গল্প

স্নায়বীয়



নবনীতা দেবনাথ


এমন অস্বস্তিতে আগে কখনো পড়েননি রজতশুভ্রবাবু। ভেতরে ভেতরে এমন চোরা শত্রুও তো কেউ থাকার কথা নয়।

বরাবরই ইন্ট্রোভার্ট মানুষ, কোনো সাতে পাঁচে থাকেন না।

কর্পোরেশনের কেরানীর চাকরি। বাড়ি নৈহাটি। থাকেন জলপাইগুড়ির একটি এক কামরার ফ্ল্যাটবাড়িতে। একলা মানুষ। নৈহাটির আদি বাড়িতে দাদা বৌদির সংসার। ভাইপোটা মাঝেমধ্যে ফোন করে! ব্যাস, আর কোনো পিছুটান নেই। মাস ফুরোলে টাকাটা পাঠিয়ে দিলেই হলো। অর্থাৎ পৃথিবীর কোনো কোণাতেই রজতশুভ্রবাবু অপরিহার্য নন।

অফিসে নেহাত খুব প্রয়োজন না হলে ফাইল থেকে মুখ তোলেন না রজতবাবু। ছুটিছাটা নেওয়া নেই। অ্যালুমিনিয়ামের আয়তাকার টিফিন বক্সে রোজের মুড়ি চানাচুর, আলাদা একটা কৌটোয় শশা কুচি, দু'টোর দিকে খান। চশমাটা খুলে রেখে আধঘন্টা চোখ বুজে বসেন। তারপর আবার কাজে লেগে যান। অন্যদের মতো ফোনে সময় দেওয়ার ব্যস্ততাটুকুও টানে না রজতশুভ্রবাবুকে। তাও...!

কারোর সাথে যেমন মনোমালিন্য নেই, মাখামাখিও নেই সেভাবে। তবুও...!

কে করতে পারে এমন? এবং কেন?

এ ক'দিন অফিস বন্ধ রেখেছেন রজতবাবু। শরীরটা ঠিক যাচ্ছে না। মাথা ঘুরছে। প্রেশারটা বোধহয় ফল করলো আবার! ঘুম হচ্ছে না ঠিকঠাক। অফিস যে যাবেন না ক'দিন সে তো নির্মাল্যকে বলেই এসেছেন। জয়েন করে মেডিক্যাল দেবেন, সে কথাও!

তবে তো এমনটা হওয়ার কথা নয়!

মর্নিংওয়াকটা রজতবাবুর ছেলেবেলার অভ্যেস। ঝড়-বৃষ্টি, শীত-গ্রীষ্ম, মর্নিংওয়াকের জন্য বরাদ্দ পাক্কা এক ঘন্টা। ওই তো গেটবাজারের রাস্তাটা ধরে ফ্লাইওভার পেরিয়ে অফিসার্স ক্লাবের পেছন দিয়ে ঘুরে স্টেশনের সামনে দিয়ে আবার বাড়ি। রোজের কক্ষপথ, নড়চড় হবার নয়।

পরশুদিন প্রথম নজরে পড়লো পোস্টারটা। স্টেশনের গেটে। পোস্টারটি নিম্নরূপ -

নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি

রজতশুভ্র বারিক
বয়স - ৫৭ বছর
রোগাটে গড়ন, শ্যামবর্ণ
উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি
ডান ভ্রুর কাছে কাটা দাগ
বাড়ি - সুভাষপল্লী, পদ্মপুকুর পাড়,
খড়্গপুর-৭২১৩০১

* হারিয়ে যাওয়ার সময় পরনে ছিল আকাশি ফতুয়া ও ট্রাউজার্স।

সাথে রজতবাবুর নিজেরই একটা সাদাকালো পাসপোর্ট সাইজের এনলার্জ্ড ছবি।

সব্বোনাশ করেছে! প্রথম দেখে সেদিন বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত্ করে উঠেছিল। অদ্ভুত একটা অনুভূতি। হেসে উড়িয়ে দেবেন? না থানায় যাবেন? এ তো রীতিমত সিরিয়াস ঠাট্টা। এ ঠাট্টা ক্ষতিকর। কে করতে পারে এমন?

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে এগিয়ে রেলওয়ে ওয়ার্কশপটা পেরোতেই বড় বটের নীচের চায়ের দোকানটায় আবার! আরেকটা একই পোস্টার।

কম কথা বলা মানুষ। ভীষণ সংকোচ হচ্ছে হঠাৎ। এ'সব জানাজানি হলে টিটকিরি বিদ্রুপ না সইতে হয় তাকে! চুপচাপ সেদিন আধঘন্টার মধ্যেই বাড়ি ফেরার পথ ধরলেন রজতশুভ্রবাবু। চায়ের দোকানে আর দাঁড়াবার রিস্ক নিলেন না। পকেট থেকে রোজের মতোই চাবিখানা বের করে ফ্ল্যাটের দরজা খুললেন। বসলেন নরম সোফাতে। বল পাচ্ছেন না শরীরে। হাঁফ লাগছে ভীষণ। একবার ডঃ সোমকে দেখিয়ে নিতে হবে ছুটির মধ্যেই। মেডিক্যাল সার্টিফিকেটটাও তো লাগবে।

চিন্তাগুলো তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

আচ্ছা, সেবার পাড়ার পুজোয় অতগুলো টাকা চাঁদা দিতে চাইলেন না বলে ক্লাবের ছেলেরা যে শাসিয়ে গেল, এ তাদের কাজ নয় তো? প্রতিহিংসায় মানুষ কি না করতে পারে!

