২০১৯-এর মার্চ মাসে সাইক্লোন ইদাই দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে ১০০০-এর বেশি মানুষের প্রাণ নিয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ ঘরছাড়া। ২০২০ সালের অস্ট্রেলিয়ার দাবানলে প্রায় ১০০ কোটি বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। ২০১১ থেকে ২০১৯-এ পূর্ব আফ্রিকা বারবার খরা কবলিত হয়েছে, ১.৬ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গত দশকে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, বাংলাদেশে অসংখ্যবার বন্যায় ফসল ধ্বংস হয়েছে, কোটি কোটি মানুষ সহায় হারিয়েছেন। এল নিনো সহ ড্ৰাই করিডোর মধ্য আমেরিকাকে প্রায় ৭ বছর ধরে শুস্ক, রুক্ষ রেখেছে, ৭০ লক্ষ মানুষ খাদ্যসংকটে ভুগছেন। গত ৫০০ বছরে এমন খরা ইউরোপ দেখেনি। গত ৪৫ বছরের স্যাটেলাইট তথ্য অনুযায়ী আন্টার্কটিকার বরফ তার সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের 'ক্লাইমেট চেঞ্জ প্যানেল' (IPCC)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী পলিসিগত পরিবর্তন না আনলে এই শতকের শেষে পৃথিবীর উষ্ণতা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে, যার ফলাফল সম্ভবত আরো একটি গণ অবলুপ্তি।
জলবায়ু পরিবর্তন সারা পৃথিবীর সমস্যা। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ তাদের নিজস্ব বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, রাজনীতি, অর্থনীতির সাহায্যে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা কর্পোরেট পলিসির বিরুদ্ধে লড়াই। সারা পৃথিবী জুড়ে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে আছে মার্কেট ইকোনমির অসংখ্য পকেট। তারা বিশেষ করে প্রাকৃতিক সম্পদকে কব্জা করে, সস্তা শ্রমিকের সাহায্যে তাদের ইন্ডাস্ট্রি প্রফিট বাড়িয়ে চলেছে। কোনওভাবেই ইকোসিস্টেমের কথা চিন্তা করছে না। যেহেতু তাদের শাখা-প্রশাখা সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে আছে, বিশেষ করে উৎপাদক দেশগুলির ভারসাম্য বিধ্বস্ত। আমাজন থেকে অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়ার গভীর জঙ্গল, ফ্লোরা ও ফনা, প্রাচীন অরণ্য, ফরেস্ট কভার, জলস্তর, বাতাসের পার্টিকুলেটেড ম্যাটার, অস্তিত্বসংকট। নাসার 'গডার্ড ইনস্টিটিউট ফর স্পেস স্টাডিজ' (GISS)-এর তথ্যে গত দশ বছরে ২০২২ উষ্ণতম বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বিশ্ব উষ্ণায়ণ-এর তুলনামুলক চিত্র।
পৃথিবীর বয়স ৪৫০ কোটি বছর। আজকের অবস্থায় আসতে পৃথিবীকে অনেকগুলি আবহাওয়া, ভৌগোলিক এবং প্রাণীজগতের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। বিশেষত, গণ অবলুপ্তি অথবা মাস এক্সটিঙ্কশন। মোট পাঁচটি গণ অবলুপ্তির চারটিই ঘটেছে আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে। শুধুমাত্র আজ থেকে প্রায় ৬ কোটি বছর আগে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে যাবার ঘটনাটি ঘটেছিল এক উল্কাপাতের ফলে। একদম শুরুতে কমলা রঙের পৃথিবী এক দীর্ঘ তুষারযুগ পেরিয়ে ধীরে ধীরে নতুন স্থলভাগ গঠনের মাধ্যমে এই অবস্থায় পৌঁছায়। যদিও এই পরিবর্তন অব্যাহত। মাটির নিচের উষ্ণতা, টেকটোনিক প্লেটের চলন ইত্যাদি। বিজ্ঞানীরা মনে করেন প্রায় এগারো হাজার বছর আগে ষষ্ঠ অবলুপ্তি শুরু হয়েছে, অর্থাৎ তুষার যুগের শেষে মানুষ যে সময়ে কৃষিকাজ শুরু করেছে, তখন থেকেই। যতদিন মানুষ শিকারী ছিল, খাদ্য আহরণ করেছে, ততদিন সে ইকোসিস্টেমের সরাসরি অংশ ছিল। উৎপাদক হবার সাথে সাথে সে ধীরে ধীরে প্রকৃতি ও পরিবেশকে বদলাতে শুরু করল। খাদ্য-খাদক সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটতে থাকলো। প্রথম দিকে উৎপাদন, ভোগ এবং বন্টনের মধ্যে একটা ভারসাম্য ছিল। