বিবিধ

সুজন - সুন্দরবন (দ্বিতীয় পর্ব)



ডাঃ অরুণোদয় মণ্ডল


[দীর্ঘ ২৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে ডাঃ অরুণোদয় মণ্ডল উত্তর চব্বিশ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ-এ রায়পাড়া সাহেবখালি অঞ্চলে 'সুজন' নামে একটি দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র চালাচ্ছেন। বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে 'সুজন' আজ একটি সেবা প্রতিষ্ঠান (Charitable Trust)-এ পরিণত হয়েছে। শারীরিকভাবে অসুস্থ, আর্ত ও অসহায় মানুষদের হয়ে কাজ করতে গিয়ে নানা সামাজিক প্রতিকূলতাকে নিজের অদম্য জেদ, সততা ও আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে একজন চিকিৎসকের জয়ী হওয়ার কাহিনীই নিজের কলমে লিখেছেন ডাঃ অরুণোদয় মণ্ডল। মানুষের পাশে থাকার, অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাদের সেবাপ্রদান করার তাঁর নিরলস মানবিক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২০ সালে ভারত সরকার তাঁকে 'পদ্মশ্রী' সম্মানে ভূষিত করেন। বকলমে এই জয় সাধারণ মানুষেরই জয়। এই লেখায় মূলত 'সুজন' গড়ে ওঠার প্রাক-কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে আজকের কিছু কথাও এসেছে। লেখাটি ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ করতে পেরে 'ডটপেন ডট ইন' ই-পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী ডাক্তারবাবুর কাছে কৃতজ্ঞ।]


শুরুর দিকে রাস্তার বেহাল দশা ছিল।


'সুজন'-এ অপেক্ষারত রোগীরা।

সেদিন শনিবার। আগের দিন অর্থাৎ শুক্রবার বিকেলে পৌঁছে গেছি পৈতৃক বাড়ী চাড়ালখালিতে। সকাল থেকেই রোগীদের আগমন। সকালবেলা চা-বিস্কুট খেয়ে রোগী দেখতে বসা। সকাল ৭টা থেকে শুরু - চলে যতক্ষণ সব রোগী দেখা শেষ না হয়। তা সে বিকেল ৩টে হতে পারে, কখনও কখনও ৪টে-৪:৩০টাও বেজে যায়। তারপর হাতমুখ ধুয়ে দুপুরের খাওয়া। মা ও বৌদি দুজনে মিলে ভাত-ডাল ও মাছের ঝোল রান্না করে দেয়। সন্ধ্যেবেলা স্নান সেরে বিশ্রাম। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়া। রবিবার ভোর থেকেই আবার রোগী দেখা। দুপুর ১:৩০টা - ২:০০টোর মধ্যে রোগী দেখা শেষ করে কলকাতার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া, শনি-রবিবার মিলিয়ে প্রায় ২৫০ জন রোগী। তখন রোগী দেখে প্রেসক্রিপশন করে দিতাম - ঔষধপত্র দেওয়ার কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। এক শনিবার সকালে ১২-১৪ বছর বয়সের একটি মেয়ে এলো দেখাতে - ডান হাতে ব্যান্ডেজ। রক্তে ব্যান্ডেজটি ভিজে জবজব করছে। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই মেয়েটির মা যা বললো - তা শুনে আঁতকে উঠলাম। মাসখানেক আগে বিলে মাছ ধরতে গিয়ে তার ডানহাতের মধ্যমায় ট্যাংরা মাছের কাঁটা ফুটে যায়। তখন জোর করে টেনে কাঁটাটি বের করা হল বটে, কিন্তু আঙুলের অগ্রভাগ ফুলে রইল। দুদিন বাদে গ্রামীন এক চিকিৎসদের শরণাপন্ন হলেন তারা। সংক্রমণ হয়েছে ভেবে তিনি antibiotics খেতে দিলেন। একবার নয়, একাধিক বার নানাবিধ antibiotics দিয়েও কোনও সমাধান হল না। অগত্যা তিনি বিধান দিলেন - Cancer হয়েছে বলে! উপায় - অপারেশন করে মধ্যমার অগ্রভাগটি কেটে বাদ দিলেন তিনি। ভালোভাবে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন কিন্তু তিনি ছোট ছোট ধমনীর bleeding বন্ধ করতে পারেননি। ফলে ক্রমাগত রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে ব্যান্ডেজটি ভিজে গেছে। আমি অতি সন্তর্পণে ব্যান্ডেজটি খুলে জায়গাটা পরিষ্কার করে antibiotic ointment দিয়ে pressure bandage করে হাতটা উঁচু করে রাখতেই bleeding বন্ধ হয়ে গেল। আসলে ট্যাংরা মাছের কাঁটা থেকে একটি foreign body granuloma হয়েছিল। হয় excision অথবা copper sulphate বা তুঁতে দিয়ে cauterisation বা ঘষে দিলেই granuloma-টা বহু অংশে শুকিয়ে যায়। সেক্ষেত্রে excision বা operation-এর কোনো প্রয়োজন পড়ে না। অন্যথায় local anesthesia করে granuloma-টা কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। তবে কোনওভাবেই amputation করতে হয় না। অস্ফুটে বলে ফেললাম - হতভাগিনী, দুদিন আগে আসতে পারলি না আমার কাছে। তাহলে তোর এতবড় সর্বনাশ হতো না। গরীব ঘরের সন্তান, তারপর ডানহাতের মধ্যমার অগ্রভাগ - বিয়ের আগে কত না কৈফিয়ৎ দিতে হবে, এমনকি বিয়ের পরও কত না শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রনা সইতে হবে। নিজের শিক্ষা-দীক্ষার উপর ঘৃণা জন্মালো। কি হবে এই শিক্ষা বা সামাজিক প্রতিপত্তি বা অর্থবিত্ত? এই শিক্ষা কি শুধুই নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য অর্থ রোজগার? যে শিক্ষা সাধারণ দরিদ্র মানুষের প্রয়োজনে আসে না - কি হবে সে শিক্ষার বড়াই করে?


