একটা লাল পাখি। টুকটুকে লাল। পালক, চোখ, ঠোঁট সব লাল। লপিতা কালরাতে পাখিটার কথা বলেছিল। লপিতা এখনও লাল পাখিটার কথা বলছে। হাসি তো পাবেই। তাই উদ্দালক হাসছে। লপিতা রুষ্ট গলায় বলল, "তুমি হাসছো?" উদ্দালক হাসি চেপে বলল, "না, না হাসলাম কোথায়!" লপিতা বলল, "একটুও বাড়িয়ে বলছি না। একেবারে লাল পাখি।" উদ্দালক আর হাসছে না।
লপিতা মাথা নিচু করে কফিতে চুমুক দেয়। একটা নীল প্রজাপতি উড়ে এসে তার শাড়ির আঁচলের ওপর বসল। আবার উড়ে গেল। লপিতা খেয়াল করল না। উদ্দালকও। ওরা লাল পাখিটার কথা ভাবছিল।
কাঁচের জানলা দিয়ে একফালি রোদ্দুর এসে টেবিলের ওপর পড়েছে। লপিতার ডান হাত কফির পেয়ালায়। প্রলম্বিত বাঁ হাতটি টেবিলে। তার ফরসা অনামিকায় লাল পাথরের আংটি, আংটিটার দিকে তাকিয়ে উদ্দালক জিজ্ঞেস করল, "এই পাথরটার মতন লাল।” লপিতা তার অঙ্গুরীয়টা দেখল। মাথা নাড়ল। না, এইরকম নয়। সেই পাখিটা এই চুনিটার মতন লাল নয়। গোলাপের মতন নয়। রক্তেরও মতন নয়। অথচ লাল। একটা লাল পাখি। ঠিক কীরকম লাল সেটা সে বোঝাতে পারে না। আবার নীল প্রজাপতিটা উড়ে এল। হয়তো ওই বাগান থেকে। ওখানে কতরকম ফুল ফুটে আছে। ফুলেরও নানা রকম রং। লাল-নীল-হলুদ-কমলা। বাগানে পাখিও আছে। সাদা-কালো-সবুজ। বক সাদা। কাক কালো। টিয়া সবুজ। অথচ লাল পাখি নেই। একেবারে সর্বাঙ্গ লাল।
উদ্দালক বলল, "সেলিম আলির বইটা উল্টেপাল্টে দেখতে হবে।" লপিতা মাথা ঝাঁকাল, "নেই। আমি দেখেছি।" উদ্দালক ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “অথচ তুমি পাখিটাকে দেখেছো! স্পষ্ট দেখেছো!” লপিতা বলল, "স্পষ্ট দেখেছি। পাখিটা নিম গাছের ডালে চুপ করে বসেছিল। কিন্তু বেশ ভাল করে দেখার আগেই উড়ে গেল। ওড়ার সময়ও দেখেছি। লাল একেবারে টুকটুকে লাল।
কফি খেয়ে ওরা উঠল। লপিতা জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বাগানের দিকে তাকিয়ে রইল। উদ্দালক কাউন্টারে গিয়ে রাতের খাবার অর্ডার দিচ্ছে।
নীল প্রজাপতিটা আবার এসেছে। এখন লপিতার মাথার ওপর উড়ে উড়ে শূন্যতার ভেতরে এক অদৃশ্য বলয় রচনা করে যাচ্ছে। এক টুকরো নীল। যেন অপরাজিতার একটা পাপড়ি। খোলা জানলা দিয়ে প্রজাপতিটা উড়ে চলে গেল।
বিয়ে হয়েছে বারোদিন আগে। ওরা এই বন পাহাড়িতে এসেছে কাল সন্ধেবেলায়। এটা বিহারের মধ্যে হলেও পা বাড়ালেই বঙ্গভূমি। বাংলার এত কাছে এত সুন্দর একটা জায়গা আছে লপিতা জানত না। উদ্দালক বলেছে সেও জানত না। সমীরণ এই বনপাহাড়ির হদিশ দিয়েছে। এখনও এখানকার কিছুই দেখা হয়নি। তবে দুজনেই বুঝতে পারছে এক সুন্দর জায়গায় এসে পড়েছে। এখানে বন আছে। পাহাড়ও। তবে এখানকার বন গভীর নয়। পাহাড়ও সুউচ্চ নয়। এখন ওরা বেরবে। একটা গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে। বনপাহাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখবে।