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্কের জটিলতা এবং সূক্ষ্মতা বৃদ্ধির সাথে যুক্ত হলো বিনোদনের বিভিন্ন উপাদান। পরিবার, সমাজ এবং ব্যক্তিগত মালিকানার সাথে বাড়তে থাকলো উদ্বৃত্ত। এরপর ইতিহাস যেভাবে এগিয়েছে, তার সাথে বেড়েছে সম্পদের মেরুকরণ। শিল্পবিপ্লবের পরে মাত্র ২৫০ বছর লেগেছে পৃথিবীর প্রায় ৪৫ শতাংশ প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করতে।
গত ১১ হাজার বছর ধরে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সরাসরি মানবসভ্যতাকে দায়ী করা যায়। শুধুমাত্র কৃষির কারণে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ অরণ্য হারিয়ে গেছে। বাতাসের স্বাভাবিক কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমান ৩০০ থেকে ৪০০ পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম)। ১৯৫৮ সাথে এই মাত্রা ছিল ৩২০ পিপিএম। ২০২২ সালে ন্যাশনাল ওশ্যানিক এন্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর হাওয়াই পর্যবেক্ষণাগার থেকে পরিমাপ করা কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমান ৪১২ পার্টস পার মিলিয়ন। শিল্পবিপ্লবের আগে প্রায় ৬০০০ বছরে ধরে এই মাত্রা ছিল ২২৮ পিপিএম। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২০ থেকে ২৪ সেন্টিমিটার। গবেষণা জানাচ্ছে আজ থেকে প্রায় ৫৫ থেকে ২৫ লক্ষ বছর আগে প্লিওসিন যুগের সাথে তুলনীয়, পৃথিবীর শীতল হবার শেষ পর্যায়। কেন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা গুরুত্বপূর্ণ? পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ বাস করেন উপকূলবর্তী অঞ্চলে। অসংখ্য আধুনিক শহর, ব্যবসায়িক কেন্দ্র থেকে শুরু করে এয়ারপোর্ট সমুদ্রের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে। সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে কেন? কারণ কার্বন ডাইঅক্সাইডের বৃদ্ধির সাথে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে। শিল্পবিপ্লব থেকে আজ অবধি ১.১৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উষ্ণতা বেড়েছে পৃথিবীর। ফলে হিমবাহ গলছে, বরফ গলা জল মিশছে সমুদ্রে। তার সাথে উপকূলের ক্ষয়, ঘনঘন বন্যা এবং সামুদ্রিক ঝড়। সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে জলস্তর আয়তনে ফুলে উঠছে, এর সাথে মাটির জলস্তর আরও কমে আসছে।
পেডারসন হিমবাহ (Pedersen Glacier) ১৯১৭ সালের ছবি (বামদিকে) আর আজকের ছবি (ডানদিকে) ২০০৫ সালে তোলা।
অতিরিক্ত উষ্ণতা এবং শুষ্কতার ফলে গত দশক জুড়ে সাইক্লোন এবং দাবানল বেশ স্বাভাবিক একটি ঘটনা। তবে ২০২৩ সালে কানাডার এই দাবানল সমস্ত রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। ১ লক্ষ ৩৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ৫৭০০টি দাবানল পুরো কানাডাকে বিধ্বস্ত করছে। ক্যুবেক-এর ওয়াইল্ডলাইফ ফায়ার সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে জ্বলেছে, তার আঁচ আটলান্টিক মহাসাগরে পেরিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপে পৌঁছে গেছে। ইয়েলোনাইফ শহর ঘিরে ২৩৬টি অ্যাক্টিভ দাবানল সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছেন ফায়ারফাইটাররা। এদিকে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার স্প্যানিশ ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ সেই আগুনে ছারখার হয়েছে। গ্রীস, পর্তুগাল পুড়ছে। আরও উত্তরের দিকে সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। ১২ হাজার মানুষকে ইভ্যাকুয়েট করা হয়েছে। অসংখ্য পর্যটককে উদ্ধার করা হয়েছে।
