প্রবন্ধ ও নিবন্ধ

এক ব্রাহ্মণের গোধন উদ্ধারের কাহিনি



লক্ষ্মী নারায়ণ হাজরা


একপত্নী দ্রৌপদীকে উপলক্ষ করে পঞ্চপাণ্ডবদের পরস্পরের মধ্যে যাতে কোনওভাবেই বিভেদ ও বিদ্বেষ না জন্মে তার জন্য দেবর্ষি নারদের উপদেশক্রমে তাঁরা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে এক এক ভাই নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দ্রৌপদীর কাছে থাকবেন। তখন অন্য কোনও ভাই সেখানে যাবেন না। যদি কোনও ভাই এই নিয়মের ব্যতিক্রম করেন, তাহলে তাঁকে ব্রহ্মচারী হয়ে বারো বৎসর বনে বাস করতে হবে। এই নিয়মই চলছিল এবং পাণ্ডবগণ দ্রৌপদীকে পত্নীরূপে পেয়ে যেমন প্রীত হয়েছিলেন, দ্রৌপদীও তেমনই পাণ্ডবদের মতো পঞ্চপতি পেয়ে আনন্দিত হয়েছিলেন। ওই সময় পান্ডবগণ রাজ্যলাভ করে খাণ্ডবপ্রস্থে বাস করছিলেন এবং তাঁদের ধর্মানুষ্ঠান ও সুশাসনে তাঁদের রাজ্য সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠেছিল।

পান্ডবদের রাজ্যশাসন-কালীন একদিন কয়েকজন চোর এক ব্রাহ্মণের কতকগুলি গোধন চুরি করে নিয়ে গেল। ওই ব্রাহ্মণ উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করতে করতে খাণ্ডবপ্রস্থে পান্ডবদের কাছে এসে হাজির হয়ে তাঁর গোধন অপহরণের দুঃসংবাদ জানালেন। তিনি বললেন, যে রাজ্যে শমপরায়ণ ব্রাহ্মণের গোধন অপহৃত হয় সেখানে তো যজ্ঞের হবি কাকে ভক্ষণ করবে এবং নীচ পশু শৃগাল ব্যাঘ্রের গুহায় প্রবেশ করবে। যে রাজা প্রজাদের কাছ থেকে এক-ষষ্ঠাংশ কর নিয়েও তাদের রক্ষার ব্যবস্থা করে না, তাদের পাপ স্পর্শ করে। ব্রাহ্মণ পান্ডবদের সম্বোধন করে বললেন যে চোরে ব্রাহ্মণের গোরু চুরি করছে, এর ফলে তাঁর ধর্মার্থ নাশ হচ্ছে, অতএব পাণ্ডবগণ যেন তাঁর গোধন উদ্ধার করে দেন।

ক্রন্দনরত সেই ব্রাহ্মণের কাতর প্রার্থনা অর্জুন শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণের গোধন উদ্ধার করে দেবেন বলে আশ্বাস দিলেন। কিন্তু সমস্যা হল যে, যে ঘরে অস্ত্রশস্ত্র থাকে সেই ঘরেই সেই সময় যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদী একান্তে ছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী অর্জুন তখন সেই ঘরে প্রবেশ করতে পারেন না। একদিকে এই নিয়ম পালন, আবার অন্যদিকে গোধনহরণজনিত নির্দোষ ব্রাহ্মণের দুরবস্থা ও ক্রন্দন। অর্জুন পড়ে গেলেন উভয়-সঙ্কটে। যদি তিনি দ্বারে উপস্থিত বিপন্ন ব্রাহ্মণের গোধন পুনরুদ্ধার না করেন, তাহলে প্রজাদের মধ্যে তাদের রাজ্য-পালনে অবজ্ঞাপ্রদর্শনের নিন্দা ঘোষিত হবে; আর যদি মহারাজের অনুমতি না নিয়ে যান তাহলে তাঁর অপমান করা হয় এবং যদি তাঁর অনুমতি নেওয়ার জন্য অস্ত্রাগারে প্রবেশ করেন তাহলে প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘনের জন্য তাঁকে বনবাসে যেতে হবে। কিন্তু রাজার কাছে গেলে অন্য সব দোষ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। অতএব প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘনের জন্য মহাপাপই হোক কিংবা বনে বাসই হোক, ব্রাহ্মণের গোধন রক্ষা করা অবশ্য কর্তব্য, কারণ শরীররক্ষার চেয়েও ধর্মের গৌরব অধিক। এই সব চিন্তা করে অর্জুন শস্ত্রাগারে প্রবেশ করলেন এবং যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে ধনুঃশর গ্রহণ করে ব্রাহ্মণের অনুসরণ করলেন। বেশিক্ষণ সময় লাগল না, কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি গোরুচোরদের হত্যা করে ব্রাহ্মণের গোধন ফিরিয়ে দিলেন এবং ব্রাহ্মণও প্রসন্নচিত্তে অর্জুনকে আশীর্বাদ করলেন।

