বিবিধ

বজ্রের ছবি আঁকতে পারেন তিনি



প্রখ্যাত ভাস্কর ও শিল্পী গোপেশ্বর পাল স্মরণে লিখেছেন গৌরব মুখোপাধ্যায়


১৮৯৯ সালে বেলুড় মঠ স্থাপিত হওয়ার পর স্বামী বিবেকানন্দ সেখানে ভবিষ্যতে স্থাপনার জন্য রামকৃষ্ণ মন্দিরের মানসচিত্র রচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে দুইজন আমেরিকান ভক্ত মন্দির নির্মাণের প্রায় সমুদয় ব্যয়ভার বহন করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাধারা ও অভিলাষ অনুসারে স্বামী বিজ্ঞানানন্দ, যিনি পূর্বাশ্রমে ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, স্বয়ং রামকৃষ্ণ মন্দিরের একটি ডিজাইন রচনা করেন। মন্দিরের নির্মাণকার্য সম্পাদনের জন্য তৎকালীন কলকাতার বিখ্যাত স্থাপত্যনির্মাণ সংস্থা মার্টিন বার্ণ কোম্পানির (Martin & Burn Co.) সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, কোম্পানির আর্কিটেক্ট হেরাল্ড ব্রাউন (Harold Brown), স্বামী বিবেকানন্দের পরিকল্পনার কথা স্মরণে রেখে ভারতীয় স্থাপত্য ভাস্কর্যের রীতি ও রূপের সমন্বয়ে একটি নকশা রচনা করেন। সেই নকশা অনুসারেই মার্টিন বার্ণ কোম্পানি কর্তৃক বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়।

স্বামী বিবেকানন্দের মানসদৃষ্টিতে এমন এক মন্দির সমাধৃত হয়েছিল যেখানে তাঁর গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মচিন্তার উদার আহ্বানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ কালক্রমে দর্শনার্থীরূপে আসবেন এবং কোনোরকম বাধা নিষেধ ছাড়া বিগ্রহ দর্শনের সুযোগ পাবেন। মন্দিরের নির্মাণকাজের দায়িত্বে থাকা মহারাজদের কাছে গর্ভমন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণের মর্মর মূর্তি অধিষ্ঠিত করাই মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল। সর্বসম্মতিক্রমে স্থির করা হয় শ্রীরামকৃষ্ণের বিগ্রহটি শ্বেতমর্মরে (ইতালিয়ান মার্বেল) নির্মাণ করা হবে। বিগ্রহটি মন্দির অভ্যন্তর ভাগের আয়তনের সঙ্গে সুসমঞ্জস্য অনুপাতে রচিত হবে। শ্রীরামকৃষ্ণের ধ্যানস্থ মূর্তির চোখ আধ-বোজা, মুখে শান্ত, সমাহিত ভাব প্রস্ফূটিত হবে। কিন্তু ঠাকুরের মুখমন্ডলে ওই স্বর্গীয় ভাব ফুটিয়ে তুলবেন কে? আছেন কি এমন কোনো শিল্পী?

অনেক খোঁজাখুঁজি আলাপ আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত ডাক পড়ে খাস কলকাতার কাশী মিত্র ঘাট স্ট্রিটের ভাস্কর শ্রী গোপেশ্বর পালের। তাঁরই দক্ষ হাতের ছোঁয়ায় শ্বেতপাথরের এক প্রকাণ্ড চাঙড় ক্রমশ পরমহংসদেবের রূপ পরিগ্রহ করতে শুরু করে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের মূর্তিটি স্থাপিত হয়েছে এক পূর্ণ প্রস্ফূটিত মর্মর পদ্মের উপর। আর সেই পদ্মটি রয়েছে আরেক প্রখ্যাত শিল্পী শ্রী নন্দলাল বসুর নকশা অনুসারে তৈরি সুশ্রী স্বল্প অলংকরণ সম্পন্ন ডমরু আকৃতির মর্মর বেদির উপর। ভারতের নানা স্থানে ধ্যানমগ্ন যোগীর রূপপ্রকাশের রীতি থেকেই দেবদেবীর জন্য পদ্মাসন ব্যবহারের প্রথা এসেছে। অবশেষে গর্ভমন্দিরের কেন্দ্রস্থলে গোপেশ্বর পালের স্বহস্তে তৈরি মর্মর পদ্মাসনে স্থাপিত শ্রীরামকৃষ্ণের নবনিকোমল-ভাবনিদ্ধ মর্মর মূর্তিটি আলোছায়ার সমন্বয়ে দর্শকের দৃষ্টিতে অপার্থিব সৌন্দর্যে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

বেলুড় মঠের রামকৃষ্ণ মন্দিরের মূল তোরণের উপর রামকৃষ্ণ মিশন-এর যে লোগো (স্বামী বিবেকানন্দ কৃত) খোদাই করা আছে - সেটিরও রূপকার ভাস্কর গোপেশ্বর পাল। এই লোগোর ছাঁচ এখনও কুমোরটুলি স্থিত তাঁর স্টুডিওতে দেখতে পাওয়া যাবে।

নির্মাণকার্য সম্পন্ন হওয়ার পর হাওড়ার বেলুড়ে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন কর্তৃক স্থাপিত শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরের শুভ উদ্বোধন সাধিত হয় ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই জানুয়ারি তারিখে। শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারার সাথে সাথে বেলুড় মঠের রামকৃষ্ণ মন্দিরের কথা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সাথে সাথেই ভাস্কর গোপেশ্বর পালের নামও পরিচিত হয়ে ওঠে জনমানসে।

