সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯-২০০৩) মূলত কবি। বাংলা সাহিত্যে তিনি 'পদাতিক'-এর কবি নামে সর্বাধিক পরিচিত। তাঁর রচিত গদ্য গ্রন্থের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয় - স্বতন্ত্র দুখণ্ডে প্রকাশিত। আজীবন কমিউনিস্ট আদর্শে আস্থাশীল এই মানুষটি সৃষ্টির মধ্যে তার সুস্পষ্ট ছাপ রেখে গেছেন। গদ্যগুলিতে, বিশেষ করে তাঁর কথাসাহিত্যে সেই আদর্শের ব্যত্যয় ঘটেনি।
সুভাষ গদ্যসাহিত্যে বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিলেও বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর সংখ্যাগত পরিধি নিতান্তই কম। তিনি উপন্যাস রচনা করেছেন মাত্র পাঁচটি এবং গল্প লিখেছেন সাতটি। তাঁর উপন্যাস রচনার পেছনে আছে সুদীর্ঘ 'বিশ-বাইশ' বছরের প্রস্তুতি। যদিও কবির প্রথম প্রকাশিত রচনা হল কথিকা ধরনের একটি গল্প - সেই 'স্কুল লাইফ'-এ লেখা। ১৯৩৬ সালে সুভাষ যখন ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনের ছাত্র, তখন স্কুল ম্যাগাজিন 'মৈত্রী'তে প্রকাশিত হয় প্রথম গল্প 'মুক্তির ডাক'। তাঁর দ্বিতীয় গল্প 'ভবন ছাড়ায়ে ভুবনে' ১৯৩৭ সালে ওই ম্যাগাজিনেই প্রকাশিত হয়। ১৯৪৩ সালে অক্টোবর ৬, 'জনযুদ্ধ' পত্রিকায় প্রকাশিত হল তাঁর তৃতীয় গল্প 'অপরাজিত' - মার্ক্সীয় দর্শনের প্রভাব এই গল্পে প্রথম পেলাম। 'অপরাজিত' পূর্বে রচিত গল্প দুটি থেকে স্বতন্ত্র ও প্রকৃত অর্থেই গল্প হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৬৮ সালে শারদীয়া 'স্বাধীনতা' পত্রিকায় সুভাষের একটি অসাধারণ গল্প প্রকাশিত হল, যার নাম 'একটি রাস্তার সূত্রে'।[১] আবার বিরতি, ১৩৮১-তে শারদীয়া 'কৃত্তিবাস'-এ বেরোল 'মনে হয়'।[২] ১৯৮২ সালে শারদীয় 'সপ্তাহ'-এ প্রকাশিত হল 'আয়না'[৩] এবং ১৯৯৪ সালে শারদীয় 'আজকাল' থেকে পাঠক পেল 'বাড়ি বদল'।[৪] পূর্বেই বলা হয়েছে, প্রথম দুটি গল্পের মধ্যে গাল্পিক বলিষ্ঠতা নেই, অনেকখানি বিবৃতিধর্মী। 'অপরাজিত' থেকেই সুভাষের গল্প বলার নিজস্ব ধরণ চোখে পড়ে।
সুভাষ গল্প লিখলেন, কিন্তু কল্পলোকের চরিত্র নির্মাণ করে চাক্ষুষ বাস্তবতাকে অতিক্রম করে নয়। কবি নিজেই এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেনঃ "ঠিক বানানো গল্প আমি কখনো লিখতে পারি না। আমার লেখা শুরু হয়েছিল গদ্য দিয়ে। ছেলেবেলায় স্কুলের ম্যাগাজিনে প্রথম লেখা বেরিয়েছিল। কথিকা ধরনের লেখা।..."[৫]
"... চাক্ষুষ দেখাশুনো ও অভিজ্ঞতা থেকে আমার গল্প। যা দেখেছি তার বেশি নেই, অথচ প্রদোষ আছে। প্রদোষ '৪৩-এর দুর্ভিক্ষে মধ্যবিত্তের অবস্থা দেখেছে - দুর্ভিক্ষের তাড়নায় গ্রামের চাষি হাল-বলদ বেচেছে, তবুও সংসার বাঁচাতে পারেনি। ক্ষুধায় এরা কাতর, তবু 'লঙ্গরখানায় গেলে এদের পৌরুষ আহত হয়'।"[৬] এক বেলা শাকান্নে এরা খুশি - এই হল সুভাষের দেখা দুর্ভিক্ষ-ক্লিষ্ট মধ্যবিত্ত বাঙালি। পেটে খিদে মুখে লাজ - না না, লাজ নয়, মধ্যবিত্তের আত্মমর্যাদা। এই আত্মমর্যাদা মধ্যবিত্তকে স্বাতন্ত্র্য দান করে। প্রদোষও মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনীতি করা এক যুবক। সে এই গল্পের দ্রষ্টা চরিত্র।