চেম্বারে রোগী দেখা চলছে।


'মেডিসিন কাউন্টার' থেকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ওষুধ নিচ্ছেন জনৈক রোগী।

ঠিক তেমনি, একদিন সকালে কলকাতা থেকে আসছি সুজন-এ, রুটিন মাফিক। লেবুখালির খেয়াঘাটে দাঁড়িয়ে আছি আমি খেয়ার নৌকার অপেক্ষায়। হঠাৎ দূর থেকে চাপা কান্নায় আওয়াজ। দেখি দূরে অন্য পাড়ে একটি ছোট জটলা। সেখান থেকেই কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। অষ্টাদশী রূপা রাতে শুয়েছিল অন্য অনেকের সাথে বারান্দায়। চৈত্র মাসের রাত - অসম্ভব গরম, কালরাত্রি - পরের দিন বৌভাত বা ফুলশয্যা। কত সাধ ছিল মনে - স্বামী-পুত্র-পরিবার নিয়ে সুখে ঘর-সংসার করবে। কিন্তু সব সাধ অপূর্ণ রেখে বেনারসী পরেই চেপে বসল কলার ভেলায়। কালাচের কামড় অতটা তীব্র না হওয়ায় 'পোকায় কামড়েছে' বলে শুয়ে পড়া। সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাই দেখে রূপার মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। ওঝা-বদ্যি ডেকে সবাই মিলে অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে বেহুলার মতো কলার ভেলায় চেপে বসল হয়ত লখিন্দরকে ফিরিয়ে আনার জন্য, না অন্য কিছু? সবার মাঝেই শুয়েছিল রূপা। কিন্তু মা মনসার তো ওকেই পছন্দ। তাই নীরব দংশন।


অক্সিজেন সিলিন্ডার পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।


আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা বহু মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল 'সুজন'-এর এই 'মেডিসিন ব্যাংক'।

খুব ব্যথা পেয়েছিলাম সেদিন। নিজের অজান্তেই গাল বেয়ে দু'ফোঁটা অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়েছিল। মাস দুয়েক আগে নবম শ্রেণীর রূপা রোগী হয়ে এসেছিল সুজন-এ। তার নতুন জীবনের সাক্ষী হতে নিমন্ত্রণও করেছিল বিয়েতে। যাওয়া হয়নি - তাই অপরাধবোধটাও ভয়ংকরভাবে জেগে উঠল। সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম - আর কলকাতায় ফিরে যাওয়া নয়, থেকে যাব গ্রামীণ এই প্রান্তিক মানুষগুলোর কাছে - তাদের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে।

(ক্রমশ)

আলোকচিত্রঃ লেখকের কাছ থেকে প্রাপ্ত।

'সুজন'-এর ওয়েবসাইট লিঙ্কঃ www.sujan-sundarban.org

লেখাটি পড়ে কেমন লাগলো? আপনার মতামত জানান এই লিঙ্কে ক্লিক করে -
https://dotpen.in/feedback/