প্রবন্ধ ও নিবন্ধ

স্বামী বিবেকানন্দ ও বিজ্ঞান



ডঃ অমিয়কুমার মজুমদার



নিউ ইয়র্ক-এ স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৯৫)।

ঊনবিংশ শতাব্দীর অস্থিরচিত্ত বাংলাদেশে তথা ভারতভূমিতে কয়েকজন মনীষী দিব্যদৃষ্টি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন যাঁরা তাঁদের দিব্যচেতনার সার্চলাইট দিয়ে মোহাচ্ছন্ন জাতির জড়তা নাশ করেছিলেন। সিপাহীবিদ্রোহের পর থেকেই বাংলা দেশে আসে জন-জাগরণের প্রবল জোয়ার। একথা অনস্বীকার্য যে পাশ্চাত্য জ্ঞান ও বিজ্ঞানের জাহ্নবীধারায় অবগাহন ক'রে জাতীয়তাবাদের নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিল নবারুণে আলোকিত তরুণ বঙ্গ সন্তানের দল। চপলতা-উচ্ছ্বলতার (অনেকের মতে উচ্ছৃঙ্খলতার) মদিরাপানে মধু-যুগীয় ইয়ং বেঙ্গলের আরক্ত চোখ স্বাজাত্যবোধের নব অনুভূতিতে স্নিগ্ধ হয়ে এল। বাংলা দেশের শিক্ষিত মানুষের প্রাণে নতুনতর চৈতন্যের সঞ্চার হ'ল।

রামমোহন থেকে যে জাগরগী গানের সূচনা, দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথামৃতে তারই এক রক্তকমল ফুটে উঠল; রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দের দৃষ্টির অনুরাগে সিঞ্চিত হয়ে শতদলে তা আত্মপ্রকাশ করলো। পরাধীনতার এবং সহজ বিলাসের আবর্তে মজ্জমান উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের মানুষের নির্জীব বিবেকের ঝুঁটি নেড়ে তাদের অস্তমিত চৈতন্যের ম্লানিমা দূর ক'রে পুনর্জাগরিত করতে চেয়েছিলেন যিনি - তিনি চাবুক হাতে নিয়ে জনগণেশের আসরে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি স্বামী বিবেকানন্দ। একটা প্রকাণ্ড দেশের স্তিমিত বীর্যকে তিনি কর্ম দিয়ে, বাক্যের কশাঘাত দিয়ে সজীব ক'রে তুলেছিলেন; কেবল তাই নয়, অধীনতার তমিস্রায় সুপ্তিমগ্ন জাতিকে তিনি বিশ্বের দরবারে সকলের দৃষ্টির সামনে তুলে ধরেছিলেন। গৈরিক বসনে রঞ্জিত আবরণের অন্তরালে যে মানুষটিকে একদিন শিকাগোর ধর্মমহাসম্মেলনে হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যা ক'রে জগৎ মাতিয়ে দিতে দেখা গিয়েছিল তিনি দার্শনিক ও মানবদরদী তো বটেনই, উপরন্তু তিনি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিসম্পন্ন আধুনিক।

তিনি কেবলমাত্র অধ্যাত্মজগতের বাসিন্দা ছিলেন না, তৎকালীন অন্যান্য সন্ন্যাসীর মতো তিনি বিজ্ঞানের বিরোধিতা তো করেনই নি, বরং তিনি ছিলেন পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক মেজাজের। এক দুর্লভ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী ছিলেন বলেই তিনি অধ্যাত্মজগতের নানা তত্ত্ব কুসংস্কারের জটাজাল থেকে বিমুক্ত ক'রে সর্বজনগ্রাহ্য ক'রে তুলতে পেরেছিলেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে যে রেনেসাঁ এসেছিল তার প্রধান কারণ পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও দর্শনের প্রভাব এদেশের তরুণ সম্প্রদায়কে প্লাবিত ক'রে ফেলেছিল। সেই তরুণ গোষ্ঠীর মধ্যে ছিলেন - জগদীশচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, প্রফুল্লচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখেরা।

