পঞ্চপাণ্ডবের একপত্নীগমনের যে বিধান ছিল, অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও অর্জুনকে সেই বিধান ভঙ্গ করতে হয়েছিল এবং তার ফলে তাঁর বারো বছর ব্রহ্মচর্য পালন করে বনবাস যাপন করার কথা ছিল। এই বারো বছর তিনি খাণ্ডবপ্রস্থে ছিলেন না বটে, কিন্তু তিনি ব্রহ্মচর্যও পালন করেননি এবং সব সময় বনবাসও করেননি। ওই সময়সীমায় তিনি ভারতবর্ষের নানা তীর্থে ও জনপদে পর্যটন করেছিলেন এবং তিন তিনটি বিবাহ করেছিলেন। প্রথম বিবাহ করেছিলেন নাগরাজকন্যা উলূপীকে ও তাঁর কাছে অর্জুন মাত্র এক রাত যাপন করেছিলেন, দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলেন মণিপুরের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে ও তাঁর সঙ্গে তিনি তিন বছর মণিপুরেই কাটিয়েছিলেন এবং তৃতীয় বিবাহ করেছিলেন কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রাকে ও তাঁর সঙ্গে দ্বারকা, পুষ্কর ইত্যাদি স্থানে তিন বছর কাটিয়ে সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে খাণ্ডবপ্রস্থে ফিরেছিলেন। বারো বছর খাণ্ডবপ্রস্থের বাইরে, কাটানোর শেষের দিকে তিনি পশ্চিম সমুদ্রতীরের প্রভাসতীর্থে পৌঁছলেন এবং সেখানে বৃষ্ণি বংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। সেখানে দুই বন্ধু কিছুদিন কাটিয়ে রৈবতক পর্বতে এলেন এবং সেখানেও কয়েকদিন আনন্দে কাটিয়ে দুজনে মিলে দ্বারকাপুরীতে এলেন। যদুবংশীয়েরা অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে অর্জুনকে অভ্যর্থনা করলেন এবং অর্জুনও সুরম্য অট্টালিকায় কৃষ্ণের সঙ্গে কিছুদিন সুখে কাটাতে লাগলেন।
এরই মধ্যে অন্ধক, বৃষ্ণি ও ভোজবংশীয় যাদবেরা রৈবতক পর্বতে খুব বড় একটা উৎসবের আয়োজন করেছিল। প্রধান প্রধান যাদববীরগণ তাঁদের পত্নীগণসহ ওই উৎসবে যোগদান করেছিলেন। নৃত্য-গীত-বাদ্য ইত্যাদিতে চতুর্দিক মুখরিত হয়ে উঠল। ওই উৎসবে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে ইতস্তত বিচরণ করছিলেন। এমন সময় সখীগণসহ উৎসবে যোগদানকারিনী অপরূপ রূপলাবণ্যবতী বসুদেবকন্যা তথা শ্রীকৃষ্ণভগিনী সুভদ্রা অর্জুনের দৃষ্টিপথে এলেন। তাঁর রূপে মোহিত হয়ে অর্জুন একদৃষ্টে তাঁর দিকে চেয়ে রইলেন। এই ব্যাপারটা কৃষ্ণের নজর এ্ড়াল না। তিনি প্রচ্ছন্ন পরিহাসের সঙ্গে অর্জুনকে বললেন যে সুন্দরী যুবতী দেখে ব্রহ্মচারী বনবাসীর এরকম মুগ্ধ হওয়াটা ঠিক হচ্ছেনা। তারপর তিনি প্রকৃতই গুরুত্ব দিয়ে অর্জুনকে বললেন যে তিনি যদি তাঁর ভগিনী সুভদ্রাকে লাভ করতে চান, তাহলে দুটো পথ আছে। প্রথমত, ক্ষত্রিয়দের মধ্যে স্বয়ংবরের রীতি আছে, কিন্তু স্ত্রীলোকের প্রবৃত্তির কথা কিছুই বলা যায় না এবং সুভদ্রা অর্জুনকে পতিত্বে বরণ করবেন কি না সে ব্যাপারে কোনও নিশ্চয়তা নেই। দ্বিতীয়ত, বলপূর্বক হরণ করে বিবাহ করাও মহাবীর ক্ষত্রিয়দের পক্ষে শাস্ত্রসম্মত এবং এই দ্বিতীয় পথটাই অর্জুনের পক্ষে প্রশস্ত। আসলে কৃষ্ণও চাইছিলেন অর্জুনের সঙ্গেই ভগিনী সুভদ্রার বিবাহটা হোক। এ ব্যাপারে দুজনে পরামর্শ করে যুধিষ্ঠিরের কাছে অনুমতি নেওয়ার জন্য দূত পাঠালেন এবং যুধিষ্ঠিরও সানন্দে তা অনুমোদন করলেন।