উদ্দালকের এখন মনে হচ্ছে লপিতা লাল পাখিটার কথা না বললেই পারত। লপিতাও একই কথা ভাবছে। কী দরকার ছিল ওই লাল পাখিটার কথা বলার।
কাল অনেক রাত পর্যন্ত ওরা জানলার সামনে দুটো চেয়ার পেতে পাশাপাশি বসেছিল। খোলা জানলা দিয়ে কোমল হাওয়া আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে পড়ছিল। দিন দুয়েক আগে পূর্ণিমা ছিল বলে চারদিকে ছড়িয়েছিল চাঁদের আলো। দূরে পাহাড়ের গায়ে, সানুদেশে কিংবা শিখরে ফোঁটা ফোঁটা আলো। জরির বুটির মতন। কিছু আলো যেন জোনাকির মতন। কখনও জ্বলে। কখনও নিভে যায়। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে বনভূমি। নিকষ কালো। রাতের অন্ধকার ওই বনভূমির ওপর আলকাতরার মতন গড়িয়ে পড়েছে। ওই দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে লপিতার সেই লাল পাখিটার কথা মনে পড়েছিল। উদ্দালককে বলেছিল, "আমি একটা লাল পাখি দেখেছি।”
এখন গাড়ি ছুটছে পাহাড়ি পথে। পাকদণ্ডির পাশে সারি সারি গাছ। গাছে নানারকম পাখি কিচির-মিচির করছে। কিন্তু কোনও পাখিই সর্বাঙ্গ টুকটুকে লাল নয়। লপিতা এখন প্রগাঢ় কণ্ঠে বলছে লাল পাখিটার কথা।
"চব্বিশ পরগণায় মালঞ্চ বলে একটা গ্রাম আছে। ওখানে মধুপর্ণার মামার বাড়ি। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে একবার মধুপর্ণা আমাকে ওর মামার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। ওই বাড়ির বাগানে পাখিটাকে দেখেছিলাম। নিমগাছের ডালে চুপ করে বসেছিল। বেশিক্ষণ বসে থাকেনি। হঠাৎ ডাল ছেড়ে উড়ে গেল। একেবারে টুকটুকে লাল।"
বনপাহাড়ি ওরা ঘুরে ঘুরে দেখল। পাহাড়-বনের মধ্যে একটা সুন্দর ঝর্না আছে। গাড়ি থেকে নেমে ওরা ঝর্নার ধারে গিয়ে চুপ করে বসে রইল। খানিকটা দূরে গাড়িটা দাঁড়িয়েছিল। ড্রাইভার গাড়ির মধ্যে অকাতরে ঘুমোচ্ছিল।
এখানে চারদিক কেমন থমথমে। ছায়াময়। পাখির কিচির-মিচির। পাথর ছাপিয়ে জলধারা একটানা পড়েই যাচ্ছে। সেই জল পড়ার শব্দও কেমন যেন। চারদিকে গাছ। বুনোফুল। সব মিলিয়ে গন্ধও কেমন আচ্ছন্ন করে দেয়।
লপিতা এখন আর লাল পাখিটার কথা ভাবছিল না। সে বিমুগ্ধ চোখে এই অপরূপ প্রকৃতিকে দেখছিল। উদ্দালক কিন্তু লাল পাখিটার কথা ভাবছিল। যে পাখি অলীক সেই পাখিটার কথা। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছিল মধুপর্ণাদের মামার বাড়ির বাগানে লপিতা কখনওই লাল টুকটুকে কোনও পাখি দেখেনি। হয়তো পাখিটা ছিল আংশিক লাল। বাকি লালটুকু সূর্যাস্তের লালও হতে পারে। কিংবা কোনও পাখিই দেখেনি। ওটা লপিতার কল্পনা মাত্র। আমাদের মনের মধ্যে কখনও জগরণে কখনও স্বপ্নে একটা কিছু থেকেই যায়। মনের অভীপ্সাটা কখনও ফুল হয়ে ফুটে ওঠে, কখনও পাখি হয়ে আকাশে ওড়ে, মনের শাখা-প্রশাখায় সেই পাখিই নাচে।
উদ্দালক ভাবে, হয়তো তার মনেও অভীপ্সার কোনও অবয়ব আছে। তা পাখি না হয়ে ফুলও হতে পারে। হয়তো একদিন সে লপিতাকে বলবে অফিস থেকে ফেরার সময় রাজভবনের বাগানে দেখেছি একটা খুব উঁচু গাছে থোকা থোকা চাঁপা ফুল ফুটে আছে। ফুলগুলির রং নীল। নীল চাঁপা ফুল। অথচ অপরাজিতা নয়। চাঁপা।
