বিবিধ

স্বপ্নের বাগানে



অমলেন্দু হাইত


রবীন্দ্রনাথের জ্যোতিদাদা (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর) তখন খুব ব্যস্ত। রোমান সম্রাট মার্কাস অরিলিয়াস (Marcus Aurelius)-এর 'দি মেডিটেশন' (The Meditation) বইটি অনুবাদ করছেন। রোমের আন্তনিনে সাম্রাজ্যের (Antonine dynasty - ২৭ খ্রীঃ পূঃ - ১৮০ খ্রীঃ) পঞ্চম ও শেষ শ্রেষ্ঠ সম্রাট যাঁকে নির্বিকার/বিষয়বিমুখ বা Stoic Philosopher বলা হতো। তাঁর সময়ে বহু উপজাতিতে বিভক্ত রোমের মানুষেরা শান্তিতে ও আরামে জীবনযাপন করছিল। মার্কাসের রাজত্বকাল ছিল উনিশ বছর (১৬১-১৮০ খ্রীঃ)। এই সময়ে তিনি বারোটি ব্যক্তিগত ডায়েরি লিখেছিলেন এবং তিনি নিজে এগুলির কোনো নামকরন করে যান নি। ১৮১১ সালে রিচার্ড গ্রাভস্ (Richard Graves) প্রথম ইংরেজীতে তা অনুবাদ করেন। প্রকাশের পর বইটি অসম্ভব জনপ্রিয় হয়।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।


উইলিয়াম শেক্সপিয়ার।

সেই বইটির অনুবাদ প্রায় শেষ করে এনেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। এমন সময় কিশোর রবি এসে জানালেন শেক্সপিয়ারের 'ম্যাকবেথ' নাটকটি পড়ে তার খুব ভাল লেগেছে তাই সেটি তিনি বাংলায় অনুবাদের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। ইতিমধ্যে শেক্সপিয়ারের আরও কয়েকটি নাটক ও কবিতা তার পড়া হয়ে গেছে। জ্যোতিদাদা সব শুনে অনুবাদ করতে গেলে যে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয় তা কিশোর রবিকে বিশদে বলে উৎসাহিত করলেন। এরপর জ্যোতিদাদার বইটি প্রকাশিত হল। কেটে গেল আরও কয়েকটি বছর। শেক্সপিয়ারের প্রায় তিনশত বছর পর রবীন্দ্রনাথ এ পৃথিবীতে এসেছেন। কিন্তু এক অমোঘ আকর্ষণে তিনি যেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে জড়িয়ে পড়ছেন।

এরপর বিলাত যাত্রা। লন্ডনের থিয়েটার হলে বসে শেক্সপিয়ারের নাটক দেখেছেন। বার কয়েক লন্ডনে যাওয়ার পরেও তাঁর অ্যাভন (Avon) নদীর তীরে অবস্থিত শেক্সপিয়ারের জন্মস্থানটিতে (স্ট্রাটফোর্ড-অন-অ্যাভন, ওয়ারউইকশায়ার, ইংল্যান্ড) (Stratford-upon-Avon, Warwickshire, England) কোনোদিন যাওয়া হয়ে ওঠেনি। হয়ত সময় করে উঠতে পারেন নি বা তাঁর সৃষ্ট নাটকের চরিত্রগুলির মধ্যেই তাঁকে তিনি পেয়েছিলেন। 'Bird of Avon' বা 'অ্যাভনের চারণকবি'-কে তিনি রেখেছিলেন অন্তরের অন্তঃস্থলে।


স্ট্র্যাটফোর্ডের কেন্দ্র, হাই স্ট্রিট থেকে শেক্সপিয়ারের জন্মস্থান। অতীতের ছবি।


স্ট্র্যাটফোর্ডের কেন্দ্র, হাই স্ট্রিট থেকে শেক্সপিয়ারের জন্মস্থান। এখনকার ছবি।

২৪শে জুন, ১৮৮৫-তে তরুন বাঙালি কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এসে হাজির হলেন স্ট্রাটফোর্ডে। তাঁর মাথায় তখন নাটকের পোকা। মনে তাঁর সুপ্ত বাসনা - হতে চান শেক্সপিয়ারের মতো নাট্যকার। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর যা মনে হয়ে ছিল তাই তিনি লিখেছেন, "শ্রান্ত পথিক, এই স্থানে দাঁড়াও! বিরামের জন্য নহে, - মৃত প্রতিভার পূজার জন্য দাঁড়াও! প্রেম-বাষ্পাকুল নয়নে, অবনত শিরে, ভক্তিভরে এই স্থানে অধিষ্ঠাত্রী দেবতাকে প্রনাম কর... সঙ্গীতের দোলা, প্রেমের আধার, আনন্দের লীলাস্থান, কবিত্বের ধাত্রী, - এ সুন্দর নগরী! পথিক, এ স্থানে দাঁড়াও।"


