প্রবন্ধ ও নিবন্ধ

একটি পরিকল্পিত মৃত্যু



অমিতাভ রায়


সে বড়ো অসুখের সময়। সারা বিশ্বে নাকি ছড়িয়ে পড়েছে এক অজ্ঞাত পরিচয় ভাইরাস, কোভিড-১৯। মানুষের প্রাণ বাঁচাতে রাষ্ট্রীয় ঘোষণায় সারা বিশ্ব অবরুদ্ধ, - যার পোশাকি নাম 'লক ডাউন'। টিভি থেকে শুরু করে যাবতীয় সংবাদপত্র-সংবাদমাধ্যম তখন একটাই খবর নিয়ে ব্যস্ত, - কোথায় কতজন মারা গেছেন আর হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন কতজন। আর তার মধ্যে ঘনঘন প্রচার চলছে, - ‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন’।

সেই দুঃসময়ে মৃত্যু-মিছিলের খবরের মধ্যে হঠাৎ করে 'ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ্ ইন্ডিয়া' সংক্রান্ত একটি ছোট্ট খবর প্রকাশিত হল। ২০২০-র পয়লা এপ্রিল থেকে ঐতিহ্যবাহী ব্যাঙ্কটিকে অন্য একটি ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার খবর। প্রাথমিক পর্যায়ে অনেকের মনে হয়েছিল যে এটা হয়তো পয়লা এপ্রিলের সেরা ধোঁকা। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই অবরোধের আড়ালে 'ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ্ ইন্ডিয়া'-র সাইনবোর্ড পাল্টিয়ে যাওয়ায় বোঝা গেল ঐতিহ্যবাহী ব্যাঙ্কটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। অর্থাৎ আরও একটি মৃত্যু সংবাদ।

সেই আবহে মনে পড়ে যায় কীভাবে 'ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ্ ইন্ডিয়া'-র জন্ম হয়েছিল। সেই সময় বেশিরভাগ বেসরকারি ব্যাঙ্ক তা সে দেশি হোক বা বিদেশি, একের পর এক লালবাতি জ্বালিয়ে গ্রাহকদের জমা টাকা হাতিয়ে নেওয়ার রেওয়াজ চালু করে দিয়েছিল। গ্রাহকরা পড়তেন অথৈ জলে। তাঁদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় রাতারাতি লালবাতি জ্বালানো ব্যাঙ্কের সুবাদে শূন্য হয়ে যেত। এই ভয়ঙ্কর প্রক্রিয়া থেকে গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ ছিল না। ইতিহাসের নথিতে তো বটেই সমসাময়িক সাহিত্য-সিনেমায় বিষয়টি বারেবারেই উচ্চারিত হয়েছে।

সেই দুঃসময়ে কয়েকজন সমাজসচেতন দূরদর্শী ব্যাঙ্কার গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় এক নতুন চিন্তা নিয়ে এগিয়ে এলেন। যার ফলে ১৯৫০-এ কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন, বেঙ্গল সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক, কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক এবং হুগলি ব্যাঙ্ক নামক চারটি ব্যাঙ্ক মিলিত হয়ে ১৯৫০-এর ১৮ ডিসেম্বর গঠিত হয় 'ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ্ ইন্ডিয়া'।

চারটি ব্যাঙ্কেরই প্রতিষ্ঠাতা চার বাঙালি। সবার আগে তৈরি হয় কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন। কুমিল্লার আইনজীবী নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত (এন সি দত্ত নামেই বেশি পরিচিত) ১৯১৪-য় মাত্র তিন হাজার টাকা সম্বল করে প্রতিষ্ঠা করেন কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক জ্যোতিষচন্দ্র দাস ১৯১৮-য় প্রতিষ্ঠা করেন বেঙ্গল সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্কিং ব্যবসায় অভিজ্ঞ কুমিল্লার ইন্দুভূষণ দত্ত ১৯২২-এ স্থাপন করেন কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক। আর উত্তরপাড়ার জমিদার, স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং ধনেখালির তৎকালীন জনপ্রতিনিধি (বেঙ্গল লেজিস্লেটিভ কাউন্সিলের সদস্য) ধীরেন্দ্রনারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের হাতে ১৯৩২-এ তৈরি হয় হুগলি ব্যাঙ্ক লিমিটেড। তবে হুগলি ব্যাঙ্কের সদর দফতর ছিল কলকাতার ধর্মতলায়।

