কুরুপাণ্ডবের মহাসমরে অর্জুন ও সুভদ্রার কিশোর পুত্র অভিমন্যু খুব বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। দ্রোণাচার্য-সংগঠিত চক্রব্যূহে প্রবেশ করে তিনি বহু বীর ও সাধারণ সৈন্যগণকে বধ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, বৃহদ্বল ও কৃতবর্মা - এই ছয় মহারথী প্রত্যক্ষভাবে ও জয়দ্রথ পরোক্ষভাবে একসঙ্গে অভিমন্যুকে ঘিরে ফেলে তাকে বধ করলেন। মাত্র ষোলো বছর বয়সেই এক মহান বীরের শোচনীয়ভাবে মৃত্যু হল। অর্জুন ওই সময় যুদ্ধক্ষেত্রের অন্য এক স্থলে সংশপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধে নিযুক্ত ছিলেন। পরে অর্জুন এই ঘোর দুঃসংবাদ শুনে খুবই কাতর হলেন এবং তাঁর স্ত্রী তথা কৃষ্ণের ভগিনী সুভদ্রাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কৃষ্ণকে তাঁর কাছে পাঠালেন। তখন কৃষ্ণ অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়ে অর্জুনের শিবিরে গিয়ে পুত্রশোকাতুর দুঃখিনী ভগিনীকে নানাভাবে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। তিনি সুভদ্রাকে ও তাঁর পুত্রবধূ উত্তরাকে বৃথা শোক করতে নিষেধ করলেন, কারণ কালের প্রকোপে সকল প্রাণীই একদিন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তাছাড়া, সৎকুলজাত বীর ক্ষত্রিয়ের পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করার চেয়ে কাম্যমৃত্যু আর নেই। অকালে হলেও অভিমন্যু বহু শত্রুকে ধ্বংস করে ক্ষত্রিয় বীরগণের অভিলষিত গতিপ্রাপ্ত হয়েছে। কৃষ্ণ সুভদ্রাকে বোঝালেন যে তিনি তো সাধারণ নারী নন, তিনি বীরমাতা, বীরপত্নী, বীরকন্যা ও বীরের ভগিনী, অতএব যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষত্রিয়বীরের গতিপ্রাপ্ত পুত্রের জন্য শোক করা তাঁর সাজে না। তিনি আরও আশ্বাস দিলেন যে পরদিনই অর্জুন তাঁর পুত্রের মূল হত্যাকারী জয়দ্রথকে বধ করার প্রতিজ্ঞা করেছেন এবং জয়দ্রথ যদি অমরাবতীতেও গিয়ে লুকোয়, তাহলেও সে অর্জুনের হাত থেকে রক্ষা পাবেনা!
যতই সান্ত্বনা ও আশ্বাস দেওয়া হোক, মায়ের মন কি মানে? কৃষ্ণের কথা শুনে সুভদ্রার পুত্রশোক আরও বৃদ্ধি পেল। তিনি বিলাপ করে বলতে লাগলেন পূর্বে যে সুকোমল মনোহর শয্যায় শয়ন করত আজ সে বাণবিদ্ধ, রক্তাক্ত ও যুদ্ধক্ষেত্রস্থ ধূলিলিপ্ত হয়ে ভূতলে শয়ান আছে। পাণ্ডব, বৃষ্ণি ও পাঞ্চালগণ সহায় থাকা সত্ত্বেও কিভাবে অভিমন্যুকে অনাথের মতো নিহত হতে হল। সুভদ্রা ভীম, অর্জুন ও ও অন্যান্য বীরগণ, যেমন কৈকেয়, চেদি, মৎস্য ও পাঞ্চালগণকে ধিক্কার দিলেন।
কৃষ্ণের ভাগিনেয় ও গাণ্ডীবধারণকারী অর্জুনের অতিরথ পুত্র হয়েও অভিমন্যু যে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হল এটা সুভদ্রা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না। তাঁর তরুণী পুত্রবধূ উত্তরাকে তিনি কীভাবে সান্ত্বনা দেবেন? কালের গতি জানা পণ্ডিতগণের পক্ষেও কঠিন, তা না হলে কৃষ্ণের মতো অভিভাবক থাকতেও তাকে অনাথের মতো নিহত হতে হল কেন? আরও নানা বাক্যবিন্যাসে সুভদ্রা যখন একমাত্র পুত্রের অকালমৃত্যুতে বিলাপ করছিলেন সেই সময় দ্রৌপদী উত্তরাকে নিয়ে সেখানে এলেন এবং সেখানে শোকের ঝড় বয়ে গেল। সুভদ্রা, দ্রৌপদী ও উত্তরা - তিনজনেই বিলাপ করতে করতে মূর্ছিত হয়ে গেলেন। কৃষ্ণ তাঁদের চোখেমুখে জল ছিটিয়ে তাঁদের চেতনা ফিরিয়ে আনলেন এবং আবার বললেন যে অভিমুন্য ক্ষত্রিয়গণের উপযুক্ত গতি লাভ করেছে এবং তাঁরাও সকলে ওই একই গতি লাভ করতে চান। এইভাবে সুভদ্রা, দ্রৌপদী ও উত্তরাকে আশ্বাস দিয়ে কৃষ্ণ অর্জুনের কাছে ফিরে গেলেন।