শেক্সপিয়ার জাদুঘরের ভিতর বসবার ঘর।

এরপর বাড়ির বর্ণনাঃ ভগ্ন দ্বিতল কাঠের বাড়ি। ভাঙা সিঁড়ি। নীচে তিনটি ওপরে দুটি ঘর। নীচের দুটি ঘরে জাদুঘর (Museum), একটি রান্নাঘর। উপরের একটি ঘর কবির জন্ম-ঘর। পাশেরটি বসবার ঘর। সেই ঘরে একটি চেয়ার ও টেবিল, জানালার ওপরে শেক্সপিয়ারের চিত্রিত মূর্তি। জন্ম-ঘরে দেওয়ালের গায়ে কবি লংফেলো (Henry Wadsworth Longfellow), উপন্যাসকার স্যার ওয়াল্টার স্কট (Sir Walter Scott) এবং অন্যান্য ভুবনবিখ্যাত ব্যক্তিত্বের নাম পেন্সিল দিয়ে লেখা।

Visitor's Book-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিংশতম রাষ্ট্রপতি জেমস গারফিল্ড (President James Abram Garfield), প্রখ্যাত থিয়েটার অভিনেত্রী ও গায়িকা মেরি অ্যান্ডারসন (Miss Mary Anderson) সহ বহু গুণী বিদ্বান কবি ও চিত্রকরের নাম রয়েছে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছেন, "কে বলে বিলাতে তীর্থ নাই? তীর্থযাত্রা নাই? সর্বত্রই প্রতিভার আদর ও সম্মান আছে"।

নীচে শেক্সপিয়ার ও তাঁর সহধর্মিণী অ্যানি হ্যাথওয়ে (Anne Hathaway)-র প্রেমালাপ চিত্রিত একখানা বড় ছবি আছে। এই ঘরটিতে বসে আঠারো বছর বয়সের যুবক প্রেমালাপ (courtship) করত।

বাড়ির সামনে বড় বাগান। প্রচুর ফুল ফুটে রয়েছে। সামনে একটি কূপ আছে। বর্তমান গৃহস্বামীনী বাগানের গাছ থেকে কয়েকটি ফুল তুলে দ্বিজেন্দ্রলালের হাতে দিলেন।


পবিত্র ট্রিনিটি গীর্জা (Holy Trinity Church)।

এরপর তিনি চললেন শেক্সপিয়ারের সমাধি মন্দিরের দিকে। সমাধি-বেদীটি আছে ট্রিনিটি গীর্জার (Holy Trinity Church) ভিতর। তার ওপরে শেক্সপীয়ারের নিজের লেখা কয়েকটি ছত্রঃ
Good friend, for Jesus sake, forbear(e)
To dig the dust enclosed he(a)re.
Blest be the man that spares these stones
But curst be he that move my bones.


শেক্সপিয়ারের সমাধি-বেদী।

সেই সমাধিস্থলে দাঁড়িয়ে ডি. এল. রায় নিজের মনে বললেন, "আটলান্টিকের অপর পার হইতে তোমার নাম প্রতিধ্বনিত হইবে; সমগ্ৰ ইউরোপ জাতি-বিদ্বেষ ভুলিয়া তোমার গুণগান করিবে। আর দূরে গঙ্গাতীরবাসী আর্যাবর্তের শ্যামল সন্তান তোমাকে ভারতীয় বর-পুত্র কালিদাসের প্রিয় ভ্রাতা, জগতের প্রিয় কবি বলিয়া আলিঙ্গন ও আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান করিবে"।

দ্বিজেন্দ্রলাল দেশে ফিরে এলেন মনে এক গভীর প্রশান্তি নিয়ে। এর পর দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নামের প্রথমে যুক্ত হল 'নাট্যকার' পরে কবি, সঙ্গীতকার ও গীতিকার।

