[শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী ডঃ সুবিমল সেন জনবিজ্ঞান আন্দোলনের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন অনুলিখিত।]
স্বাধীনতার আগে থেকেই যুক্তিবাদী চিন্তাধারা, মানবিক মূল্যবোধ ও বিজ্ঞানচর্চার গৌরবময় ঐতিহ্য এদেশে গড়ে উঠেছিল।
১৮৩৬ সালে মধুসূদন গুপ্ত ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজে প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ করেন। বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এই ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণ, দীর্ঘদিনের কুসংস্কার যেকোনো উচ্চবর্ণের মানুষ মৃতদেহ ছোঁবে না, তা তিনি ভেঙে দেন।
এই ঘটনার কুড়ি-পঁচিশ বছর পর আরেক মধুসূদন, তিনি দত্ত, লিখলেন 'মেঘনাদবধ কাব্য'। এখানেও রামায়ণকে আশ্রয় করেই ধারণাকে উল্টে দিলেন। তাঁর সৃষ্টিতে ইন্দ্রজিৎ নায়ক। নিকুম্ভিলা যজ্ঞে প্রবেশের জন্য লক্ষ্মণ এবং বিভীষণকে তিনি 'তস্কর' বললেন।
অক্ষয়কুমার দত্ত, 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'র সম্পাদক, বাংলায় বিজ্ঞানচর্চাকে ছড়িয়ে দিলেন। যুক্তিবাদী মানসিকতার পক্ষে ভূমিকা নিলেন। তাঁর কথা ছিল, ঈশ্বরকে শক্তিমান মানতে আপত্তি নেই। কিন্তু যিনি মাত্র একটি ভাষা জানেন তাঁকে সর্বশক্তিমান বলতে আপত্তি আছে। অর্থাৎ,হিন্দু হলে সংস্কৃত, ইসলামে আজান পড়া হয় আরবিতে, খ্রীস্টান হলে ল্যাটিন ভাষায় উপাসনা করেন। মানে একটিই ভাষায়, তিনি সর্বশক্তিমান হবেন কিভাবে!
অক্ষয়কুমারই লিখলেন 'বাংলাদেশে কৃষকদের দুরবস্থা'।
বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যিক, তিনি বিজ্ঞানমনস্কতার পক্ষে লিখেছেন। আবার হাসিম শেখ ও রামা কৈবর্তের যন্ত্রণা যে এক, সে কথাও বলেছেন। যুক্তিবাদ এবং মানবিক মূল্যবোধ বাংলা সাহিত্যে সমান্তরাল ধারায় চলেছে। তার সঙ্গে আজকের সময়ের তুলনা করতে হবে আমাদের।
রবিঠাকুর 'অচলায়তন'-এ একদিকে যুক্তিবাদী ছাত্রকে রাখলেন। আরেকদিকে দাদাঠাকুর প্রেম ও ভালবাসার প্রতীক। রবীন্দ্রনাথ দেখালেন যুক্তিবাদ আর মানুষের প্রতি ভালবাসা, দু'য়ে মিলে অচলায়তনকে ভেঙে দিতে পারে। 'পূজারিণী' কবিতায় তিনি সরাসরি বললেন যে হিন্দু রাজা অজাতশত্রু বৌদ্ধধর্মকে নিকেশ করছেন। বৌদ্ধ শাস্ত্র পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছেন।
আমাদের কিছু মনে হয়নি। মধ্যযুগে তো বিভিন্ন সময়ে এ' কাজ হয়েছে। আবার মুসলিম শাসকরা হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছে।
এখনকার পরিপ্রেক্ষিতে আমার কাছে অসাধারণ লাগে শরৎচন্দ্রের 'মহেশ' গল্পটি। এই গল্প পড়ে চোখের জল ফেলেনি এমন কোনো বাঙালি নেই। কারও তো এমন মনে হয়নি যে মুসলিম চাষী গফুর তার চাষের বলদের নাম রাখল 'মহেশ', যা কিনা হিন্দু দেবতা শিবের নাম।
নজরুল 'বিদ্রোহী' কবিতায় লিখলেন, "আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন"। আমরা আবৃত্তি করেছি। কারও মনে হয়নি যে ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেবে, এত বড় সাহস!
