ভ্রমণ

মন্দিরময় কম্বোজ ও আকাশের বুক চিরে নেমে আসা ড্রাগনের দেশে



প্রীতিলতা গুহ


যাত্রা হল শুরু

ছোটবেলায় ইতিহাস বই-এ পড়েছি, কাম্বোডিয়ায় হিন্দু সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন এক অকুতোভয় রাজা। সাগর পেরিয়ে দূর দ্বীপে পালতোলা জাহাজ, রণতরী নিয়ে একটি দ্বীপ দখল করে রাজ্য স্থাপনা মুখের কথা নয়। হিন্দু এবং ভারতীয় বোধে শ্লাঘার জন্ম হয়েছিল যেন। দেখ আমরাও পারি। আসলে ২০০ বছর দাসত্ব করেছি তো ব্রিটিশের। কিন্তু কাম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম ঘুরে এসে নিজের জন্য, নিজের দেশের জন্য একটু দুঃখ হচ্ছে। কেন? সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। এক বিস্ময় যেন অপেক্ষা করেছিল আমার জন্য।

৪ঠা ডিসেম্বর রওনা হলাম মেদিনীপুরের শরৎপল্লী থেকে বেলা ৪টা নাগাদ। নেতাজী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছে, ভিসা, পাশপোর্ট দেখিয়ে ইমিগ্রেশনের পাট চুকিয়ে সিকিউরিটি চেক করে ভিতরে ঢুকলাম যথাসময়ে, আমাদের উড়ান রাত সাড়ে বারোটায় Air Asia-র প্লেনে। Air Asia-র প্লেন যথাসময়ে ছাড়ল।

ইতিহাসে অবগাহন

পরদিন ভোর চারটে নাগাদ ব্যাংকক পৌঁছলাম। পরবর্তী উড়ান ৯.৩০-এ। আমাদের কাম্বোডিয়ার সিয়েম রীপ পৌঁছে দেবে। সাড়ে ১১টায় পৌঁছলাম সিয়েম রীপ। এখানে বেশ গরম। প্রথমে আমাদের একটি বাসে করে হোটেলে নিয়ে যাওয়া হল। হোটেল দেখে মনে হল কোন রাজপ্রাসাদ, নামও 'হোটেল এস্পেরর'। ক্ষুন্নিবৃত্তির পর আমরা গেলাম 'National Museum of Cambodia' দেখতে।

কাম্বোডিয়ার প্রাচীন সভ্যতাকে ইতিহাসবিদরা তিনটি ভাগে ভাগ করেন, প্রাক আঙ্কোরিয়ান (Pre Angkorian); আঙ্কোরিয়ান (Angkorian) এবং আঙ্কোর পরবর্তী পর্যায় (Post Angkorian) এদের সময়কালগুলি যথাক্রমে এরকমঃ

প্রাক আঙ্কোরিয়ানঃ প্রথম - অষ্টম শতাব্দী
আঙ্কোরিয়ানঃ নবম - ত্রয়োদশ শতাব্দী
আঙ্কোর পরবর্তীঃ চতুর্দশ - বিংশ শতাব্দী

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সভ্যতাগুলির মধ্যে কাম্বোডিয়ান সভ্যতা অত্যন্ত প্রাচীন যা ভারতীয় সভ্যতার প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। চৈনিক ইতিহাসবিদ এর নাম দেন সু-নান এবং লিন-ই (Lin-Yi)। খেমার জাতি কাম্বোডিয়ার অধিবাসী ছিল। দক্ষিণ ভারত থেকে প্রথম এখানে আসেন রাজা দ্বিতীয় জয়বর্মন। তিনিই হিন্দু সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। এরা প্রথমে শিবের উপাসক ছিলেন। যুগে যুগে ধর্ম ও সভ্যতা পরিবর্তিত হয়েছে। শিব থেকে বিষ্ণু এবং তারপর বুদ্ধ। সংগ্রহালয়টি দেখলে এর নিদর্শন মেলে। 'হরি হর' মূর্তি, ব্রহ্মা মূর্তি, অশোক স্তম্ভ, শিবলিঙ্গ এবং পরে শিবের লিঙ্গ উপড়ে ফেলে সেখানে বুদ্ধমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারও নিদর্শন আছে। এই ধর্মান্তরণের মধ্যবর্তী সময়ে কিছু কালাপাহাড় ছিলেন নিশ্চয়ই। কারণ বহু মূর্তির শিরচ্ছেদ করা হয়েছে। পরতে পরতে সেখানে ইতিহাস কথা বলে। কাম্বোডিয়ার এই জাতীয় সংগ্রহালয়ে এক হাজার বুদ্ধ মূর্তি আছে। বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিশ্রামরত বুদ্ধ ও মহিলা বুদ্ধ (Lady Buddha)। কাম্বোডিয়ার বিভিন্ন মন্দির থেকে এগুলি উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়েছে এবং অনেক মূর্তির পুনঃর্নিমাণ করা হয়েছে। এবার আসল মন্দির প্রাঙ্গন ঘুরে দেখার পালা। সে তো একটা শহর জুড়ে কয়েকশো মন্দির। আমাদের হাতে সময় কম, কাজেই আমরা বেছে বেছে কয়েকটিমাত্র দেখেছি। আঙ্কোরভাট তার অন্যতম। আমরা শুধুমাত্র তার দক্ষিণ দরোয়াজা দেখেছি। এর বিশালত্বের কোনো তুলনা আমার কাছে নেই। অপূর্ব বেলে পাথরের তৈরী মন্দির, তার খিলানে অসাধারণ কারুকার্য্য এবং যেহেতু কয়েক শতাব্দী ধরে এই মন্দির গড়ে উঠেছে তাই নকশার বিবর্তন, সূক্ষতা ও জৌলুশ ক্রমশ বেড়েছে। ২১৩ ফুট উঁচু এই মন্দির, ৪০২ একর জমির উপর অবস্থিত। এখন দর্শকদের জন্য ঐ উঁচু মন্দিরে ওঠার জন্য কাঠের রেলিং দেওয়া সিঁড়ি করে দেওয়া হয়েছে, আগে ছোট পাথরের সিঁড়ি ছিল, যেন মন্দির কারুকার্য্যের অংশ। পুরোহিত ও দর্শনার্থীরা কি করে অতটুকু সিঁড়ি দিয়ে, অত উঁচুতে উঠতেন, ভাবতে অবাক লাগে। মূলত এই মন্দির বিষ্ণুর জন্য নিবেদিত ছিল, পরে বুদ্ধ মন্দিরে রূপান্তরিত হয়। এখানে বুদ্ধের দন্ডায়মান, বিশ্রামরত বিশাল মূর্তি আছে। পুজো পাচ্ছেন এখনও। ফুল, গোটা ফল এবং বিয়ার রাখা আছে দেবতার সামনে। এছাড়া আমরা দেখলাম আঙ্করথম, টা-প্রম (Ta-Prohm) মন্দির, বাইওন (Buyon) মন্দির, বাফুওন (Baphuon) মন্দির।