শেক্সপীয়ারের নাটকসমূহ এবং রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকৃতিতে জীবন চিত্রিত হয়েছে তার সামগ্রিকরূপে। দু'জনের সাহিত্যকর্মেই আছে ইতিবাচক চিন্তাধারায় প্রাধান্য। তাঁরা দিয়ে গেছেন নৈতিক সঞ্জীবনী বার্তা। মানুষের জন্য তাঁদের ছিল হৃদয়ের উষ্ণ সমবেদনা। শেক্সপীয়ারের সাহিত্য অনুশীলনের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকজন ভারতীয় পণ্ডিত উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন শেক্সপীয়ারের একজন অকুণ্ঠ অনুরাগী। এটা এখন বিশ্বজনীন সত্য যে শেক্সপীয়ার হলেন চিরকালের ও সব দেশের।

ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার রেনেসাঁর সবচেয়ে উজ্জ্বল ফসল রবীন্দ্রনাথ। তাঁর প্রতিভা পূর্ব ও পশ্চিমের সামাজিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সব গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলিকে আত্তীকরণ করেছিল। আমাদের সাহিত্য ও শিল্পে তাঁর প্রগাঢ় ও উল্লেখযোগ্য অবদান তো আছেই। পাশাপাশি তিনি সারা জীবন মানবিকতার স্বার্থে এবং বিশ্বজনীন ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রসারের লক্ষ্যে নিরন্তর কাজ করে গেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃজনশীল প্রতিভা কোন নির্দিষ্ট শিল্পমাধ্যমে সীমাবদ্ধ ছিল না। সাহিত্যের সব শাখাতেই তিনি নিজেকে অনবদ্যভাবে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। বাংলা ভাষাকে তিনি দিয়েছেন এক নতুন রূপ ও গতিবেগ। চিত্রকলাতেও তিনি উৎকর্ষের স্বাক্ষর রেখেছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত বাণী ও সুরের গুণে শ্রোতাদের হৃদয়ের অন্তঃস্থল স্পর্শ করে। অপরদিকে তাঁর কবিতা, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ গভীরভাবে অনুসন্ধানী ও আবিষ্টকারী। বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েই দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীতকে তাদের জাতীয় সঙ্গীতরূপে গ্রহণ করেছে। শুধু শিল্পকলাই নয়, শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন একজন অগ্রদূত। তাঁর সামাজিক চেতনা প্রকাশিত হয়েছে অভ্রান্তভাবে। তিনি কোনো সময়ই বাস্তবতা থেকে সরে যাননি। তিনি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ-যন্ত্রণা, আনন্দ সবকিছুর প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন। পৃথিবীর কোথাও মানবতার উপরে আক্রমণ নেমে এলে তিনি গভীরভাবে বেদনাহত হতেন। তিনি যেমন ছিলেন জাতীয়তাবাদী, তেমনই ছিলেন আন্তর্জাতিকবাদী। তাঁর জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা কিন্তু তাঁর আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে অন্বিত ছিল। ফ্যাসিস্ত বিভীষিকার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছিলেন। ফ্যাসিবাদ যে পরাজিত হবে সে ব্যাপারে তিনি তাঁর গভীর বিশ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ 'সভ্যতার সঙ্কট' আশাবাদে উজ্জ্বল।

শেক্সপিয়ারের তিনশত বৎসর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ২৮শে নভেম্বর, ১৯১৫ শিলাইদহে বসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "যেদিন উদিলে তুমি, বিশ্বকবি, দূর সিন্ধু পারে/ ইংল্যান্ডের দিকপ্রান্ত সেদিন তোমারে/ আপন বক্ষের কাছে, ভেবেছিল বুঝি তারি তুমি/ কেবল আপন ধন; উজ্জ্বল ললাট তবে চুমি/... (বলাকা-৩৩)