'একটি রাস্তার সূত্রে' গল্পে উপন্যাস লিখতে ইচ্ছুক হরিগোপালের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে মধ্যবিত্ত বাঙালির বিচিত্র জীবন-ছবি। অত্যন্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের হরিগোপাল জীবনের তিরিশ বছর অতিক্রম হলেও উপন্যাসের প্লট-এর কোনো সূত্র নির্ধারণ করতে পারলেন না। সে উপন্যাসের কাহিনি বা প্লটের সন্ধান করতে করতে পেয়ে গেল একটি রাস্তা। তাদেরই পাড়ায় বকুলগাছের কাছেই রয়েছে একটি রাস্তা। সেই রাস্তার পার্শ্বে রয়েছে তার উপন্যাসের পাত্রপাত্রীরা। তাদের মাধ্যমে হরিগোপাল জীবনকে দেখতে শুরু করল। আর এই সূত্রে পাঠক পেয়ে গেল মধ্যবিত্ত বাঙালির কিছু খণ্ড ছবি।
হরিগোপাল প্রথমেই দেখতে পেল তার বন্ধু সন্তোষদের বাড়ি। এ-পাড়ায় যে বাড়ি 'পাগলের বাড়ি' বলে পরিচিত। এই পরিবারটি হল জীবন-যন্ত্রণা ক্লিষ্ট, রোগদীর্ণ, অসহায় এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার। অজানা পাগলামি রোগে এই পরিবারের চার চারজনের মৃত্যু হয়েছে। লেখক পরিবারের অন্দরমহলে প্রবেশ করেননি। তবে, হরিগোপাল বলে দিলেন পাগলদের বাড়ি বলে এই বাড়ির জানালার দিকেও মানুষ তাকিয়ে দেখে না - সহানুভূতিহীন, সংস্কারাচ্ছন্ন, এও তো মধ্যবিত্তের মানসিকতা। আবার, সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেনঃ "এখন সবাই মিষ্টি মেয়েটাকে দেখবে বলে জানালার দিকে মুখ তুলে তাকায়।"[৭]
টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত পরিবার হল এক ইঞ্জিনিয়ারের পরিবার। বাগানওয়ালা বাড়ি। এই উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে ছিল একমাত্র মেয়ে। কিন্তু, আভিজাত্য বা মধ্যবিত্তের জটিল মানসিকতার কারণে মেয়ের সাধারণের সঙ্গে মেলামেশা বা বাড়ির বাইরে বেরোনোর হুকুম ছিল না। সুভাষ একটি বাক্যে এরূপ মধ্যবিত্ত পরিবারের চরম পরিণতির ইঙ্গিত দিয়েছেনঃ "কিন্তু হাতে শাঁখা আর সিঁথিতে সিন্দুর থাকা সত্ত্বেও কেন যে সে মেয়ে বরাবর বাপের বাড়িতেই থেকে গেল হরিগোপাল বুঝে উঠতে পারে না।”[৮] হরিগোপাল বুঝতে না-পারলেও পাঠক বুঝতে পারে এর আসল রহস্য - মধ্যবিত্তের আভিজাত্য, অহংবোধ, সামাজিকীকরণের অভাবের চূড়ান্ত পরিণতি।
হরিগোপালের দৃষ্টিতে সুভাষ মধ্যবিত্তের চারিত্রিক স্খলনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। কোম্পানির সাধারণ চাকুরে, তার স্ত্রীও মধ্যবিত্ত ঘরের বউ। সাধারণত মধ্যবিত্ত পরিবাবের মেয়েরা 'লোকে কী বলবে' এই মানসিকতায় বেড়ে ওঠে। খুব প্রয়োজন না-হলে বাড়ির বাইরে বেরোয় না। তার অর্থ এই নয়, যে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। যাই হোক, কোম্পানির