ভ্রমণ

এক অন্য সুন্দরবনের গল্প



গৌরব মুখোপাধ্যায়


আমাদের দেশের মানুষ এমনকি বিদেশীদের মধ্যেও সুন্দরবন নিয়ে কিছু মিথ রয়েছে। বিশেষ করে বাঙালি পর্যটকদের মধ্যে। তাদের কাছে সুন্দরবন মানেই বাঘ, কুমির, সাপ, ম্যানগ্রোভ, খাঁড়ি এইসব। ইদানিং যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা পর্যটন সংস্থাগুলোর দৌলতে সুন্দরবন বেড়াতে যাওয়া মানুষদের মধ্যে বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে একটা মুগ্ধতা কাজ করে। দুই কি তিনদিনের সুন্দরবন সফরে তাদের ব্যাঘ্রদর্শন চাই-ই চাই। তার জন্য তারা মাত্রাতিরিক্ত অর্থব্যয় করতেও পিছপা হন না। অধিকাংশ পর্যটন সংস্থা এই সুযোগে তাদের ব্যবসার খাতিরে পর্যটকদের বাঘ দেখানোর মিথ্যা আশ্বাস দেন। যা পরোক্ষে সুন্দরবনের প্রকৃত পর্যটনের ক্ষতিসাধন করছে। প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে উদাসীন মানুষদের বিশেষ করে পর্যটকদের পরিবেশের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগানোর পরিবর্তে 'ক্ষনিকের আনন্দলাভ' সুন্দরবনের পরিবেশ ও পর্যটনের ব্যাপকতাকে ধীরে ধীরে সমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। 'আইইউসিএন রেড লিস্ট অফ ইকোসিস্টেম ফ্রেমওয়ার্ক'-এর অধীনে ২০২০ সালের মূল্যায়নে ভারতীয় সুন্দরবনকে বিপন্ন বলে মনে করা হয়েছিল। এ নিয়ে পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী ও বিভিন্ন এনজিও সংস্থা ও সংগঠন জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে দীর্ঘদিন ধরেই লাগাতার প্রচার আন্দোলন সংগঠিত করছেন। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই আমার মধ্যেও সুন্দরবন নিয়ে একটা ভাসা ভাসা ধারণা ছিল। আমার মনে সেই ধারণা গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল সুন্দরবন নিয়ে লেখা নানা লেখকের লেখা বিভিন্ন বই। সেগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য শিবশঙ্কর মিত্র-র লেখা 'সুন্দরবন সমগ্র'। সুন্দরবনকে তার প্রকৃতি ও পরিবেশকে সেখানকার পশুপাখিকে সেখানে বসবাস করা মানুষকে যাঁরা গভীরভাবে জানতে চান তাদের জন্য এটিই হচ্ছে একমাত্র প্রামাণ্য গ্রন্থ।

১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সুন্দরবন 'ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান' হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এর বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশ বস্তুত একই নিরবচ্ছিন্ন ভূমিখণ্ডের সন্নিহিত অংশ হলেও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় ভিন্ন ভিন্ন নামে সূচিবদ্ধ হয়েছে; যথাক্রমে 'সুন্দরবন' ও 'সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান' নামে। এহেন সুন্দরবন অঞ্চলেই আমার একদিন হঠাৎ গিয়ে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। সৌজন্যে ডাঃ অরুণোদয় মণ্ডল। ডাঃ মণ্ডলের পৈতৃক বাড়ি সুন্দরবনের হিঙ্গলগঞ্জ-এর সাহেবখালি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত চাঁড়ালখালি গ্রামে। সেখানেই তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বর্তমানে তিনি চাঁড়ালখালি থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে রায়পাড়ার সাহেবখালিতে 'সুজন' নামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় চালান। যেটি এখন 'সুজন চ্যারিটেবল ট্রাস্ট'-এর অন্তর্গত। ডাক্তারবাবু প্রতি শনিবার ভোরে তাঁর সহকারীদের নিয়ে নিয়ম করে হিঙ্গলগঞ্জে অবস্থিত সাহেবখালি গ্রামে যান ও শনিবার ও রবিবার রোগী পরিষেবা প্রদান করে রবিবার বিকেলে ওখান থেকে রওনা হয়ে রাতের মধ্যেই কলকাতায় নিজ বাসভবনে ফিরে আসেন। খুব জটিল পরিস্থিতি ব্যতীত এই নিয়মের আজ পর্যন্ত কোনো অন্যথা হয়নি।