শুরুর কথা

১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণী অঞ্চলে এক মৃৎশিল্পী-পরিবারে গোপেশ্বর পালের জন্ম। পিতা বিনোদবিহারী ও মাতা কুসুমকুমারী দেবী। তাঁদের চার পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে গোপেশ্বর ছিলেন তৃতীয় সন্তান। অল্প বয়সেই তাঁর মা গত হন। মূর্তি তৈরিতে ছোট থেকেই হাতযশ ছিল গোপেশ্বরের। প্রাথমিকভাবে কাকা যদুনাথ পালের কাছে গোপেশ্বর মাটির কাজ শেখেন। তাঁর মাতুল লব্ধপ্রতিষ্ঠ মৃৎশিল্পী সতীশচন্দ্র পাল ছিলেন পুতুল শিল্পী। মামার কাছে কিশোর গোপেশ্বরের মৃৎশিল্পে অনুশীলনের সূত্রপাত। মামার সুনিপুণ কাজ দেখে আর অনুশীলনে অচিরেই মূর্তি তৈরিতে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করলেন। নিমেষে অসাধারণ সব মূর্তি তৈরি করে ফেলা শুরু করেন তিনি।


লর্ড কারমাইকেল (Lord Thomas David Gibson-Carmichael)।

সহজাত প্রতিভার স্ফুরণ

১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন বাংলার ছোটলাট লর্ড কারমাইকেল [Lord Thomas David Gibson-Carmichael - First Governor of Bengal (1912-1917)] কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণিতে এসে স্বচক্ষে দেখলেন গোপেশ্বরের কর্মদক্ষতা। যাঁর হাতের জাদু-স্পর্শে এবং অবিশ্বাস্য দক্ষতায় সাধারণ মাটির তাল নিমেষের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যায় এক অপরূপ শিল্পমন্ডিত মূর্তিতে। গোপেশ্বরের বয়স তখন ২৩ বছর। ছোটলাটকে ক্ষনিকের মধ্যে দুর্গাপুজোর কিছু মুহূর্তের অসাধারণ জীবন্ত ছবি তৈরি করে দেখালেন তিনি। লর্ড কারমাইকেল অভিভূত হয়ে তাঁকে 'The Lightening Sculptor' হিসাবে অভিহিত করলেন। ফলস্বরূপ সংশ্লিষ্ট মহলে তাঁর খ্যাতি বৃদ্ধি পেল। ধীরে ধীরে ঈশ্বরপ্রদত্ত তাঁর চাঞ্চল্যকর হাতের কাজ রাজ্য ছাড়িয়ে দেশে এমনকি বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। ওঁনার কাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি অত্যন্ত দ্রুততার সাথে নিখুঁতভাবে ও নৈপুণ্যের সাথে মূর্তি নির্মাণকাজ শেষ করতেন।

বিদেশে পাড়ি

এই ঘটনার ন' বছর বাদে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরে পরেই) ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার 'গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ'-এর অধ্যক্ষ পার্সি ব্রাউন (Percy Brown)-এর উদ্যোগে ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে তিনি জাহাজে চড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন এক শিল্প প্রদর্শনীতে (British Empire Exhibition) অংশগ্রহণ করতে। সেই শিল্প প্রদর্শনীতে অংশ নিতে ভারতবর্ষ থেকে আমন্ত্রিত হিসেবে গিয়েছিলেন উদয়শংকর ও গোপেশ্বর পাল।


উদয়শংকর

গোপেশ্বর মূর্তি তৈরি করার কাঁচামাল হিসেবে সাথে দুই ব্যারেল পরিপূর্ণ করে মাটি নিয়ে গিয়েছিলেন। যাত্রাপথে তিনি সময় অতিবাহিত করার জন্য মাটি দিয়ে কিছু ক্ষুদ্রাকৃতির পুতুল তৈরি করেছিলেন। তারই কয়েকটি তিনি জাহাজের ক্যাপ্টেন খালাসিদের উপহারস্বরূপ দিয়েছিলেন। একজন অচেনা ভারতীয়র কাছ থেকে আকস্মিকভাবে এই উপহার পেয়ে তারা এতটাই আনন্দে আপ্লুত হয়েছিল যে তারা তাঁকে তৃতীয় শ্রেণী থেকে প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করেছিল। এই সামান্য ঘটনাটি প্রমাণ করে যে গোপেশ্বর ইউরোপের তীরভূমি স্পর্শ করার আগেই তিনি তাদের মন জয় করেছিলেন।

ইংল্যান্ডের ওয়েম্বলি (Wembley)-তে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীতে তিনি কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের প্রতিনিধি হিসাবে যোগ দিয়ে মৃর্তিগড়ার কলাকৌশল প্রদর্শন করেন। আধ মিনিটের মধ্যে মাটির কুকুর এবং ৪৫ সেকেন্ডের মধ্যে অভিব্যক্তি সমেত ছুটন্ত ঘোড়া বানিয়ে বিদেশে স্বনামধন্য শিল্পীদের অবাক করে দেন তিনি। প্রদর্শনীতে একদিন রাজা পঞ্চম জর্জ (King George V) ও রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কনাট্-এর রাজা (Duke of Connaught) যিনি একাধারে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার পুত্র। তিনি তাঁর কন্যা প্যাট্রিসিয়া র‍্যামসে (Patricia Ramsay)-কে সাথে নিয়ে এসেছিলেন। সেখানেই গোপেশ্বর পাল ডিউকের মুখের নিখুঁত অবয়ব তাঁর সামনে পাঁচ মিনিটে গড়ে দেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ৭ই জুলাই লণ্ডনের 'ডেইলি টেলিগ্রাফ' (The Daily Telegraph) সপ্রশংস প্রচার করে সে ঘটনা আর গোপেশ্বরের দুরন্ত প্রতিভার কথা। সংবাদের শিরোনাম ছিল - "বজ্রালোক ভাস্কর: ওয়েম্বলিতে বাংলার একজন প্রতিভা তাঁর দক্ষতা প্রদর্শন করল” ("Lighting Sculptor: A Genius from Bengal Exhibits His Skill at Wembley”)। ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে খবরে লেখা হয় - “Remarkable talent in clay modelling is being shown in the Indian Pavilion at Wembley by Srijut Gopeswar Pal, who hails from Krishnagar in Bengal..."

