প্লাস্টিক বর্জ্যে জর্জরিত বিশ্বে নতুন সমস্যা হিসেবে উঁকি দিচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক ও ন্যানোপ্লাস্টিক নামের দুই 'ঘুমন্ত দৈত্য'। সাধারণভাবে, ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা বলতে এদেরকে বোঝায়। বিগত শতাব্দীর ছয়ের দশকে সমুদ্রের জলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। বাতাস, মাটি, মেরু অঞ্চলের মতো এখন জলের বোতল, কলের জলে, মানুষের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক বাসা বেঁধেছে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের উৎস - প্লাস্টিকের জিনিস তৈরির আগে প্লাস্টিক দানা ও পাউডার, গাড়ি চলার সময় টায়ারের ঘর্ষণের কণা, যানবাহন নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে রাস্তায় ব্যবহৃত পেইন্ট, প্রসাধনী শিল্পে ব্যবহৃত দানা, সামুদ্রিক যানে রঞ্জক দ্রব্য প্রভৃতি। নানাভাবে ধীরে ধীরে পরিবেশে এরা যুক্ত হয়, পরে জল নিকাশির মধ্য দিয়ে নদী-নালা মারফত সাগরে জমা হতে থাকে। মানুষ সহ জীবদেহে এই সব ক্ষুদ্র কণার প্রভাব নিয়ে গবেষণা চলছে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে জীবদেহে এই সব কণা মারণ প্রভাব ফেলতে পারে। মাইক্রোপ্লাস্টিক বর্তমান দিনের ভয়ংকর বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। সমুদ্রে থাকা জ্যুপ্ল্যাঙ্কটনের বংশবৃদ্ধির গতি বন্ধ করে দেয় মাইক্রোপ্লাস্টিক। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে বিপদ নেমে আসবে সামুদ্রিক খাদ্যশৃঙ্খলে। মাছ জাতীয় প্রাণী খাবার পাবে না। মাছদের খাদ্যসঙ্কটে প্রভাব পড়বে আমাদের খাবারের থালায়। সামুদ্রিক প্রাণী খাবারের সাথে মাইক্রোপ্লাস্টিক খেয়ে ফেলছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। এতে তাদের প্রজনন ক্ষমতা ও স্নায়বিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
প্রধানত খাবার ও জলের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবদেহে প্রবেশ করে বলে বিজ্ঞানীদের দাবি। অস্ট্রেলিয়ার 'নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি' থেকে একটি গবেষণায় জানা গেছে মানবদেহে সপ্তাহে ৫ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক জমা হতে পারে (যদিও এই তথ্য এখনও পরীক্ষার আওতায় আছে)।
মায়ের শরীর থেকে গর্ভস্থ সন্তানের শরীরে কি মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করতে পারে? সম্প্রতি আমেরিকায় 'রটগারস বিশ্ববিদালয়'-এর একটি গবেষণার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে 'সায়েন্স অফ দ্য টোটাল এনভারমেন্ট' জার্নালে। সেখানে বলা হয়েছে সন্তানসম্ভবা ইঁদুরের শরীরে পলি-অ্যামাইড-২১ (পিএ-২১) প্রবেশ করানো হলে সন্তান জন্মানোর পর দেখা যায় মাইক্রোপ্লাস্টিক সন্তানের ফুসফুস, হৃদপিণ্ড, যকৃত, কিডনি, এমনকি মস্তিষ্কে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। যার অর্থ প্লাসেন্টা ভেদ করে মাইক্রোপ্লাস্টিক চলাচল করতে পারে। শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি ও প্লাসেন্টার মধ্য দিয়ে যাতায়াতে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন বিজ্ঞানী মহল। মাইক্রোপ্লাস্টিক থেকে বিসফেনল ও থ্যালেট নিঃসৃত হয়। বিসফেনল দেহের হরমোন ব্যবস্থাকে ঠিকমতো কাজ করতে দেয় না এবং মহিলাদের জনন ক্ষমতার সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। থ্যালেট শুক্রাণু নিঃসরণ হ্রাস করে। প্লাস্টিক নিঃসৃত রাসায়নিক স্নায়ুজনিত সমস্যা, শ্রবণ হ্রাস, ক্যানসার সৃষ্টির জন্য দায়ী হতে পারে। বিজ্ঞানীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অতিমাত্রায় উপস্থিতিতে উপরোক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। ফলে বর্তমানে তো বটেই ভবিষ্যতে বিপদে পড়বে সমগ্র মানবজাতি।
২০১৭ সালে আটলান্টিক মহাসাগরের জল থেকে ন্যানোপ্লাস্টিকের নমুনা পাওয়ার পর এই ধরনের ক্ষুদ্র কণা নিয়ে গবেষণা চলছে। এই মুহূর্তে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ও ন্যানোপ্লাস্টিকের মাত্রা পরিবেশে কম তবে ভবিষ্যতে এই দুই 'ঘুমন্ত দৈত্য' বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। কারণ সারা বিশ্বে সচেতনতার অভাবে ও প্রশাসনের উদাসীনতায় যে হারে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে যুক্ত হচ্ছে তাতে এর হার বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছবে। তখন? প্লাস্টিকের মতো মাইক্রোপ্লাস্টিক ও ন্যানোপ্লাস্টিকের দূষণের কবল থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে। পলিইথিলিন, পলিস্টাইরিন, পলিইউরিথিন পলিয়েস্টার বিয়োজনে সক্ষম এমন কোনও বাস্তু তথা জীবাণুর কথা ভাবতে হবে। তাছাড়া সবার আগে দরকার প্লাস্টিককে বাগে আনতে আমাদের আরও সচেতনতা।
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।