নাসার টেরা (TERRA, ল্যাটিন শব্দ, এর অর্থ পৃথিবী) স্যাটেলাইট-এর ইমেজিং স্পেকট্রোমিটার-এর এই ছবিতে দেখা গেছে ক্যুবেক-এর অরণ্যের আগুন কিভাবে ইউরোপ দখল করছে। অসংখ্য আদিবৃক্ষ, বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণ মুহূর্তে ছাই হয়ে যাচ্ছে। এমন তো আগেও হয়েছে বলে এড়িয়ে যাওয়া আর বোধহয় সম্ভব না। এই আগুন আরও লেলিহান হবে, আরও প্রসারিত হবে। এই ছবি খুব সহজে প্রমাণ করে আমরা আসলে কি ভয়ঙ্করভাবে জুড়ে আছি। এই মুহূর্তে পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র সাস্টেইনেবিলিটি ছাড়া আর কোনোকিছুকেই অগ্রাধিকার দিতে পারে না।
প্রথম ক্লাইমেট কনফারেন্স হয়েছিল জেনিভাতে, ১৯৭৯-র ফেব্রুয়ারি মাসে। গত ৪৫ বছরে পরিবেশগত পরিবর্তন কি কি হয়েছে? ওয়ার্ল্ড ব্যাংক জানিয়েছে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় ২২ কোটি মানুষ 'ক্লাইমেট রিফিউজি'তে পরিণত হবেন, সংখ্যাটা ব্রাজিলের জনসংখ্যার থেকেও বেশি। গত ২০ বছরে গ্রীন হাউস গ্যাস ৪৭% বেড়েছে, গত ৪০ বছরে হিমশৈলের ভরের ভারসাম্য প্রায় ২৫ মিটার জলের উচ্চতার সমতুল্য কমে এসেছে। জনসংখ্যার থেকেও বড়ো কথা জনঘনত্বের ভারসাম্য। কারণ পৃথিবীর গড় জনঘনত্ব ১৫ জন প্রতি বর্গকিলোমিটার, যেটা রেফারেন্স (৫০-৭০)-এর থেকে অনেক কম। কিন্তু বিভিন্ন দেশের মধ্যে খাদ্য এবং জনঘনত্বের যে অসঙ্গতি তার ভারসাম্যের চেষ্টা করা হয় না।
অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি।
১৯৯৭ সালে কিয়োটো প্রোটোকল গ্রহণের সময় রাষ্ট্রপুঞ্জে ১২টি দেশ একত্রিত হয়ে একটি 'আম্ব্রেলা গ্রুপ' তৈরি করেছিল। অস্ট্রেলিয়া, বেলারুশ, কানাডা, আইসল্যান্ড, ইসরায়েল, জাপান, নিউজিল্যান্ড, কাজাখস্তান, নরওয়ে, দি রাশিয়ান ফেডারেশন, ইউক্রেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৯-এর 'কোপেনহেগেন ক্লাইমেট সামিট' রাজনৈতিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ক্লাইমেট পলিটিক্স-এর দরজা খুলে যায় সেখানেই। ফ্রি মার্কেট ইকোনমি উৎপাদনের সাথে পরিবেশের ভারসাম্যে নষ্টের সরাসরি যোগাযোগ ঘটায়। এখন পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে অসংখ্য এনজিও, স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিকোলাই বুখারিন-এর আর্টিকল 'New Form of World Crisis' প্রকাশিত হয় 'The Labour Monthly' পত্রিকায়। সেখানে তিনি শিল্পবিপ্লব পরবর্তী আমেরিকা এবং ইউরোপের পুঁজিবাদী আধিপত্য বিস্তার এবং সমস্ত বিপদ সংকেত দিয়েছেন। বুখারিনের সাথে যদি মার্ক্সকে যোগ করি তাহলে ক্যাপিটালে পাই,
“Moreover, all progress in capitalistic agriculture is a progress in the art, not only of robbing the labourer, but of robbing the soil; all progress in increasing the fertility of the soil for a given time is a progress towards ruining the lasting sources of that fertility. The more a country starts its development on the foundation of modern industry, like the United States, for example, the more rapid is this process of destruction.”