বাফুওন মন্দিরে ৫৪টি চূড়া আছে। প্রতিটি চূড়ায় বুদ্ধের হাসি মুখ, এটির গঠন পিরামিডের মতো, হিন্দু পুরাণের সুমেরু পর্বতের কল্পনায়। মন্দিরের চারপাশে ঘন জঙ্গল এবং ক্রমাগত যেন এক ঘণ্টাধ্বনি বেজে চলেছে সারাক্ষণ। ব্যাপারটা অলৌকিক নাকি জঙ্গলের কোন পোকামাকড়ের আওয়াজ জানিনা। তবে মন ও পরিবেশ যেন ফিরে যায় সেই ১২-১৩ শতকে। কেমন এক ঝিম ধরা আবেশে মন আচ্ছাদিত হয়ে ওঠে। একইরকম অনুভূতি হয়েছিল টা-প্রম মন্দির দেখে। এটি একেবারে জঙ্গলে ঢাকা, কোনো কোনো মন্দিরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে উঠেছে বড় বড় গাছ, আর চারদিকে জঙ্গল থেকে আসা সেই ঘন্টাধ্বনির শব্দ।

সবশেষে দেখলাম বায়ন মন্দির, এটি শিবের মন্দির ছিল, এখন কোন পুজো হয় না। মন্দিরের কারুকার্য্য অপূর্ব। এই মন্দির দেওয়ালে পাথরে খোদিত সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাও বর্ণিত। সেখানে চৈনিকদের সাথে কাম্বোডিয়ানদের ব্যবসার ছবি। কাম্বোডিয়ান মেয়েদের সাথে চৈনিক ব্যবসায়ীর প্রেম চিত্রিত। এছাড়া রামায়ন কাহিনীও বর্ণিত আছে মন্দির গাত্রে।

আঙ্কোরভাট মন্দির দেখার জন্য যে টিকিটটা কাটতে হয়েছিল, সেটায় আমার ছবি ছাপা হয়েছিল এবং চাইলে এই টিকিটে ৬ দিন ধরে মন্দির দেখতে পারতাম। কিন্তু এত সময় তো আমাদের ছিল না। কাজেই এক দিনের এই ভ্রমণেই আমাদের সন্তুষ্ট হতে হল। মন্দির দেখার ফাঁকেই এক স্থানীয় রেঁস্তোরায় Lemon Grass, Amok Fish, Stirred Beef এবং Sticky Rice খেলাম। অপূর্ব সুস্বাদু খাবার, এত নরম গোমাংস, ভীষণ উপাদেয়।

মন্দিরতো দেখা হল, এবার একদম প্রকৃতির মধ্যে হ্রদ ভ্রমণ, লেকের নাম Tonle-Sap, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম মিষ্টি জলের হ্রদ। একটি ক্রুজে আমরা দলের সবাই চড়ে বসলাম, সঙ্গে আমাদের গাইড চাউ, এই হ্রদের মাঝে ভাসমান গ্রাম, বাজার, মন্দির সব আছে। গ্রামবাসীদের মূল জীবিকা মাছ ধরা। আমরা একটা এরকম ভাসমান দোকানে গেলাম, সেখানে নানান উপহার সামগ্রী ও খাবার পাওয়া যায়। কুমিরের মাংস খেয়ে দেখলাম, সঙ্গে বিয়ার। কুমিরের মাংস নাকি খুব উৎকৃষ্ট স্বাদের হয়, তবে এটি কুমিরের শুঁটকি, আমার তেমন ভাল লাগেনি। টাটকা কুমির হলে বোধহয় স্বাদ আরও খুলত। দুটো ছোট কুমির ছানা (stuffed) কিনলাম। এরপর একটি ভাসমান বুদ্ধমন্দিরে গেলাম। সেখানে বুদ্ধের সামনে বসলাম কিছুক্ষণ। হ্রদের দৃশ্য নয়নাভিরাম। দুপাশে Mangrove অরণ্য। একটু এগোলে মনে হচ্ছে সমুদ্রে এসে পড়লাম। এই হ্রদের সঙ্গে মেকং নদীর যোগ রয়েছে। এটির জীববৈচিত্র এত ব্যাপক যে ১৯৯৭ সালে UNESCO এটিকে 'বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ' হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই হ্রদের মাঝে দ্বীপও দেখলাম। দুপাশে অজস্র জলস্রোত। আর দ্বীপটি Mangrove অরণ্যে পরিপূর্ণ সবুজ। খুব দ্রুত গতিতে একটি ছোট নৌকা (মোটরচালিত) পেরিয়ে গেল আমাদের। আমাদের গন্তব্য দ্বীপের দক্ষিণ দিক। ভাসমান গ্রামের একটি জানালায় এক মা তার ছোট বাচ্চাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে, সে আমাদের হাত নেড়ে অভিবাদন জানিয়ে দিল।