সাধারণ চাকুরে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারটি হঠাৎ উচ্চ-মধ্যবিত্ত হয়ে গেল। মধ্যবিত্তের ধর্মই হলো উপরে তাকানো। অবশ্য, কেউ কেউ উপরের দিকে তাকাতে গিয়ে নীতি-আদর্শ বা চারিত্রিক অবনমনকে পরোয়া করে না। সুভাষ এমনই এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ ঘটালেন। তিনি স্বল্প বাক্যে অধিক কথা বলে দিলেনঃ "ভদ্রলোকের ভোল বদলেছে যুদ্ধের ভিতর দিয়ে। আরও হালে বদলেছে তার স্ত্রী। আগে ছিলেন মধ্যবিত্ত ঘরের বউ। বাড়ির বাইরে যেতে বড় একটা দেখা যেত না। এখন তো সন্ধ্যে হলেই ঠোঁটে রঙ মেখে ভেঁপু বাজিয়ে বেরিয়ে পড়েন, ফেরেন সেই রাত্রে।"[৯] পাঠক বুঝলেন লেখকের ইঙ্গিত।
মধ্যবিত্ত বাঙালির মহিলামহলের অন্যতম ধর্ম হল পিএনপিসি। পাড়ার মেয়েদের নিয়ে চর্চা হয় বুড়িদের মহলে। হরিগোপালকে দেখে মাঝে-মাঝে তারা থেকে যায়। হরিগোপাল বোঝেন, এদের আলোচ্য বিষয় তাদের (হরিগোপাল) পরিবার। মধ্যবিত্ত পরিবারে ডিভোর্স মানানসই নয়। তার ওপর ডিভোর্স দিয়ে দ্বিতীয় বিবাহ - বড্ড চক্ষুলজ্জার ব্যাপার বলে সাধারণ মধ্যবিত্তের ধারণা। হরিগোপালের ছোট বোনের এমনই ঘটনা পাড়ার বুড়িদের আলোচ্য বিষয়। আবার, মধ্যবিত্ত সব তাল বাঁচিয়ে চলে। বুড়িরাও তাল বাঁচিয়ে চলতে জানে। তাই, হরিগোপালের ছোটবোন 'গট গট করে হেঁটে' বাড়ি এলে, বুড়িরা ডেকে কথাও বলে। তবে মধ্যবিত্ত সমাজের পরিবর্তন হয়েছে। পূর্বে হরিগোপালের ছোট কাকা কায়স্থ মেয়ে বিবাহ করলে পাড়ার বুড়িরা হরিগোপালের মায়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু, এখন সময় বদলেছে, মধ্যবিত্ত বাঙালির বুড়িরাও বদলেছে - বলা ভালো বুড়িদের জেনারেশনের পরিবর্তন হয়েছে। এখন পিএনপিসি করলেও আগের মত ডাইরেক্ট এভোয়েড করে না।
হরিগোপাল নিম্ন-মধ্যবিত্তের করুণ ছবি দেখেছে বৃদ্ধ ব্যোমকেশবাবুর মধ্য দিয়ে। একটা মোটে ভাড়া ঘর। ছেলে-বউয়ের সাথে একঘরে একসাথে থাকা অসম্ভব। কাজেই ব্যোমকেশবাবু দিনের বেলায় বকুলগাছের নীচে ইজিচেয়ারে বসে কাটিয়ে দেন, আর রাত্রে থাকেন পাশের বাড়ির গাড়ি বারান্দার নীচে।
আবাসন সমস্যা কেবল ভিক্ষুক দরিদ্র্য মানুষের নয়, মধ্যবিত্তেরও। ভাড়া বাড়িতেই তাদের জীবন অতিবাহিত করতে হয়। সবসময় একটা ভয় তাড়া করে, 'এই বুঝি নোটিশ আসবে উচ্ছেদের'। প্রভাত মেশোমশাই সেই নোটিশ পেয়েছেন।
এই গল্পে সন্তোষ, ব্যোমকেশবাবু ও প্রভাত মেশোমশাই ব্যতীত আর কোনো চরিত্রের নামোল্লেখ লেখক করেননি। মূলত দুটি কারণে বলে মনে হয়ঃ প্রথমত, এই টুকরো-টুকরো ছবিগুলি কোনো ব্যক্তি বিশেষের নয়, বাঙালি অসংখ্য মধ্যবিত্ত জীবনের প্রতিরূপ। দ্বিতীয়ত, পাড়ার রাস্তাকে কেন্দ্র করে প্রতিদিনের দেখা ছবি হলেও তারা হরিগোপালের অপরিচিত। সন্তোষ ছিল তার বন্ধু, সেই সূত্রে তাদের বাড়ি হরিগোপালের পরিচিত। আর ব্যোমকেশবাবু ও প্রভাত মেশোমশাইয়ের সঙ্গে তার নিয়মিত কথাবার্তা হতো। বাকিদের সঙ্গে তার সম্পর্ক সামাজিকও নয় - মধ্যবিত্তের এ-এক বড়ো সংকট। প্রতিবেশীদের সঙ্গে বাঙালি মধ্যবিত্তের পারস্পরিক সম্পর্কের অসারতার দিকটি উন্মোচন করার জন্যই লেখক চরিত্রগুলির নামোল্লেখ করেননি।
