্গে। পি. সি. সরকারের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গতা শুরু হয়েছিল ১৯৪৫ সালের শুরুতে কলকাতায় 'দৈনিক কৃষক' পত্রিকার অফিসে, আমি ছিলাম যার রবিবাসরীয় সম্পাদক। ম্যাজিক-মগ্ন মানুষ আমি তখনই ভালবেসে ফেলেছিলাম ম্যাজিকের একনিষ্ঠ পূজারী এই আশ্চর্য মানুষটিকে। কিন্তু বটবৃক্ষের সেই ক্ষুদ্র বীজটি যে চোখের সামনে দেখতে দেখতে এমন বিরাট বটবৃক্ষে পরিণত হবে, ম্যাজিক দিয়ে যে এমন ম্যাজিক করা যায়, তা আমি তখন কল্পনাই করতে পারিনি।
ভারতে যাদুবিদ্যা ছিল একটি অবহেলিত বিদ্যা, পথে-ঘাটের ভেলকিওয়ালা আর 'ভানুমতীর খেল'ওয়ালীদের মধ্যেই প্রায় সীমাবদ্ধ। শিক্ষিত সুধীসমাজে ম্যাজিকের তেমন মর্যাদা ছিল না। পি. সি. সরকার সেই ম্যাজিককে শিক্ষিত সুধীসমাজে সমাদৃত করেছেন, ভারত সরকার থেকে 'পদ্মশ্রী' উপাধি জয় করে যাদুবিদ্যাকে সরকারী স্বীকৃতি পাইয়েছেন, ভারতীয় সংস্কৃতির দূতরূপে যাদুকর সরকারকে ভারত সরকার পাঠিয়েছেন সোভিয়েত রাশিয়ায়।
মনে প্রাণে ভারতীয় পি. সি. সরকার বিদেশী ম্যাজিশিয়ানদের পোশাক বদলে ধরলেন খাঁটি ভারতীয় মহারাজার বেশ, তাঁর সম্পূর্ণ যাদু প্রদর্শনীকে ভারতীয় ছাঁচে ঢালাই করে তার নাম দিলেন 'ইন্দ্রজাল', ভারতের ইন্দ্রজালের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে এলেন আমেরিকায়, ইউরোপে, রাশিয়ায়, জাপানে।
১৯১৩ সালে জন্মেছিলেন তিনি, যে বছর রবীন্দ্রনাথ 'নোবেল পুরস্কার' পাওয়ার পর কবি সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেনঃ
"জগৎ কবি সভায় মোরা
তোমার করি গর্ব।
বাঙালী আজ গানের রাজা
বাঙালী নহে খর্ব।”
পি. সি. সরকারের সাফল্য গৌরবে আমরা তেমনি বলতে পারতামঃ
"জগৎ যাদু সভায় মোরা
তোমার করি গর্ব।
বাঙালী আজ যাদুর রাজা,
বাঙালী নহে খর্ব।"
চিরদিনের জন্যে চলে গেছেন আমাদের গৌরবের সেই মানুষটি। একান্ত নিষ্ঠা আর সাধনা থাকলে অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়, তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্তরূপে তিনি আমাদের স্মৃতিতে বেঁচে রইলেন।
এই পর্যন্ত লিখেছিলাম কিশোর-মাসিক 'রোশনাই' মাঘ, ১৩৭৭ সংখ্যায়, বন্ধুবর যাদুসম্রাটের অপ্রত্যাশিত অকালমৃত্যুতে শোকার্ত চিত্তে।
জাপানকে বলা হয় সূর্য-উদয়ের দেশ (Land of the Rising Sun)। সেই দেশে গিয়েই অস্ত গেলেন আমাদের যাদু-গগনের সূর্য, ভারতের যাদুচর্চার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পুরুষ প্রতুলচন্দ্র সরকার। তাঁর এই অস্ত গমনের সঙ্গে রহস্যময়তার দিক দিয়ে চীনা-ছদ্মবেশী মার্কিন যাদুকর চুং লিং সূ-র জীবন-রবি অস্ত যাওয়ার সাদৃশ্য আছে বলে আমার মনে হয়। চুং লিং সূ-র মৃত্যু আকস্মিক দুর্ঘটনা, হত্যা, না পরোক্ষ উপায়ে আত্মহত্যা, তা আজ পর্যন্ত নিঃসংশয়ে নির্ধারিত হয়নি। তেমনি যাদুসম্রাট পি. সি. সরকারের মৃত্যু আকস্মিক, না ইচ্ছামৃত্যু, সে বিষয়ে নিঃসংশয় হতে পারছি না।
আমেরিকার 'নিউ-টপস্' (New Tops) যাদু-মাসিকের মার্চ, ১৯৫০ সংখ্যায় শ্রীমতী ফ্রানসেস মার্শ্যাল সরকারের মৃত্যু সম্পর্কে লিখেছিলেনঃ
"He was on tour in Japan with the big show, severe winter weather prevailed, he had a heart condition and was weary from a great deal of work, contact with the very cold air caused a sort of explosion in that seemingly strong chest, and Sorcar was gone."