এদিকে সুভদ্রা একদিন রৈবতক পর্বতে পুজো দিতে গিয়েছিলেন। পুজোশেষে পর্বতকে প্রদক্ষিণ করে ও ব্রাহ্মণদের আশীর্বাদ নিয়ে সুভদ্রা যখন দ্বারকায় ফিরছেন, সেই সময় অর্জুন তাঁকে বলপূর্বক নিজের স্বর্ণমণ্ডিত ও নানা অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত রথে তুলে নিয়ে নিজ রাজধানী খাণ্ডবপ্রস্থের দিকে রওনা হলেন। বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে কৃষ্ণের পূর্ণ সম্মতি ছিল এবং ওই রথও কৃষ্ণেরই। কিন্তু সুভদ্রাহরণের সংবাদ পেয়ে অন্যান্য যাদববীরগণ এই আপমানের প্রতিশোধ নিতে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করার আয়োজন করতে লাগলো। কৃষ্ণ নিরাসক্ত থাকায় তাঁর অগ্রজ বলরামও বললেন যে অর্জুনের মতো অভিজাত বংশের কৃতকর্মন পুরুষের ওই কাজটা করা খুব গর্হিত হয়েছে, বরং তিনি চাইলে তাঁরা সানন্দে সুভদ্রার সঙ্গে তাঁর বিবাহ দিতে পারতেন। বলরাম বললেন যে সুভদ্রাহরণের জন্য তিনি খুব অপমানিত বোধ করছেন এবং অর্জুনের ওই অপরাধ কোনওভাবেই ক্ষমা করবেন না ও যুদ্ধে তাঁকে প্রতিহত করবেন।
কৃষ্ণ খুব ঠাণ্ডা মাথায় বলরামকে বোঝালেন যে অর্জুন তাঁদের বংশের অপমান নয়, বরং সম্মান করেছেন। অর্জুন অর্থ দিয়ে সুভদ্রাকে গ্রহণ করে তাঁদের বংশকে ছোট করার চেষ্টা করেননি, স্বয়ংবরে কন্যালাভ খুবই অনিশ্চিত ব্যাপার, সেইজন্য তাতেও অর্জুন সম্মত হননি এবং পিতামাতার অনুমতি নিয়ে কন্যাকে বিবাহ করা মহাবীর ক্ষত্রিয়ের পক্ষে প্রশংসনীয় নয়। এই সব বিবেচনা করেই অর্জুন সুভদ্রাকে বলপূর্বক অপহরণ করেছেন এবং এটা ক্ষত্রিয়ধর্মের অনুকূল। অমিতবিক্রম অর্জুনকে পরাজিত করা একমাত্র মহাদেবের পক্ষেই সম্ভব। তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে পরাজিত হয়ে ফিরে এলে এবং তারপর অর্জুন সুভদ্রাকে খাণ্ডবপ্রস্থে নিয়ে গেলে তাঁদের অপমানের সীমা থাকবে না। তার চেয়ে অর্জুনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তাঁর সঙ্গে সুভদ্রার বিবাহ দিলে তাঁদের বংশের যশবৃদ্ধি হবে, কারণ কুন্তীভোজের দৌহিত্র এবং মহাত্মা ভরতের বীরশ্রেষ্ঠ বংশধর অর্জুনের চেয়ে, ভাল পাত্র আর কোথায় পাওয়া যাবে? কৃষ্ণের বাকচাতুর্যে সকলেই মুগ্ধ হলেন এবং তাঁর যুক্তি মেনে নিলেন। অর্জুনকে সম্মানের সঙ্গে ফিরিয়ে আনা হল। দ্বারকাতে অর্জুনের সঙ্গে যথাবিধি সুভদ্রার বিবাহ হল এবং অর্জুন সেখানে সুভদ্রার সঙ্গে এক বছর কাটালেন। তারপর পুষ্করতীর্থে গিয়ে তাঁরা একাদশ বর্ষ অতিবাহিত করলেন। এইভাবে দ্বাদশ বর্ষ পূর্ণ হলে অর্জুন সুভদ্রাকে নিয়ে খাণ্ডবপ্রস্থে ফিরে এলেন।