বিজ্ঞান মানুষকে দেয় বিচারের ক্ষমতা, এনে দেয় জ্ঞানচক্ষু। এর অভাবে অনেকেরই দৃষ্টিশক্তি হয়নি স্বচ্ছ। আমাদের দেশে একটি কথা প্রবাদের মত চলে আসছে - তা হচ্ছে বিজ্ঞান ও সাহিত্যের মধ্যে বিরোধ। ধর্ম সম্বন্ধে তো কথাই নেই। মঠে, আশ্রমে যাঁরা থাকেন তাঁদের প্রতি অধিকাংশই উন্নাসিকতা প্রকাশ করে। এর প্রাবল্যে তাঁদের অবৈজ্ঞানিক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে করুণা প্রকাশ করতেও দ্বিধা বোধ করি না। বিবেকানন্দ-ই সর্বপ্রথম যিনি ধর্মের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ক'রে তাকে প্রতিষ্ঠিত ক'রে যান।

বিজ্ঞানের সংজ্ঞার পরিবর্তন ঘটলেও একথা সত্য যে প্রতি বিষয়কে বিশেষভাবে জানার নামই বিজ্ঞান। এই অনুসন্ধিৎসা বৃত্তি মানুষকে বৃহত্তর ও মহত্তর কার্যে অনুপ্রেরণা দেয়। স্বামী বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী, কিন্তু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী কোনক্রমেই অবৈজ্ঞানিক ছিল না তা তাঁর ভাষণ ও লিখিত গ্রন্থাবলী প্রমাণ করে।

কৈশোরেই বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন, যদিও স্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষার দিকে দৃষ্টি দেওয়া হ'ত না বললেই চলে। অতি শৈশবে অঙ্কশাস্ত্রের প্রতি বিরাগ থাকলেও কলেজীয় জীবনে সেই বিরাগ পরিণত হ'ল অনুরাগে। কলেজে পাঠকালীন সময়ে গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ অনুভব ক'রে তা অনুশীলন করেছেন নিজের খেয়ালে, নিজের আনন্দবিধানের জন্য। এ বিষয়ে স্বামীজীর অন্যতম জীবনীকার প্রমথনাথ বসু লিখেছেন[১];

কলেজে অধ্যয়নকালে নরেন্দ্রনাথ যে-সকল বিষয় আয়ত্ত করিবার জন্য বিশেষ যত্ন করিয়াছিলেন তন্মধ্যে গণিত ও গণিত-জ্যোতিষ (Astronomy) অন্যতম। জ্যোতিষে তাঁহার সবিশেষ অধিকার জন্মিয়াছিল। চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণীতে পড়িবার সময় তিনি 'Godfrey's Astronomy' নামক পুস্তকখানি সমগ্র আয়ত্ত করিয়াছিলেন এবং উচ্চাঙ্গের গণিত (Higher Mathematics) অভ্যাসে সাতিশয় আনন্দ অনুভব করিতেন।

পরবর্তী অধ্যায়ে যখন সারা ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়িয়েছেন পরিব্রাজকরূপে, তখন নানাস্হানে বিজ্ঞান প্রসঙ্গ তুলে আলোচনা করেছেন বৈজ্ঞানিকের মত। বিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হলে যে বিশেষ মুন্সীয়ানার প্রয়োজন তা তাঁর মধ্যে দেখে বিজ্ঞানীরা বিস্মিত হয়েছেন তার প্রমাণ এদেশে এবং বিদেশে ছড়িয়ে আছে। বিজ্ঞান বিষয়ে কথা বলা বা দর্শনের জটিল তত্ত্ব বিজ্ঞানের সূত্রের সাহায্যে অথবা উপমার সহায়তায় বিশ্লেষণ করা সহজসাধ্য নয়।

বিষয়বস্তুর উপর বিশেষ অধিকার জন্মালে তবেই তা সম্ভব। স্বামী বিবেকানন্দ নিজের চিত্তের তৃপ্তির জন্য আস্বাদন করেছিলেন বিজ্ঞানের রসসমুদ্র। নিজের চিন্তাধারার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বাবলী। তারপর তা ছড়িয়ে দিয়েছেন কথায়, লেখায় ও কর্মে।