গেরিলা যুদ্ধের দেশের দিকে

তিনদিনের কাম্বোডিয়া ভ্রমণ শেষে এবার ভিয়েতনামের দিকে যাত্রা। আমাদের ভ্রমণ তালিকায় ছিল সিয়েম রিপ থেকে হো চি মিন সিটি অর্থাৎ সাইগন; ৮ ঘন্টার রাত্রিকালিন বাস ভ্রমণ। সেটা যে একটা বাস পরিবর্তন করে আর একটা বাস ধরতে হবে, এবং ৮ ঘন্টার ভ্রমণ ১৬ ঘন্টায় পৌঁছবে তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। আমরা রাতের খাবার খেয়ে সিয়েম রীপ বাস টার্মিনাস থেকে রাত ৯টায় বাসে উঠলাম। জুতো খুলে প্যাকেটে নিয়ে বাসে উঠতে হয়।

ভোররাত্রে রাজধানী নমপেন-এ পৌঁছলাম। নমপেন, মেকং নদীর তীরে সুন্দর ছবির মত শহর। বাস টার্মিনাসটা মস্ত বড়, Public Toilet কত সুন্দর, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ভোরের নমপেন তখন আস্তে আস্তে জেগে উঠছে, দ্বিচক্রযান নিয়ে দু-চারজন পুরুষ, মহিলা আসছে। কেউ দোকান খুলবে, কেউ তার কাজে যোগ দেবে। বেলা সাড়ে নটায় নমপেন থেকে বাস ছাড়ল সায়গনের উদ্দেশ্যে।

সায়গনঃ এক অপূর্ব শহর

অবশেষে সায়গনে নামলাম। সেখান থেকে গাইড কিম আমাদের অভ্যর্থনা করে একটি গাড়িতে তুলল। রাত্রিবাস হোটেলে। পরদিন সকালে ভিয়েতনাম দেখা শুরু হল।

ভিয়েতনাম দর্শনের প্রথম ধাপে, মেকং নদীর অববাহিকায় যে দ্বীপগুলি গড়ে উঠেছে তার কিছু ঘুরে দেখা হল। ছোটবেলায় ইতিহাসে যে মেকং নদীর কথা পড়েছি সেই মেকং নদীতে নৌকায় চড়লাম My Tho বোট ষ্টেশন থেকে। দু'কূল ভাসানো নদী মেকং। আমরা গেলাম যে দ্বীপ গ্রামগুলিতে সেগুলির অদ্ভুত নাম যেমন ইউনিকর্ন, কচ্ছপ, ড্রাগন এবং ফিনিক্স। এখানকার অধিবাসী মেয়েদের গান শুনলাম। খুব সুরেলা, ছন্দের গান। এরা আমাদের আপ্যায়ন করে খেতে দিল ওদেশের সব ফল, কাঁঠাল, পেঁপে, ড্রাগন ফল, আনারস, আম এবং ছিল মধু চা। টাঙ্গায় করে লাগোয়া একটি গ্রামেও গেলাম। গ্রামগুলি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, এদের ফলের বাগান দেখলাম। Coconut-durian Candy এবং নানা হাতের কাজের কারখানা ছিল। সেগুলি বিক্রীও হচ্ছিল। আরও চমক আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। এবারে ছোট সরু নৌকায় মেকং-এর খাঁড়ি পথে ভ্রমণ। দুইদিক থেকে "জল-নারকেলের" (Water-Coconut) গাছ যেন ঝাঁপিয়ে পড়বে নৌকায়।