হাতির দাঁতের তৈরি সেই ফলক।

১৯৬৪ সালে শেক্সপিয়ারের জন্মের পৌনে চারশো বছর উদযাপনের সময় 'Calcutta Art Centre' রবীন্দ্রনাথের ঐ লাইনগুলি একটি হাতির দাঁতের তৈরি ফলকে খোদাই করে 'শেক্সপিয়ার সেন্টার' (The Shakespeare Centre)-কে (প্রযত্নে Shakespeare Birthplace Trust) উপহার হিসেবে প্রদান করেন। এর ত্রিশ বছর পর ১৯৯৪ সালে লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার ডাঃ এল. এম. সিংভী (Dr. Laxmi Mall Singhvi -1931-2007) লাইব্রেরীতে ঐ কবিতা-ফলকটি দেখতে পান। কবিতাটি দেখতে পেয়ে তাঁর মনে পড়ে তিনি কলেজ জীবনে এলাহাবাদে এই কবিতাটি পড়ে শেক্সপিয়ারকে গভীরভাবে জানার প্রতি উৎসাহিত হয়েছিলেন। এই কবিতাটির অনুষঙ্গেই তাঁর মনে হয়েছিল, শেক্সপিয়ারের নিজ বাসভবনে রবীন্দ্রনাথের একটি ভাস্কর্য গড়ে যদি এই কবিতাটি একটি ফলকে খোদাই করে রাখা হয় তাহলে অচিরেই ভারতীয়দের কাছে সেটি একটি নূতন দর্শনীয় স্থান হিসেবে গড়ে উঠবে। এই জায়গাটি হলো লন্ডন থেকে আড়াই ঘণ্টা দূরে। এখানে আছে শেক্সপীয়ারের বাড়ি, মিউজিয়াম। প্রতি বছর এখানে ১০ লক্ষ মানুষ আসেন।


ডাঃ এল. এম. সিংভী (Dr. Laxmi Mall Singhvi)।

কালবিলম্ব না করে তিনি পরিকল্পনাটি 'শেক্সপিয়ার বার্থপ্লেস ট্রাস্ট' (Shakespeare Birthplace Trust)-এর পরিচালক ও অছি পরিষদ (ট্রাস্টি বোর্ড)-এর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এদিকে দেশে যোগাযোগ করলেন কলকাতায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সাথে। জ্যোতিবাবু এই প্রস্তাবে উৎসাহিত হয়ে প্রখ্যাত ভাস্কর ও চিত্রকর দেবব্রত চক্রবর্তীকে অনুরোধ করেন রবীন্দ্রনাথের একটি ব্রোঞ্জের আবক্ষ মূর্তি গড়তে। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৫ সালের ৫ই জুলাই মূর্তিটি হস্তান্তরিত করা হয় 'শেক্সপিয়ার বার্থপ্লেস কমিটি'র চেয়ারম্যান প্রফেসর স্যার স্ট্যানলি ওয়েলস্‌ (Professor Sir Stanley Wells CBE, FRSL) এবং ট্রাস্ট ডিরেক্টর রজার প্রিংগল (Roger Pringle)-এর কাছে।


প্রফেসর স্যার স্ট্যানলি ওয়েলস্‌ (Prof. Sir Stanley Wells)।

আবক্ষ মূর্তিটি স্থাপন করার জন্য উদ্যানের একাংশে একটি উপযুক্ত নিরিবিলি ও শান্তিপূর্ণ স্থান নির্বাচন করা হয়, যেখানে দর্শকরা শেক্সপিয়ারের জন্মস্থানের বাড়ির চারপাশের প্রধান কার্যকলাপ থেকে দূরে রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তিটি একান্তে দর্শন করতে পারেন।


ভাস্কর শ্রী দেবব্রত চক্রবর্তী।


উইলিয়াম হকস (William Hawkes)।

মূর্তির স্তম্ভমূল (plinth) বা প্লিন্থটি তৈরী করেন স্থপতি উইলিয়াম হকস (William Hawkes)। লিচফিল্ডের লিনফোর্ড গ্রুপ (The Linford Group, Lichfield) ইয়র্ক পাথর দিয়ে সেটি তৈরি করে। প্রখ্যাত ফরাসী ভাস্কর ক্যাথরিন রিটেইলেউ (Catherine Retailleau) শেক্সপিয়ারকে নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা স্তম্ভের উপর বাংলায় ও ইংরেজীতে উৎকীর্ণ করেন। স্তম্ভের গায়ে লেখা - Rabindranath Tagore - Poet, Painter, Playwright, Thinker, Teacher - The voice of India...