খেতড়ি রাজ্যের মহারাজার* সঙ্গে (স্বামীজীর শিষ্য) 'নিয়ম' বা 'Law' সম্পর্কে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে বর্তমান যুগের বিজ্ঞানের সঙ্গে সাংখ্যের সিদ্ধান্তগুলির বিশেষ ঐক্য আছে। সেখানে বিজ্ঞানের প্রসঙ্গ প্রায়ই আলোচিত হ'ত। স্বামীজী মহারাজকে বিজ্ঞানের বিষয় আলোচনার জন্য খুব উৎসাহ দিতেন এবং সজোরে অভিমত প্রকাশ করতেন যে এদেশে বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও তত্ত্ব সংগ্রহেব বহুল প্রচলন একান্ত প্রয়োজন। শুধু অভিমত প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হননি। মহারাজের জন্য কয়েকখানি সরল বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ (Science Primer) এবং যন্ত্রাদি এনে নিজে তাঁকে কিছুদিন শিক্ষা দেন। পরে নিয়মমত শেখানোর জন্য একজন শিক্ষক নিযুক্ত হন।

১৮৯২ সালের অক্টোবরে বোম্বে প্রেসিডেন্সীর অন্তর্গত বেলগাঁওতে (অধুনা মহীশূব প্রান্তে) থাকাকালীন যাঁরা স্বামীজীর সংস্পর্শে এসেছিলেন তাঁরা তাঁর জড় বিজ্ঞান, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূতত্ত্ব এবং উচ্চগণিতে অসাধারণ অধিকার দেখে বিস্মিত হতেন। ধর্মসম্পর্কীয় জটিল প্রশ্নের সমাধান করতেন বিজ্ঞানসম্মত উদাহরণের সাহায্যে। বেলগাঁও-এর তদানীন্তন ফরেষ্ট অফিসার হরিপদ মিত্র বলেছেন[২] -

"আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সকল বিভাগেই, যথা - Chemistry (রসায়ন), Physics (পদার্থবিদ্যা), Geology (ভূবিদ্যা), Astronomy (জ্যোতির্বিদ্যা), Mixed Mathematics (মিশ্রগণিত) প্রভৃতিতে তাঁহার (স্বামীজীর) বিশেষ দখল ছিল এবং তৎসংক্রান্ত সকল প্রশ্নই অতি সরল ভাষায় দুইচারি কথায় বুঝাইয়া দিতেন। আবার ধর্মবিষয়ক মীমাংসাও পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সাহায্যে ও দৃষ্টান্তে বিশদভাবে বুঝাইতে এবং ধর্ম ও বিজ্ঞানেব যে একই লক্ষ্য - একই দিকে গতি, তাহা দেখাইতে তাঁহার ন্যায় ক্ষমতা আর কাহারও দেখি নাই।"

শুধু তাই নয় কলেজীয় জীবনে প্যাথলজি এবং জু'লজির নানা গ্রন্থ সাগ্রহে পড়তেন[৩]। পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, প্রভৃতি আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্বাদি নিয়ে তিনি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যেভাবে আলোচনা করতেন তাতে তাঁরাও যথেষ্ট বিস্মিত হতেন এমন অনেক নিদর্শন আছে। মহীশূর রাজসভাতে এক তড়িৎ বিজ্ঞানীর সঙ্গে আলোচনায় তিনি ঐ বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের প্রগাঢ়তা দেখিয়েছেন। বিদেশে গিয়ে অনেক বিজ্ঞানীর সঙ্গে পরিচিত হন। তাঁদের সঙ্গে বিজ্ঞান বিষয়ে নানা আলোচনায় অশেষ পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন। পরে এ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

বিজ্ঞান প্রীতি যে তাঁর নিছক সখের ছিল না তার প্রমাণ তাঁর সমগ্র জীবনের কর্মসাধন। বিজ্ঞান সাধনার সঙ্গে বেদান্ত আর ব্রহ্মচর্যকে একসূত্রে গেঁথে নতুন শিক্ষাপদ্ধতির প্রবর্তন করতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেনঃ

"আমাদের চাই কি জানিস - স্বাধীনভাবে স্বদেশী বিদ্যার সঙ্গে ইংরেজী আর Science (বিজ্ঞান) পড়ানো; চাই Technical Education (কারিগরি শিক্ষা), চাই যাতে industry বাড়ে; লোকে চাকরি না ক'রে দু-পয়সা ক'রে খেতে পারে।"[৪]