দীর্ঘ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ডাঃ অরুণোদয় মণ্ডল উত্তর চব্বিশ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ-এ রায়পাড়ার সাহেবখালি অঞ্চলে 'সুজন' নামে একটি দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র চালাচ্ছেন। বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে 'সুজন' আজ একটি সেবা প্রতিষ্ঠান (Charitable Trust)-এ পরিণত হয়েছে। মানুষের পাশে থাকার, অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাদের সেবাপ্রদান করার তাঁর নিরলস মানবিক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২০ সালে ভারত সরকার তাঁকে 'পদ্মশ্রী' সম্মানে ভূষিত করেন। বকলমে এই জয় সাধারণ মানুষেরই জয়।

শারীরিকভাবে অসুস্থ, আর্ত ও অসহায় মানুষদের হয়ে কাজ করতে গিয়ে নানা সামাজিক প্রতিকূলতাকে নিজের অদম্য জেদ, সততা ও আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে একজন চিকিৎসকের জয়ী হওয়ার কাহিনীই নিজের কলমে আমাদের 'ডটপেন ডট ইন' ই-পত্রিকায় ধারাবাহিক আকারে লিখছেন ডাঃ অরুণোদয় মণ্ডল। এই লেখায় মূলত 'সুজন' গড়ে ওঠার প্রাক-কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে আজকের কিছু কথাও এসেছে।

এই লেখার সূত্রে ও একই পাড়ায় থাকার সুবাদে আমি মাঝেমধ্যেই ডাক্তারবাবুর বাড়ি যেতাম। উনি নানান কথার মাঝে আমাকে 'সুজন'-এ যাবার জন্য বলতেন। কিন্তু নানা কাজে আটকা পড়ে ব্যস্ত থাকার ফলে আমার আর ওখানে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। খারাপ লাগলেও আমি নিরুপায় ছিলাম। অথচ সুন্দরবন দেখার একটা তীব্র আকাঙ্খা আমার মনের কোণে লুকিয়ে ছিল।

মে মাসে কলকাতায় তখন কয়েকদিন ধরেই তীব্র দাবদাহ চলছে। এমনই এক সময় আমার কাজের ব্যস্ততা একটু কমতে ভাবলাম কোথাও পালিয়ে যাই। এদিক ওদিকে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও এখন চট্ করে ট্রেনের টিকিট বুকিং করা বা মনমতো একটা থাকার জায়গা পাওয়া খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার। এমন সময় আমার সুন্দরবন দেখার সেই ইচ্ছেটা আবার চাগাড় দিয়ে ওঠে। এদিকে কলকাতায় তখন ক'দিন ধরেই টিভির বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলে ঘূর্ণিঝড় 'রেমাল' নিয়ে সতর্কবার্তা ঘোষিত হচ্ছে। পরিস্থিতি অনুকূল না থাকায় একপ্রকার 'যাওয়া হবে না' ধরে নিয়েই ডাক্তারবাবুর বাড়ি গিয়ে ওঁনার কাছে 'সুজন' দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করি। উনি সাগ্রহে রাজি হয়ে যান। আমি ঘূর্ণিঝড় ও প্রতিকূল পরিস্থিতির কথা তুলতেই আমাকে উৎসাহ দিয়ে বলেন, "যেতে যখন হবেই তখন ওসব ঝড়টরের কথা ভেবে লাভ নেই। চলো দেখা যাক কি হয়..."। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। ঠিক হয় যথারীতি আসছে শনিবার (অর্থাৎ ২৫শে মে, ২০২৪) ভোর চারটেয় কলকাতা থেকে আমরা রওনা হবো।