লপিতা ধ্যাৎ বলে হেসে উঠবে, "নীল চাঁপা ফুল! তা আবার হয় নাকি!" উদ্দালক বলবে, "তাহলে তো লাল টুকটুকে পাখিও হয় না।” লপিতা বলবে, "আমি যে স্পষ্ট দেখেছি।" উদ্দালক বলবে, "আমিও।” লপিতা বলবে, "বেশ, তাহলে আমাকে একদিন নীল চাঁপা গাছটা দেখাও। এতো আর পাখি নয় যে উড়ে যাবে।" উদ্দালক বলবে, "তা পারব না। সিগন্যালে গাড়িটা থেমেছিল। চকিতে একবার দেখেছিলাম। এখন সে গাছ খুঁজে পাওয়াই মুশকিল।"
এ যেন পরস্পরের প্রতিযোগিতা। তুমি যদি লাল পাখি দেখে থাকো তাহলে আমি কেন নীল চাঁপা ফুল দেখব না! আসলে লপিতা লাল পাখি দেখেনি। উদ্দালকও কোনও দিন নীল চাঁপা দেখবে না।
অদূরে গাড়িটা পার্ক করা আছে। অবাঙালি ড্রাইভারটা অকাতরে ঘুমোচ্ছে। লোকটার নাম যাদব। যাদব ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতেই পারে। যাদবের স্বপ্নে লাল পাখি উড়ে আসে না। কোনও চাঁপা গাছে নীল ফুল ফোটে না। হয়তো যাদব একটা সবুজ গোরুর স্বপ্ন দেখে। সবুজ গোরু সবুজ ঘাস চিবিয়ে খাচ্ছে। গাড়ি চালাতে চালাতে বিহারের কোনও প্রত্যন্ত গ্রামে সে একবার এইরকম সবুজ গোরু দেখেছিল। জেগে দেখেছে। ঘুমিয়েও দেখেছে। এবং এখনও দেখে।
কয়েকদিন হল লপিতা আর লাল পাখিটার কথা বলছে না। উদ্দালকও নীল চাঁপার স্বপ্ন দেখেনা। ওরা এখন বনপাহাড়িকে ভালবেসে ফেলেছে।
একদিন ওরা হোটেল থেকে বেরিয়ে হেভেন গার্ডেনে চলল। হেঁটে যেতে বড়জোর আধঘণ্টা। ভোররাতে খানিকটা ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। এখন আকাশ পরিস্কার। এটা শ্রাবণ মাস। কিন্তু এখানে তেমন বৃষ্টি নেই। মাঝে মাঝে দু' এক পশলা বৃষ্টি। এখানকার আবহাওয়া বার বার শরৎকালকে মনে পড়িয়ে দেয়। অবশ্য শরতের আর তেমন দেরিও নেই। শ্রাবণ শেষ হতে চলল।
হেভেন গার্ডেন একটা বিশাল ফুল বাগিচা। এখানে নানারকম ফুলের চাব হয়। তবে গোলাপের সম্ভারই বেশি। গোলাপ যে এতরকমের হয় তা লপিতার জানা ছিল না। কত রকম রঙের গোলাপ। গোলাপ গন্ধে সমস্ত বাগানটা আমোদিত হয়ে আছে।
ফুলের রাজ্যে এসে লপিতা বাক্যহারা। উদ্দালকও। কথাহীনভাবে দুজনে ওই বাগানের ভেতর ঘুরে বেড়াতে লাগল। লপিতার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে আত্মহারা হয়ে গেছে। উদ্দালকও তাই। হঠাৎ লপিতা মুখ তুলে বলল, "এখানে যদি লাল পাখিটাকে দেখতে পেতাম!" উদ্দালক এর কোনও জবাব দিতে পারল না। সে লপিতার দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু মনের ভেতরে একটা চাঁপা গাছ যেন বাস্তবের কুয়াশা সরিয়ে আস্তে আস্তে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। উদ্দালক স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সেই গাছে একটা দুটো করে চাঁপা ফুল ফুটে উঠছে। ফুলগুলি নীল।
চিত্রঃ লেখায় ব্যবহৃত ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কাল্পনিকভাবে তৈরি।