গল্প

অলখ' আগল



বর্ণা কুণ্ডু


ঋতমা মিত্র!

জামরঙা মলাটের নীল নীল পাতাও'লা খাতাটার ঠিক শুরুর পাতায়, খুব যত্ন করে নিজের স্কুলের নামটাকে লিখেছিল রিনি। সেদিন আকাশটায় তখন সদ্য গ্রীষ্মের এক শিশু-সন্ধ্যে। ওদের শিমুলতলির পুরোনো বাড়িটার বাগানের ঐ জারুল গাছটায় বার কয়েক কুব কুব ডেকে উঠেছিল কুবো পাখিটা। বেশ মনে পড়ে রিনির এখনো! তখন ওর ক্লাস সেভেন্। হাতের লেখাটা তখনো একটু ভিতু ভিতু, কাঁচা কাঁচা টাইপের। জামরঙের এই মাঝারি খাতাটা আসলে ছোট্‌কা'র। খাতাটা ছোট্‌কা'রও বড় প্রিয়। তবু ভালোবেসে খাতাটা রিনিকে একেবারেই দিয়ে দিলো ছোট্‌কা। শর্ত একটাই। গুছিয়ে সুন্দর করে, প্রতিদিন ডায়েরি লিখতে হবে ওকে। তাও আবার ইংরেজিতে! পুজোর সময় ছোট্‌কা যখন আবার বাড়ি আসবে, তখন রিনির সেই লেখাগুলো প'ড়ে ট'ড়ে, কারেকশন করে দেবে খন্ ঐ ছোট্‌কাই! ওকে শুধু ততদিন নির্ভয়ে, হাত খুলে লিখে যেতে হবে!

খাতাটার লোভে বেশ জমকালো করে ঘাড়টা একবার নেড়েছিল রিনি। অর্থাৎ, লিখবে।

কথামতো লিখতে শুরুও করেছিল সে।

একটু বেশি ধ'রে ধ'রে, বেশ গোটা গোটা অক্ষরে, কারসিভ রাইটিংয়ে,
...আর এইচ্ আই ...টি এ ...এম্ ...এ ...ঋতমা।

পরের 'মিত্র' শব্দটায় পৌঁছে, লেখায় যত্নটা সামান্য হলেও খানিক ক'মলো রিনির।

তবুও সেটুকু পর্যন্ত ঠিকই ছিল। বেশ একটা ইংরেজি ইংরেজি মন নিয়ে দিব্যি এগোচ্ছিল রিনি, লেখাটাকে!

কিন্তু খাতাটার ভেতরের দিকের পাতায় যেই না মনের কথাগুলো লেখার চৌহদ্দিটাতে এসে পৌঁছল রিনি, পেনটা দুম্ করে লিখে বসলো ঠিক তিনটে লাইন...
"তেপান্তরের পাথার পেরোই রূপ-কথার,
পথ ভুলে যাই দূর পারে সেই চুপ-কথার!
পারুলবনের চম্পারে মোর হয় জানা...
"

যাঃ!

এ তো স্কুলের লিপিদি'র শেখানো নতুন গানটার মাঝের লাইন দু'টো!

আনমনে সেগুলোকেই যে লিখে বসে আছে রিনি!

ছোট্‌কা তো এমন বলে নি!

লেখা লাইনটুকু কাটাকুটি করে, কিংবা পাতাটা পুরোটাই ছিঁড়ে ফেলে, আবার নতুন করে লেখাটাকে শুরু করাই যেত!

কিন্তু রিনির মন সরে নি!

কি আর হবে! ছোট্‌কা-ই তো!

রবি ঠাকুরের লাইন লিখেছে বলে কি আর রাগ করবে ছোট্‌কা? তাও আবার রিনির ওপর!