নৌকায় ওদের একজন আর আমাদের দলের চারজন করে আছে। আমাদের প্রত্যেককে Life Jacket এবং ভিয়েতনামী চুপি দেওয়া হয়েছে। খাঁড়ি বেয়ে তরী পড়ল মেকং নদীতে, ওদের ভাষায় Tien River। বুকটা বেশ দুরু দুরু করছিল। যাইহোক নিরাপদেই ফিরে এলাম দ্বীপে। তারপর ক্রুজে। মেকং নদী ও তার অববাহিকা মনে থাকবে। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ বহু চর্চিত। বাম ঘেঁষা ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্রে ভিয়েতনাম যুদ্ধ অর্থাৎ গেরিলা যুদ্ধ এবং আমেরিকার আগ্রাসী মনোভাবের প্রতি ঘৃণা এখনও মজ্জাগত। এখানে এসে সুযোগ পেলাম, ভিয়েতনামের প্রতিরোধের কিছু নিদর্শন দেখার। সায়গনের নিচে প্রায় আর একটা সায়গন ছিল বলা যায়। পুরো গেরিলা যুদ্ধে ভিয়েতনামী গেরিলা বাহিনী টানেলের ভিতরে থেকে এবং জঙ্গলের সাহায্য নিয়ে পরাক্রমশালী আমেরিকাকে পালাতে বাধ্য করেছিল। কি করেনি আমেরিকা? বোমা ফেলে প্রায় ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল ভিয়েতনামকে। ওদের নাপাম বোমার আঘাতের চিহ্ন ধরা আছে War Museum-এ। মুখে রক্ত ঝড়ছে এক বালিকার, সম্পূর্ণ উলঙ্গ দৌড়ে বেরোচ্ছে গ্রাম থেকে, সে গ্রাম আগুন গ্রাস করেছে। এগুলো সব আমেরিকান নানা সংবাদ সংস্থারই খবর। একাধিক আমেরিকান সাংবাদিক এই খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে মারা গেছেন। যেমন Robert Capa, তিনি Photographer ছিলেন। বিখ্যাত কুচি টানেল (Cuchi Tunnels) দেখলাম আমরা। দিনের বেলায় যোদ্ধারা টানেলের মধ্যে লুকিয়ে থেকে যুদ্ধ করতেন, গ্রামবাসীরাও এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ত্রিস্তরীয় সুড়ঙ্গ, এর ভিতরে ছিল হাসপাতাল (প্রসূতি প্রসবের ব্যবস্থাও ছিল) মন্ত্রনাকক্ষ, রান্নাঘর ও খাবার ঘর। টানেলের ভিতর কিভাবে নিঃশ্বাস নিতেন তাঁরা? এরজন্য তৈরী করেছিলেন Ventilation System। জঙ্গলের ভিতর মাটির উপর এগুলি দেখে মনে হতো সাপের গর্ত বা উইয়ের ঢিবি। আমেরিকান সেনারা এগুলি খুঁজে বন্ধ করতো, ভিয়েতনামীরাও আরও অজস্র বানাত এগুলি। প্রায় ২৫০ বর্গ কিমি. জুড়ে ছিল ভিতরের সুড়ঙ্গ, এক গ্রামের গেরিলারা অন্য গ্রামের সুড়ঙ্গে ঢুকলে ধাঁধায় পড়ে যেতেন। সুতরাং সেই গ্রামের অধিবাসী ছাড়া সুড়ঙ্গে প্রবেশ নিরাপদ ছিল না। এতে নিরাপত্তা থাকত সব দিক থেকেই। আমেরিকান সেনা কি চেষ্টা করত না এই সুড়ঙ্গে ঢোকার? অবশ্যই করত। কিন্তু যেগুলি মনে হতো সুড়ঙ্গে ঢোকার মুখ সেগুলি প্রায়শই হতো মরণ ফাঁদ। পা দিলেই হড়কে নিচে পড়তে হবে। সেখানে বাঁশের ছুঁচলো ফলা পোঁতা আছে। রান্নার আগুনের ধোঁয়া বাইরে বেরোলে আমেরিকান বোমারুদের চোখে পড়তে পারে, সেজন্য কাঠের ধোঁয়া বিভিন্ন প্রকোষ্ঠের ভিতর নিয়ে গিয়ে অবশেষে সামান্য ধোঁয়া বাইরে বেরোত, যা জঙ্গলে ঢাকা পড়ে যেত। গেরিলা যোদ্ধারা ঢুকতেন যে গর্ত দিয়ে সেটির বাইরে কাঠের ঢাকনা পাতায় ঢাকা। সেটি মাথায় নিয়ে ঢুকলে মাটিতে খাপে খাপে বসে যাবে ঢাকনা। উপরে শুকনো পাতা ছড়ানো, বোঝার উপায় নেই। বর্ষায় কাঠ ফুলে গর্তের মুখ শক্ত হয়ে এঁটে যাবে যাতে ভিতরে জল ঢুকতে না পারে। কিন্তু শুধু দিনের বেলা লুকিয়ে যুদ্ধ করলে তো হবে না। খাবে কি? জঙ্গলের চারপাশের জমি রাত্রে চাষ করত মেয়েরা। কারণ দিনে বোমা পড়ার ভয়। এই অবস্থায় যোদ্ধাদের জন্য চালও বাড়ন্ত হতো। তখন কাঠ আলু সেদ্ধ করে খেয়েই তাদের চালাতে হতো। তবে ভাববেন না ছেলেরাই শুধু যুদ্ধ করত। মেয়েরা চাষ এবং যুদ্ধও করতেন। ছেলে, মেয়ে সবাই সবকিছু করতেন, তাদের আগ্রহ এবং দক্ষতানুযায়ী।

সুড়ঙ্গের ভিতরে কারখানা ছিল। সেখানে শত্রুর ফেলে যাওয়া বা উদ্ধার হওয়া বিভিন্ন ধাতু দিয়ে, যোদ্ধারা নিজেদের অস্ত্র বানিয়ে নিতেন। এগুলি সব কুচি টানেলের মডেল এবং Diorama-র (আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে প্রায় জীবন্ত আকারে রাখা ছায়াছবি) মাধ্যমে রাখা আছে। আর আছে War-remnants, যেখানে আমেরিকান কামান, সাঁজোয়া গাড়ী, বোমারু বিমান (Fighter Bomber) সবই সযত্নে রাখা।