রবীন্দ্রনাথের আবক্ষমূর্তির পাশে প্রফেসর স্যার স্ট্যানলি ওয়েলস্‌ ও জ্যোতি বসু।

অবশেষে ২০শে সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬ শুক্রবার শেক্সপিয়ারের বাসভবন সংলগ্ন উদ্যানে রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তিটির আবরণ উন্মোচন করেন শ্রী জ্যোতি বসু এবং সেদিন তাঁর পাশে ছিলেন শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী এবং ডাঃ এল. এম. সিংভী ও প্রফেসর স্ট্যানলি ওয়েলস। এই মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন শেক্সপীয়ার জন্মভূমি অছি পরিষদের সভাপতি স্ট্যানলি ওয়েলস্‌। এই অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধান অতিথি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেন, "এখানে রবীন্দ্রনাথের আবক্ষমূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করতে পেরে আমরা গর্বিত। শেক্সপীয়ার ও রবীন্দ্রনাথ উভয়েই চিরকালের। এই আবক্ষমূর্তি স্থাপনের মধ্যে দিয়ে শেক্সপীয়ার এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যেকার অভিন্ন সূত্রটি আরও গুরুত্বলাভ করবে। বিভিন্ন দেশের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষ তাঁদের চিন্তাভাবনার দ্বারা প্রভাবিত ও সমৃদ্ধ হয়েছেন। এই ঐতিহাসিক স্থানে শিল্পকর্মটি দিতে পেরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিজেদের দারুন মর্যাদামণ্ডিত বলে মনে করছে। সে কারণে আমরা শেক্সপীয়ার জন্মস্থান অছি পরিষদের কাছে কৃতজ্ঞ। যাঁরা এই প্রকল্পটিকে সার্থক করে তুলতে সাহায্য করেছেন, তাঁদের প্রত্যেককেই আমি আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ...রবীন্দ্রনাথ সমগ্র মনুষ্যসমাজের কাছে অনুপ্রেরণার নিরন্তর উৎসস্থল। শেক্সপীয়ার এবং রবীন্দ্রনাথ চিরকালের জন্য ভাস্বর হয়ে থাকবেন। উভয়ের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।"

বিশেষ অতিথি পশ্চিমবঙ্গের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেন, সংস্কৃতি ও সাহিত্যপ্রেমী মানুষের কাছে শেক্সপীয়ারের জন্মস্থান স্ট্রাটফোর্ড আপ অন অ্যাভন যেন তীর্থভূমি। এখানে উপস্থিত হতে পেরে আমরা আনন্দিত।

রবীন্দ্রনাথের আবক্ষমূর্তির ভাস্কর দেবব্রত চক্রবর্তীর পরিচয় প্রদান করেন বুদ্ধদেব ভট্টাচর্য। শেক্সপীয়ারের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথের লেখা কবিতা 'বিশ্বকবি'-র ইংরাজী অনুবাদ আবৃত্তি করেন শেক্সপীয়ার জন্মস্থান অছি পরিষদের অধিকর্তা রজার প্রিংগল। বাংলায় কবিতাটি পাঠ করেন মানসী বড়ুয়া। গান গেয়ে শোনান সুনীল ঘটক।

ভারতীয় হাইকমিশনার এল. এম. সিংভি-ও ভাষণ দিয়েছিলেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মরিস রিবন, জেনি ব্যাসন এবং অছি পরিষদের সদস্যরা। এল. এম. সিংভি বিশেষ উপহার হিসেবে স্ট্যানলি ওয়েলস্‌, জ্যোতি বসু এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে তুলে দেন রবীন্দ্রনাথ ও শেক্সপীয়ারের স্বাক্ষরের প্রতিলিপি খচিত টাই।

এভাবেই রবিঠাকুরের জায়গা হয় শেক্সপিয়ারের বাগানে। আজ বহু মানুষ লন্ডন থেকে মাত্র এক থেকে দেড় ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছেন স্ট্রাটফোর্ডে এই তীর্থস্থানটি পরিদর্শন করতে। আমাদের প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথও মনেপ্রাণে বোধহয় তাই চেয়েছিলেন। অবশেষে বিশ্বকবির জায়গা হল আরেক বিশ্বকবি এবং সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকের স্বপ্নের বাগানে।

বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ শ্রী দেবব্রত চক্রবর্তী, গণশক্তি পত্রিকা।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল ও গণশক্তি পত্রিকার ডিজিটাল আর্কাইভ থেকে প্রাপ্ত।