অনলাইন এই শব্দটার সাথে এখন আমরা সবাই মোটামুটি পরিচিত। আজ থেকে ১০ বছর আগেও আমরা ভাবতে পারতাম না যে দুটো মানুষের মধ্যে যোগাযোগ এত সহজ হয়ে যাবে। যেদিন থেকে সমুদ্রের তলা দিয়ে মানুষ কেবল্ (তার) নিয়ে গেছে সেদিন থেকে মানুষ কিছুটা হলেও দুনিয়াকে নিজের হাতের মুঠোয় করে ফেলেছে। আর তার পর থেকেই প্রভূত উন্নতি ঘটেছে যোগাযোগ ব্যবস্থায়। এসেছে ভার্চুয়াল মাধ্যম। যেখানে মানুষ ঘরে বসেই তার প্রিয়জনকে দেখতে পারে কথা বলতে পারে। তবে এই আন্তর্জলিক ব্যবস্থার আশীর্বাদ যেমন আছে সেরকম অভিশাপও আছে।
যেকোনো নতুন জিনিস আবিষ্কার হলেই যে তার সবকিছু ভাল হবে তা নয়। সবকিছুই ভাল খারাপ মিলিয়ে তৈরি হয়। অনলাইন-এর আবিষ্কার কিছুটা সেরকম। আগে আমাদের কোনো কিছু বুকিং করতে গেলে বাড়ি থেকে অনেক দূরে বুকিং কাউন্টার-এ যেতে হতো কিন্তু এই অনলাইন মাধ্যম আসার পর থেকে সেটা অনেকটা কমে গেছে। এখন তো ঘরে বসেই সব কাজ হয়ে যাচ্ছে। ঘরে বসে খাবার অর্ডার করলে সেটাও আমরা মুহূর্তের মধ্যে বাড়িতে পেয়ে যাই। এখন আর রেস্তোরাঁ গিয়ে খাবার খেতে হয় না। শুধু এটাই নয় এখন তো মাসের বাজারও চলে আসে ঘরে তাও আবার ঘরে বসে অর্ডার করেই। অফিসের কাজ, পড়াশোনা সব কিছুই অনলাইন-এ হচ্ছে। সব থেকে বড় ব্যাপার হলো এখন আবার ই-বই (e-book)-ও এসে গেছে বাজারে। এর সুবিধা হলো পাঠকরা অনলাইন লাইব্রেরি পেয়ে যাচ্ছে একেবারে হাতের মুঠোয় আর সেইজন্যই পুরোনো হয়ে গিয়ে বই-এর পাতা ছিঁড়ে যাওয়া বা ঘরে লাইব্রেরি রাখার কোনো দরকারই পড়ছে না।
এই তো গেল আশীর্বাদ বা সুবিধার দিক এর সাথে অভিশাপ বা অসুবিধার দিকও আছে। এই অনলাইন এসে যাওয়ায় অনেকেই ভুল পথে চলে যাচ্ছে। অনেক বাজে কাজের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ছে। অনলাইন কেলেঙ্কারি বা প্রতারণা (Scam)-র কথা আজকাল প্রায়শই শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। মানুষের সামান্য অসাবধানতাবশত ঘটা ভুলের সুযোগ নিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে সেখান থেকে টাকা বের করে নেওয়ার ঘটনা এখন আর নতুন কিছু নয়। অনেক সময় এই Personal Database-ও হ্যাক হয়ে যাচ্ছে। মানুষ এই অনলাইন ব্যবস্থায় অনেক অসুবিধায় পড়ছে। বিশেষ করে যারা একটু বয়স্ক অনলাইন ব্যবস্থার খুঁটিনাটি এখনও অতটা রপ্ত করে উঠতে পারেননি তারাই অনেক সময় বুঝতে না পেরে অনেক ভুল লেনদেন করে ফেলছেন যার ফলস্বরূপ তাদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
সব থেকে ভয়ানক দিকটা এখনও তুলেই ধরিনি। এখন আমরা খেতে পাই বা না পাই আমাদের প্রত্যেকের কিন্তু একটা করে মোবাইল ফোন অপরিহার্য। আগে এই মোবাইল ফোন ছিল মূলত আপৎকালীন ক্ষেত্রে ব্যবহারের বস্তু আর এখন সেটা হয়ে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় একটা বস্তু। প্রথমদিকে আসত Keypad দেওয়া ছোট Screen-এর ফোন। তখনও বিপদটা এতটা ছিল না। কিন্তু যবে থেকে বড় Touch Screen-এর ফোন এল সেদিন থেকেই সর্বনাশের শুরু। ছোট স্ক্রিন-এর ফোনে কেউ গেইম (Mobile Game) খেলতে পছন্দ করত না কিন্তু যখন থেকে বড় টাচ স্ক্রিন-এর অ্যান্ড্রয়েড (Android) ফোন এল তখন থেকে গেইম খেলাটা একটা নেশায় পরিণত হলো। জানি না অনলাইন-এর এই আবিষ্কার কতটা আশীর্বাদ স্বরূপ কিন্তু এটা বলতে পারি যে এটা বর্তমানে অনেকটাই অভিশাপ ডেকে এনেছে মানুষের জীবনে। একটু গভীরে গিয়ে যদি দেখা যায় তাহলে এটাও দেখা যাবে যে কত অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের জীবন এই মোবাইল ফোন-এর জন্য নষ্ট হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। আজকাল কলকাতায় বইমেলা হয় কিন্তু প্রশ্ন জাগে কতজন পড়ার জন্য বই কেনে। বই পড়ার চল তো এখন প্রায় উঠেই গেছে, ছোটবেলায় আমরা কত গল্পের বই, বিশেষতঃ পুজোসংখ্যা ইত্যাদি পড়তাম। কিন্তু এখনকার প্রজন্মকে এগুলোর প্রায় কিছুই আকর্ষণ করে না।
