ইদানিং রোজই বাড়ি ফিরতে রাত হচ্ছে নন্দিতার। নতুন অফিসে জয়েন করার পর এই অনিয়ম আরম্ভ হয়েছে। ভারতী, নন্দিতার শাশুড়ি ঘড়ির দিকে তাকালেন। দশটা বেজে গিয়েছে, অজান্তেই ভ্রু কুঁচকে উঠল তাঁর, অপাঙ্গে একবার ছেলে ও নাতনির দিকে তাকান তিনি, দুজনেই তন্ময় হয়ে টিভি-র মনোরঞ্জনী সিরিয়াল দেখছে। দু'জনের কেউই দরজা খোলার জন্য এগিয়ে এল না। অগত্যা ভারতীই উঠলেন, দরজার ম্যাজিক আই-এ চোখ রেখে দরজার ওপারে ক্লান্ত বিধ্বস্ত চেহারার নন্দিতাকে দেখতে পেলেন। দরজা খুলে সরে দাঁড়ালেন। নন্দিতা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ক্লান্তি-কালীন ধ্বনি তুলে বলল, "ওঃ আর পারি না -" বলতে বলতে বাপ ও মেয়েকে টিভিতে নিমগ্ন দেখে চটিজোড়া ছাড়তে ছাড়তেই বলে উঠল, "একি পরশু রিমির পরীক্ষা, ওকে পড়তে না বসিয়ে দু'জনে মিলে টিভি গিলছ?"
স্ত্রীর দিকে একবারও না তাকিয়ে টিভির পর্দায় চোখ-রাখা অবস্থাতেই ধীমান উত্তর দেয়, "মাঝরাতে বাড়ি ফিরে আর পারিবারিক কর্তব্য করতে হবে না!" নিজের শোওয়ার ঘরের দিকে যেতে যেতে নন্দিতাও একটু না-থেমে, এই কথা বলতে বলতে ঘরে ঢোকে যে, "প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি তো করতে হয় না, সরকারি বাবু বুঝবে কী তুমি!" বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজের ঘরের সংলগ্ন বাথরুমে গিয়ে ঢোকে নন্দিতা।
পরদিন বেশ সকাল সকাল বাড়ি আসে নন্দিতা। মুখ হাত পা ধুয়ে মেয়েকে ধমক চমক লাগিয়ে পড়তে বসায়, কাজের মেয়েটিকে কড়া করে এক কাপ চা করে দিতে বলে, শাশুড়ির নির্দেশ মতো ইস্ত্রি করবার জামাকাপড় আলনা থেকে আলাদা করে গুছিয়ে রাখে এবং মেয়ে ভালবাসে বলে সকালে বাজার থেকে আসা পমফ্রেট মাছ নিজে রান্না করে। ধীমান বাড়ি ফিরে মা, বউ ও মেয়ে তিনজনকেই যথাস্থানে দেখে খুশি হয়; আপাতত ধীমান দত্তের ফ্ল্যাটে যথারীতি শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করতে থাকে।
রাত্রে মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে ধীমান বলে মেয়ে বড় হচ্ছে এবার ওকে ওর ঠাম্মার সঙ্গে শোওয়ার অভ্যাস করাও। একপাশে মেয়ে ও অন্যপাশে স্বামী মাঝখানে শুয়ে আছে নন্দিতা, সারাদিনের ক্লান্তির পর ঘুমে ডুবে যেতে যেতে বলে, "সারাদিন মেয়েটাকে পাই কতটুকু? রাতে ঘরে, গায়ে ওর হাত রেখে শুতে একটু ভাল লাগে আমার -”
নন্দিতাকে নিজের দিকে টানতে গিয়েও হাত সরিয়ে নেয় ধীমান, মেয়ে বড় হয়ে উঠেছে, মা বাবার শারীরিক অন্তরঙ্গতার কথা তার না জানাই ভাল। সন্ধেবেলায় একটু ঘুমিয়েছে ধীমান, টিভি দেখেনি আজ, ঘুম আসছিল না তার, পাশ ফিরে শুতে শুতে মনে হয় নন্দিতা ইদানিং একটু একটু করে দূরে চলে যাচ্ছে যেন। নন্দিতা কি তবে তনুশ্রীর সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা কিছু জানতে পেরেছে? কিন্তু কীভাবে তা জানা সম্ভব? তনুশ্রীর সঙ্গে বাড়ি থেকে টেলিফোনেও তো বেশি কথা বলে না সে! কৃচ্চিৎ কখনও তনু ফোন করলে সে সামান্য কথায় প্রসঙ্গ সেরে অফিস থেকে ফোন করার আশ্বাস দিয়ে টেলিফোন রেখে দেয়। অফিসের কেউ শয়তানি করে কিছু জানায়নি তো? মৃদু উদ্বেগের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে ধীমান।
