সময় হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাবার পর মনে হয় সেটাই শাশ্বত সত্য। অথচ স্মৃতির পথ থেকে এরকম কতকিছু হারিয়ে যাবার পর আমরা কী অদ্ভুত তৎপরতায় ভুলে যাই সেইসব দুর্ঘটনা। আলো ফেলে অন্ধকার সে পথে যাবার কষ্ট আমরা কেউই করতে চাই না। আর শতকরা নিরানব্বই ভাগ মানুষের রুটি-রুজি নিয়ে সমস্যার শেষ নেই। তারা সময়কে টেনে হিঁচড়ে নিজের সঙ্গে নিয়ে চলতে ভালবাসে না। জীবনের ছোট ছোট খুশিকে তারা মুঠোবন্দী করে রাখতে গিয়ে অনেক বড় বড় সমস্যাকে তাচ্ছিল্য দেখানোর সাহস রাখে। তাই মোমবাতির আলোয় গ্রামের রাস্তা কখনও আলোময় হয়ে উঠতে পারে না। আর, সেখানে চিরকালীন আলোর ব্যবস্থা ইচ্ছা করেই রাখা হয় না রাষ্ট্রের চক্রান্তে। রাষ্ট্র জানে এই শতকরা নিরানব্বই ভাগেই তাদের ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে। রাষ্ট্রশক্তি তাই সেই নিরানব্বই শতাংশের যাপিত সময়কে তালুবন্দী করে রাখার চেষ্টায় থাকেন ভর্তুকির টোপে।
এক শতাংশের প্রতিবাদে আরও দু-এক শতাংশ যোগ দিলেও তাতে ভোটের কম-বেশি এমন কিছু হবে না ধরে নিয়েই শাসক তার স্পর্ধা দেখাতে শুরু করেন। একটা ধর্ষণকাণ্ডের প্রভাব যত না বড় তার থেকে অনেক বেশি বড় হয়ে দাঁড়ায় শাসকের সহনশীলতা ও সমবেদনার অভাব। তার উপর যদি ঔদ্ধত্য প্রকাশ পায় তার যাবতীয় আচরণে তাহলে তো অনেক কিছুই ঘটতে পারে।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আর. জি. কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কান্ডে অনেক কিছু ঘটনা ঘটলেও সেই অর্থে পশ্চিমবাংলা বাংলাদেশ হয়ে ওঠেনি বলে যারা আফসোস করছেন তারা জানেন না বা বোঝেননি ঘটনার মোকাবিলা কীভাবে চলছে। মানুষ বিচার চেয়ে পথে নেমেছে আর প্রতিবারের মতো বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদার প্রস্তুতি নিচ্ছে কী অদ্ভুতভাবে! বিরোধীদের মতন শাসকেরাও একই দাবিতে পথে নেমে সমগ্র ঘটনাটিকে যে তারল্যের স্তরে আনতে চেয়েছিলেন তাতে সফল হয়েছেন অনেকটাই। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে দোষীর বিচার চেয়ে অনেক নাটক করার পর ট্যাক্সের টাকায় কেন উকিল নিয়োগ করা হল বুঝলাম না। সেই একই মঞ্চ থেকে নির্যাতিতার ফাঁসি চেয়ে আলোচনার মোড় ঘোরানোর কৌশলটা ঠিক ডহরবাবুকে খুঁজতে পথে নামার মতন। পাশাপাশি শাসকের বিরোধিতায় প্রথম স্থান দখল করতে বদ্ধপরিকর প্রায় সব বিরোধী রাজনৈতিক দল। সেক্ষেত্রে অরাজনৈতিক শব্দটিকে গালাগাল দিতে ব্যস্ত রাজনৈতিক নেতারা মিছিলের পিছনে নিজের সমর্থনে লোকের অভাব বুঝেও বুঝতে চাইছেন না। সময় হারিয়ে গিয়ে ফিরে আসার পূর্বমুহূর্তে মুখ পরিবর্তন চাইছে। দলবদলের রাজনীতিকে এক ঘৃণ্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে ফেলার পর কোনও দলই আর সেরকম গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না মানুষের কাছে। তবু যাদের হাতে আমরা দলীয় পতাকা দেখতে পাচ্ছি সেটা অতীত কিম্বা ভবিষ্যতের ধান্দাকে জিইয়ে রাখা সময়ের হাতিয়ারমাত্র। এ কথা মেনে নেবার সময় এখনও আসেনি। যখন আসবে তখন রাজনীতিটা শুধুমাত্র সমাজবিরোধীদের মঞ্চ হয়ে উঠবে। তবে, বর্তমান সময়ের দলীয় রাজনীতি যে মারাত্মক মৌলবাদসর্বস্ব হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাতে মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে তা বলা যেতেই পারে। কোনও দলই অন্য কোনও বিরুদ্ধ মত বা সমালোচনা মেনে নিতে রাজি নন অথচ সবাই নাকি সমাজের মঙ্গল করতে রাজনীতির মাঠে নেমেছেন। আর এর মারাত্মক সুফল আমরা দেখতে পাই রাজনৈতিক নেতাদের সম্পদের উত্তরোত্তর বৃদ্ধিতে। অনেক সময় এদের সম্পদের বৃদ্ধির হার বিশ্বের যে কোনও ধনী ব্যবসায়ীর ব্যবসার সম্পদের বৃদ্ধির হারের চেয়েও বেশি!
না, বিস্মিত হবেন না। রাজনীতি এখন নিটোল, নিবিড় এক ব্যবসা মাত্র। আর সেই ব্যবসার ক্ষেত্রটিকে ছিন্নভিন্ন করতে পারে এক বা একাধিক মানুষের রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। কেউ কেউ 'অরাজনৈতিক' শব্দটি নিয়ে ভীষণ রকমের আপত্তি তুলেছেন। তাঁরা 'অদলীয়' শব্দটি পর্যন্ত মান্যতা দিয়েছেন। কিন্তু আমার মনে হয় পশ্চিমবাংলার "মেয়েরা রাত দখল করো" আন্দোলনটি অরাজনৈতিক আখ্যা পাওয়াতেই দলবদলের রাজনীতিতে ক্ষুব্ধ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছেন। এখন আমরা আরও কঠিন একটা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আজকের অরাজনৈতিক আন্দোলন কি কালকের রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবসার হাল ধরার জন্য প্রস্তুত নাকি সেও এই রাজনীতি-শিল্পের বিজ্ঞাপনী চমকমাত্র?
[লিখিত বক্তব্যের দায় সম্পূর্ণরূপে লেখকের নিজস্ব।]