এখনো মাস ছয়েক দেরি আছে পুজোর। পুজোর ছুটিতে দেরাদুন থেকে আবার বাড়ি ফিরবে ছোট্‌কা'রা। দেখতে দেখতে সে' ছুটিও ফুরোবে একদিন। আবার সেই বাক্স প্যাঁটরা বেঁধে গুছিয়ে, ছোটকাকী আর মিতুলটাকে নিয়ে, নিজের চাকরির জায়গায় ফিরে যাবে ছোট্‌কা! ঐ অল্প ক'টা দিনের আহ্লাদে ছোট্‌কা একটুও বকাবকির ভেজাল মেশাবে না, বেশ জানে রিনি।

তাই তো এই নীল পাতার খাতাটাকে নিশ্চিন্তে নিজের পড়ার ডেস্কে পুরে রেখে দিয়েছিল রিনি। নতুন কিছু আর লেখে নি সেদিন।

রবি ঠাকুরকেও আর ছেঁড়ে নি।

আর, ইংরেজিতে ডায়েরি লেখালেখিটা রিনি শুরু করেছিলো আরো কিছু পরে; ওর নতুন কালো ডায়েরিটাতে। ওটা ওর বাবার অফিস থেকে পাওয়া ডায়েরি। অমন ডায়েরি বাবার কাছে একবার চাইলেই অনেক পাওয়া যায়! তাই ও' খাতা রিনিকে টানে কম!

কিন্তু ছোট্‌কা'র দেওয়া খাতাটা রিনির কাছে যাকে বলে এক্কেবারে স্পেশাল!

ছোট্‌কার মতোই প্রিয় ওটা!

আর হবে নাই বা কেন!

পুজোয় ফিরে, সে' খাতা জমা চেয়ে, ছোট্‌কা রিনিকে একটুও কি বকেছিল?

একটুও না।

শুধু মিটিমিটি হেসে, রিনির মাথার চুলগুলো একটু ঘেঁটে দিয়ে বলে উঠেছিল, "পাগলী একটা!"

আর, হরিকাকার দোকান থেকে একটা 'গল্পগুচ্ছ' কিনে এনে, হাতে ধরিয়ে গেছিলো ছোট্‌কা।

ঐ বইটা থেকেও নাকি অনেক ভালো ভালো লাইন কোট্ করে রাখা যাবে... বুদ্ধিটা ছোট্‌কাই দিয়ে গেল দেরাদুনে ফেরার আগে।

সেই থেকে রিনির এই জামখাতাটায় পাকাপাকিভাবে ঢুকে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ।

ঋতুর সঙ্গে বেশ মানানসই কোনো লাইন, কিংবা বিশেষ কোনো দিনের বিশেষ বিশেষ ভালোলাগাগুলোর সঙ্গে তাল রেখে, কিংবা ওর ছোটো ছোটো এলেবেলে দুঃখগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে, রবি ঠাকুরের লেখা পছন্দসই লাইনগুলোকে খুব যত্ন করে জমা করতে লেগেছিল রিনি, ঐ খাতাটাতেই।

এরপর একে একে শীত গেল, পরের গরমের ছুটিগুলোও গেল... শিমুলতলির ছপাৎ ছপাৎ বর্ষায়, বৃষ্টিভেজা কালো স্কুল শ্যু আর ভিজে জুবড়ি টুপটাপানো ইউনিফর্ম গায়ে বাড়ি ফেরার দিনগুলো গেল... পুজোর ছুটি এলো, গেল; ...আবার শীতের কঠিন দিনগুলোও ফিরে এল। ছোট্ট রিনির খুব সাদামাটা জীবনটুকুর মধ্যে শুধু একটু একটু ক'রে প্রগাঢ় একটা নেশার মতো মিশে যেতে লাগলেন রবীন্দ্রনাথ!

দেখতে দেখতে সেই জামখাতাটার পাতাগুলো একটা একটা করে বসন্ত পেরোলো।

একদিন লেখার পাতাগুলো সত্যিকারের পলাশও ছুঁলো।

সেদিনও রিনি খুব লুকিয়ে 'গীতবিতান' থেকে লিখে রাখলো মাত্র একটাই লাইন... খাতাটার ঠিক মধ্যিখানের নীল একটা পাতায়...
"গোপনে তোমারে সখা কত ভালোবাসি!"