কিছুদিন আগে একটি ঘটনা শুনেছিলাম, খুব সম্ভবত আমেরিকায় একটি ছেলে মোবাইল গেইম-এর প্রতি এতটাই আসক্ত ছিল যে সে মায়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে যত টাকা ছিল সবটাই একটি গেইম-এর সাবস্ক্রিপশন-এর জন্য ঢেলে দেয়। ভাবুন কারোর কষ্ট করে উপার্জিত টাকা কিভাবে ওড়ানো হচ্ছে। ব্যাপারটা শুধু এখানেই থেমে থাকেনি, সম্প্রতি কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া 'Blue Whale Challenge' Game Scam-এর ব্যাপারেও আপনারা নিশ্চয়ই জানেন। কত মানুষ নিজেদের জীবনকে শেষ করে দিয়েছে এই 'Blue Whale Challenge' গেইম খেলার জন্য। জানিনা আরো কত 'উন্নতি' আমরা দেখবো। এমন উন্নতি যা মানুষকে শেষ করে দেয়। যে আশীর্বাদ অভিশাপ ডেকে আনে সেরকম আশীর্বাদ কি আদৌ দরকার আছে জীবনে?
এক এক সময় মনে হয় যে বিজ্ঞানের এই যে উন্নতি এটা ঠিক আশীর্বাদ বা অভিশাপ তর্কের উর্দ্ধে চলে গেছে এখন বলতে ইচ্ছে করে যে এটা হলো আশির শাপ অর্থাৎ শাপ রূপী আশীর্বাদ। আবার অনেক সময় এটাও শুনতে পাওয়া যাচ্ছে যে ছেলেরা কোন ফোন চেয়েছে আর সেটা মা-বাবারা দিতে পারছে না তাই তারা আত্মঘাতী হয়ে যাচ্ছে। কি এমন জিনিস যেটার জন্য কেউ মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনছে। এ তো Drug-এর নেশার থেকেও ভয়ানক কিছু যে সুপ্ত থেকে মানুষ মারছে। দুনিয়াজুড়ে এর প্রতিবাদ হওয়া দরকার। এখন এমন পর্যায়ে আমরা পৌছে গেছি যেখানে প্রযুক্তি আমাদের চালনা করছে আমরা প্রযুক্তিকে চালনা করতে পারছি না। সময় এসে গেছে এই বিষয়টা নিয়ে ভাবার। আজকে হয়তো দুটো ছেলে বা মেয়ের প্রাণ গেছে কিন্তু আরও প্রাণ যাতে না যায় সেটা আটকানোর চেষ্টা করতে হবে। কথায় বলে অতিরিক্ত কোনোকিছুই ভাল নয় আর সেটাই এখন ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছে। মানবসমাজের অস্তিত্ব বাঁচানোর সময় এসে গেছে, এবারে জাগতে হবে আমাদের।
এই প্রসঙ্গেই আরও একটি বিষয় এখন মাথাচারা দিয়ে উঠেছে আর সেটি হলো অনলাইন লটারি। আগে শুনেছি যে মানুষ লটারিতে অনেককিছু খুইয়েছে কিন্তু অনেকের কাছে সেটাই এখন একটা উপার্জনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ এখন এতটাই মত্ত হয়ে গেছে এই অনলাইন লটারি নিয়ে যে তারা পরিবার নিয়ে আর ভাবছে না। মনে এতটুকু ভয় নেই যে তারা সর্বস্বান্ত হয়ে যেতে পারে। এগুলোকেও তারা কিন্তু অনলাইন গেমিং-এর একটি অঙ্গ ভাবছে। এইসব মানুষকে নেশার মতন গিলে ফেলছে। সব থেকে বড় ব্যাপার হলো মানুষ তার নিজের স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলছে। এইভাবে যখন মানব সমাজকে একটি বিষয় গ্রাস করে তখন সেটাকে আশীর্বাদ বলা যায় কি? যে জিনিস আমাদের পঙ্গু করে দিচ্ছে আমরা অবনতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি সেই জিনিস নিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব আমার তো জানা নেই। আগে এই বাঙালীকেই লড়তে দেখেছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে অথচ আজ সেই অন্যায়কেই তারা আশ্রয় করে নিয়েছে। বাঙালি গড়তে ভুলে গেছে। বাঙালি অনেক অনেক বড় বড় বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সাথে যুক্ত এবং সেগুলি কিন্তু মানবসমাজের অনেক উন্নতিতে কাজে লেগেছে। কিন্তু একি আবিষ্কার হলো যা মানুষকে ক্রমশ শেষ করে দিচ্ছে, তার চিন্তা