বানা পাহাড়ে বৃষ্টি

ভাগ্য বিপর্যয়ে, দানাং এবং মধ্য ভিয়েতনামের একটি দ্রষ্টব্য স্থান বানা পাহাড় আমরা প্রায় কিছুই দেখতে পাই নি, প্রচণ্ড কুয়াশা এবং ঝিরঝিরে বৃষ্টির জন্য। প্রথমে চলন্ত সিঁড়ি এবং তারপর কেবল কার (Cable Car) আমাদের পাহাড়ের চূড়ায় তুলে দিল। কেবল কারে ওঠার সময় পাহাড় থেকে দুগ্ধ ফেননিভ ঝর্ণা ঝাঁপিয়ে নামছে, এটুকু বুঝতে পারলাম, বৃষ্টির মধ্যেও। ঝর্ণার উপর দিয়ে আমরা উড়ে যাচ্ছি এরকমই অনুভূতি হল আমার। বৃষ্টির জন্য দুটি বর্ষাতি কিনতে হল। পাহাড়ের মধ্যে উঁচু-নিচু পথ হেঁটে পৌঁছলাম Fantasy Park, ওখানে বিভিন্ন Ride এবং 3D, 4D, 5D Show দেখলাম। সেগুলিতে নিজেকে অংশগ্রহণ করতে হয়। কোথাও গুলি ছুঁড়ে শয়তানদের শায়েস্তা করা, মনে হচ্ছে আমি যেন ঘোড়ার পিঠে ছুটছি, কোথাও বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে উড়ে চলেছি। কত তারা, গ্রহকে পাশ কাটিয়ে ছুটছি, কোথাও বিশাল পাহাড়, বিশাল গহ্বর পেরিয়ে গেলাম। কোনো রেলগাড়ীতে যাবার সময় ভূত, প্রেত, দৈত্য, দানো প্রায় ঘাড়ের উপর এসে পড়ল। সুন্দর মজার এক পৃথিবী। আর Chinese New Year-এর জন্য এই Fantasy World-এর মলটি খুব সুন্দর সেজেছে Christmas Tree এবং সান্তা ক্লজও আছেন।

ফেরার সময় আবহাওয়া আরও খারাপ হল। বানা পাহাড় থেকে ফিরে দানাং-এ যখন এলাম কোনো বৃষ্টি নেই। চিন উপসাগরের পাড়ে গেলাম। ভিয়েতনামীরা এই সাগরকে বলে East Asian Sea। সত্যিই তো, শুধু চিনের নামেই বা এই সাগরের নাম হবে কেন? দানাং শহরের আলোগুলি এই সাগরের গলায় মালার মতো বিছিয়ে আছে। রাতের সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়া তীরে এবং আলোর চন্দ্রহার আজকের বানা পাহাড়ের সৌন্দর্য্য না দেখতে পাওয়ার দুঃখ, খানিক ভুলিয়ে দিল।

আমার মনে আজও দৃশ্যমান দানাং-এর কামথানি গ্রামে বাঁশের গোল নৌকায়, বৃষ্টির মধ্যে বর্ষাতি পরে খাঁড়িতে ভ্রমণ। দু'পাশে সেই আগের দেখা জল নারকেলের Mangrove অরণ্য, যেন ঘাড়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। খাঁড়ি অবশেষে বড় নদীতে মিশল এবং সেখানে বক্সে বাজছে দ্রুত লয়ের গান, সেই সঙ্গে Boat Dance, গোলাকার একটি নৌকা একজন মানুষ অসম্ভব দক্ষতায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছন্দে ছন্দে নেচে নেচে চলেছে, কখনও মনে হচ্ছে নৌকাটি বোধহয় উল্টে যাবে।

এরপর হইয়ান (Hoian) শহরে জাপানি ও চৈনিক সংস্কৃতির অনেক নিদর্শন পেলাম। এই শহরটি দুটি ভাগে বিভক্ত। একটি চৈনিক এবং অপরটি জাপানি। জাপানিদের তৈরী ছোট নদীর উপর ঢাকা সেতুটির দুই দিক দুটি অংশে বিভক্ত। 'ফুজিয়ান অ্যাসেম্বলি হল' দেখলাম, যেখানে চিনারা মিলিত হতো। এমন একটি চিনা বাড়ী দেখলাম, যারা তিরিশ প্রজন্ম ধরে আছে এবং তাদের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রেখেছে। এদের ছোট ছোট বাড়ী ও দোকান আছে যেগুলি কোচিনে ইহুদি পাড়ার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। যে নদীর পাড়ে এই হইয়ান (Hoian) শহর, সেই নদীটির নাম Thu-Bon। এখন নদীটি ছোটখাট দেখতে হলেও বন্যায় এই নদী এই শহরকে ডুবিয়ে দেয়, যে চৈনিক বাড়ীটির কথা বলছি সেখানে কোন সালে বাড়ীর কতটা অংশ ডুবে গেছিল, সেটা লিপিবদ্ধ আছে। এখন সাজানো গোছানো সুন্দর বাড়ীটি এবং তার সুদৃশ্য পসরাগুলি দেখে তা বোঝার উপায় নেই।

হ্যানয়ের পাহাড় ও উপসাগর এবং নতুন ভিয়েতনাম

মধ্য ভিয়েতনামের যে দ্রষ্টব্য স্থানগুলি আমাদের দেখার তালিকায় ছিল, সেগুলি সেরে এবার উত্তর ভিয়েতনামের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। হ্যানয় আমাদের গন্তব্য, এবং ভিয়েতনামের রাজধানী। সায়গন থেকে দানাং এবং দানাং থেকে হ্যানয় আমরা ভিয়েতনামের আন্তর্জাতিক বিমানে গেছি। সংস্থাটির নাম Vietjet, হ্যানয়ের গাইড ব্যাং ব্যাং আমাদের অভ্যর্থনা করল।