কয়েকদিন পরে ধীমানের ফ্ল্যাটের সামনে একটি মারুতি গাড়ি এসে থামে, গাড়ি থেকে নামে নন্দিতা। ফ্ল্যাটের বারান্দার থেকে সবই ঝুঁকে দেখেন ভারতী। রাত্রি ন'টা বেজে গেছে, সকাল ন'টায় অফিস গেছে নন্দিতা, বারো ঘন্টা বাদে বাড়ি ফিরছে নন্দিতা কিন্তু চেহারায় আজ কোনও ক্লান্তির ছাপ নেই বরং অন্য দিনের তুলনায় অনেক সজীব আর সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে।
নিজের মনে এই প্রশ্নের কোনও উত্তর পেলেন না ভারতী, অচেনা মারুতি থেকে নামা, সজীব, তৃপ্ত চেহারা, কোথাও ক্লান্তির ছাপ নেই, কিছু একটা ঘটনা আছে, কিন্তু এখনই প্রশ্ন করতে পারছেন না, সামনে রিমি রয়েছে, পাশের ঘরে ছেলে খবরের কাগজ পড়ছে।
রাত্রে রিমি শুয়ে পড়েছে, ধীমান মশারির তলায়, খাবার ঘরের বেসিনের কাছে শোবার আগের দাঁত ব্রাশ করছিল নন্দিতা, রাত্রের ইসবগুল খেতে খেতে ভারতী অনুচ্চ কিন্তু দৃঢ় স্বরে প্রশ্ন করেন - "আজ কার গাড়িতে অফিস থেকে এলে, নন্দিতা?"
মৃদু চমকে শাশুড়ির মুখের দিকে তাকায়, নন্দিতা, তারপর সহজ সপ্রতিভ হয়ে মুহূর্তেই বলে - "ও হো ও তো আমার অফিসের রায়দার গাড়ি। আমার ডিপার্টমেন্টের বস, এসেছিলেন আমার পাড়ার দিকে, বললেন, "পৌঁছে দিচ্ছি। আমিই বা বিনি পয়সার লিফট ছাড়ি কেন, মা?" বলে শাশুড়ির দিকে পিছন ফিরে ব্রাশ-করা দাঁত বেসিনের কল খুলে জলে ধুতে থাকল নন্দিতা। আর কথা না বাড়িয়ে ভারতী নিজের ঘরে চলে গেলেন। শুধু যাওয়ার আগে আর একবার পুত্রবধূর মুখের দিকে দু-মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন।
আয়নায় শোওয়ার আগের নাইটক্রিম মাখতে মাখতে নন্দিতার মনে পড়ল আজ শোভন রায়ের সঙ্গে অন্তরঙ্গতার পরে মহার্ঘ্য রেস্টুরেন্টের পরিচ্ছন্ন বাথরুমে গিয়ে ওইরকম নতুন করে না সাজলেও পারত, এই সব সূক্ষ্ম পরিবর্তন ধীমান ধরতে না পারলেও ভারতীর মেয়েলি দৃষ্টিতে এ সব কিছুতেই এড়িয়ে যায় না, এ বার থেকে সতর্ক হওয়া খুবই জরুরি। নিজেকে সামান্য শাসন করে রাতের পোশাক পরে মশারি সরিয়ে নিজের বালিশে মাথা রাখে সে। নিজেই নিজের মনে মনে বলে সে যদি শোভন রায়ের সঙ্গে কিছুটা অন্তরঙ্গতা না করে, তবে তার জায়গায় ওই ফ্যাকফ্যাকে ফরসা নয়না এসে অধিকার করবে আর আগামী মাসে যে ইনক্রিমেন্টটা, প্রোমোশনটা আশা করছে তা হাতের বাইরে চলে যাবে তা হলে। যে করেই হোক নয়নাকে শোভনের কাছাকাছি ঘেঁষতে দেওয়া যাবে না, যতই ফর্সা হোক, নারী হিসেবে নয়নার চেয়ে নন্দিতা যে অনেকখানি আবেদনময়ী, অনেক বেশি আকর্ষণীয়া, এ কথা নন্দিতার চেয়ে আর কে বেশি জানে!