কুরু-পাণ্ডবের মহাসমরের শেষে মহামতি যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের রাজা হলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে কৃষ্ণ পাণ্ডবদের সাহায্যের জন্য সেই যে দ্বারকা ছেড়ে এসেছিলেন, নানা ঘটনার ঘনঘটা ইত্যাদির জন্য কৃষ্ণ বহুদিন দ্বারকায় ফিরতে পারেননি। এবার সব কিছু গোলমাল মিটে গেছে, যুধিষ্ঠিরের রাজ্যে শান্তি স্থাপিত হয়েছে। তাই কৃষ্ণ দ্বারকায় ফিরতে মনস্থ করলেন এবং যুধিষ্ঠিরের কাছে অনুমতি চাইলেন। যুধিষ্ঠির সানন্দে তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হলেন এবং তিনি যখন অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন, তখন কৃষ্ণকে প্রজাগণ সহ সপরিবারে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানালেন। কৃষ্ণ তাঁর পিসিমা কুন্তী, বিদুর প্রভৃতি মাননীয় ব্যক্তিবর্গের কাছে অনুমতি নিয়ে এবং কুন্তী ও যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞা অনুসারে ভগিনী সুভদ্রাকে সঙ্গে করে দ্বারকায় চলে গেলেন। কৃষ্ণের সুভদ্রাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার কারণ ছিল, পুত্রহারা সুভদ্রা তখনও খুবই শোককাতরা ছিলেন, তাই কৃষ্ণ তাঁকে সঙ্গে করে পিতা বসুদেব ও মাতা দেবকী এবং পিতৃগৃহের অন্যান্য প্রিয় পরিজনের কাছে নিয়ে এলেন যাতে সেখানে কিছুদিন থেকে পুত্রশোক কিছুটা ভুলতে পারেন।
ইতিমধ্যে যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় এসে গেল। কৃষ্ণ অগ্রজ বলদেব ও অন্যান্য বৃষ্ণিবংশীয় বীরগণ এবং সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে হস্তিনাপুরে এসে গেলেন। চতুর্দিকেই যখন আনন্দের পরিবেশ, সেই সময় উত্তরা মৃতপুত্র প্রসব করলেন এবং অন্তঃপুরে রমণীগণের কান্নার শব্দ শোনা গেল। কৃষ্ণ দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা কর্তৃক অস্ত্রনিক্ষেপে উত্তরার গর্ভনাশ করার ব্যাপারটা জানতেন এবং তিনি তখন অশ্বত্থামাকে বলেছিলেন যে তিনি নিজে উত্তরার সন্তানকে সঞ্জীবিত করে দেবেন। তাই কান্নার শব্দ শুনেই কৃষ্ণ অন্তঃপুরের দিকে ধাবিত হলেন এবং দেখলেন কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা ও অন্যান্য নারীগণ বিলাপ করছেন। দাদাকে দেখে সুভদ্রা আর্তস্বরে বললেন যে দ্রোণপুত্র আজ পাণ্ডবদের সর্বস্ব হরণ করেছেন। অভিমন্যুর মৃত পুত্র জন্ম নেবে এর চেয়ে বেশি দুঃখজনক ব্যাপার আর কী হতে পারে? তিনি কৃষ্ণকে তাঁর পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভাগিনেয় পুত্রের পুনর্জীবন দান করতে অনুরোধ করলেন। তিনি কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করলেন তিনি যেন পাণ্ডবদের প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং ভাগিনেয় পত্নীর প্রতি দয়া দেখিয়ে তাঁদের কুলরক্ষা করেন। কৃষ্ণ সুতিকাগারে গিয়ে দেখলেন উত্তরাও খুব বিলাপ করছে। তিনি তাঁর তপঃপ্রভাবে অশ্বত্থামা-নিক্ষিপ্ত ব্রহ্মাস্ত্রকে প্রতিসংহার করে অভিমন্যু নন্দনের জীবন দান করলেন।
