আশ্চর্য মৃত্যুর সন্ধানে শিকড় খুঁজছি। এ জীবনের গাছ, ডাল, পাতা শুকিয়ে এলে আমরা সবাই শিকড় সন্ধানী। স্বপ্নের কাহিনি রূপকথায় লেখার আগেই ঘুম ভেঙে যায়। গলা শুকিয়ে যায়। তৃষ্ণায় নিজের থুতু গিলে পাশ ফিরে শুই। আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। স্বপ্ন বদলে যায়। লেখা বদলে যায়। লিখনশৈলী বদলে যায়। আমিও বদলে যাই শিকড় সন্ধানে।
নিজের ঘুমের ভিতর আমি হাসি, কাঁদি, ভয় পাই, প্রতিবাদ করি, মার খাই, মার দিই আর স্বপ্নের ভিতর আমার এই জেগে থাকাগুলোকে উপভোগ করি। ঘুম ভাঙলে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। হাসি না, কাঁদি না, মারি না, প্রতিবাদ করি না। শুধু ভয় পাই আর মার খাই। মার খাই আর ভয় পাই। ভয় পাই আর ভুলে যাই নিজের পরিচয়, অধিকার, দায়িত্ব। শুধু দায় কাঁধে নিয়ে শিকড়ের সন্ধানে স্বাধীন হবার পরাধীন চেষ্টা চলে।
এ পরাধীনতার বর্ণ নেই, গন্ধ নেই, স্বাদ নেই। অমৃতের মতো পরাধীনতার স্বাধীন শিকড় খুঁজে জল দিই। নিজেকে স্বৈরাচারী করতে না পেরে স্বৈরতান্ত্রিক গণতন্ত্রের শিকড় বানিয়ে ফেলি। আমি বাঁচবার জল শুষে মরবার প্রস্তুতি নিই। মরতে মরতে বেঁচে থাকি, নিজেকে বেঁধে রাখি আশ্চর্য মৃত্যুর সন্ধানে।
অনুভূতিহীন মৃত্যুর প্রার্থনাসভা চলে দেশে, রাজ্যে, জেলায়, পাড়ায়। কখনও কখনও ঘরে, পরিবারে এবং নিজের ভিতরে। নিজের অজান্তে নিজেকে খুন করে আমরা তৃষ্ণার জল জোগাড় করতে শিকড় সন্ধান করি। আর আমাদের শিকড় কবেই কাটা পড়েছে উন্নয়ন আর বিকাশের ঝাঁ চকচকে রাস্তার সম্প্রসারণে।
আশ্চর্য মৃত্যুর সন্ধান মিলেছে। যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আমরা মৃত্যুকেই জীবন নামে চিনতে শিখেছি। দশচক্রে ভগবান ভূত হয়েছেন। ভবিষ্যতও হবেন। শুধু আমরা নিজেদের শুকিয়ে নিজেদেরই চিতার কাঠ হিসাবে বানাতে বানাতে রাম নাম জপছি।
অযোধ্যা কান্ড শেষ করে ঢুকে পড়ছি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে। রামায়ণের মাহাত্ম্যে মহাভারত ক্রমশ উজ্জ্বল সম্ভাবনায় ঢুকে পড়েছে আমাদের জীবনে। রাজসভায় দ্রৌপদীদের বস্ত্রহরণের গল্প সত্যি হয়েও শুধুমাত্র খবরে থেকে যায়। ধর্মের জন্য কোনও যুদ্ধ নেই। সবটাই 'অশ্বত্থামা হত, ইতি গজ'-র মতো জবানবন্দি। রথের চাকা মাটি ছুঁলেও যুধিষ্ঠির এখনও ধর্মপুত্র।
অথচ শিকড়ের সংবাদসূত্র নেই। শিকড়টাইবার আছে কিনা জানি না। নিজেকে হারিয়ে ফেলে নিজেকে খোঁজার কাজে অলস ভাবনা ঘিরে ধরে। পরজীবী উদ্ভিদের জীবন কাটিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি ঘুমানোর। যে ঘুমে আমরা নিজেদের মৃত্যুদিন লিখি। লিখতে লিখতে পাশ ফিরতে ভুলে যাই। খেতে ভুলে যাই। গাইতে ভুলে যাই। সুন্দর ফুলের দিকে তাকাতে ভুলে যাই। কিন্তু উৎসবে নেচে উঠতে ভুলি না। নাচতে নাচতে এক আশ্চর্য মৃত্যুর দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। যেখানে জীবনের মোড়কে ভয়ংকর সুন্দর এক মৃত্যু আমাদের প্রত্যেকের জন্য অপেক্ষা করছে। জেগে জেগে, স্বপ্নের ভিতর নাচতে নাচতে আমরা সেই মৃত্যুর শিকড় সন্ধানের শেষ পর্যায়ে এসে পড়েছি। এবার জন্ম, মৃত্যু, বেঁচে থাকার অভিধান বদলাবে। বদলাবে নাগরিক সংবিধানও।