শিক্ষাব্যবস্থার যে ধারা তৎকালীন ভারতবর্ষে চলে আসছিল তিনি তার বিরোধী ছিলেন। বিদ্যাশিক্ষার মধ্যে নতুন শক্তিসঞ্চার করা প্রয়োজন তা তিনি অনুভব করেছিলেন। বলেছেন, "পণ্ডিতমশাইরা হাত বাড়িয়ে বিদ্যাটা টেনে নিয়ে টোল খুলেই দেশের সর্বনাশটা ক'রে বসেছেন।" তাই তিনি নতুন পথের নিশানা দিলেন। বাল্যবন্ধু প্রিয়নাথ সিংহের কথার জবাবে তিনি বললেনঃ

"এখন তোদের কি করতে হবে জানিস? প্রতি গ্রামে প্রতি শহরে মঠ খুলতে হবে। পারিস কিছু করতে? কিছু কর। কলকাতায় একটা বড় ক'রে মঠ কর। একটা ক'রে সুশিক্ষিত সাধু থাকবে সেখানে, তার তাঁবে Practical Science (ব্যবহারিক বিজ্ঞান) ও সব রকম Art (কলাকৌশল) শেখাবার জন্য প্রত্যেক branch-এ specialist সন্ন্যাসী থাকবে।"[৫]

এই প্রসঙ্গে টাটা শিল্প প্রতিষ্ঠানের মহান প্রতিষ্ঠাতা স্যার জামসেদজী টাটার একটি চিঠি তুলে ধরবো। ১৮৯৩ সালে জাপান থেকে শিকাগো যাবার পথে ভারতের বিশিষ্ট শিল্পপতি ও দানবীর স্যার জামসেদজী টাটার সঙ্গে স্বামীজীর পরিচয় হয়েছিল। তখন উভয়ের মধ্যে ভারতের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয় এবং স্বামীজীর বক্তব্য জামসেদজীকে মুগ্ধ করে। এ প্রসঙ্গে মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন -

"সুপ্রসিদ্ধ টাটা সেই জাহাজে ছিলেন। স্বামীজী পত্রে লিখিয়াছিলেন যে, তিনি টাটাকে বলিয়াছিলেন, 'জাপান থেকে দেশলাই নিয়ে গিয়ে দেশে বিক্রয় ক'রে জাপানকে টাকা দিচ্ছ কেন? তুমি তো সামান্য কিছু দস্তুরী পাও মাত্র। এব চেয়ে দেশে দেশলাইয়ের কারখানা করলে তোমারও লাভ হবে, দশটা লোকেরও প্রতিপালন হবে। এবং দেশের টাকা দেশে থাকবে।"**

স্বামীজী ভারতে ফিরে এলে ১৮৯৮ সালের ২৩শে নভেম্বর জামসেদজী টাটা স্বামীজীকে এই চিঠিখানা লেখেন[৬] -

'প্রিয় স্বামী বিবেকানন্দ,

          আমার বিশ্বাস আপনি জাপান থেকে চিকাগোর পথে জাহাজে সহযাত্রীরূপে আমাকে মনে রেখেছেন। ভারতের বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার স্থাপন সম্বন্ধে আমার পরিকল্পনার কথা আপনি নিশ্চয়ই পড়েছেন বা শুনেছেন। এই প্রসঙ্গে আপনার চিন্তা ও ভাবরাজির কথা আমি স্মরণ করছি। আমার বিবেচনায়, যদি ধর্মভাবে উদ্বুদ্ধ মানুষেরা আশ্রম জাতীয় আবাসিক স্থানে অনাড়ম্বর জীবন যাপন ক'বে মানবিক ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের চর্চায জীবন উৎসর্গ করে তাহলে তার অপেক্ষা ত্যাগ ও ধর্মাদর্শের উৎকৃষ্টতর প্রয়োগ আর কিছু হতে পাবে না। আমার ধারণা, এই জাতীয় ধর্মসমবেব দায়িত্ব কোনো যোগ্য নেতা গ্রহণ করলে তার দ্বারা ধর্মের ও বিজ্ঞানের উন্নতি হবে এবং আমাদের দেশের সুনাম বৃদ্ধি পাবে। আর এই অভিযানে বিবেকানন্দের অপেক্ষা বড় নায়ক কে হবেন! আপনি কি এই পথে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করবার জন্য আত্মনিয়োগ করবেন? বোধহয় সুরুতে এ ব্যাপারে জনসাধারণকে উদ্দীপিত করবার জন্য অগ্নিময় বাণী সম্বলিত একটি পুস্তিকা প্রচার করলেই ভাল করবেন।