শিমুলতলি বয়েজের ফার্স্ট বয়, বাচ্চুদা, সেদিনই প্রথম রিনির অঙ্ক খাতাটার ভাঁজে রেখে দিয়েছিল বুক ঢিপঢিপ করা ছোট্ট সেই চিঠিটা। অতনু স্যারের কোচিং ক্লাস থেকে বাড়ি ফিরে যে চিঠিটা আচমকাই চোখে পড়ে গেছিল শুধুমাত্র রিনিরই!

ভাগ্যিস!

রিনি তখন বড় ভীতু ছিল।

খুব মুখচোরা মানুষ ছিল।

ওর মনের কথাগুলো জানতো শুধু ওর ঐ জামরঙা খাতাটার ক্রমশ ফ্যাকাশে হ'তে থাকা নীল পাতাগুলো, আর রবীন্দ্রনাথ।

এই সময়টাতে খাতাটাও যেন দ্রুত ভ'রে যেতে লাগলো, 'গীতবিতান' আর 'সঞ্চয়িতা'-র লাইনে লাইনে।

রিনি কখনো লিখলো,
"মুহূর্ত-আলোকে কেন, হে অন্তরতম,
তোমারে চিনিনু চিরপরিচিত মম।
"

আবার কখনো বা লিখলো,
"সেই কথা ভালো, তুমি চলে এসো একা,
বাতাসে তোমার আভাস যেন গো থাকে...
স্তব্ধ প্রহরে দুজনে বিজনে দেখা,
সন্ধ্যাতারাটি শিরীষ-ডালের ফাঁকে।"

শুধু এই একটাও কথা বলা হল না রিনির, বাচ্চুদাকে।

রিনির লাজুক নীরব কথাগুলো সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ সেই বাচ্চুদার হৃদয়কোরক অব্দি আর পৌঁছলো না কোনোদিন।

সে ভুল বুঝে, নিজেকে প্রত্যাখ্যাত মনে করে, অভিমানে শিমুলতলি ছাড়লো।

উচ্চশিক্ষার জেদ নিয়ে পাড়ি দিল রাউরকেলায়।

...ছাদের এক কোণে বসে, লুকিয়ে খুব কেঁদেছিল রিনি সেদিন!

তার আগে, কাঁপা কাঁপা হাতের খুব শিথিল প্রয়াসে খাতাটায় লিখে রেখেছিল সেই রবি ঠাকুরকেই...
"বন্ধু, তোমার পথ সম্মুখে জানি,
পশ্চাতে আমি আছি বাঁধা।
অশ্রুনয়নে বৃথা শিরে কর হানি
যাত্রায় নাহি দিব বাধা।
"

ওর এই খুব গোপন দুঃখ বাড়ির কেউ টের পায় নি।

শুধু ধরে ফেলেছিল নতুন বৌদিমণি!

পুলুদাদার বউ সে।

রিনির জ্যেঠুর একমাত্র সন্তান পুলুদাদা যেন কেমন কেমন!

নতুন বৌদিমণির মতো নয় যেন ওবাড়ির ওরা কেউই।

পুলুদাদাদের ঘরগুলো রিনিদের ঘরের ঠিক মুখোমুখি... মাঝে লতাপাতার বাহারি ডিজাইনের সাবেক রেলিং ঘেরা দোতলার চৌখোপ্পি বারান্দাটা, যার সমানে সমানে একতলায় ওদের চৌকো ঠাকুরদালানটা।

কতোদিন দেখেছে রিনি, নিজের ঘরে বৌদিমণি নিঝুম বসে আছে জানলাটার গরাদগুলোয় মাথাটা ঠেকিয়ে, চোখ বুজে!