এন সি দত্তের পুত্র বটকৃষ্ণ দত্ত ১৯৩৭-এ নিউ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৫-এ এই ব্যাঙ্কটি কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। ১৯৬৯-এর ১৯ শে জুলাই ভারতে ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রীয়করণের পরেও 'ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া' স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল।

নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত অর্থাৎ এন সি দত্ত নিঃসন্দেহে বাংলার ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার দিশারী। তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলার ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার প্রসঙ্গে কোনও আলোচনা সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়। ১৮৭৮-এর ২৫শে নভেম্বর নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার (বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা) কালিকচ্ছ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কালিকচ্ছ এখনকার বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলায় অবস্থিত। বাবা মহেশ চন্দ্র দত্ত যখন মারা যান তখন নরেন্দ্র চন্দ্র-র বয়স মাত্র নয় মাস। তাঁর মা অসহায় হয়ে পড়লেও ছেলের লেখাপড়ার বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন। নরেন্দ্র চন্দ্র ১৯০৫-এ কলকাতার রিপন কলেজ থেকে আইনে স্নাতক হন। কলকাতার আদালতে আইনজীবী হিসেবে কাজ করলে প্রভূত অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কুমিল্লার দেওয়ানী আদালতে তিনি আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আইন ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করেন।

আইন ব্যবসায় থেকে অর্জিত অর্থ মূলধন করে ১৯১৪-য় নরেন্দ্র চন্দ্র প্রতিষ্ঠা করলেন কুমিল্লা ব্যাংকিং কর্পোরেশন। নিজের সঞ্চয়ের তিন হাজার টাকা হল ব্যাঙ্কের ঘোষিত মূলধন। প্রতিষ্ঠার অল্পদিনের মধ্যেই তিনি আরও আড়াই হাজার টাকা সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। একসময় মূলধন জোগাড় করার জন্য নিজের বাড়িটিও মাত্র দেড় হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলেন। এবং সেই সময় তিনি ব্যাঙ্ক থেকে পারিশ্রমিক পেতেন মাসে আট টাকা।

নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত পূর্ব ভারতের একটি অর্থনৈতিক সমীক্ষা করে চা শিল্পে বিনিয়োগ শুরু করেছিলেন। কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশনের মাধ্যমে তিনি চা শিল্পের সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের চা বাগান এবং সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি কেনার জন্য ঋণ প্রদান শুরু করেন।

পড়াশোনা শেষ করে নরেন্দ্র চন্দ্রের বড়ো ছেলে বটকৃষ্ণ দত্ত কুমিল্লায় ফিরে এসে কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশনে শিক্ষার্থী হিসেবে যোগ দেন। কয়েক সপ্তাহ পরে নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত পুত্র বটকৃষ্ণকে নিজস্ব ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন। তরুণ বটকৃষ্ণ পিতার উপদেশ মেনে নিয়ে ১৯৩০-এ বিলুপ্ত কুমিল্লা রাইস অ্যান্ড অয়েল মিলস্ লিমিটেডের দায়িত্ব গ্রহণ করে ত্রিশ হাজার টাকার প্রাথমিক পরিশোধিত মূলধন নিয়ে নিউ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাঙ্ক অফ্ ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠা করেন।

ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তৎকালীন গভর্নর চিন্তামন দ্বারকানাথ দেশমুখের (সি ডি দেশমুখ) পরামর্শে নিউ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া তার সমস্ত সম্পত্তি স্থানান্তর করে ১৯৪৬-এ কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশনের সাথে একীভূত হয়। ভারতের স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত জ্যোতিষ চন্দ্র দাসের সঙ্গে কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন, কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক, বেঙ্গল সেন্ট্রাল ব্যাংক ও হুগলি ব্যাঙ্ক একীভূতকরণ সম্পন্ন করার মাধ্যমে কলকাতায় 'ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ্ ইন্ডিয়ার' প্রতিষ্ঠা করেন।

নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি। ১৯৬২-র ১৫ই এপ্রিল কলকাতায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর সাত বছর পর তাঁর স্বপ্নের 'ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ্ ইন্ডিয়া'-র রাষ্ট্রীয়করণ হয়।

বাংলা তথা পূর্ব ভারতে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার দিশারী নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ক্রমশ বিস্মৃতির গহনে হারিয়ে যাচ্ছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলার এক জেলা শহরে একটি ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করে সাফল্য অর্জন সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান। প্রসঙ্গত, দেশের এক প্রান্তিক জেলায় ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি ব্যাঙ্ককে সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা মোটেও সহজ কাজ নয়।

অথচ তাঁর উত্তরসূরী প্রজন্ম শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে নরেন্দ্র চন্দ্র দত্তের অবদান ভুলে গেলেও বাংলার মানুষ তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্যাঙ্কের পাশে দাঁড়িয়েছে। এক সময়ে প্রায়ই ব্যাঙ্ক ফেল করার কথা ছিল পরিচিত ঘটনা। অনেক সময়েই কোনও ব্যাঙ্কের নামে ভুয়ো (কখনও সত্যিও) খবর রটত যে, ব্যাঙ্কটি সমস্যায় পড়েছে। আতঙ্কিত গ্রাহকরা ছুটতেন ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার জন্য। এক সঙ্গে অত মানুষ টাকা তুলতে চাইলে ব্যাঙ্কের পক্ষে তা সামাল দেওয়া সম্ভব হত না। সমস্যা বাড়ত আরও, অনেক সময়েই এর জেরে ব্যাঙ্ক ফেল পড়ত। শুরুর কয়েক বছর পর কেনো এক গুজবের সুবাদে ইউবিআই-ও এক বার এই সমস্যায় পড়েছিল। এক সঙ্গে বহু গ্রাহক এসে লাইন দিয়েছিলেন টাকা তুলে নেওয়ার জন্য। খবর চলে যায় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কানে। তিনি স্বয়ং চলে আসেন ব্যাঙ্কের রয়্যাল এক্সচেঞ্জ প্লেস শাখায়। সেখানে একটা টেবিলের উপর উঠে দাঁড়িয়ে গ্রাহকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। বলেন,- ব্যাঙ্কে কোনও সমস্যা নেই, সকলের টাকাই সুরক্ষিত। অযথা আতঙ্কিত হয়ে কেউ যেন টাকা তুলে না নেন। তাঁর কথায় আস্থা ফিরে পায় আতঙ্কিত গ্রাহক। সে যাত্রায় বেঁচেছিল ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক। যে টেবিলের উপরে দাঁড়িয়ে বিধানবাবু বক্তব্য রেখেছিলেন, সেটি এখনও ইউবিআই-এর ‘রয়্যাল এক্সচেঞ্জ প্লেস’ শাখায় সংরক্ষিত।

বিধানচন্দ্র রায় নিজেও ছিলেন ইউবিআই-এর গ্রাহক। এই ব্যাঙ্কের গ্রাহক তালিকায় আছেন নামকরা বহু মানুষ, যেমন দেশের প্রাক্তন চার রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ, জৈল সিংহ, প্রতিভা পাটিল ও প্রণব মুখোপাধ্যায়। এ ছাড়া রয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধি, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের উদ্যোগেই ইউবিআই-এর রজত জয়ন্তী বর্ষ উপলক্ষে ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রপতি ভবনে ইউবিআই-এর একটি শাখার উদ্বোধন হয়, যার পোশাকি নাম প্রেসিডেন্ট এস্টেট ব্রাঞ্চ। রাষ্ট্রপতি ভবনে এটাই কোনও ব্যাঙ্কের প্রথম শাখা।