ব্রিটিশ রাজপরিবার ও প্রদর্শনীর উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে গোপেশ্বর পাল-কে বিশেষ শংসাপত্র দিয়ে সম্মানিত করা হয়। সেই শংসাপত্রটি এখনও ওঁনার কলকাতার কাশী মিত্র ঘাট স্ট্রিট-এর স্টুডিওতে সযত্নে রাখা আছে। যে কেউ সেটি দর্শন করতে পারেন।

ভাস্কর গোপেশ্বর পাল অচিরেই বিদেশে পরিচিত হন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি মৃৎশিল্পী 'জি. পাল' নামে। লন্ডনে তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি হিসাবে, উদ্যোক্তাদের তরফে তাঁকে একটি স্বর্ণপদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল এবং মহাদেশ ভ্রমণে এবং তাঁর কাজ প্রদর্শন করার জন্য সমস্ত রকম সহায়তার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। পরিবর্তে, গোপেশ্বর তাঁর কাজের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ইতালিতে যাওয়া বেছে নিয়েছিলেন এবং 'চিরায়ত শিল্প ও ভাস্কর্যের মক্কা'য় ইউরোপের শিল্পকলা দেখার পর তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন।

ইউরোপে অবস্থানকালে, গোপেশ্বর লন্ডন চিড়িয়াখানা সহ লন্ডনের অনেক জাদুঘর পরিদর্শন করেন। প্রতিটি জাদুঘরে তিনি বিশুদ্ধ ইউরোপীয় শৈলীতে পাথরের খোদাই, চিত্রকর্ম এবং মানব মূর্তিগুলির ভাস্কর্যের বিবরণ অধ্যয়ন করতেন। চিড়িয়াখানায় তিনি সিংহ, বাঘ, সাপ এবং অন্যান্য প্রাণীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা প্রাণীদের মুখের অভিব্যক্তি এবং শরীরের নড়াচড়া মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করতেন। পরে কলকাতায় ফিরে তিনি তাঁর সেই পরিশ্রমকে কল্পনাশক্তির সাহায্যে বাস্তবে মাটির তালে আকার দিতে শুরু করেছিলেন।

লন্ডন থেকে, তিনি ইতালির কিছু শহর পরিদর্শন করেছিলেন, যেখানে ইউরোপীয় মডেলিং স্কুলগুলির সাথে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর বোধকে সমৃদ্ধ করেছিল। ইতালিতে, তিনি ভাস্কর্যের (মডেলিং) একটি আনুষ্ঠানিক কোর্সে ভর্তি হয়ে অধ্যয়ন করেন এবং এই বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই সংগ্রহ করেন।

কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে বহু মাস কাটিয়ে, গোপেশ্বর সম্পূর্ণ অন্য একজন পরিবর্তিত মানুষ হয়ে ভারতে ফিরে আসেন, তখন তিনি ছিলেন তাঁর কর্মক্ষেত্রের অতুলনীয় জ্ঞানের অধিকারী একজন ঋষিতুল্য ব্যক্তি।

কলকাতায় ফিরে এসে সংসারের হাল ধরতে নিজের শিল্পশালায় পেশাদারী ভাবে গড়তে লাগলেন বিভিন্ন মৃন্ময়মূর্তি ও প্রস্তরমূর্তি। শুরুতে মৃন্ময়মূর্তি তৈরি করলেও ব্যাপক চাহিদা থাকায় ক্রমে তিনি প্রস্তরমূর্তি গড়তে শুরু করলেন। এখানেই তাঁর শিল্পী জীবনে সাফল্যের সূচনা হয়। সেই সময়ে তাঁর কাজের ব্যাপক চাহিদা ছিল এবং তিনি নিজেও তাঁর পেশাকে অত্যন্ত উপভোগ করতেন।

জীবিকার সন্ধানে

পারিবারিক কলহের কারণে, গোপেশ্বর ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে তার মামার পরিবারের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন।  তিনি আসানসোলের রানীগঞ্জে স্থানান্তরিত হন এবং তাঁর আত্মীয় কান্তি চন্দ্র পালের স্টুডিওতে এবং একই সাথে বার্ন কোম্পানির মৃৎশিল্প বিভাগে কাজ করেন। ওখানে তাঁর বেতন ছিল পঁচিশ টাকা। সেখানে অল্প কয়েকদিনে প্রতিমা গড়ে সকলকে চমৎকৃত করেন। কর্মরত অবস্থায়, গোপেশ্বরের গভীর বন্ধুত্ব হয় রাধাকৃষ্ণ সোনথালিয়া (Radha Kisan Sonthalia) নামে একজন সচ্ছল ব্যবসায়ীর সাথে। যিনি তাঁকে কলকাতায় স্থানান্তরিত হতে আর্থিকভাবে সাহায্য করেছিলেন।

কলকাতায় আগমন

পরবর্তীকালে তাঁদের পুরো পরিবার জীবন জীবিকার সন্ধানে উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি অঞ্চলে পাকাপাকিভাবে চলে আসেন। কারণ তৎকালীন কলকাতার এই অঞ্চলটিই ছিল তাঁদের পারিবারিক কর্মকাণ্ড টিকিয়ে রাখার জন্য উপযুক্ত জায়গা। কলকাতায় এসে তিনি কুমোরটুলির অভয় চরণ মিত্র লেনে একটি বাড়ি ভাড়া নেন। সেই সময়ে তিনি মূলত কলকাতার বিভিন্ন বনেদি বাড়িতে ও ব্রিটিশ অধ্যুষিত বাড়িগুলিতে তৈলচিত্র পরিষ্কার ও পুনরুদ্ধারের কাজ করতেন।