প্রাচীন ভারতে গোরু অন্যতম মূল্যবান সম্পাদ হিসাবে পরিগণিত হতো। এখানে দেখা গেল, গোরু চুরি হয়ে গিয়েছিল বলে ব্রাহ্মণ অসহায়ভাবে কান্নাকাটি করছিলেন আবার তা ফিরে পেয়ে তিনি মহা আনন্দিত হয়ে অর্জুনের যশকীর্তন করেছিলেন। বশিষ্ঠর কামধেনুকে কেন্দ্র করে তাঁর সঙ্গে বিশ্বামিত্রের মহাসংঘর্ষ বেধে গিয়েছিল এবং সেখানে ব্রাহ্মণ বশিষ্ঠের কাছে ক্ষত্রিয় বিশ্বামিত্রকে পরাজিত হতে হয়েছিল। মৎস্যরাজ বিরাটের ষাট হাজার গোধন ছিল। ওই বিশাল সংখ্যক গোধন যখন কৌরবগণ অপহরণ করতে উদ্যত হয়েছিলেন, তখন বিরাটরাজের আশ্রয়ে ছদ্মবেশে থাকা বৃহন্নলারূপী অর্জুন এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ করে কৌরবদের পরাজিত করে গোধন পুনরুদ্ধার করেছিলেন।

রাজ্যের মধ্যে চুরিডাকাতি বা অন্য যে কোনও অপরাধই সংঘটিত হোক না কেন, আদর্শ রাজার পক্ষে সমদৃষ্টি নিয়ে তার প্রতিকারে ব্রতী হওয়া উচিত। সেখানে ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণের কোনও প্রশ্ন নেই, রাজ্যের প্রজা হলেই হল। অথচ এই কাহিনিটা পড়ে মনে হচ্ছে যেন গোধন ব্রাহ্মণের হওয়ার জন্য চৌর্যকর্মজনিত এই অপরাধ বিশেষ মাত্রা পেয়েছে, যেন 'ইতরে জনাঃ'-র গোরুচুরি হলে তেমন মাথা না ঘামালেও চলত। অর্জুন মনে করছেন নির্দোষ ব্রাহ্মণের গোধন অপহৃত হয়েছে এবং তিনি রোদন করছেন, অতএব যে কোনও ঝুঁকির বিনিময়ে ব্রাহ্মণের চোখের জল মোছানো যেন তাঁর অবশ্য কর্তব্য কর্ম। এখানে ঝুঁকিটা হল যে ব্রাহ্মণের গোধন উদ্ধার করতে গেলে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিতে হবে এবং অনুমতি নিতে গেলে ও অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে নিতে গেলে অস্ত্রাগারে প্রবেশ করতে হবে যেখানে মহারাজ যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদী অবস্থান করছেন, আর অস্ত্রাগারে প্রবেশ করলে পূর্ব-সংস্থাপিত নিয়ম অনুযায়ী অর্জুনকে বারো বৎসরের জন্য বনে যেতে হবে। শেষ পর্যন্ত অর্জুন স্থির করলেন প্রতিজ্ঞালঙ্ঘনজনিত গুরুতর অধর্মই হোক বা বনবাসই হোক, যে কোনো মূল্যের বিনিময়েই ব্রাহ্মণের গোধন রক্ষা করা সর্বতোভাবে কর্তব্য। অর্থাৎ ব্যাপারটাকে বিশ্লেষণ করলে এমনই দাঁড়ায় যে সাধারণ মানুষের গোরু চুরি গেলে হয়তো তার করুণ আবেদন গ্রাহ্যই হতো না। অথবা প্রিয়জনবিচ্ছিন্ন হয়ে বারো বৎসরের বনবাসের ঝুঁকিও নেওয়া হতো না, কেবল ব্রাহ্মণ বলেই এত কান্ড করা হল। তবু তো একটা বিষয়ের এখানে কোনও ইঙ্গিত নেই - ব্রাহ্মণরা সাধারণত কোপনস্বভাব এবং ভয়ঙ্কর অভিশাপদানে বেশ পারদর্শী হতেন। দেখা যাচ্ছে, গোধন-হারানো ব্রাহ্মণটি বেশ নিরীহ ছিলেন। শুধু কান্নাকাটিই করেছেন, অভিশাপ দেওয়ার ভয় দেখাননি।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।