'এক বাড়ির আলাদা হাঁড়ি'-র আত্মীয়তা তখন ওদের শিমুলতলির পরিবারে।

বাবারা তিন ভাই ততদিনে হেঁশেলের হাঁড়ি কড়াই উনুনে আলাদা।

মতাদর্শে, উপার্জন-সাচ্ছল্যে আর মনের নিবিড় বাঁধনটুকুতেও বেশ খানিকটা তফাতে।

নতুন বৌদিমণি ছাদে শুকোতে দেওয়া কাপড়গুলো গুছোতে গুছোতে হঠাৎ সেদিন দেখে ফেলেছিল রিনিকে... ছাদের এককোণে বসে কাঁদছে রিনি।

ছোট্ট ননদিনীটিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে, বেশ অনেকটা ক্ষণ চুপটি করে বসে রইল বৌদিমণি।

বৌদিমণির মুখটাও বড় উদাস দেখাচ্ছিল সেদিন!

ওর একান্ত কষ্টটুকুকে পাঁচ কান হ'তে দেয় নি মানুষটা।

রিনির মাথার চুলগুলোয় বিলি কাটতে কাটতে অস্ফুটে শুধু বলেছিল নতুন বৌদিমণি, "পাগলী একটা!"

* * * * * *

...আজ রিনির বিয়ের দ্বিতীয় বার্ষিকী।

বাড়ির দেখাশোনায়, কলেজ পেরোতে না পেরোতেই ওর বিয়ে হয়ে গেছে কলকাতার সম্পন্ন ব্যবসায়ী বর্মণরায় পরিবারে। মৈত্রেশ দেশ-বিদেশ ঘুরে, বেশ কিছু দামি ব্যবসাবুদ্ধি নিজের অধীত ডিগ্রিগুলোর মধ্যে পুরে, তবেই কলকাতায় নিজেদের পারিবারিক ব্যবসায় স্থায়ীভাবে থিতু হয়েছে!

রিনির জন্যে, রিনির জামরঙা খাতার জন্যে, আর রিনির রবীন্দ্রনাথের জন্যে তার বিশেষ সময় নেই।

নিজেরটুকু বুঝে নিতে বরাবরেরই অপারগ রিনির নতুন করে আর তেমন অভিযোগও নেই!

নতুন বাড়িতে, একলার একতলা, দোতলা, তিনতলায় রিনি এতোদিন ওর রবীন্দ্রনাথের এক একটা লাইনকে সাথে নিয়েই ঘুরে বেড়িয়েছে আপনমনে...

অতি বৈভবের শূন্যতায় নিজেকে বড় বেমানান মনে হয়েছিল প্রতিটি মুহূর্তে; তবুও সয়েই তো নিয়েছিল রিনি!

শুধু কানে বেজে গেছেন স্কুলের লিপিদি... কিংবা পূর্বা দাম... কিংবা জর্জ বিশ্বাস...

আর হেমন্তবাবুর গাওয়া সেই গানটা... গানের সেই লাইনটা...
"স্বপনদুয়ার খুলে এসো অরুণ-আলোকে
এসো মুগ্ধ এ চোখে।
ক্ষণকালের আভাস হতে চিরকালের তরে
এসো আমার ঘরে।
"

সে' প্রিয়তম মুখটি রিনির অন্তরমহলে এ' জীবনে পা রাখে নি।

একমাত্র রবি ঠাকুর আর রিনি জানে সে' কথা।

রিনি জানে আর একটা বিশেষ কথাও!

ওর শরীরের প্রথম বীজটা অঙ্কুরিত হতে শুরু করেছে মৃদু স্পন্দনে।

সে বুঝি শিশু ভোলানাথ!

নাকি ছোট্ট মিনি!

নাকি পরবর্তীতে সমাপ্তি'র সেই দস্যি মৃন্ময়ী!

বড় হাসি পায় রিনির!

সেই একার সুখে একার হেসে ওঠার সাক্ষী থাকেন কেবল রবীন্দ্রনাথ।

* * * * * *

গতকাল সকাল থেকে মাথাটা আর তুলতে পারে নি রিনি।

কাল দুপুরের দিকে পারিবারিক ডাক্তার প্রমথেশ সাহা খসখস করে প্রেসক্রিপশনে এক পাহাড় নতুন ওষুধ লিখে দিলেন।

অনেক রক্তপাত হয়েছে রিনির এই বাইশ বছরের ফিনফিনে শরীরটা থেকে।

খুব দ্রুত ঘাটতি পূরণ করতে হবে তো!