কিছুদিনের মধ্যেই বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন গোপেশ্বর। সেখানেই জন্ম নেয় তাঁদের একমাত্র সন্তান সিদ্ধেশ্বর পাল (Siddheswar Pal)। সিদ্ধেশ্বর বিবাহ করেন যমুনাদেবীরকে। পরবর্তীকালে তাঁদের পরিবারের অনেকেই কর্মসূত্রে নানা জায়গায় চলে গেলেও কুমোরটুলিই গোপেশ্বরের মূল কর্মক্ষেত্রে পরিণত হয়। কলকাতায় বসবাসকারীরা কুমোরটুলি-ঘরানায় নির্মিত মূর্তির সঙ্গে ইতিমধ্যেই পরিচিত ছিলেন। গোপেশ্বর সেই জায়গায় কৃষ্ণনগরী-ঘুর্ণী ঘরানার রীতিতে নির্মিত মূর্তি তৈরি করা শুরু করেন। এই নতুন ধারায় নির্মিত বাস্তবসম্মত (Realistic) মূর্তিগুলি কলকাতার জনমানসে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ধীরে ধীরে তাঁর নাম ও কাজ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

গড়ে তুললেন নিজস্ব শিল্পশালা

চাকরি ছেড়ে এরপর গোপেশ্বর পাল একটি অস্থায়ী শিল্পালয় গড়ে মূর্তি গড়তে শুরু করলেন। সেটিই ছিল তখন তাঁর সৃষ্টিক্ষেত্র। প্রথমে তিনি কাশী মিত্র ঘাটের কাছে একটা ছোট জায়গা ভাড়া নিয়েছিলেন। এটি প্রাথমিকভাবে মৃতদের শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার জন্য খাটের স্টোরহাউস হিসাবে ব্যবহৃত হতো। তিনি তাঁর ওয়ার্কশপ শুরু করার জন্য সেটির সামনে একটি ছাউনি তৈরি করে নেন। 


জি. পাল অ্যান্ড সন্স (G. Paul & Sons.)।

পরবর্তীতে ১৯৩৩ সালে সেই পূর্বপরিচিত মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী রাধাকৃষ্ণ সোনথালিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতার কাশী মিত্র ঘাট সংলগ্ন এলাকায় (তাঁদের বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে) ৪০এ, কাশী মিত্র ঘাট স্ট্রিটে তিনি নিজস্ব শিল্পশালা 'জি. পাল অ্যান্ড সন্স' (G. Paul & Sons.) স্থাপন করেন। স্টুডিওটি তিনি অনেক ভালবাসা এবং আবেগের সঙ্গে নির্মাণ করেছিলেন। এটি ইউরোপীয় স্টুডিওগুলির আদলে তৈরি করা হয়েছিল, তখনকার দিনে কলকাতায় এটি একটি বিরল ঘটনা ছিল। তৎকালীন কলকাতায় সেটিই ছিল প্রথম বিশ্বমানের স্টুডিও। সেই রিয়েলিস্টিক ভাস্কর্যের আঁতুরঘরে আজও রাখা রয়েছে তাঁর তৈরি বেশ কিছু মূর্তি ও মূর্তির প্রতিরূপ (Replica)। তাঁর তৈরি প্রথম মূর্তি 'বিশুদ্ধানন্দ সরস্বতী' এখনও সেখানে বিরাজমান। রাখা আছে বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনের শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের মূর্তিটির প্রতিরূপ। রামকৃষ্ণ মিশন তাদের বিভিন্ন কেন্দ্রের জন্য মূর্তি এখনও তাঁর এই শিল্পশালা থেকেই তৈরি করান। ১৯৪৪ সালে গোপেশ্বর পাল প্রয়াত হলে পুুত্র সিদ্ধেশ্বর পাল স্টুডিওর দায়িত্ব নেন। নিঃসন্তান সিদ্ধেশ্বরের মৃত্যুর পর থেকে গোপেশ্বরের শ্যালক ব্যোমকেশ পাল স্টুডিওর রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। তিনি প্রয়াত হলে তাঁর দুই পুত্র সুরজিৎ পাল ও অভিজিৎ পাল বর্তমানে স্টুডিওর দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।

প্রচলন করলেন নিজস্ব শিল্পরীতির

এহেন গোপেশ্বর পাল জড়িয়ে রয়েছেন একাধিক ঐতিহাসিক ও দুঃসাহসিক কাজের সঙ্গে। গোপেশ্বর পাল ভাস্কর্যকলায় পারদর্শী হয়েও সারাজীবন পারিবারিক পেশা মৃৎশিল্পের অনুশীলন অব্যাহত রেখেছেন। শুরু থেকেই গোপেশ্বরের বৈশিষ্ট্য ছিল চলতি কাজের বাইরে সম্পূর্ণ অন্য ধারার কাজের মধ্যে দিয়ে নিজের সৃষ্টিকে প্রকাশ করার। বছরভর মূলত ভাস্কর্য ও মূর্তি নির্মাণের কাজ করলেও দুর্গাপুজোর মাসখানেক আগে থেকেই কুমোরটুলি অঞ্চলের অন্যান্য পটুয়াদের সাথে গোপেশ্বরও দুর্গাপ্রতিমা গড়ার কাজে যুক্ত হয়ে পড়তেন। ফলে পরিণত জীবনে তিনি দেব-মূর্তি গড়ায় পারদর্শী হন। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ হতে কলকাতার কুমারটুলি সর্বজনীন পুজোর দুর্গাপ্রতিমা গড়ার দায়িত্ব দীর্ঘদিন তাঁর হাতে ছিল। 