হ্যানয়ের প্রথম দ্রষ্টব্য স্থান Hoalu গ্রাম। এটি ভিয়েতনামী রাজার প্রাচীন রাজধানী। স্বর্গীয় পরিবেশ চারিদিকে। এটি একটি সমতল গ্রাম, কিন্তু চারপাশে বেলে পাথরের পাহাড়গুলি যেন রাজার রাজধানীকে অতন্ত্র প্রহরায় ঘিরে রেখেছে। এর নদী, হ্রদ এবং হ্রদের জলে ভর্তি পদ্ম এবং বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, যেন অন্য এক প্রশান্তির জগৎ। এখানে একটি প্যাগোডা ও মন্দির দেখলাম। ভিয়েতনামে দু'ধরণের মন্দির আছে। বুদ্ধের মন্দির অর্থাৎ প্যাগোডা এবং মন্দির, যেখানে পুজো করা হয় রাজা, রাণী এবং নানান পৌরানিক দেবদেবী, যেমন সমুদ্রের, বায়ুর, পৃথিবীর। দুটিই পাশাপাশি বিরাজমান বর্তমান মানুষের জীবনে। দেবতার সামনে তাজা ফুল, গোটা ফলের অর্ঘ্য। মোমবাতি ও ধূপ আছে। প্রতিটি মন্দির ও প্যাগোডা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এতটুকু ধূলো ময়লা, বাসি ফুল, ফল, পাতা কোথাও পড়ে নেই। আর মন্দিরের কাঠের খিলানের ম্যুরাল অপূর্ব। এরপর Tam-Coc অর্থাৎ তিনগুহা অভিযানে বেরোলাম, সাম্পানে ভাসলাম আমরা Ngo Dong নদীতে।

আমরা যখন রওনা দিয়েছি তখন বেলা চারটে হবে। একটি সাম্পানে আমরা দুজন ও একজন ভিয়েতনামী মাঝি, দুইপাশে বেলে পাথরের পাহাড়গুলি হুমড়ি খেয়ে যেন পড়ে যাচ্ছে নদীর জলে, মাঝির একটা পিঠ হেলান দেওয়া আসন আছে, হেলান দিয়ে বসে দুই পায়ে বৈঠা চালাচ্ছেন তিনি, বেশ ভাল সংখ্যক মহিলাও এই জীবিকায় আছেন। এই নৌকায় দুইদিকে বৈঠা এমনভাবে চালাতে হয় যাতে দিক ও গতি দুটিই সঠিক হয়। বেশিরভাগ সওয়ারি কমলা রঙের Life Jacket পরে আছেন। জলের বর্ণ সবুজ, উপরে আকাশ নীল, বেলে পাথরের পাহাড়গুলি সবুজ। অনেকটা যাবার পর সাম্পান গুহায় প্রবেশ করল। ভিতরটা অন্ধকার ও ঠান্ডা, প্রথম গুহায় তবু বিদ্যুতের আলো ছিল, এদিকে সূর্য ক্রমে অস্ত যাচ্ছে। সাম্পানে যেন অন্তহীন ভেসে দ্বিতীয় গুহায় প্রবেশ করলাম। একেবারে অন্ধকার। মনে হচ্ছে বেরোবার রাস্তা বন্ধ। না, তা নয়, নদী ঠিক তার পথ করে নিয়েছে, আমরাও গুহার বাইরে বেরিয়ে এলাম, তৃতীয় গুহা দেখে ফেরার জন্য নৌকা ঘুরল।

আস্তে আস্তে শহর, বাড়ী ঘর এসে পড়ল নদীর পাড়ে। Ngo Dong নদীতে সাম্পানে ভেসে Tam-Coc অভিযানে না গেলে জীবনে অভিযানের উদ্দীপনা এবং এক অনির্বচনীয় আনন্দ আস্বাদই করা হতো না। গাইড ব্যাং ব্যাং আমাদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা করল। তিনগুহা থেকে যখন আমরা ফিরছি, সূর্য প্রায় বিদায় নিয়েছে, দিনের নিভন্ত আলোয় নদীর দু'পাশে বেলে পাথরের পাহাড়গুলি যেন রহস্যে মোড়া। ভিয়েতনামের এই উত্তর অংশে কিন্তু বেশ ঠান্ডা। কনকনে ঠান্ডায় প্রায় কাঁপছি, তখন দেখি কোমর জলে দাঁড়িয়ে এক মহিলা জলের গাছপালাগুলি কাটছেন। জীবনযুদ্ধের এক যোদ্ধা। শ্রমের বিনিময়ে সকলকেই গ্রাসাচ্ছাদন করতে হয়।

এক জায়গায় দেখলাম মুক্তোর চাষ হচ্ছে। সেখানে ঝিনুকের মধ্যে কোন রাসায়নিক প্রবেশ করানো হচ্ছে, এবং বিভিন্ন রাসায়নিকের প্রভাবে কোথাও গোলাপী, কোথাও মাখন রঙা মুক্ত, ছোট বড় আকৃতির, পরিবেশ ও সময় নিয়ন্ত্রণ করে পাওয়া যায়। এগুলি সবই নিয়ন্ত্রিত সামুদ্রিক জলাশয়ে। আমাদের এগুলি কারখানায় দেখান হল পদ্ধতির প্রকারভেদ হিসাবে। বহু যুদ্ধ পীড়িত এবং বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তি এই সমস্ত কর্মশালাগুলিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছেন। ভিয়েতনামে এগুলি প্রায় সবই সরকারী নিয়ন্ত্রিত কার্যালয়। তবে ধনী ব্যক্তির বিশাল অট্টালিকাও ভিয়েতনামে দেখেছি। সরকারের সঙ্গে এদের ভালই সম্পর্ক। আমরা দক্ষিণ থেকে মধ্য হয়ে উত্তর ভিয়েতনাম ঘুরলাম। অনেকটা পশ্চিমবঙ্গের মত লম্বাটে গঠন এই দেশটির। এই লম্বা ভ্রমণে প্রচুর মোটর সফর করেছি, কিন্তু কোথাও ট্রাফিক জ্যাম চোখে পড়েনি। রাস্তাঘাটে অনেক দ্বিচক্রযান। মাখনের মতো রাস্তায় যে যার কাজে ছুটে চলেছে। ভিয়েতনাম ও কাম্বোডিয়ায় বেশ কয়েকটি নদী, হ্রদ এবং উত্তর ভিয়েতনামের উপসাগর ও হালং বে ও বাই টু লং বে-তে আমরা নৌকাবিহার, ক্রুজ সফর, কায়াকিং করেছি, এছাড়াও গ্রামের ভিতরে পুকুর ও জলাশয় দেখেছি। সবগুলিই নির্মল ও প্লাষ্টিক মুক্ত। এরা গর্ব করে বলে আমরা প্লাষ্টিক মুক্ত দেশ। সাধারণ দোকানেও কিন্তু যে প্যাকেটটি দেওয়া হয় তা সহজেই পরিবেশে মিশে যেতে পারে।