২০১৫-র 'প্যারিস এগ্রিমেন্ট'-এর পরে পৃথিবীর প্রধান দেশগুলি 'রেস টু জিরো'-তে নেমেছে। অর্থাৎ কার্বন এমিশন-এর মাত্রা শূন্যে নামিয়ে আনার চেষ্টা। গত পাঁচ বছরে মাত্র ১৪টি দেশ এই উদ্যোগ নিয়েছে। সাতটি দেশে আইন তৈরি হয়েছে; সুইডেন, ইউনাইটেড কিংডম, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, হাঙ্গেরি। মাত্র দুটো দেশ জিরো কার্বন লক্ষ্যপূরণে সফল। দক্ষিণ আমেরিকার সুরিনাম এবং আমাদের প্রতিবেশী ভুটান। ভারত এই ব্যাপারে কোনও উদ্যোগই নেয়নি।
২০২১ সালে গ্লাসগোতে ক্লাইমেট কনফারেন্স 'COP26'-এর প্রধান লক্ষ্য ছিল গ্রীনহাউস গ্যাসের মাত্রা একদম কমিয়ে আনা এবং সারা পৃথিবীর কার্বন এমিশন-এর মাত্রা শূন্যে পৌঁছানো। সেখানে ডিফরেস্টেশন, কয়লা ব্যবহার, উষ্ণায়ন, আর্টিকল ৬, নেট জিরো, মিথেন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়। সাসটেইনেবল কৃষির জন্য ৪ বিলিয়ন ডলার ধার্য হয়েছিল। মজা হলো, এই সেমিনারগুলো স্পন্সর করে বেশিরভাগ ফসিল ফুয়েল কোম্পানিগুলি। সমস্ত পুঁজিবাদী দেশ অংশ নেয়। ব্রিটেন, আমেরিকা, ইউরোপ, ব্রাজিল, ভারত-এর সবথেকে বেশি ফসিল ফুয়েল ব্যবহারকারী, সবথেকে বেশি কার্বন ফুটপ্রিন্ট রাখা কর্পোরেট সংস্থাগুলি। গুগল সার্চ করলে মোস্ট পলিউটিং কোম্পানি হিসেবে সবার আগে নাম আসবে কোকাকোলা, পেপসিকো, নেসলের। তেল কোম্পানি, গাড়ির ব্যবসায়ী, ফ্যাশন ব্র্যান্ড, প্রসেসড খাদ্য প্রস্তুতকারক কোম্পানি সবথেকে বেশি জল ব্যবহার করে, তেল খরচ করে, বিলিয়ন টন কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিবেশে ছড়ায়। এরাই আবার ক্লাইমেট কনফারেন্স-এ পরিবেশ দূষণ নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করে। এদিকে অসংখ্য মানুষ রাস্তায় নামছেন, মিছিল করছে, স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা ধর্নায় বসছে।
জলবায়ু এবং জনস্বাস্থ্য একই মুদ্রার দুই পিঠ। ভারতের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য অপরিমেয়। উত্তরে হিমালয় পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম তুষার ভর, দক্ষিণে ৭৫০০ কিলোমিটার উপকূল এলাকা এবং দেশের ৭০ কোটি মানুষ কৃষি, অরণ্য এবং মৎসজীবি। প্রাকৃতিক সম্পদ ছাড়া তাঁদের বেঁচে থাকার বিশেষ অবলম্বন নেই। ভারতে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৪৮০ জন বাস করেন। জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা, খরা, তাপপ্রবাহ, সাইক্লোন তাঁদের প্রতি বছর প্রায় ২ কোটি মানুষকে গৃহহীন করে। জল এবং বায়ুবাহিত রোগ, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, অপুষ্টি আমাদের দেশের সবথেকে বড় সমস্যা। প্রায় ৩৫ শতাংশ শিশুর সঠিক বিকাশ হয় না। জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো এবং অর্থবরাদ্দ অপ্রতুল।