সে'যুগের বিশিষ্ট প্রতিমাশিল্পী গোপেশ্বরের প্রতিমার বৈশিষ্ট্য ছিল - বাস্তবসম্মত মূর্তি। প্রতিমার টানা চোখের অনুরূপ-প্রতিমা গড়ার প্রচলন ভেঙ্গে তিনি মানুষের স্বাভাবিক মুখাকৃতিকে বেছে নিয়েছেন। প্রতিমার ত্বকের রঙ সাধারণত হতো উজ্জ্বল হরিদ্রাভ বর্ণের। তিনিই প্রথম তা বদলে করেন মানুষের স্বাভাবিক ত্বকের রঙের। তাঁর তৈরি মূর্তি ও প্রতিমাগুলি হতো সাধারণ গড়পড়তা মানুষের উচ্চতার। গোপেশ্বর লক্ষ্য করেছিলেন যে দুর্গার বয়স এবং তাঁর কন্যাদের বয়স এক নয়। সেইজন্য তিনি দুর্গার কন্যা ও পুত্র সন্তানদের মুখমন্ডল কিছুটা অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মুখভঙ্গীর আদলে তৈরি করতেন। তিনি মূর্তি ও ভাস্কর্যের সমস্ত অলঙ্কারগুলি শুধুমাত্র মাটি দিয়েই তৈরি করতেন। অন্যদিকে যে কোনো প্রাণীর মূর্তি তৈরি করার সময় সেগুলিকে মূর্তির মতো কঠিন বৈশিষ্ট্যযুক্ত না করে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে জীবন্ত রূপ দিয়েছিলেন। লন্ডন এবং কলকাতা চিড়িয়াখানায় সিংহ, সাপ এবং বন্য বাইসন পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতায় গোপেশ্বর সমৃদ্ধ হয়েছিলেন যা তাঁর কোনো প্রাণীমূর্তি তৈরিতে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। এছাড়া সর্বজনীন দুর্গাপূজার প্রারম্ভিক একচালার (একই চালচিত্রের নিচে দুর্গা ও তাঁর পুত্রকন্যাদের মূর্তি গড়ার) প্রথাকে পরিবর্তন করে তিনিই প্রথম মূর্তিগুলিকে পৃথক পৃথক করে গড়া ও পাঁচ চালায় স্থাপন করা শুরু করেন। সাধারণত আমরা দেখি প্রতিমার পিছনের দিকে মাটি লেপা হয় না, সেখানে কাঠামোর খড়, বাঁশ ইত্যাদি দেখা যায়। কিন্তু শোনা যায় গোপেশ্বর প্রতিমার পিছনের দিকটিও যত্নসহকারে মাটি লেপে নির্মাণ করতেন। দুর্গার বাহন সিংহের মূর্তির সঠিক অনুপাত ও মাংসপেশির সঠিক গঠনের আন্দাজ পেতে, গোপেশ্বর বহুবার আলিপুর চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করেন এবং সেখানেই সিংহের কতকগুলি ক্ষুদ্র মূর্তির ভাস্কর্য তৈরি করেন। সেগুলি তাঁর বাস্তবিক আকারের ভাস্কর্যের মডেল হিসেবে কাজ করেছিল। সিংহের চামড়ার জন্য তোয়ালে এবং কেশরের জন্য নারকেল ছোবড়ার কুণ্ডলী ব্যবহার করা ছিল তাঁর অন্যতম উদ্ভাবন। নিজের সৃষ্টির সাথে কতটা একাত্ম বোধ করলে কোনো শিল্পী এমন করতে পারেন ভাবলেও আশ্চর্য হতে হয়। নিজের কাজের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাঁর নিজেকে উৎসর্গ (Dedication) করার এই সদিচ্ছাই তাঁকে যে কোনো আকৃতির মূর্তি তৈরির ক্ষেত্রে করে তোলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এখনও কুমোরটুলি স্থিত তাঁর স্টুডিওতে গিয়ে প্রমাণ সাইজের মুর্তিগুলির পাশাপাশি তার সৃষ্ট অসংখ্য ক্ষুদ্রাকৃতি (Miniature) মূর্তিগুলি দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। সেগুলির মধ্যে যেসব পূর্ণাবয়ব মূর্তি রয়েছে সেগুলির দেহের অঙ্গভঙ্গিমা দেখলে অবাক হতে হয়! কোনো বড় আকারের মূর্তি তৈরি করার আগে গোপেশ্বর পাল সেগুলির একটি মিনি মডেল করতেন। তারপর সেখান থেকে আসল মূর্তিটি তৈরি হতো। এই স্টুডিওয় আজও দেখা যায় গোপেশ্বর-সিদ্ধেশ্বর-এর তৈরি মাটির ছাঁচ। যদিও উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে সেগুলির অধিকাংশই ক্ষয়ে গেছে।

পূর্ণাবয়ব ও আবক্ষ মৃন্ময়মূর্তি, প্রস্তরের প্রতিকৃতি ইত্যাদি তৈরিতে গোপেশ্বর পালের শিল্পদক্ষতা ছিল প্রশংসনীয়। কলকাতা সহ ভারতের নানা শহরে এমনকি দেশের গন্ডী ছাড়িয়ে বিদেশেও গোপেশ্বর পালের করা মূর্তি ও ভাস্কর্য ছড়িয়ে রয়েছে।

কলকাতার কুমারটুলির ৪০এ, কাশী মিত্র ঘাট স্ট্রিটে অবস্থিত গোপেশ্বর পালের নিজস্ব শিল্পশালা 'জি. পাল অ্যান্ড সন্স'-এ এখন বহু মূর্তি ও প্রতিকৃতির মধ্যে আছে - বিশুদ্ধানন্দ সরস্বতী, মা আনন্দময়ী, শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা, স্বামী বিবেকানন্দ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ বাংলার সব মনীষীর মৃৎমূর্তি। এছাড়াও রয়েছে শিক্ষাবিদ স্যার আশুতোষ মুখার্জি, শিশির কুমার ঘোষ প্রমুখের মূর্তি।

গোপেশ্বর ছিলেন জাদুকর শিল্পী। মাটির তাল ওঁর হাতে প্রাণ পেত। তাঁর অনুরোধে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও এখানে সিটিং দিয়েছিলেন নিজের মূর্তি বানাতে। একবার নয়, তিন-তিনবার। সেই মূর্তিটিও এখানে এখন সংরক্ষিত রয়েছে।