ভাবার্থঃ "তিনি (সরকার) তাঁর বিরাট প্রদর্শনী নিয়ে জাপানে সফর করছিলেন তীব্র শীতের মরশুমে, যখন তাঁর হৃদ্-যন্ত্রের অবস্থা ছিল খারাপ এবং প্রচুর পরিশ্রমের ফলে অবসন্ন। ভীষণ ঠাণ্ডা হাওয়া লেগে তাঁর দৃশ্যতঃ সবল (কিন্তু আসলে দুর্বল) বুকের ভিতরে এক ধরনের বিস্ফোরণ ঘটল, সরকার চলে গেলেন।"
নিজের দেহ-যন্ত্রের, বিশেষ করে হৃদ্-যন্ত্রের, মারাত্মক দুর্বলতার কথা জেনেশুনে সরকারের মতো অসাধারণ বুদ্ধিমান এবং সাবধান মানুষ তাঁর শেষ জাপানযাত্রার জন্য বিশেষ করে তীব্র শীতের মরশুমটাই বেছে নিয়েছিলেন কেন, যা তাঁর দুর্বল হৃদ্-যন্ত্রের পক্ষে নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক? এবং ম্যাজিক দেখাতে কেন গিয়েছিলেন বেছে বেছে জাপান দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে বেশী ঠাণ্ডা অঞ্চলে? সেখানে মৃত্যু-সম্ভাবনা নিশ্চিত জেনেই কি?
হয়তো তাই। অথবা হয়তো তা নয়। এ বিষয়ে কোনো নিশ্চিত মীমাংসায় আসতে পারি না। তাই যখনই বন্ধুবর প্রতুলচন্দ্রের মৃত্যুর কথা ভাবি, তখনই মনে পড়ে চুং লিং সূ-র কথা।
(সমাপ্ত)
[১] যাদুসম্রাটের মৃত্যুতে শোক প্রকাশের জন্য বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী শ্রীপূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তীর ভবনে 'রবিবাসর' সাহিত্য সভার যে বিশেষ অধিবেশন হয়েছিল, তাতে যাদুসম্রাটের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীমান প্রফুল্লচন্দ্র পিতার স্মৃতিচারণ করেছিল এবং যাদুকর 'সূ ভন' - যাদুসম্রাটের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিলেন বিশ্বের প্রাচীনতম যাদুর খেলা 'বাটি আর গুটির খেলা' (Cups and Balls) দেখিয়ে।
[২৩ ফেব্রুয়ারি 'বিশ্ব জাদুকর দিবস' উপলক্ষ্যে লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হল।]
সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতিঃ
অজিতকৃষ্ণ বসুর ব্যঙ্গচিত্রটি এঁকেছেন স্বনামধন্য কার্টুনিস্ট অমল চক্রবর্তী। যিনি 'অমল' নামেই সুপরিচিত।
অজিতকৃষ্ণ বসু-র জন্ম ১৯১২ সালের ৩ জুলাই বৃটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি (বর্তমানে বাংলাদেশ)-র ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। অজিতকৃষ্ণ বসু পেশায় লেখক ও অধ্যাপক। 'অ. কৃ. ব.' ছদ্মনামেই তিনি লেখক ও পাঠকমহলে সর্বত্র পরিচিত। পিতা ছিলেন শৈলেন্দ্রমোহন বসু। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ কুঞ্জলাল নাগ ছিলেন তার মাতামহ। অজিতকৃষ্ণ বসু মূলতঃ ব্যঙ্গ ও কৌতুক রস সাহিত্যিক হলেও জাদুবিদ্যা ও সঙ্গীতে তাঁর বিশেষ পারদর্শিতা ছিল। ১৯৯৩ সালে ৮১ বছর বয়সে কলকাতায় তিনি প্রয়াত হন।