উপকূল রক্ষায় এক অনন্য প্রহরী ম্যানগ্রোভ। সমুদ্র এবং সভ্যতার সহাবস্থান ঘটিয়ে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। পৃথিবীতে ম্যানগ্রোভের বাস ১৫ কোটি বছর ধরে। অসামান্য কার্বন স্টোরেজ সিস্টেম। ছোট মাছেদের চারণভূমি। সবথেকে বড় কথা হলো ম্যানগ্রোভ বড়ো নরম, দুর্বল উদ্ভিদ। এদের বেঁচে থাকার লড়াই খুব কঠিন। উষ্ণায়নের কবলে পড়ে এরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে বলে ম্যানগ্রোভ বাঁচানো আরও মুশকিল হয়ে পড়ছে। ২০১৫ সালে ইউনেস্কো ২৬ জুলাই দিনটিকে 'বিশ্ব ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেম সংরক্ষণ দিবস' হিসেবে বেছে নেয়। শুধু ম্যানগ্রোভ চারা রোপণ করে এই ইকোসিস্টেমকে বাঁচানো সম্ভব না। কারণ মাটিকে ধরে রাখার শিকড় একবার নষ্ট হয়ে গেলে তাকে স্বাভাবিকভাবে ফেরানো মুশকিল। ২০০০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের প্রায় ১১০ বর্গ কিলোমিটার ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হয়েছে।
এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে ১৭৭৬ থেকে ২০১৪ অবধি, গত ২৩৮ বছরে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ কভার কিভাবে শেষ হয়ে আসছে। এই পেপারটি ২০১৫ সালে 'ডাইভারসিটি' জার্নালে প্রকাশিত। সরকারি স্তরে উদ্যোগ না নিলে সুন্দরবনের মতো বায়োস্ফিয়ার ঘনবসতিতে ভরে যাবে। প্রায় বাফার অঞ্চল অবধি মানুষ ঢুকে পড়েছে। এরপর কি? প্রাকৃতিক উপায় ছাড়া ম্যানগ্রোভ বাঁচে না। তাই ম্যানগ্রোভকে সংরক্ষণ করতে হবে। এছাড়া শহর, সভ্যতাকে রক্ষা করার কোনো পথ নেই। যেমন সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য শহর কলকাতার বর্ম। কলকাতা বেঙ্গল বেসিন-এর অংশ। গঙ্গা থেকে ৯ মিটার উঁচু। স্বাভাবিক ঢাল পশ্চিম থেকে পুবে। কলকাতার আকার গামলার মতো। মাঝখান ঢালু। কলকাতার মাটি পলিমাটি। কম ছিদ্রযুক্ত। জল শোষণ কম হয়। শহরের নিকাশি ব্যবস্থা ১৪০ বছরের পুরনো। ১৯৪৭ এবং ১৯৭০-এর পরে যখন জনসংখ্যা বেড়েছে এবং তারপর যে দ্রুতহারে নগরায়ণ হয়েছে সেসব কোনো প্ল্যান করে হয়নি। বিশেষ করে বস্তি অঞ্চল। এই কংক্রিটের জঙ্গল অত পুরোনো নিকাশি ব্যবস্থা সামলাতে পারছে না। তাছাড়া প্লাস্টিকের ব্যবহার চূড়ান্ত বেড়েছে। বঙ্গোপসাগরের উচ্চতা আরব সাগরের তুলনায় প্রায় ৪ গুন বেগে বাড়ছে। তাই সুন্দরবনের ক্ষতি কলকাতার প্রত্যক্ষ ক্ষতি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ভয়াবহতা বাড়ছে। কিছুদিন আগেই মাত্র কয়েক মিনিটের ঝড়ে জলপাইগুড়ি লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। আয়লা, উম্পুনের মতো উপকূলের ঝড়ের তীব্রতা বাড়ছে। আমরা ভাবতেও পারছিনা কি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। তাই হয়তো এখনও ম্যানগ্রোভ আমাদের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। কিন্তু এই বিষয়টি আন্দোলনের পর্যায়ে না পৌঁছলে অচিরেই উপকূলবর্তী শহরগুলি শেষ হয়ে যাবে।
জলবায়ু সংকট ভারতকে প্রায় খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। Water Quality Index-এ ভারতের স্থান মোট ১২২টি দেশের মধ্যে ১২০তে। ভারতের ৭০ শতাংশ জল দূষিত। বেঙ্গালুরু, চেন্নাই ইতিমধ্যেই ভূগর্ভস্থ জলের অভাবে ধুঁকছে। ইয়েল ইউনিভার্সিটির Environmental Performance Index-এ ১৮০টি দেশের তালিকা আছে। Water and Sanitation-এর নিরিখে প্রথম দশে সেই ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্ক। আর আশপাশে কেনিয়া, বুরুন্ডি, ইথিয়োপিয়াকে নিয়ে ১৪৫-এ ভারত। Environmental Health Index-এ ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারত ১৭২তম স্থানে। যমুনার দূষণ সব মাত্রা অতিক্রম করেছে। একটি কৃষিপ্রধান, নদীমাতৃক দেশ কৃষিতে ১০৮তম স্থানে!
ভারতের 'Environmental Impact Assessment (EIA) 2020' ড্রাফট তীব্রভাবে পরিবেশ বিরোধী। বিশ্বায়ন এবং উন্নয়নের নামে নির্বিচারে প্রকৃতিকে ধ্বংস করার ছাড়পত্র। প্রায় পাঁচ বছর ধরে কর্পোরেটের হাতে কৃষি তুলে দিতে মরিয়া এই সরকার। ভারতে গত ৩০ বছরে প্রায় ২৪ হাজার প্রজেক্ট-এর জন্য প্রতি বছর গড়ে ৪৬ হাজার হেক্টর জঙ্গল কেটে ফেলা হয়। এই সময়ে উষ্ণায়ন, কার্বন ফুটপ্রিন্ট বেড়ে যাওয়া এবং প্রাকৃতিক পলিনেটরদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে আসার পরেও এমন প্রস্তাবনা কোনও দেশ কিভাবে আনতে পারে, পরিবেশবিদদের কাছে সেটা সবথেকে বড় প্রশ্ন।
পৃথিবীর ইতিহাসে যত উল্লেখযোগ্য পরিবেশ আন্দোলনের কথা লেখা আছে, তার সূচনা মূলত ১৯৬০-এর আশেপাশে। তার অনেক আগেই ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫১ আমাদের সাস্টেইনেবল ভবিষ্যৎ-এর নাগরিক দায়িত্ব লিপিবদ্ধ করেছিল।
“It shall be the duty of every citizen of India to protect and improve the natural environment including forests, lakes, rivers and wildlife and to have compassion for living creatures.” - Article 51-A (g), Indian Constitution.