এই মুর্তিগুলির সঠিক সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য প্রয়াত শিল্পীর পরিবারের প্রস্তাব মতো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেরিটেজ কমিশন গোপেশ্বর পালের শিল্পশালা তথা স্টুডিও হেরিটেজ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এছাড়াও তাঁর শিল্পশালায় বহু নাম না জানা মানুষের ও ব্যক্তিত্বের মূর্তি রয়েছে। 'রাজ্য হেরিটেজ কমিশন'-এর সহায়তায় ও তত্বাবধানে সেগুলির একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করার কাজ চলছে।

ভারতে প্রতিষ্ঠিত তাঁর উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে দিল্লি কালীবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত কালীমূর্তি, বর্ধমানের মহারাজার মূর্তি, হাওড়ার বেলুড়মঠে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মূর্তি, কলকাতা হাইকোর্টে প্রতিষ্ঠিত স্যার রমেশচন্দ্র মিত্রের মূর্তি, স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি (১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ডালহৌসি স্কোয়ারে স্থাপিত, বর্তমানে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দক্ষিণ উদ্যানে স্থানান্তরিত) ইত্যাদি।

বিদেশের জন্য করা তাঁর উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্মগুলি হল শিকাগোতে রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাঙ্গণে প্রদর্শিত স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তি। এখানেই স্বামীজি 'বিশ্ব ধর্ম সম্মেলন'-এ তাঁর বিখ্যাত ভাষণ দিয়েছিলেন। এছাড়াও ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জ, কার্ল মার্কস প্রমুখের মূর্তি। আমেরিকার হোয়াইট হাউস-এ জন এফ কেনেডি-র যে আবক্ষ মূর্তিটি রাখা রয়েছে সেটির ভাস্কর অবশ্য মণি পাল (গোপেশ্বর পালের ভাইপো)। মূর্তিটি তৈরি করা হয়েছিল গোপেশ্বর পালের স্টুডিওতেই ওঁনার মৃত্যুর পর।

একসময় কলকাতা তথা ভারতের নানা প্রান্তের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে গোপেশ্বর পালের স্বহস্তে নিজেদের আবক্ষ মূর্তি তৈরি করানোর হিড়িক পড়ে যায়। ভারতের অনেক ধনী ও রাজপরিবারে তাঁর ক্লায়েন্ট ছিল। সেই সময় কাজের সূত্রেই দেশের নানা প্রান্তের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সাথেও গোপেশ্বর পালের পরিচয় ঘটে।

বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া

কলকাতার সর্বপ্রথম বারোয়ারি পুজো বাগবাজারের পুজো, এ কথা অনেকেই জানেন। স্থানমাহাত্ম্যের সামাজিক গুরুত্ব হেতু বাগবাজার কিন্তু শতবর্ষ পরেও জৌলুসহীন হয়ে পড়েনি। বারোয়ারি পুজোর আয়োজন একরকম বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত বৈকি। প্রাথমিকভাবে যুবসমাজকে উদ্ধুদ্ধ করার কাজে এই পাঁচদিনের পুজো আয়োজনের ভূমিকা ছিল বিরাট। ফলে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে, শরৎচন্দ্র বসু প্রমুখ রাজনৈতিক নেতারা পুজোর প্রধান কর্ণধার রূপে অবতীর্ণ হতেন। বাগবাজার, সিমলা ব্যায়াম সমিতি, বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাব থেকে শুরু করে দক্ষিণের সমাজসেবী, বালিগঞ্জ কালচারাল, সঙ্ঘশ্রী, সঙ্ঘমিত্র, সহযাত্রী, মুক্তদল, ফরওয়ার্ড ক্লাব, যুবমৈত্রী - সর্বত্রই চিত্রটা একইরকম ছিল। আজও বাগবাজারে ধুমধাম করে বীরাষ্টমী পুজো হয়, গ্রামীণ মেলা বসে, লাঠি খেলা ইত্যাদির প্রদর্শন নিয়ম করে হয়। এই যে পুজোর ছলে যুবসমাজকে দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ করে রাখা এও একপ্রকারের থিম আর সেই থিমকে ঘিরে আচার অনুষ্ঠান এবং পুজো আবহ নির্মাণ - সেই ঐতিহ্যের ধারা এখনও বহমান।

১৯১৯ সালে এই পুজো শুরু হয়েছিল নেবুবাগানে। স্থান-নাম অনুযায়ী পুজোর নাম ছিল ‘নেবুবাগান বারোয়ারী’। ১৯২৬-এ এই ‘নেবুবাগান বারোয়ারী’ই নাম পাল্টে হল ‘বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব’। শুরুর দিকে একচালা বিশিষ্ট বাগবাজারের প্রতিমা গড়তেন নিরঞ্জন পাল তারপর দীর্ঘ কয়েক দশক পর প্রতিমা গড়েন জিতেন পাল। জিতেন পালের সময় থেকেই মা দুর্গার সাজ আলাদা করে অর্ডার দিয়ে বানানো হতো। কৃষ্ণনগরের রথীন সাহা বানাতেন মা দুর্গার সাজ ও অলঙ্কার। শুরু থেকেই বাগবাজারের প্রতিমার রীতিনীতি মেনে এপার বাংলার কৃষ্ণনগরী-ঘুর্ণী ঘরানার মৃৎশিল্পীরাই করে আসছেন । ১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে এই পুজোর সভাপতি ছিলেন নেতাজি।

সেই সময় বাগবাজার ছাড়াও আরও একটি পুজোর তিনি সভাপতি ছিলেন, পুজোটির নাম হলো 'কুমোরটুলি সর্বজনীন'। কুমোরটুলি অঞ্চলের নিজস্ব সর্বজনীন দুর্গাপূজার সূচনা হয় ১৯৩৩ সালে। পুজো সূচনার তিন বছর পর থেকে গোপেশ্বর পাল ছিলেন কুমোরটুলি সর্বজনীনের প্রতিমার নির্মাতা। ১৯৩৬ সাল থেকে উনি পরপর ন'বছর প্রতিমা গড়েছিলেন। সেই সময় তিনি প্রতিমা নির্মাণের খরচ বাবদ তিন হাজার টাকা পারিশ্রমিক নেন। সেই সময়ে এটি ছিল একটি অকল্পনীয় পারিশ্রমিক যা তৎকালীন একজন প্রতিমা নির্মাতা ভাবতেও পারতেন না। যাইহোক, এই উচ্চ পারিশ্রমিক শুধুমাত্র তার আন্তর্জাতিক মর্যাদার জন্য নয় বরং তাঁর বৈপ্লবিক সব ধারণার জন্য যা গোপেশ্বর ইংল্যান্ড এবং ইতালির ভাস্কর্যশৈলী থেকে আত্মস্থ করেছিলেন।

এপ্রসঙ্গে একটি বিতর্কিত প্রশ্ন উঠে আসে - কোন সালে গোপেশ্বর সর্বপ্রথম কুমোরটুলি সর্বজনীন-এর দুর্গাপূজার জন্য তাঁর বৈপ্লবিক কাজ করেছিলেন? বেশিরভাগ লোকের মতে এটি ছিল ১৯৩৩, কিন্তু অনিতা অগ্নিহোত্রী তাঁর 'কলকাতার প্রতিমাশিল্পীরা' বইয়ে লিখেছেন যে এটি ১৯৩৭। তিনি এমনকি লিখেছেন যে, গোপেশ্বরের অনেক আগে, পূর্ব বাংলার কিছু কারিগর 'একচালাকে পাঁচটি ভিন্ন চালায় বিভক্ত করার নৈপুণ্য নিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন।' কুমোরটুলি সর্বজনীন দুর্গোৎসবের স্যুভেনির দাবি করে যে এটি ১৯৩৯ সালের, যখন তাদের মূর্তি পুজোর আগে রাতারাতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং গোপেশ্বর পুজোকে বাঁচাতে রাতারাতি পাঁচটি ছোট মূর্তি তৈরি করতে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের মতে, গোপেশ্বরের দ্বারা মূর্তিটির একচালা বিন্যাস বিভক্ত করা একটি দুর্ঘটনাবশত শুরু হয়েছিল। গোপেশ্বর পালের শ্যালক ব্যোমকেশ পালের মতে, এটি ছিল ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৬ সালের মধ্যে। গেইর হিয়ারস্টাড (Geir Heierstad)-এর লেখা এবং 'কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস'-এর অফিসিয়াল পেজে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে এই বছরটিকে ১৯৩৫ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

উত্তর কলকাতার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী পুজো কুমোরটুলি সর্বজনীন৷ কুমোরটুলির শিল্পীরা মিলেই এই পুজো শুরু করেন৷ পুজোর প্রথম সভাপতি ছিলেন স্যার হরিশংকর পাল। সাত বছর পর কমিটির পক্ষ থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে পুজোর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয় এবং কমিটির নতুন সভাপতি হন সুভাষ চন্দ্র বসু। ১৯৩৮-এ স্যার হরিশংকর পাল কমিটি থেকে বেরিয়ে গিয়ে কুমোরটুলি সর্বজনীনের পাশেই আলাদা করে একটি দুর্গাপুজো করেন৷ পরবর্তীকালে সেই পুজো 'হাটখোলা গোঁসাইপাড়া' নামে পরিচিত হয়।

সেই সময় একচালা প্রতিমার পুজো করার চল ছিল সর্বত্র। ১৯৩৮ সালে পঞ্চমীর দিন কুমোরটুলি সর্বজনীন পূজামণ্ডপের একচালার দুর্গাপ্রতিমাটি কীভাবে যেন আগুন লেগে পুড়ে গেল। উদ্যোক্তারা মহা বিপদে পড়লেন, কারণ পরের দিনই মহাষষ্ঠী! সেই বছর কি তাহলে মায়ের পূজা হবে না? তাঁরা ছুটে গেলেন তাঁদের পূজা কমিটির সভাপতি সুভাষচন্দ্রের কাছে (ঘটনাচক্রে তিনি তখন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসেরও সভাপতি)। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস, হালের কাছে সুভাষ আছে - করবে তরী পার! সুভাষচন্দ্র তৎক্ষণাৎ ছুটলেন মৃৎশিল্পী গোপেশ্বর পালের কাছে। অনুরোধ করলেন, একরাত্রের মধ্যে সম্পূর্ণ দুর্গা প্রতিমা তৈরি করে দিতে হবে। স্বয়ং সুভাষচন্দ্রের অনুরোেধ ফেলতে পারলেন না গোপেশ্বরবাবু। কিন্তু বললেন, এত কম সময়ের মধ্যে তিনি একচালায় পাঁচটি প্রতিমা নির্মাণ করতে পারবেন না। মুহূর্তের মধ্যে সুভাষ চন্দ্র বসু ও গোপেশ্বর পাল আলোচনা করে একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিলেন, গোপেশ্বর পাল নিজে কেবল মা দুর্গার প্রতিমাটি (সিংহ ও মহিষাসুর সহ) তৈরি করে দিলেন। বাকি চারটি স-বাহন প্রতিমা (গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী ও কার্তিক) তৈরি করে দিলেন তাঁর চারজন সুদক্ষ সহকারী। এইভাবে রাতারাতি নতুনভাবে পাঁচচালার ঠাকুর তৈরি হয়ে গেল। আজ অধিকাংশ পূজামণ্ডপে পাঁচচালার ঠাকুর দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু, আমরা কি জানি যে সুভাষচন্দ্র বসু ও গোপেশ্বর পালই তার আদি পরিকল্পক?