অফিস যাওয়ার সময়ে নন্দিতার সাজগোজ এবং পোশাকের পারিপাট্য অনেক বেশি বেড়ে যেতে শুধু ভারতীরই না, ধীমানেরও তা নজরে পড়ে, - এ কথা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে গেলে নন্দিতা ইদানিং ফোঁস করে ওঠে এবং এ সব নিয়ে কথা বলাকে সে তার ব্যক্তি-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলেই মনে করে আজকাল। রিমির দিকে মন দেওয়ার সময় এখন কম পায় নন্দিতা; তাকে মাঝে মধ্যেই সান্ধ্য পার্টিতে যেতে হয়। ফিরতে রীতিমতো রাত হয়। গত মাসে প্রমোশন পেয়েছে সে চাকরিতে। তার বিজ্ঞাপন সংস্থার সুপারভাইজারের পোস্টটি তাকেই দেওয়া হয়েছে এবং সেটা সম্ভব হয়েছে শোভন রায়ের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গতার কারণে যতখানি, ঠিক ততখানিই তার কাজের যোগ্যতার কারণেও বটে। কিন্তু নন্দিতা জেনেছে এই সব প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান, এখানে যোগ্যতার সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক কিছুই লাগে, শুধু যোগ্যতা হলে চলে না মোটেই। ব্যাপারটিকে তার একটুও অনুচিত মনে হয় না। সে কোনও অপরাধবোধেও ভোগে না।
আজ এক তারিখ। নতুন প্রমোশনের জন্য কিছু অতিরিক্ত টাকা আজ বর্ধিত বেতনে হাতে পেয়ে বাড়ি ফেরার পথে চাইনিজ রেস্তরাঁ থেকে কিছু চিনা খাবার কিনে নেয় নন্দিতা। বাড়ি এসে দেখে আজ সকাল সকালই রিমি খেতে বসে গেছে, মোটে সন্ধে সাড়ে সাতটা এখন। মাকে চিনা খাবার নিয়ে ঢুকতে দেখে উৎসাহে বাড়ির খাবার ফেলে চিনা খাবারের দিকে ঝোঁকে রিমি। খাবার টেবিলের কাছেই বসে খবরের কাগজ পড়ছিল ধীমান, চোখ তুলে মেয়েকে আর মেয়ের মাকে এক ঝলক দেখে চোখ নামিয়ে নিয়ে মেয়ের উদ্দেশে বলে, "দেখিস আজেবাজে বাইরের খাবারের জন্য ঘরের খাবার নষ্ট করিস না।"
কথার মধ্যে নন্দিতার জন্য কিছু আঘাত আছে তা নন্দিতা আগেই বুঝেছিল, অবোধ বালিকা কন্যা সে সব কথার গুঢ় মর্ম কী বোঝে? সে সরল বিশ্বাসে বলে - “হ্যাঁ বাবা, বাইরের রেস্টুরেন্টের খাবার আমি দারুণ ভালবাসি" - বলেই উৎসাহভরে খেতে থাকে।
রাত্রে খাওয়ার টেবিলে ধীমানকে সেই খাবার গরম করে দিতে গেলে ধীমান তা প্রত্যাখ্যান করে; দারুণ অপমানিত বোধ করে নন্দিতা, মুখে বলে, - "ও আমার প্রমোশন হয়েছে তো, তাই তোমার হিংসে হচ্ছে, না?"
ভারতী খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে যেতে যেতে বলেন, - "ও তোমাকে হিংসে করে না, করুণা করে।"
তীক্ষ্ণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে নন্দিতা, গলার স্বর ওপরে ওঠে তার, বলে, "আমাকে করুণা করার কোনও অধিকার ওর নেই, আমি প্রমোশন পেয়েছি নিজের যোগ্যতায় -" তাকে থামিয়ে দিয়ে ধীমান বলে - "যাক আর নিজের যোগ্যতার বড়াই করতে হবে না।"
খাওয়া অসম্পূর্ণ রেখে নন্দিতাও উঠে যায়। রাত্রে শোওয়ার ঘরে দু'জনে দু'জনের মুখোমুখি, রিমি কয়েকদিন ধরে ঠাকুমার কাছে শুচ্ছে। খাটের পাশের চেয়ারে বসেছিল ধীমান, ঘরে ঢুকে নন্দিতা ধীমানের কাঁধ খামচে ধরে। বলে, "তুমি এবং তোমার মা দু'জনেই আমাকে অপমান করছ, কেন, কেন এ্যাঁ?"
ধীমান স্ত্রীর হাত কাঁধ থেকে নামিয়ে দেয়, শান্ত স্বরে বলে, "শোনো তোমাদের অফিসের নয়নার প্রমোশন না হয়ে কেন তোমার একার হয়েছে তা আমরা জানি, আমার কলিগ তুনশ্রীর ছোট বোন নয়না, সে আমায় সব বলেছে।"
"ওঃ তোমার তনুশ্রী তো তোমাকে সবই বলে, সবই দেয়, তবু যদি সব কিছু না জানতাম -”
"কী? কী বললে?” ঘাড় ফিরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে গর্জন করে ওঠে ধীমান; নিজের ভিতরে ভিতরে নিজের দুর্বলতা টের পাচ্ছিল সে, গলার স্বর এ কারণেই চড়ে যায় তার।
ধীমানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নন্দিতা, দু'জনেই ফুঁসছে, দু'জনেই দু'জনের সামনে নিজেকে নিজেকে আড়াল করতে চাইছে।