পরিবেশ ও বিজ্ঞান

নগরায়নের নামে সবুজের সর্বনাশের ফল মিলছে



বিশেষ প্রতিবেদন


আকাশ কালো। কিন্তু সেই কালো মেঘকে আকর্ষণ করে একটানা বৃষ্টির মতো গাছের সারি এরাজ্যে নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ন সবুজের সর্বনাশ করে দিয়েছে। যত্রতত্র জলাশয় বুজিয়ে তৈরি হচ্ছে ফ্ল্যাটের পর ফ্ল্যাট আর কমপ্লেক্স। লাগাতার সবুজ ধ্বংসের জন্য কলকাতা সংলগ্ন শহরতলি থেকে বৃষ্টি মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের। তা না হলে এমনটা হয়! আষাঢ় মাস পড়ে গেছে। দক্ষিণবঙ্গে চার দিন আগে ঢুকে পড়েছে মৌসুমী বায়ু। তবুও বৃষ্টির দেখা নেই। দিনের বেলা কার্যত বাইরে বেরোনো কঠিন। সামান্য হাঁটলেই গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। আকাশ থেকে ঠিকরে পড়ছে সূর্যের লেলিহান কিরণ।

কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দপ্তরের প্রকাশিত জুন মাসের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে নদীয়া, হুগলি, উত্তর ২৪ পরগনায় ইতিমধ্যে ৭৭ শতাংশের ওপর বৃষ্টির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। হাওড়ায় সেই ঘাটতির হার ১০০ শতাংশ, কলকাতায় সেই ঘাটতির হার ৯৯ শতাংশ। পূর্ব বর্ধমানে ঘাটতি পৌঁছে গেছে ৯৩ শতাংশে। স্বাভাবিকভাবে জুন- জুলাই মাসে যেভাবে বৃষ্টি আগে হতো, সেটা এখন আর দেখা মাচ্ছে না। এবিষয়ে কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দপ্তরও বেশ চিন্তিত। বিশ্ব উষ্ণায়নকে সবাই বৃষ্টি হ্রাস ও জলবায়ুর পরিবর্তনের মূল কারণ বলে চিহ্নিত করে। জলবায়ু পরিবর্তনের একটা বড় কারণ অবৈজ্ঞানিক নগরায়ন, জলাশয় বোজানো, গাছ কাটা।

দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন জঙ্গলকে 'বিশ্বের ফুসফুস' বলা হয়। এটাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘন বনভূমি। এই বনভূমিতে লাগাতার আগুন লাগার জেরে দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কিছু দেশে জলবায়ুর পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। সাধারণত বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদের পাতায় যে ছিদ্র (স্টোমাটা) থাকে তা দিয়ে কার্যত উদ্ভিদ শ্বাস নেয়। ওই ছিদ্র দিয়েই অতিরিক্ত জল বাষ্প আকারে ছাড়তে থাকে গাছ। ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট আমেরিকার স্মিথসোনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের প্রকাশিত গবেষণায় বৃষ্টিতে গাছের ভূমিকার কথা বিস্তারিত বলা রয়েছে। গাছ-মেঘের মধ্যে সম্পর্ক নিয়েই মার্কিন বিজ্ঞানীদের ওই গবেষণা।

বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদের পাতার তৈরি হাতা (ক্যানোপি) যত ঘন হবে বাষ্প তৈরির হার তত বাড়বে। আর তার জেরে স্থানীয় মেঘের দেখা মিলবে। আকাশে ঘুরে বেড়ানো মেঘকে মাটিতে বৃষ্টি আকারে নামিয়ে আনতে এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যথেষ্ট কার্যকরী। কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণকারী গাছের বৃষ্টি ঘটানোর যে ভূমিকা তা নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয় না। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে গাছের নিধনের জেরে পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে সকলের এখন টনক নড়েছে। নগরায়নের নাম করে যত্রতত্র গাছ কাটা, জলাভূমি ভরাটে কঠিন বর্জ্য ফেলাতে কোনও ধরাবাঁধা নিয়ম না থাকায় বিষম পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে গঙ্গার পাশের জেলায় জেলায়।