এবারে ভিয়েতনামের একেবারে উত্তর প্রান্তে Ha-Long Bay অভিমুখে যাত্রা সোয়ান (Swan) কোম্পানির বাসে। হ্যানয় থেকে বাসে প্রায় ৮০ কিমি। সবচেয়ে আকর্ষনীয় স্থান হল যেখানে সমুদ্র প্রবেশ করেছে পাহাড়গুলির ভিতর দিয়ে। অতন্দ্র প্রহরীর মতো এই পাহাড়গুলি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে, প্রাচীনকালে ভিয়েতনাম রাজার রাজত্বকে রক্ষা করে এসেছে। এখানে পৌরানিক চরিত্র ড্রাগনের কথা এসে পড়ে। Ha-Long-Bay নিয়ে গল্প কথা হচ্ছে আকাশ থেকে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ড্রাগন (Descending Dragon) রাজত্বকে বাঁচাতে। আর ভূতাত্বিক ব্যাখ্যা হচ্ছে, দুটো tectonic plate-এ ধাক্কা লেগে সমুদ্রের মধ্যে বেলে পাথরের পাহাড়গুলির সৃষ্টি। ফলস্বরূপ, ভিয়েতনামের রাজা প্রাকৃতিকভাবেই সুরক্ষা পেয়েছিলেন এর বিশেষ ভূ-প্রকৃতির জন্য। সমুদ্র এবং পাহাড়ের আড়ালে রাজত্বের নজরদারী এবং নিয়ন্ত্রণ দু'রকম সুবিধাই হয়েছিল।

আমরা Swan Cruise-এ ছিলাম একটা রাত। এই জাহাজে আমাদের অভ্যর্থনা করল Phuc। সুদর্শন ব্যক্তিত্বশালী যুবক, ইংরাজীর উচ্চারণ খুব ভাল। জাহাজ থেকে একটি নৌকা করে আমরা একটা জেটিতে গেলাম। এখান থেকে নিজেদের নৌকা চালিয়ে, অর্থাৎ কায়াকিং করে যেতে হবে একটি সোনালী সমুদ্রতটে। আমাদের কায়াকিং-এর কোন অভিজ্ঞতা নেই। আমি আর একজন জুটি বেঁধে একটি নৌকায় উঠলাম।

প্রথমে দুজনে গোল হয়ে ঘুরছি, সবাই চলে গেছে। ভয়ই পাচ্ছি দুজনে। এরপর বুঝলাম ডানদিকে বৈঠা টানলে বাঁ দিকে যাবে। বাম দিকে বৈঠা টানলে ডান দিকে যাবে। দিক নির্দিষ্ট করে পৌঁছলাম স্বর্ণ সৈকতে। সবাই পৌঁছে গেছিল। আমরাই শেষ দল। আমাদের জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল।

দেখলাম Stalagtite Stalagmite-এর অতি সুন্দর গুহা, কোথাও মনে হচ্ছে সমুদ্রের ঢেউ ভাঙছে, কোথাও হাস্যময় বুদ্ধ, কোথাও প্রেমিক প্রেমিকা, বৃষ্টির জল বেলে পাথর ছুঁয়ে নেমে আসে গুহার মেঝেতে এবং সৃষ্টি হয় এরকমই নানা আকৃতি, যেখানে মানুষের মনের মাধুরি এসে মেশে। এই গুহা দেখে যারা দক্ষ কায়াকিং করে তারা উপসাগরটি ঘুরতে বেরোলো, এর মধ্যে কোরিয়ান কয়েকটি মেয়ে, রাশিয়ান, লিথুয়ানিয়ার বেশ কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তি ছিলেন। আমরা যারা এই প্রথম কায়াকিং করলাম তারা ফিরে চললাম সেই জেটিতে।

এই উপসাগরীয় অঞ্চলটি খুবই শান্ত, কোনো বড় জাহাজ যায় না। এজন্য উদ্যোক্তারা নিরুদ্বিগ্ন ছিল তাদের যাত্রীদের নিয়ে। Swan Cruise-এ ফিরে আসার পর সে আরও খানিক গভীরে নিয়ে নোঙর করল। রাত্রে নোঙর করা থাকবে। ক্রুজের ডেকে আমাদের রান্নার ক্লাস হল। সেখানে আমাদের তৈরী করা Spring Roll আমাদেরই ভেজে খেতে দেওয়া হল। ক্লাস নিলেন নামী ভিয়েতনামী সেফ।

আমরা উপসাগরের যে অঞ্চলটায় আছি তার নাম বাই টু লং বে (Bai Tu Long Bay) উপসাগরের এই অংশটি অত্যন্ত নির্জন, বেশী মালবাহী জাহাজ যায় না এবং প্রকৃতি নির্মল। স্বর্গ যেন এখানে মর্তে নেমে এসেছে। চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, দূরে আমাদেরই মতো এক পর্যটনের জাহাজের আলো দেখা যাচ্ছে, চারিদিকের বেলে পাহাড়গুলি মুনি ঋষির মত মৌন।