পরশু গভীর রাতে মৈত্রেশ কি একটা ট্যাবলেট প্রায় জোর করে মুখে পুরে দিলো ওর।

চোখে তীব্র শাসন আর ঔদ্ধত্য।

তার ঠিক কয়েক ঘণ্টা পরেই, ভোররাত থেকে অসহ্য যন্ত্রণায় তলপেটটা ছিঁড়ে যেতে লাগলো রিনির।

সঙ্গে প্রবল বমি বমি ভাব। শরীর জুড়ে অস্থির এক অশান্তি।

তখনো ভালো করে সকাল হয় নি... রিনির শরীর ছিঁড়ে রক্তগঙ্গা।

কাটা ছাগলের মতো ছটফট করতে করতে রিনি দিব্যি বুঝে গেল, ওর জীবনের একমাত্র মুক্তিটুকুও আজ ছিন্নভিন্ন হয়ে এই রক্তের হড়পা বানে ভেসে গেছে কখন!

আর, মৈত্রেশ আর ওর পরিবার, পাশের ঘরে ডাক্তার সাহার সঙ্গে ফোনে ফিসফিসিয়ে খুব গোপন কোনো আলোচনায় ভীষণ ভীষণ ব্যস্ত তখন!

ডাক্তারবাবুর বেশ হাতযশ আছে, মানতেই হয়।

মাত্র দু' দিনেই তিনি রিনিকে দিব্যি উঠিয়ে বসিয়েই ছেড়েছেন!

শুধু প্রবল এক অবসন্নতাবোধ এখনও রিনির গোটা শরীরটা জুড়ে।

মাথা তুলে বসতে ইচ্ছেই করে না!

কিন্তু জেহাদি চেতনাটা ছাড়ছেও না কিছুতেই রিনিকে! সে ক্রমশঃ উত্তাপ জড়ো করছে শিরায় শিরায়... শরীরের প্রতিটি কোষে কোষান্তরে।

মৈত্রেশ বেডরুমের ড্রেসিং মিররটার সামনে তৈরি হচ্ছিল।

একটা হাই প্রোফাইল পার্টি আছে ওর... হায়াত্-এ।

রিনি ঝিম মেরে বসে থেকে থেকে হঠাৎই মৈত্রেশকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে উঠেছিল, "আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেললে কেন? কি খাওয়ালে ওটা আমাকে?"...

রিনিকে ঠিক একটা ভূতে পাওয়া মানুষের মতোই দেখাচ্ছে!

"শাট আপ!

ব্লাডি হেল!

কি আলতু ফালতু ব'কছ!

বিষয়টা কমপ্লিটলি একটা গাইনোকোলজিক্যাল ডিজাস্টার। তোমার শরীর ওকে রাখতে পারে নি‌। দ্যাটস্ ইট্!

...বেমক্কা কিছু ভুলভাল স্টেটমেন্ট দিয়ে, আমাদের ফ্যামিলির রেপুটেশনটার চোদ্দটা বাজিয়ো না আর... আই ওয়ার্ন য়্যু!" - চিৎকার করে উঠল মৈত্রেশ।

ব্যর্থ মাতৃত্ব ফুঁসে উঠলো এবার, এক অচেনা রিনির অস্তিত্বের সবটুকু মরিয়া কাঠিন্য জুড়ে!

তীব্র ধিক্কারে ফেটে পড়েছিল রিনি, "আমি আলতু ফালতু বকছি?

আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেললে, তোমরাই। আর আমি মুখ বুজে বসে থাকবো? তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। ওষুধটা মুখে পুরে নিয়েছিলাম...।

কেন করলে এ' কাজ?

কি দোষ ছিল ওর?