'মনে হয়' গল্পে আছে তিনটি অংশ। প্রথম অংশ 'নিজস্ব সংবাদদাতা'। এই অংশে দেখা যায় লেখকের কাছে এসেছে একটি চব্বিশ-পঁচিশ বছরের যুবক। যুবক প্রকৃত লেখককে দেখে 'অন্যলোক' ভেবেছে। বোঝা গেল প্রকৃত লেখকের আড়ালে অন্য কেউ আছে। দ্বিতীয় অংশের নাম 'এক বুজরুক'। কবির নাম ও পরিচয় ব্যবহার করে কোনো এক কবি যশোপ্রার্থী আত্মগোপন করে আছে। কবি সমস্ত কিছু বুঝেও তাকে চিহ্নিত করতে পারছেন না। তৃতীয় অংশের নাম 'আরেকটু হলেই'। কবি চেষ্টা করেও জাল বা নকল কবিকে ধরতে পারলেন না। হাত ফস্কে বেরিয়ে গেল - পাঁকাল মাছের মতো। এও তো মধ্যবিত্ত, তবে বুজরুক মধ্যবিত্ত। সুভাষের নির্মিত বাঙালি মধ্যবিত্ত চরিত্রের অন্য এক দিক।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একটি অন্যতম গল্প 'আয়না'। সংসার জীবনে কর্তব্যপরায়ণ, মিতভাষী, Introvert এক মধ্যবিত্ত চরিত্র বিমল। সাধারণ চাকুরীজীবী, সংসারের সব ধরণের দায়-দায়িত্ব আপন স্কন্ধে স্থাপন করে গতানুগতিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত। কেবল সমাজে নয়, পরিবারেও সকলের মধ্যে থেকেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে - পাছে সে অন্য কারোর অসুবিধার কারণ হয়, এই ভেবে। সে ভীড়ের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে দিতে ভালোবাসে, হয়তো বা লজ্জাবশত। সুভাষ তার চরিত্রের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেনঃ "বিমল ঠিক কচ্ছপের মতোই একটা শক্ত খোলসের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখত।"[১০]
পড়াশুনায় ভালো হলেও মধ্যবিত্তের ambitious তার না-থাকায় ভালো ফল কোনোদিনই হয়নি। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা না-থাকার কারণ অত্যন্ত হাস্যকর - এগিয়ে যাওয়ার অর্থ অন্যকে পিছিয়ে ফেলা। যে পিছিয়ে যায় তার মনে কষ্ট হয়। আর কাউকে কষ্ট দেওয়া বিমলের প্রকৃতি নয়। সে অস্বাভাবিক রকমের সহানুভূতিশীল। বিশ্বের কোনো দিকে তাকাবার ফুরসৎ বা ইছা কোনোটাই তার ছিল না।
মধ্যবিত্ত বাঙালি আড্ডাবাজ, গল্পবাজ, সিনেমা-খেলা সব কিছুতেই তাদের আগ্রহ। কিন্তু বিমল এসবের বাইরে। বহির্জগৎ সম্পর্কে সে উদাসীন।
সে প্রথম অপরের নিকট থেকে খবরের কাগজ চেয়ে পড়ল, লিফটে করে নীচে নামল এবং এক ঠোঙা চিনে বাদাম কিনে পার্কে গিয়ে বসল। পার্কে দেখা হল তার সহপাঠী যতীনের সঙ্গে। যতীনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে পড়ল সহদেবের কথা। যতীন ও সহদেব একই ক্যাটাগরির লোক। বলা যেতে পারে ফুটানিবাজ মানুষ। তার গানের থেকে বাজনা বেশি। সেই কিনা বিমলের কাছে পঞ্চাশ টাকা ধার চেয়ে বসল - মধ্যবিত্তের এও এক রূপ।