বাই টু লং বে অর্থাৎ শিশু ড্রাগন মাকে অভিবাদন করছে। ভিয়েতনামের উপকথায় প্রকৃতির এক সুন্দর মিষ্টি রূপ প্রকাশ পেয়েছে। রাত্রির উপসাগর তার পর্বতমালা দেখে প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় মন ভরে গেল।

সকাল ১০টার মধ্যে আমরা বাই টু লং বে-কে বাই বাই করে হ্যানয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ক্রুজ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাং ব্যাং আমাদের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে। হ্যানয়ে কিছু কেনাকাটা করে রাত সাড়ে বারোটায় কলকাতার ফিরতি উড়ান ধরলাম।

উপসংহার

সিয়েম রীপ ও নমপেনের যে কোনো মন্দির প্রাঙ্গণ, বাস টার্মিনাস, বিমানবন্দর প্রতিটি জায়গায় সাধারণের জন্য ব্যবহৃত বাথরুমগুলি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। প্রতিটি বাথরুমে তরল সাবানের ব্যবস্থা। রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কোন traffic পুলিশ চোখে পড়ল না। বড় বড় রাস্তাঘাট, যানবাহন চলছে নিয়ম মেনে। Traffic Police বিহীন আলোক সংকেতই বুঝিয়ে দেয় এদের শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা।

কুচি সুড়ঙ্গ দেখলে একটা জাতির দেশপ্রেম, নিয়মানুবর্তিতা, বুদ্ধিমত্তা এবং নিজের প্রতি আস্থা ও জেদ টের পাওয়া যায়। আর বোঝা যায় হো চি মিনের মত নেতার শক্তি, আত্মপ্রত্যয় ও বুদ্ধি। যিনি দেশের সমস্ত জনসাধারণকে এই যুদ্ধে সামিল করেছিলেন। এই যুদ্ধ কারও একার যুদ্ধ নয়, হয়ে উঠেছিল গোটা জাতির বেঁচে থাকার লড়াই।

ভিয়েতনাম ঘুরে যে শিক্ষা পেলাম, তা হল যুদ্ধের স্মারক চিহ্ন ওরা সযত্নে রেখেছে শুধু শত্রুর আক্রমণের চিহ্ন হিসাবে নয়, নিজেদের প্রতিরোধের প্রমাণ হিসাবেও। ওদের War Museum-এ দেখেছি দলে দলে স্কুলের শিশুরা, কিশোররা আসছে মিউজিয়াম দেখতে।

কি সুন্দর করে ওরা গড়ে তুলেছে ওদের দেশকে, এক ফোঁটা ধুলো ময়লা কোথাও পড়ে নেই। রাস্তাগুলি বিশাল চওড়া। রাস্তার পাশে জঞ্জালের পাহাড়, ঝুপড়ি, ভাঙা বাড়ী চোখে পড়েনি। আদি অনন্ত সবুজ মাঠ, ধান চাষ হচ্ছে, সবজি, ফলের বাগান আছে। ট্রাফিক পুলিশহীন বিশাল রাস্তা, Traffic Signal মেনে গাড়ী চলছে। গ্রামের বাড়ীগুলিও সুন্দর, দোতলা পাকা বাড়ী, ছাদগুলি একচালা বাড়ীর মতো ঢালু নেমে গেছে দু'দিকে, মনে হয় যেন লাল টালি। সুন্দর পরিকল্পনার ছাপ সমস্ত গ্রামের ভিতর। ওদের এই বাড়ীর ধাঁচটা ফরাসীদের থেকে নেওয়া হতে পারে। কারণ ভিয়েতনাম এককালে ফরাসি উপনিবেশ ছিল। সায়গনে কুচি সুড়ঙ্গ ছাড়াও আমরা ফরাসিদের তৈরী অপেরা হাউস দেখেছি। সেখানে এখনও অপেরা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া দেখেছি ফরাসিদের তৈরী Central Post Office। যেটি এখনও কর্মচঞ্চল এবং যে দেশে চিঠি বা পার্সেল যাবে সেই দেশের কাউন্টারের উপরে সেই দেশের বর্তমান সময় দেখানো মস্ত দেওয়াল ঘড়ি। এখানেও স্কুলের শিশুদের নিয়ে এসেছে শিক্ষক শিক্ষিকারা। দক্ষিণ থেকে উত্তর ভিয়েতনাম ঘুরে একমাত্র Central Post Office এবং কুচি টানেলে হো চি মিনের ছবি এবং স্ট্যাচু দেখলাম। আমাদের নেতানেত্রীদের মতো ফ্লেক্সে ঢেকে দেওয়া শহর ওখানে কল্পনাতীত। শ্রদ্ধা তো মনের ভিতরের জিনিস, তাই নয় কি? আমাদের নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে তো আমরা অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি তাঁর ত্যাগের জন্য। তাঁর দেওয়ালজোড়া মস্ত ছবি দেখে নয়।

ভিয়েতনামে দেখেছি হাটে বাজারে, শপিং মলে, অফিসে সমস্ত জায়গাতেই বেশ ভাল সংখ্যক মহিলা কর্মী আছেন। মহিলা ফেরিওলা বাঁক কাঁধে চলেছেন দেখেছি। আবার শাপলা, পদ্মবনে জলের মধ্যে এক মহিলাকে নৌকা নিয়ে ঝিনুক সংগ্রহ করতেও দেখেছি। ভিয়েতনামে কেউ বসে থাকে না, রাস্তায় কোনো ভিখিরি চোখে পড়েনি। ভিয়েতনামের আত্মনির্ভরতা শ্লোগান নয়, বাস্তব সত্য।