হুগলি, হাওড়ায় প্রকাশ্যে তৈরি করা হয়েছে জঞ্জাল ফেলার ডাম্পিং গ্রাউন্ড। সেখানে রাতবিরেতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বর্জ্য কমাতে নাকি এই আগুন। আদপে তা পরিবেশকে ধারাবাহিক দূষিত করে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গে সবুজের যে কি পরিস্থিতি তা জানতে 'ইন্ডিয়ান স্টেট ফরেস্ট রিপোর্ট ২০২১'-এর রিপোর্টটিই যথেষ্ট। ওই রিপোর্ট বলছে, এরাজ্যে ৭০ বর্গ কিলোমিটারের কিছু বেশি পরিমাণ জমির সবুজ চিরতরে হারিয়ে গেছে। ২০১১ থেকে ২০২১ এই ১০ বছরে সবচেয়ে বেশি বৃক্ষ জাতীয় গাছ কমেছে।

কলকাতা ও শহরতলিতে সেই গাছ কমার পরিমাণ ৩০ শতাংশ। নগর উন্নয়নের নথি বলছে, কলকাতা ও শহরতলিতে নির্মাণ শিল্প বা রিয়েল এস্টেট বৃদ্ধির হার ৩১ শতাংশের কাছাকাছি। বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানকর্মী তপন সাহা জানাচ্ছেন, "আমরা ষষ্ঠ মহাবিনাশের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা যারা পরিবেশ নিয়ে কাজ করি, তারা জানি, গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো আবহাওয়া পরিবর্তন। এই যে ঋতুর বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গেছে, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এখন সারা পৃথিবীজুড়েই 'হিট ওয়েভ' বাড়ছে। সাধারণত স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে ৪ বা ৫ ডিগ্রি বেশি তাপমাত্রাকে বলে 'হিট ওয়েভ'। আমরা যারা এই দ্রুত পরিবর্তনে অভ্যস্ত নই তাদের শরীর খারাপ হচ্ছে এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।"

'ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন'-এর রিপোর্ট বলছে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে ৩৬৫ দিনের মধ্যে কলকাতাতেই ১৮৮ দিন তাপপ্রবাহ চলবে। কলকাতা ও শহরতলি অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হবে। যার নমুনা আমরা এপ্রিল-জুন মাসে টের পেয়েছি। তাপপ্রবাহ যত বাড়তে থাকবে ততই অনিয়মিত হয়ে পড়বে সময়কালীন বৃষ্টি। রিসার্চ গেট থেকে পাওয়া ইইআরসি'র অনুদানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের গবেষক টি. কে. দাস, বি. মৈত্র, এ. রায়চৌধুরি, টি. যশ তাঁদের জলাশয় ও জলাভূমি সংক্রান্ত গবেষণাপত্রে লিখেছেন ৭০-৮০ শতাংশ মিষ্টি জলের জলাভূমি গত ৫০ বছরে গাঙ্গেয় উপত্যকা থেকে হারিয়ে গেছে ।

পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম কর্মী আইনজীবী বিশ্বজিৎ মুখার্জি বলেন, "২০১১ থেকে ২০২৪ এই কয়েক বছরে চুঁচুড়া চন্দননগরের মধ্যে শতাধিক পুকুর বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১০ বছরে উত্তরপাড়া থেকে বাঁশবেড়িয়া পর্যন্ত জলাভূমি বোজানো হয়েছে আনুমানিক ৭০০ থেকে ৮০০।" গাছপালা কাটা ও জলাভূমি ভরাট রোধে প্রচুর আইন আছে। গাছ কাটা রুখতে 'টি প্রোটেকশন অ্যাক্ট' হয়েছে ২০০৬ সালে। সরকারি বনবিভাগকে না জানিয়ে গাছ কাটা যায় না, তার জন্য অনুমতি লাগে।

কিন্তু আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সব হচ্ছে। বাগানের চরিত্র বদলের বিরুদ্ধে 'ল্যান্ড রিফর্ম অ্যাক্ট' আছে। জলাভূমি ভরাট রোধে একাধিক আইন আছে যেমন 'জল দূষণ প্রতিরোধ আইন ১৯৭৪', 'ফিশারিজ অ্যাক্ট' কিন্তু এর কোনোটিই মানছে না বর্তমান শাসকদল বা তাদের পরিচালিত পৌরসভা, পৌরনিগম বা পঞ্চায়েত। অবৈজ্ঞানিক নগরায়নের কুফল হিসেবে তাপ বাড়ছে। একদিকে বিশ্বের তাপ বাড়ছে, অন্যদিকে মুনাফার জন্যে সরকার এই ধ্বংসের কারবারে নেমেছে। আর তার কুফল সহ্য করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।