অর্জুন সশ্রদ্ধচিত্তে জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্ঠিরকে প্রণাম করে ব্রাহ্মণদের পুজো করলেন। তারপর তিনি দ্রৌপদীর কাছে গেলেন। অর্জুন নববধূ সঙ্গে করে এনেছেন বলে দ্রৌপদী ছদ্ম প্রণয়কোপ প্রকাশ করে একটু রসিকতা করলেন। অর্জুন তাঁর কাছে বারবার ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন। এইখানেই দ্রৌপদী চরিত্রের আভিজাত্য ও হৃদয়ের বিশালতার পরিচয় পাওয়া যায়। সাধারণ নারীর মতো তিনি স্বামীর প্রতি ক্রোধ বা সপত্নীর প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করেননি। বরং যখন সুভদ্রা তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে বললেন যে তিনি সেইদিন থেকে তাঁর অনুচরী হলেন, তখন দ্রৌপদী অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে তাঁকে আলিঙ্গন করলেন এবং সপত্নীকে আশীর্বাদ করলেন তাঁর পতি যেন শত্রুবিহীন হন। কালক্রমে সুভদ্রা এক শুভলক্ষণযুক্ত পুত্র প্রসব করলেন এবং তাঁর নাম রাখা হল অভিমন্যু। অভিমন্যুর জন্মের আনন্দে যুধিষ্ঠির প্রচুর দানধ্যান করলেন এবং অচিরকালের মধ্যেই এই অভিমন্যু পান্ডবদের, কৃষ্ণের ও পুরবাসীদের অত্যন্ত প্রিয় হয়ে উঠলেন। ছলনাপূর্ণ পাশাখেলায় পরাজিত হয়ে পঞ্চপাণ্ডব দ্রৌপদীসহ যখন বারো বছর বনবাস ও এক বছর অজ্ঞাতবাসের জন্য গমন করলেন, সেই সময় সুভদ্রা পুত্র অভিমন্যুসহ পিতা বসুদেব ও অগ্রজ কৃষ্ণের কাছে থাকবার জন্য দ্বারকায় চলে গেলেন। কুন্তী বিদূরের কাছে রইলেন এবং দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র মামার বাড়ি চলে গেল।
বারো বছর বনবাসের পর এক বছর অজ্ঞাতবাসের সময় পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী ছদ্মবেশ ধারণ করে মৎস্যদেশের রাজা বিরাটের প্রাসাদে নানা কার্যে নিযুক্ত হয়ে গেলেন । এক বছরের অজ্ঞাতবাস যখন শেষ হওয়ার মুখে, সেই সময় দুর্যোধন অন্যান্য কুরুবীরগণসহ বিরাটরাজের ষাট হাজার গোরু অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
এই সময় রাজপ্রাসাদে একমাত্র বিরাটের পুত্র উত্তর বর্তমান ছিলেন। যুদ্ধে যাবার জন্য উত্তর যখন সারথির খোঁজ করছিলেন, সেই সময় সুযোগ বুঝে বৃহন্নলারূপী অর্জুন উত্তরের সারথ্যকর্ম গ্রহণ করলেন এবং তাঁরই শৌর্য ও পরাক্রমে কৌরবগণ পরাজিত হয়ে হস্তিনাপুরে চলে গেলেন। ইতিমধ্যে অজ্ঞাতবাসের পর্ব শেষ হল এবং দ্রৌপদীসহ পঞ্চপাণ্ডব আত্মপ্রকাশ করলেন। বিরাটরাজের আনন্দ তো আর ধরে না, তিনি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের জন্য অর্জুনের সঙ্গে নিজ কন্যা উত্তরার বিবাহ দিতে চাইলেন। অর্জুন বললেন সেটা অসম্ভব; কারণ এক বছর ধরে তিনি সন্তানস্নেহে উত্তরাকে শিক্ষাদান করেছেন, সেইজন্য তিনি বিরাটরাজের কন্যাকে নিজের পুত্রবধূ করার জন্য প্রার্থনা করলেন। এই সময় পান্ডবগণ বিরাট রাজ্যের অন্তর্গত উপপ্লব্য নামক এক নগরে বসবাস করতে লাগলেন। অর্জুন কৃষ্ণ, সুভদ্রা, অভিমন্যু ও অন্যান্য যাদবগণকে আনার জন্য দূত পাঠালেন। রাজা দ্রুপদও এক অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, ধৃষ্টদ্যুম্ন ইত্যাদি সহ মৎস্যদেশে এসে উপস্থিত হলেন। আরও অনেক রাজা এই বিবাহানুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। মহাধুমধামে অভিমন্যুর সঙ্গে উত্তরার বিবাহ হয়ে গেল। তেরো বছর পর আবার সুভদ্রা দ্রৌপদীর দেখা পেলেন।
(ক্রমশ)
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।