প্রকাশের সমস্ত ব্যয়ভার আমার।

২৩শে নভেম্বর, ১৮৯৮               শ্রদ্ধানত, হে প্রিয় স্বামী
এসপ্ল্যানেড হাউস, বোম্বাই          আপনার বিশ্বস্ত
                                           জামসেদজী এন. টাটা

স্বামীজী এই চিঠির কি জবাব দিয়েছিলেন তা জানা যায়নি। তবে এ চিঠির মাধ্যমে একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে ভারতে বিজ্ঞানচর্চা ও শিল্পোন্নয়ন সম্পর্কে স্বামীজীর গভীর আগ্রহ অনেকের কাছেই সুবিদিত ছিল। ভারতে শিল্প ও বিজ্ঞানের অধোগতিকে এদেশের পতনের অন্যতম কারণ বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। জামসেদজী টাটা আত্মত্যাগী যুবকদের বিজ্ঞানসাধনায় ব্রতী হবার জন্য যে প্রস্তাব স্বামীজীর কাছে পাঠিয়েছিলেন তা নিঃসন্দেহে স্বামীজীর ভাবধারার অনুসারেই - পত্রলেখক তাঁর চিঠির প্রথম দিকে তা স্বীকারও করেছেন। বিশুদ্ধ বিজ্ঞান এবং ফলিত বিজ্ঞান উভয়কেই যে তিনি অতি অবশ্য প্রয়োজনীয় মনে করতেন তা পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচিত হবে।

বর্তমান সভ্যতা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যাকে অধিকতর স্থান দিয়েছে, অনেক বেশি মূল্য দিয়েছে; যেমন প্রাচীনকালে একে অনেক নীচে স্থান দেওয়া হয়েছে। আজ মানবসমাজের কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে বিজ্ঞানের যথার্থ প্রয়োগ হওয়া উচিত। স্বামী বিবেকানন্দ অনেক আগেই তা ভেবেছিলেন। এ সম্বন্ধে পূজ্যপাদ স্বামী রঙ্গনাথানন্দজীর# বক্তব্য তুলে দেবার লোভ সম্বরণ করতে পারছি না। তাঁর ভাষায়[৭] -

"There is need to-day to view Science in its proper perspective - the perspective of total human knowledge and welfare. This is one of the several vital contributions of Swami Vivekananda to modern thought".

তথ্যসূত্রঃ
১. প্রমথনাথ বসু - 'স্বামী বিবেকানন্দ' (প্রথম ভাগ), পৃঃ ৬৫।
* অজিত সিং।
২. হরিপদ মিত্র - 'স্বামীজীর সহিত কয়েকদিন', স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, নবম খণ্ড, শতবর্ষ সংস্করণ।
৩. মহেন্দ্রনাথ দত্ত - 'শ্রীমৎ বিবেকানন্দ স্বামীজীর জীবনের ঘটনাবলী', দ্বিতীয় খণ্ড।
৪. প্রিয়নাথ সিংহ - 'স্বামীজীর স্মৃতি', 'স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা', শতবর্ষ সংস্করণ, নবম খণ্ড।
৫. প্রিয়নাথ সিংহ - 'স্বামীজীর স্মৃতি', 'স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা', শতবর্ষ সংস্করণ, নবম খণ্ড।
** মহেন্দ্রনাথ স্বামীজীর যে চিঠির কথা বলেছেন সে পত্র স্বামীজীর 'পত্রাবলী'তে নেই - লেখক।
৬. 'বিশ্ববিবেক', পৃষ্ঠা ১৪০, ১৪১।
# রামকৃষ্ণ মিশন ইনষ্টিটিউট অব কালচারের সাধারণ সম্পাদক।
৭. Swami Ranganathananda - 'Swami Vivekananda's Synthesis of Science and Religion'. P.10.

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।

['রূপা এন্ড কোম্পানী' কর্তৃক ১৯৬০ সালে প্রকাশিত ও ডক্টর অমিয়কুমার মজুমদার রচিত 'বিবেকানন্দের বিজ্ঞান চেতনা' বইয়ের ১২টি প্রবন্ধের মধ্যে একটি ছিল এই প্রবন্ধটি। সেটিই পুনঃপ্রকাশ করা হল। বানান অপরিবর্তিত। প্রকাশকের প্রতি আমরা অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।]