করার শক্তি কেড়ে নিচ্ছে। কিছু মানুষের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সমাজের একটা বড় অংশের ক্ষতি আমরা হতে দিতে পারি না। এখনই আমাদের সকলের একত্র হয়ে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত নয়তো আবার আমরা বিনাশ দেখবো। এবারে কিন্তু প্রাকৃতিক নয় কৃত্রিমভাবেই ধ্বংস হবে মানব সভ্যতা। করোনা মারণ রোগ এসেছিল দেশে সেখান থেকে আমরা অতি কষ্টে বেঁচে ফিরতে পেরেছি কিন্তু এ এমন এক রোগ যার কোনো চিকিৎসা আলাদাভাবে হয়না। আমরা নিজেরাই পারি এই চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসতে যদি আমরা চাই।
এখন আমরা অনলাইন মাধ্যমে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে আমরা জীবনজীবিকার জন্য সেই মাধ্যমকেই বেছে নিচ্ছি। খুব সম্প্রতি অনেক বড় বড় YouTuber-দের নাম আমরা খবরের কাগজে বা সংবাদমাধ্যমে শুনতে পাচ্ছি। প্রচুর মানুষ আছেন যারা Online Content Creation করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। অনেকের content আবার এরকম যেখানে তাদের খুব বেশি পড়াশোনা জানার দরকার পড়েনা অথবা মাথা খাটিয়ে বা মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও তাদের সেটা বানাতে হয়না কিন্তু একবার যদি জনসমাজে স্বীকৃতি পেয়ে যায় তাহলেই সেটা তার একটি উপার্জনের অন্যতম রাস্তা হয়ে যায়। কিছু Vlogger আছেন যারা খুব Informative Vlog বানান আবার কিছু আছেন যারা রোজনামচার উপর ভ্লগ বানান। রোজনামচা নিয়ে যারা ভ্লগ বানাচ্ছেন তাদের থেকেও যারা কোনো একটি বিষয়ের উপর অনেক তথ্য দিয়ে ভ্লগ বানান সেটি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি। আমরা নিজেদের এরকম জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি বা এরকম কাজের সাথে যুক্ত করতে চাইছি যেখানে আমাদের বুদ্ধি খুব বেশি ব্যবহার করতে হবে না কিন্তু উপার্জন হয়ে যাবে। আমি কিন্তু চিরকাল জানি যে বাঙালি হলো খেটে খাওয়া জাতি কিন্তু হঠাৎ করে একি হলো এই জাতির যে তারা ঠিক ভুলের মাত্রাটা হারিয়ে ফেলছে। আবারও বলছি যে ভাবার সময় এসে গেছে। আমাদের মাথা যদি কাজ করা বন্ধ করে দেয় তাহলে কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি আমরা প্রযুক্তির দাস হয়ে যাব। যদিও তার কিছুটা ইতিমধ্যেই চালু হয়ে গেছে। সমাজকে তা পুরোপুরিভাবে গ্রাস করে নেওয়ার আগে আমাদের সাবধান হতে হবে। আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কি উদাহরণ রেখে যাচ্ছি? এটাই কি তাদের প্রাপ্য।
বিজ্ঞান উন্নতি করছে আরও করুক এটাই চাই কিন্তু সেই উন্নতি যদি কোনো জাতি বা একটা গোটা সমাজকে শেষ করে দেয় তাহলে সেই উন্নতি কিন্তু একেবারেই কাম্য নয়। জীবনটা নিয়ে ছেলেখেলা করার সময় এটা নয়। সময় এসেছ এটা বোঝার যে আমরা ক্রমশ ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আর এটা অন্য কেউ আমাদের বোঝাতে পারবেন না বা কারোর বোঝানোর দায় নেই নিজেদেরকেই যা করার করতে হবে। একটা বিশাল বড় ভুল থেকে রক্ষা পেতে এখন কিছু করা যেতে পারে কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলে আর কিছুই করার থাকবে না। তাই আবারও বলব যে বিজ্ঞান আশীর্বাদ রূপে অনেক কিছুই দিয়েছে আমাদের কিন্তু তার ব্যবহার ঠিক কতটা করা উচিত সেটা কিন্তু আমাদেরকেই ভেবেচিন্তে করতে হবে না হলে এই পৃথিবী ধ্বংস হতে আর বেশি দিন বাকি নেই। আশীর্বাদকে অভিশাপ করে তুলছি আমরাই। একটু ভেবে দেখবেন আপনি কিসের পক্ষ নিতে চান আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ।
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।