উপরিউক্ত ঘটনাটির সত্যতা নিয়ে অনেকের মধ্যেই সংশয় রয়েছে। কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বদের নিয়ে এরকম মিথ হামেশাই ছড়িয়ে থাকে। যাই হোক, ঘটনার সত্যাসত্য বিচার না করেও একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে গোপেশ্বর পালই সর্বপ্রথম দুর্গা প্রতিমা ও তার সন্তানদেরকে পাঁচচালায় বিভক্ত করেন। একাজ করতে গিয়ে সেই সময়ে তাঁকে গোঁড়া পুরোহিতদের প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। কিন্তু তিনি ঠান্ডা মাথায় যুক্তি সহকারে শোভাবাজার রাজবাড়ির টোলে বসে পুরোহিতদের বোঝাতে সক্ষম হন কেন তিনি একাজ করলেন। তাঁর দেখানো পথেই পরবর্তীকালে প্রতিমাশিল্পীরা দুর্গা প্রতিমার এক নতুন অবয়ব সৃষ্টি করেছেন।

সেবার একেই তো ছিল পাঁচচালা আর তার উপর ছিল দেবীর জমকালো সাজসজ্জা, এইসব দেখে পুরোহিত-সমাজ বেঁকে বসেছিল৷ তারপর গোপেশ্বর পালের সঙ্গে বহু আলোচনার পর খোঁজ মেলে পুজোর পুরোহিতের৷ এভাবেই এই বাংলায় সর্বপ্রথম একচালা ভেঙে পাঁচচালার প্রতিমার চল শুরু করেন গোপেশ্বর পাল।

তবে এতেই শেষ নয়, পরের বছর ১৯৩৯ সালে সুভাষ চন্দ্র বসু পুজো কমিটির সভাপতি থাকাকালীন কুমোরটুলি সর্বজনীনের দেবী দুর্গার গায়ে উঠেছিল সত্যিকারের বাঘের ছাল৷ তা দেখার জন্য সেবার ভীড় উপচে পড়েছিল মণ্ডপে। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে প্রথম থিমের প্রতিমা গোপেশ্বর পালের হাতেই গড়ে ওঠে।

জীবনাবসান

প্রবাদপ্রতিম মৃৎশিল্পী গোপেশ্বর পাল ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ই জানুয়ারি (বাংলা ২৩শে পৌষ) প্রয়াত হন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫২ বছর।

'হেরিটেজ' তকমা লাভ করল তাঁর স্টুডিও

২০০৯ সালে 'রাজ্য হেরিটেজ কমিশন' গোপেশ্বর পালের স্টুডিওকে 'হেরিটেজ সাইট' তকমা দিয়ে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।  কিন্তু শুরুতে সেখানে কাজ করার কোনো অনুমতি ছিল না। গোপেশ্বর পালের পরিবারের তরফ থেকে সেখানে কাজ করার জন্য অনুমতির আবেদন করা হয় ২০১২ সালে। অনেক চেষ্টা করার পর নানা বাধা অতিক্রম করে অবশেষে ২০২২ সালে সেই অনুমতিপত্র মেলে। এখন সেখানে সংগ্রহশালা তৈরি করছে রাজ্য সরকার। স্টুডিওর মূর্তিগুলির পুনরুদ্ধার কাজ (Restoration)-এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনকে। মিশনের তরফে স্বামী সুপর্নানন্দ মহারাজের তত্বাবধানে সেই কাজ চলছে। প্রসঙ্গক্রমে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান শিল্পী শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, “গোপেশ্বর পাল অসাধারণ মৃৎশিল্পী ছিলেন। তিনি কাউকে একবার দেখে মিনিটের মধ্যে অবিকল তাঁর মূর্তি তৈরি করতে পারতেন, হাতে যেন জাদু ছিল। ওঁর স্টুডিওকে হেরিটেজ তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে তাঁর স্টুডিওকে সংগ্রহশালা করা হবে"।

তারও আগে কলকাতা পৌরসংস্থা (KMC)-র পক্ষ থেকে কুমোরটুলি স্ট্রিটের কিয়দংশের নামকরণ করা হয় 'ভাস্কর জি. পাল স্ট্রিট' (৯ নং ওয়ার্ড)।

গোপেশ্বর পালের একমাত্র সন্তান সিদ্ধেশ্বর পাল ছিলেন নিঃসন্তান। বর্তমানে গোপেশ্বর পালের দৌহিত্র আশিস পাল এবং শ্যালক ব্যোমকেশ পাল আপাতত সেই স্টুডিয়োর দায়িত্বে রয়েছেন। রয়েছেন ব্যোমকেশবাবুর জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রী সুরজিৎ পাল (Surajit Pal) ও কনিষ্ঠপুত্র শ্রী অভিজিৎ পাল (Abhijit Pal)। স্টুডিওর তত্বাবধান করেন রয়েছেন সমীর পাল (Samir Pal), সমীরণ চক্রবর্তী (Samiran Chakraborty) সহ অন্যান্যরা। এঁদের অনেকে এখানেই কাজ শিখেছেন। স্টুডিওর সন্মুখে একটি অংশে এখনও রাখা আছে গোপেশ্বর পালের ব্যবহৃত ভিনটেজ গাড়িটি। যেটি একটি অবশ্য দ্রষ্টব্য। এছাড়াও রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত পাদুকা, স্টাফ করা বাঘের মাথা, একটি স্ফটিকের টুকরো, অজস্র শংসাপত্র, পুরস্কার, দেশ-বিদেশের নানা ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্যে থাকাকালীন তাঁর আলোকচিত্র, বিভিন্ন সময়ে তাঁর করা দুর্গা প্রতিমার ছবি ইত্যাদি। স্টুডিওর সামনে নানা রকমের ফুলগাছ সমেত একটি ছোট বাগানও রয়েছে।


বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ সুরজিৎ পাল, অভিজিৎ পাল

সৌজন্যঃ আনন্দবাজার পত্রিকা আর্কাইভ, সংবাদ প্রতিদিন, দি স্টেটসম্যান, দি টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া, গেট বেঙ্গল, বঙ্গদর্শন।

চিত্রঋণঃ ব্যবহৃত অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত। কিছু আলোকচিত্র লেখকের কাছ থেকে প্রাপ্ত।