পরেরদিন ভোরে একটা অন্য রুট ধরলেন রজতবাবু। আজ একটু মালঞ্চের দিকে যাবেন যেখানে ওর সচরাচর যাওয়া হয় না। নিশ্চিত হতে চান ওখানে অন্ততঃ নিজের নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তির পোস্টারের দেখা মিলবে না। তবে হায় রে ভবিতব্য! রজতবাবুকে আরও একবার বেশ অবাক করে দিয়ে বালাজী মন্দির পর্যন্ত যাওয়ার পথে অন্ততঃ পাঁচবার চোখে পড়লো বিজ্ঞপ্তিটি! ভ্রু কুঁচকে উঠলো অজান্তেই। মাথাটা আবার দপদপ করছে। নাহ্! আজই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে ডঃ সোমের। মনস্থির করে পাশের এটিএম থেকে ডাক্তার ও ওষুধ বাবদ হাজার দুই টাকা তুলতে পকেটে হাত দিলেন। ওয়ালেটটা কই? এ কি? কোত্থাও নেই তো! ওতেই দু'দুটো ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ড রাখা থাকে!

আর ভালো লাগছে না! রজতশুভ্রবাবুর এই নিস্তরঙ্গ জীবনে এহেন হতবুদ্ধি অবস্থায় কক্ষনো পড়তে হয়নি তাকে। একটার পর একটা এই ঝামেলা যেন সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে রজতশুভ্রবাবুকে! ভীষণ বিরক্তিতে পাশের একটি বাঁধানো অশ্বত্থের তলায় বসলেন খানিক। চুপচাপ মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবতে চেষ্টা করলেন এটিএম কার্ড, নিজের ছবি আর খুচরো কিছু টাকা সমেত ওয়ালেটটা ঠিক কোথায় ফেলে এলেন! এমন দায়িত্বহীন মানুষ তো তিনি নন কক্ষনো!

হ্যাঁ, সেদিন যেখানে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন! ওই তো ফ্লাইওভারের ডানদিকের ওই শাপলা বনের জলা জায়গার পাশের জনবিরল রাস্তাটায়! ওখানে পড়ে টড়ে যায়নি তো? যাবেন একবার? শেষ চেষ্টা করে দেখবেন? না পেলে তো এফআইআর করতেই হবে। তখনই না হয় পোস্টারের বিষয়টাও পুলিসে জানানো যাবে, এমনটাই সিদ্ধান্ত নিলেন রজতশুভ্রবাবু।

সেদিন ওখানে হোঁচট খেয়ে পড়েই পায়ে কোমরে চোট লেগেছে ভীষণ। ক'দিন ধরে ভালো যাচ্ছিল না শরীরটা। সেদিন না বেরোলেই ভালো হতো। কিন্তু ওই যে অভ্যেস! সেই অভ্যেসের টানেই আজও বেরোলেন।

নাহ্, উঠে একবার ওই জলাটার ধারে গিয়ে খুঁজে আসা যাক বরং! উঠলেন রজতশুভ্রবাবু। বেশি দূর নয়। পনেরো মিনিট মতো!

বেলা হয়ে এলো। তবু রাস্তাটা ফাঁকা, অন্যদিনের মতোই। খুঁড়িয়ে চলছেন ক'দিন পায়ের ব্যথায়। ঝুঁকে সবটা জায়গা খুঁটিনাটি জরিপ করতে করতে এগোতে লাগলেন রজতশুভ্রবাবু।

ওই তো, ওই জায়গাতেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন সেদিন। মাথাটা হঠাৎ কেমন ঘুরে গেছিল।

নিজের দেহটা কেমন ভারী লাগছে! অনেক কষ্টে নিজেকে টেনে নিয়ে গিয়ে কিছু একটা চোখে পড়তেই সন্দিহান দৃষ্টিতে অকুস্থলে এগিয়ে গেলেন রজতবাবু। একি দেখছেন তিনি! চোখ কচলে আবারও দেখলেন। দূর থেকে যা দেখেছিলেন, কাছে এসেও তাই! একটা দীর্ঘকায় দেহ। উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আকাশী রঙের ফতুয়া পরা শরীরটার উর্ধ্বাংশ জলায় ডুবে আছে। কোমর থেকে নীচের অংশ শুকনো রাস্তায়। তাৎক্ষণিক প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় পায়ের দিকটা ধরে এক ঝটকায় বরফের মতো ঠান্ডা শরীরটাকে চিৎ করে ঘোরালেন রজতশুভ্রবাবু।

এমন করে তার সামনে আয়না ধরল কে? কিন্তু কি বিভৎস এই রূপ! কি পান্ডুর এই দৃশ্য! ছিটকে পড়ে গেলেন আবারও। হাড়গুলো যেন কাচের মতো ভাঙল! কিন্তু কোনো ব্যথা নেই! তীব্র গন্ধে নাক চাপা দিতে গেলেন ভয়ার্ত রজতশুভ্রবাবু। তক্ষুণি লক্ষ্য করলেন নিজের শীর্ণকায় রক্তশূন্য আঙুলগুলো। একটা হিমেল হাওয়ায় পচা গলা মুখটার ওপর উড়ে এসে পড়ল সেই নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তির ছেঁড়া এক টুকরো কাগজ...