যুধিষ্ঠির-আয়োজিত অশ্বমেধ যজ্ঞের মূলপর্ব যখন শুরু হল, সেই সময় অর্জুনের পুত্র বভ্রুবাহন তাঁর মাতা মণিপুররাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা ও বিমাতা নাগরাজকন্যা উলূপীকে সঙ্গে নিয়ে হস্তিনাপুর উপস্থিত হলেন। বিভিন্ন স্থান থেকে প্রিয়পরিজনদের সমাগমে রাজপ্রাসাদে আনন্দের স্রোত বয়ে গেল। অর্জুনের সমস্ত পত্নী দ্রৌপদী, সুভদ্রা, চিত্রাঙ্গদা ও উলূপী প্রথম ও শেষবারের মতো একত্রিত হলেন এবং পরস্পরকে আলিঙ্গন করলেন। এর পর থেকে মহাপ্রস্থানের সময় পর্যন্ত চার পত্নীই হস্তিনাপুরের প্রাসাদে ছিলেন। তারপরই এই সুখের দিন শেষ হয়ে গেল। মহাপ্রস্থানের পূর্বে পরীক্ষিৎকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করে যুধিষ্ঠির তার দেখাশোনার ভার সুভদ্রাকে দিলেন, দ্রৌপদী মহাপ্রস্থানের সঙ্গিনী হলেন উলূপী গঙ্গায় প্রবেশ করলেন এবং চিত্রাঙ্গদা মণিপুরে চলে গেলেন। পঞ্চপাণ্ডবের মাতা কুন্তীও ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর সঙ্গে বনগমণ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সুভদ্রাই পরীক্ষিতের দেখাশোনার ভার নিয়ে প্রায় নিরানন্দ প্রাসাদে থেকে গেলেন।
এইখানে বিরাটরাজকন্যা উত্তরা সম্বন্ধে কিছু কথা উল্লেখ করলে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এক বৎসর অজ্ঞাতবাসকালে অর্জুন ক্লীবের ছদ্মবেশে নারীবেশ ধারণ করে 'বৃহন্নলা' নাম নিয়ে মৎস্যরাজ বিরাটের রাজভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি নৃত্য-গীত-বাদনে পারদর্শী ছিলেন। সেইজন্য রাজা বিরাট তাঁকে তাঁর কন্যা উত্তরা, তাঁর সখীগণ ও অন্যান্য রাজ-অন্তঃপুরিকাগণের নৃত্য-গীত-বাদ্যের শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। অজ্ঞাতবাস প্রায় শেষ হওয়ার মুখে কৌরবগণ বিরাটরাজের গোধন হরণ করতে উদ্যত হলে বৃহন্নলা-রূপী অর্জুন রাজপুত্র উত্তরের সারথি হয়ে কৌরবগণকে গোধন হরণে প্রতিহত করতে গিয়েছিলেন এবং তাঁর শৌর্যবীর্যের কাছে পরাজিত হয়ে কৌরবগণ ফিরে যান। বিরাটরাজ ভেবেছিলেন তাঁর পুত্র উত্তরই বুঝি ওই বীরত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। অজ্ঞাতবাস শেষ হওয়ার ঠিক পরের দিনই দ্রৌপদী সহ পঞ্চপাণ্ডব আত্মপ্রকাশ করলেন। বিরাটরাজের বিস্ময় ও আনন্দের আর পরিসীমা রইল না।বিশেষত অর্জুনের শৌর্যবীর্যের কথা শুনে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের জন্য তিনি উত্তরাকে অর্জুনের সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। এই স্থলে অর্জুন খুবই সংযমের পরিচয় দিয়েছিলেন। অসমবয়সী পত্নীগ্রহণ কেবল প্রাচীনকালেই নয়, আধুনিক যুগেও (সচরাচর না ঘটলেও) দেখা যায়, কিন্তু অর্জুন তা করলেন না। তিনি রাজা বিরাটকে বললেন যে তিনি এক বৎসর তাঁর অন্তঃপুরে বাস করেছেন, তাঁর কন্যাকে নিজের কন্যার মতই দেখে এসেছেন, তিনি তাকে যত্নসহকারে নৃত্যগীত শিক্ষা দিয়েছেন এবং উত্তরাও তাঁকে পিতার ন্যায় শ্রদ্ধা করে এবং গুরু বলে মান্য করে। অর্জুন তাঁকে আরও বললেন যে উত্তরা যৌবন প্রাপ্ত হয়েছে, সুতরাং তাঁদের কারও মনে যাতে অনুচিত সন্দেহ দেখা না দেয়, সেইজন্যই তিনি উত্তরাকে পুত্রবধূরূপে বরণ করছেন। এইরূপ করলেই তিনি জিতেন্দ্রিয় রূপে খ্যাতিলাভ করবেন এবং উত্তরার চরিত্রও শুদ্ধ বলেই সবাই মেনে নেবে। তাঁর পুত্র অভিমন্যু, দেবকুমারতুল্য, কৃষ্ণের প্রিয়তম ভাগিনেয় এবং সর্বপ্রকার অস্ত্রবিদ্যায় নিপুণ। অর্জুন বললেন তাঁর পুত্র বিরাটরাজের উপযুক্ত জামাতা ও উত্তরার উপযুক্ত পতি হওয়ার যোগ্য। এর চেয়ে ভালো প্রস্তাব আর হতে পারে না। বিরাটরাজও সানন্দে মেনে নিলেন এবং অর্জুনের পত্নীর সংখ্যা অযথা আর একটা বাড়ল না।
(সমাপ্ত)
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।
লেখাটি পড়ে কেমন লাগলো? আপনার মতামত জানান এই লিঙ্কে ক্লিক করে -
https://dotpen.in/feedback/