মধ্যবিত্ত সমাজে প্রভু-ভৃত্যের একটা যান্ত্রিক সম্পর্ক আছে। সেই সম্পর্ককে অতিক্রম করে 'বাড়ি বদল' গল্পে মানবিক সম্পর্কের বন্ধন লক্ষিত হয়। দীর্ঘ বত্রিশ বছর পরিচারিকার কাজ করেছে ঊষা। বত্রিশ বছর পর কাজ ছেড়ে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করছে। তাকে বিদায় দিয়ে গৃহস্থের লোকেরা মর্মাহত - "ট্যাক্সিটা মোড় ঘুরে অদৃশ্য হওয়ার পর ফাঁকা বাড়িটাতে ফিরতে ফিরতে তাদের চোখ ছলছল করছিল।"[১১]
"বাড়ির ছেলেমেয়েরা ঊষাকে পিসি বলে জানত। ঊষাও তাদের নিজের ছেলেমেয়ে-নাতিনাতনির মতো ভালোবাসে। কাজের লোক হলেও এ বিষয়ে কেউই গভীরে যেত না।"
ঊষার বেতন সমস্থান ও সমকালের প্রেক্ষিতে যথেষ্ট কম হলেও, "ঊষাও ও নিয়ে মাথা ঘামায় না। কেননা এ বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্কটা তো ঠিক টাকার নয়। প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক হলে ওসব কথা ওঠে। কিন্তু ঊষা তো এ বাড়ির একজন।"[১২]
এ সম্পর্ক কেবল ঊষার দিক থেকে নয় - মনিব বাড়ির দিকে থেকেও কম নয়। ঊষা চলে যাওয়ার পর থেকে এ বাড়ির নাতনিটি চুপ হয়ে গেছে। এছাড়াও, "সকলের বুকের মধ্যে দমসানো ভাব।"[১৩] মধ্যবিত্ত কেবল স্বার্থপর নয়, মানবিকও হয় - সুভাষবাবু সেদিকেও পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় কেবল কবি বা সাহিত্যিক নন, তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে সমাজবিজ্ঞানী। তাঁর গল্পগুলির মধ্যে যে সমাজ-বাস্তবতার প্রাবল্য লক্ষিত হয় তা ওই সমাজ-বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। তাছাড়া, তাঁর নির্মল হৃদয়বৃত্তি যে সুস্থ সমাজের কল্পনা করতো গল্পগুলিতে সেই পরিণতিই সূচিত হয়েছে। যদিও তিনি বলেছেন, তাঁর গল্পের কাহিনি বানানো নয়, চাক্ষুষ বাস্তব। কাজেই বলা যায়, সুভাষ কোনো নির্দিষ্ট তত্ত্বে নয়, মধ্যবিত্ত বাঙালির বৈচিত্র্যময় চরিত্রগুলিকে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন তাঁর গল্পে। মধ্যবিত্তের হাত ধরেই সমাজ পরিবর্তন সম্ভব, মনে হয় এই ভাবনা থেকেই তাঁর গল্পের চরিত্রগুলি নির্মিত। আবার, মধ্যবিত্তের চরিত্র একই সরলরেখায় প্রবাহিত হয় না। সেই বৈচিত্র্যের প্রতিও তিনি আলোকপাত করেছেন।
তথ্যসূত্রঃ
১। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ঃ 'গদ্য সংগ্রহ', দ্বিতীয় খণ্ড, দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৩, পৃ. ৫০৯।
২। ঐ, পৃ. ৪৭৮, অনুবাদকঃ শুক্তি সরকার।
৩। ঐ, পৃ. ৫১৫।
৪। ঐ।
৫।ঐ, ৫১৬।
৬। ঐ, ৫১৯।
৭-৯। ঐ, ৫২১।
১০। ঐ, ৫২৯।
১১। ঐ, ৫৩৯।
১২। ঐ, ৫৪৪।
১৩। ঐ, ৫৪৬।
[লেখাটি 'আত্মবিকাশ'; ১৩ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা; মার্চ-মে ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত। লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত হল।]
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।