সুতরাং, পরিবেশের উপর যা কিছু ভার আমরা অর্পণ করছি, সবটাই অসাংবিধানিক।
তবু আশার আলো দেখা যায় মাঝে মাঝে। এবছরই সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তে এই প্রথম, স্বাধীনভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই সংবিধানসম্মত হলো। ১৯৭২ থেকে ২০২২ অবধি অসংখ্য এনভায়রনমেন্ট অ্যাক্ট তৈরি হয়েছে, কিন্তু জলবায়ুকে ইকোলজির থেকে আলাদা করে দেখার এবং মানবাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করার এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। রাজস্থান এবং গুজরাটের 'দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড' প্রায় লুপ্ত হয়ে যাবার কারণে ২০২১ সালে যে মামলা শুরু হয়েছিল, তার রায়ের সাথেই এই জাজমেন্ট পাশ হয়েছে গত ২১ মার্চ। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সংবিধানের আর্টিকল ১৪ এবং আর্টিকল ২১ অর্থাৎ সমতার অধিকার এবং জীবনের অধিকারের মধ্যে পড়ে। জলবায়ুর সাথে দূষণ, খাদ্যসংকট, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রকৃতি সবার। এই সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে ধনী এবং গরীবের এই মেরুকরণ সংবিধান বিরুদ্ধ।
"Despite governmental policy and rules and regulations recognising the adverse effects of climate change and seeking to combat it, there is no single or umbrella legislation in India which relates to climate change and the attendant concerns. However, this does not mean that the people of India do not have a right against the adverse effects of climate change."
"Right against climate change recognised as a fundamental right in India."
"Climate crisis threatens Right to Life, equality."
২০২২ সালে শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারতের জিডিপির ৮ শতাংশ লোকসান হয়েছে। ২৭০ বিলিয়ন ডলার। সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রকে বাধ্য করবে সাস্টেইনেবল ডেভেলপেমেন্ট, বিকল্প শক্তির ব্যবহার এবং ইকোসিস্টেম সংরক্ষণে। লোকদেখানো জিরো কার্বন আর সোলার প্রজেক্ট-এর প্রোপাগান্ডার আড়ালে একের পর এক আদিম গাছ কাটা, ফসিল ফুয়েল ব্যবহার, প্রকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করা যাবে না আর।
যশোর রোডের আদিবৃক্ষ ধ্বংসের বিরুদ্ধে মানুষের সংঘবদ্ধ হওয়া, দেউচা পাচামীর কয়লাখনির বিরুদ্ধে আন্দোলন, মনিপুরের জাতিযুদ্ধ থেকে লাদাখের ষষ্ঠ তফসিলে স্বায়ত্তশাসনের দাবি, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে পরিবেশ, জলবায়ু, ইকোসিস্টেম, জমির অধিকারের লড়াই জড়িয়ে আছে। প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থানের ক্ষেত্রে জীববৈচিত্র্য রক্ষার গুরুত্ব অসীম। বিকল্প শক্তির ব্যবহার, গ্রীন লাইফস্টাইল, দূষণমুক্ত যানের ব্যবহার, রিসাইক্লিং, প্লাস্টিক বর্জন করা, কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, জল সংরক্ষণ, গাছের সংখ্যা বাড়ানো, এমন বহু নাগরিক দায়িত্ব হয়তো এই সংকট কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কিন্তু এই লড়াই অনেকটা বৃহৎ, অনেক সুদূরপ্রসারী। রাষ্ট্রের নীতিগত পদক্ষেপ ছাড়া এই ধ্বংসের মোকাবিলা অসম্ভব।
তথ্যসূত্রঃ
• ডাইভার্সিটি
• ওয়ার্ল্ড ব্যাংক
• 'নেচার' পত্রিকা
• ইউনাইটেড নেশনস ক্লাইমেট, অক্সফ্যাম ইন্টারন্যাশনাল
• ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম
• ন্যাশনাল এরোনটিক্স এবং স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা)
• ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
• ন্যাশনাল ওশ্যানিক এন্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নোয়া)
[লেখিকা গবেষক ও 'প্রসার ভারতী'-তে বিজ্ঞান আলোচক।]