কেবল কলকাতায় নয়, এই কবিতা পড়ানো হয়েছে গ্রামে। আমরা এই পরিবেশে বড় হয়েছি।
পাশাপাশি চলেছে বিজ্ঞানচর্চা। মনে রাখতে হবে দেশের মানুষের উদ্যোগে তা হয়েছে। সেখানে ইংরেজদের কোনও ভূমিকা ছিল না।
'রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ' তৈরি হয়েছে তারকনাথ পালিত এবং রাসবিহারী ঘোষের দানে। এখনকার মূল্যে প্রায় দু'শো কোটি টাকা দান করেছিলেন। স্বাধীনতার আগে তৈরি হয় 'ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স', 'ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজি' বা আইআইসিবি, বেঙ্গালুরুতে 'ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স' প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ দেন জামশেদজী টাটা।
পরাধীন দেশে নিজেদের উৎসাহে বিজ্ঞানচর্চার উদাহরণ অন্য ঔপনিবেশিক দেশে নেই।
প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা সম্পর্কে আলোচনায় দেখা যায় যে স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিজ্ঞানচর্চা গড়ে উঠেছে।
স্বাধীনতার পর ব্যক্তি-উদ্যোগে সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেয় সরকার। নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়া হতে থাকে। ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিজ্ঞানচর্চার সব শাখায় অগ্রগতি দেখা যায়।
ইতিহাস চর্চার দিকেও নতুন চিন্তা দেখা যেতে থাকে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ আখ্যা দিতেন বিভিন্ন পর্বকে। এই দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞানসম্মত ছিল না। সে কারণে দেশের ইতিহাসবিদরা প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ এবং আধুনিক যুগ আখ্যা দিলেন। তাঁরা দেখালেন ইতিহাস কেবল রাজাদের বিষয় নয়। মুঘল সাম্রাজ্যের কৃষিব্যবস্থা কেমন ছিল, প্রযুক্তি কেমন ছিল। কৃষকদের জমির ওপর অধিকার কেমন ছিল তা নিয়ে গবেষণা চলল। ইতিহাসের নতুন দিক উঠে এল।
এই সময়েই দর্শনের চর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করলেন দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। একেবারে লুপ্তপ্রায় 'লোকায়ত দর্শন'কে সামনে নিয়ে এলেন। কেবল বিজ্ঞান নয়, জ্ঞানের সবদিকে অগ্রগতি হল। সাহিত্যে নিম্নবর্গের কথা উঠে এল। মুলকরাজ আনন্দ চা শ্রমিকদের জীবন নিয়ে লিখলেন। সমরেশ বসু লিখলেন 'বি টি রোডের ধারে'। নাটক, সিনেমায় অসাধারণ অগ্রগতি হল। যে কারণে 'মহেশ' নাম অস্বাভাবিক মনে হয়নি, নজরুলের কবিতা অস্বাভাবিক মনে হয়নি।
সমস্যা হল পশ্চাদপদতা টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। ভূমি সংস্কার হয়নি। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। অগ্রগতি আর পশ্চাদপদতা এই দু'টো নিয়ে আমরা বড় হচ্ছিলাম।
কিন্তু গণআন্দোলন সজীব থাকায় পশ্চাদপদতা সামনে আসার সাহস পায়নি। এটা হল বিশ্বায়নের সময়।
বিশ্বায়ন বিশ্বের সর্বত্র পশ্চাদপদতাকে জোর দিয়েছে। ১৯৮০'র পর থেকেই তা এদেশে শুরু হয়। পাঁচশো বছরের পুরনো ঐতিহাসিক সৌধ, কে কিভাবে তৈরি করেছিল, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু আজকের সময়ে সৌধ ভেঙে ফেলা যায় ভাবতে পারিনি।
তখন থেকেই আরম্ভ হল অগ্রগতি পিছিয়ে দেওয়া। এতে সাহায্য করছে বিশ্বায়ন।
সারা পৃথিবীতেই পিছিয়ে পড়া মানসিকতাকে মদত দিয়েছে বিশ্বায়ন। আমাদের এখানে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা। আমেরিকায় বর্ণবৈষম্য প্রবল হয়ে মাথাচাড়া দেয়। চাকরি না পাওয়ার জন্য মেক্সিকান অভিবাসীদের দায়ী করা হল। ইংল্যান্ডে পোলিশ বংশোদ্ভূতদের প্রতিপক্ষ বানানো হয়। পরিকল্পিতভাবেই তা করা হতে থাকে।
এখন এমন অবস্থা যে নাটক, উপন্যাস, সিনেমা - সবকিছু চলে যাচ্ছে আদালতে। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এই ভারত চাননি। 'হর ঘর তিরঙ্গা' শ্লোগান দিচ্ছে সরকার, কত লোকের তো ঘরই নেই!
চিন্তার জগতে অগ্রগতি বন্ধ করা হল সুপরিকল্পিতভাবে। গবেষণায় অর্থ নেই। গবেষণাগার প্রায় বন্ধ, গবেষকের সংখ্যা কমে গিয়েছে। তার ওপরে গবেষণার বিষয় ঠিক করতে খবরদারি চলছে ওপরতলা থেকে। আগে হয়নি, হলে অগ্রগতি সম্ভব হতো না।
সবচেয়ে বিপজ্জনক যেটা স্কুলের শিশুদের ভুল শেখানো হচ্ছে। কোনটা বিজ্ঞান কোনটা অপবিজ্ঞান গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বিজ্ঞান কংগ্রেসে আজগুবি তত্ত্ব প্রচার হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের একাংশ মেরুদণ্ডহীন, তা মেনেও নিচ্ছেন। ৫ হাজার বছর আগেই নাকি ভারতে মহাকাযান ছিল, এসব আবার ভিডিও করে স্কুলের শিশুদের দেখানো হচ্ছে।
মানবিক মূল্যবোধে আঘাত নামছে। নাগরিক নই, আমরা যেন প্রজা। প্রভু যা বলবে মেনে নেবে। মহামারীর সময় প্রধানমন্ত্রী কাঁসর-ঘন্টা বাজিয়ে করোনা তাড়ানোর নিদান দিলেন। লোকে তা করলও। এতে শহরে তথাকথিত শিক্ষিত অংশেরও আগ্রহ দেখা গিয়েছে!
তার একটা কারণ বিশ্বায়ন আমাদের সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। আমাদের অগ্রগতির পেছনে সামাজিক আন্দোলনের ভূমিকা ছিল।
এখন নতুন করে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। সত্য কী, খোঁজার চেষ্টা করতে হবে। তার জন্য লড়াই চালাতে হবে। চেষ্টা করলে সম্ভব। সূর্যগ্রহণ* নিয়ে কুসংস্কারও তো ভেঙে দিতে পেরেছিলাম আমরা।
* ১৯৯৪'র অক্টোবরে সূর্যগ্রহণের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। গ্রহণ ঘিরে নানা কুসংস্কার ভেঙে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যার খোঁজে জন অংশগ্রহণ দেখা গিয়েছিল।
[লেখাটি 'সংযোগ ডটকম'-এর সৌজন্যে প্রাপ্ত।]