দেশের যে সব অঞ্চলে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা এখনও পৌঁছয়নি, কেন্দ্রীয় সরকার এখন সেই সব অঞ্চলেই ব্যাঙ্কের শাখা খোলার ব্যাপারে বেশি উৎসাহ দিচ্ছে। ইউবিআই কিন্তু জন্মলগ্ন থেকে সেই কাজটিই করে আসছে। পশ্চিমবঙ্গের যে সব অঞ্চলে ব্যাঙ্ক নেই, সেখানে শাখা খোলাই ছিল এর পরিষেবা সম্প্রসারণ কর্মসূচির অঙ্গ। এক সময়ে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা প্রায় ছিলই না। সুন্দরবনের মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নদী। প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য এক সময়ে নদীপথই ছিল সম্বল। আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে নদীপথকে ব্যবহার করেই সেখানে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা চালু করেছিল ইউবিআই। দুটি ভ্রাম্যমাণ লঞ্চে ব্যাঙ্কের শাখা চালু করে তারা। উদ্বোধন করেছিলেন পশ্চিম বঙ্গের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। লঞ্চগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে মানুষকে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা দিত। টাকা জমা দেওয়া, তোলা-সহ বিভিন্ন ব্যাঙ্কিং পরিষেবা দেওয়ার জন্য এই লঞ্চদুটিই ব্যাঙ্কের শাখা হিসাবে কাজ করত।

বাংলার ছোটো-বড়ো শিল্প সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ইউবিআই-এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। রাজ্যের চা শিল্পে এই ব্যাঙ্কই সব থেকে বেশি ঋণ দিয়েছে। এক সময়ে ব্যাঙ্কের মোট ঋণের ৩০ শতাংশই পেত চা শিল্প। ঋণের আওতায় ছিল পাট শিল্পও। রাজ্যের বহু ক্ষুদ্র, ছোটো ও মাঝারি শিল্প এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে ইউবিআই-এর ভূমিকা কম নয়। ফুলের চাষ, কুমোরটুলির প্রতিমা শিল্প, তাঁত শিল্প, চিরুনি বা পিতলের জিনিস তৈরির মতো উদ্যোগকে চাঙ্গা করতেও এগিয়ে এসেছিল ইউবিআই। রাজ্যের হিমঘরগুলিকেও বিমুখ করেনি। ঋণ নিয়ে ব্যবসা বাড়িয়েছে বড়ো মাপের অনেক শিল্প সংস্থাও। প্রথম যে বড়ো শিল্পগোষ্ঠীকে এই ব্যাঙ্ক ঋণ দেয়, সেটি হল টাটা গোষ্ঠী। তাদের একটি কাপড়ের মিল ইউবিআই-এর থেকে ঋণ নেয়। বিড়লা গোষ্ঠীর প্রথম যে দু’টি সংস্থা ইউবিআই-এর দেওয়া ঋণের তালিকায় আসে, তারা হল হিন্দ সাইকেল এবং ইন্ডিয়ান রেয়ন। কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেল বা ওবেরয় গোষ্ঠী, বেঙ্গল কেমিক্যালস্, বেঙ্গল এনামেল, সরস্বতী প্রেস, মার্টিন বার্ন, টিস্কো ইত্যাদি সংস্থার ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ইউবিআই-এর ঋণের বড়ো ভূমিকা রয়েছে।

ইউবিআই-এর ৯০ শতাংশ আমানতই পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের পূর্বাঞ্চলের গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগৃহীত। একটি জাতীয় স্তরের ব্যাঙ্ক হলেও এই ব্যাঙ্কের মোট ঋণের ৫০ শতাংশই খেটেছে দেশের পূর্বাঞ্চলেই। তুলনামূলক ভাবে অনেক দুর্বল, এমন বহু ব্যাঙ্ক-কে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণার জেরে ‘ইউবিআই’ নামের অস্তিত্ব বিলুপ্ত। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক, ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্ক অব কমার্স এবং ইউবিআই - তিনটি ব্যাঙ্ক মিলে তৈরি হয়েছে নতুন একটি ব্যাঙ্ক। সম্মিলিত ব্যাঙ্কের নতুন নাম হওয়ার কথা ছিল। নতুন নামের মধ্যে অন্তত 'ইউনাইটেড' শব্দটা থাকুক এমনটাই আশা করা হয়েছিল। হয়নি। পক্ষান্তরে যে নামের সঙ্গে 'ইউবিআই' মিলে গেছে তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে। কী আর করার!

ইতিহাস রচনা করা যায়, তবে ঐতিহাসিক সত্যকে কি মুছে ফেলা যায়?