কি খুঁত ছিল, আমার সন্তানের শরীরে? ...বলতেই হবে তোমাকে! বলতেই হবে!"

হিংস্র একটা হাসি খেলে গেল মৈত্রেশের মুখে!

"ইট ওয়াজ অ্যা বেবি গার্ল! অ্যান্ড উই জাস্ট ডোন্ট্ ওয়ান্ট এনি ড্যাম গার্ল, ম্যান... ক্লীয়ার?"

রিনির চোখ দুটো ধ্বক্ করে জ্বলে উঠেছিল।

"বেবি গার্ল! শুধু এ'টুকুর জন্যেই? ...হে ঈশ্বর!

...আমি কমপ্লেন ফাইল ক'রবো তোমার নামে ...তোমাদের সবার নামে।

তুমি আমার বাচ্চাটাকে এভাবে..."

একটা ভীম-থাপ্পড় সটান এসে পড়লো এবার রিনির রক্তশূন্য গালটার ওপর।

তারপর বার কয়েক... এলোপাথাড়ি...

হিসহিসিয়ে বলছে অভিজাত মৈত্রেশ বর্মনরায়, "মুখে কুলুপ এঁটে থাকবি তুই।

বুঝলি ডান্!

পাগল বলে পুরো রটিয়ে দেবো বাজারে, হা হা হা... আমাদের নামে তোকে কেস ফাইল করাচ্ছি, দাঁড়া!"

মৈত্রেশের শেষ বজ্রমুঠিটা রিনির নাকের তলায় পড়তে পড়তেও কুৎসিত মুখ-বিকৃতিতে শেষবারের মতো বলে উঠলো  রিনিকে, "শালা... বদ্ধ পাগল একটা!"

* * * * * *

ফরাসি সুগন্ধি গায়ে স্প্রে করে, গালে আফটার শেভের রোলারটা আরো একবার বুলিয়ে নিয়ে, কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছে মৈত্রেশ।

বিছানায় নিজের অশক্ত শরীরটাকে আঁকড়ে নিয়ে লুটিয়ে পড়ে আছে রিনি।

ওর ঠোঁট ফুলে ঢোল।

কষ বেয়ে বলকে বলকে রক্তের ধারা... আবার।

একটু পরে হাতটা বিছানার ম্যাট্রেস্-এর প্রান্তে চালিয়ে রিনি বের করে ফেললো, ছোটোবেলার সেই 'ঋতমা মিত্র' লেখা জামখাতাটা। খাতাটাকে আজও কাছছাড়া করে নি রিনি। মাথার বালিশটার কাছেই কোথাও স্তব্ধবাক পড়ে আছে রিনির সেই খাতাখানা আর তার মধ্যের রবীন্দ্রনাথ।

শুধু এই খাতাটায় পুরে রাখা রিনির নিমগ্ন দুনিয়াটা, আর রিনির রবীন্দ্রনাথ এখনো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।

তন্নিষ্ঠ চিত্তে খাতাটার শেষের দিকের নীল পাতাটায় পৌঁছল এবার রিনি।

তারপর ডান হাতের তর্জনীটাতে মেখে নিল ঠোঁট থেকে ফিনকি দিয়ে চুঁইয়ে পড়া রক্তটুক্।

সেটাই আজ রিনির একমাত্র লেখার কালি।

লিখে চলেছে রিনি সেই কালি দিয়ে, ওর জামখাতার ফুরিয়ে আসা শেষের নীল পাতায়...
"যে তোরে পাগল বলে, তারে তুই বলিস নে কিছুই।"

আজ যেভাবেই হোক রিনি স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে যাবে, এ বাড়ির সঙ্গে ঠিক বছর আড়াইয়ের সম্পর্কটাতে জন্মের শোধ ইতি টেনে!

আজ ওর সঙ্গে যাবে ছায়াসঙ্গী জামরঙা এই খাতাটা, আর খাতাটার আকাশ আকাশ নীল পাতাগুলো।

আর যাবেন রবীন্দ্রনাথ।।