এপ্রসঙ্গে একটা ছোট তথ্য দিয়ে রাখি। উত্তর চব্বিশ পরগণার হিঙ্গলগঞ্জ-এর সাহেবখালি (পিনকোড-৭৪৩৪৩৯) গ্রাম পঞ্চায়েতটি পাঁচটি গ্রাম নিয়ে গঠিত - চাঁড়ালখালি, পুকুরিয়াচক, সাহেবখালি, দেউলি, রামপুর। সাহেবখালির নিকটবর্তী গ্রামগুলি হল - লেবুখালি, পুঁটিয়ামাথাবাড়ি, দুলদুলি, পুকুরিয়াচক, দেউলি, চাঁড়ালখালি, কানাইকাঠি, কাঁঠালবেড়িয়া, রামপুর, মাধবকাঠি, পাটঘড়া ইত্যাদি। সাহেবখালি গ্রামের মোট জনসংখ্যা আনুমানিক ৫,৭৯২ জন। এর থেকেই আপনারা আন্দাজ করতে পারবেন অঞ্চলটি খুব একটা বড় নয়। সাহেবখালির নিকটবর্তী শহর টাকি (২৫ কিমি)।

শুক্রবার রাতে শুতে যাবার সময় মোবাইলে সকাল তিনটেয় অ্যালার্ম দিয়ে রাখলাম। কাকভোরে উঠে তৈরি হয়ে নিয়ে একটু চা খেয়ে বাড়িতে বসে রইলাম। কথা ছিল ডাক্তারবাবু আমাকে বাড়ি থেকেই ওঁনার গাড়িতে তুলে নেবেন। ঠিক চারটেয় ডাক্তারবাবুর গাড়ি এসে থামল। মা'র কাছে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। পরিবারের বাকিরা তখন গভীর ঘুমে আছন্ন। গাড়ি চলল দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের উদ্দেশ্যে। পথে দমদম পার্ক থেকে উঠলেন শ্রী অশোক সাহা। যিনি ছিলেন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (Bank of India)-র প্রাক্তন আধিকারিক এখন অবসরপ্রাপ্ত। এরপর কেষ্টপুর থেকে উঠলেন শ্রী অশোক ভট্টাচার্য। যিনি একসময় বহুজাতিক কর্পোরেট ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলিতে বরিষ্ঠ ফার্মাসিস্ট হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিও এখন কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নিয়েছেন। আমরা চারজনে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। সেখানে পাঁচটা ৪৫ মিনিটে শিয়ালদহ-হাসনাবাদ লোকাল এসে পৌঁছনোর কথা। আমাদের গন্তব্য হাসনাবাদ। ট্রেন ভ্যাবলা, বসিরহাট হয়ে হাসনাবাদ পৌঁছবে সকাল ন'টায়। পথে বিরাটি স্টেশন থেকে উঠলেন ডাক্তারবাবুর দীর্ঘদিনের সহকর্মী শ্রী শম্ভু চক্রবর্তী। পথে চা সহযোগে নানান কথাবার্তা চলল।

ট্রেন মোটামুটি সঠিক সময়েই হাসনাবাদ এসে পৌঁছলো। স্টেশনে নেমে আগে থেকে ঠিক করে রাখা রউফ মিঞার টোটোর জন্য অপেক্ষা। একসময় 'ভবঘুরে' লেখা টোটো এসে পড়ল। আমরাও মালপত্র সমেত টোটোয় উঠে পড়লুম। পথে একে একে পড়ল ডাঁসা নদী, কাটা খাল। প্রায় মিনিট ৪৫ পর আমরা এসে পৌঁছলাম হিঙ্গলগঞ্জের ব্যাকরা বাজারে। সেখানে কিঞ্চিৎ জলযোগ হল। ডাক্তারবাবু শম্ভুদাকে নিয়ে গেলেন সবজি ও মাছ বাজারের উদ্দেশ্যে। আসলে আমরা যেখানে যাবো সেটি সুন্দরবনের প্রত্যন্ত একটি অঞ্চল। সেখানে ত্রিসীমানায় কোনো বাজার নেই। সুতরাং যা কিছু দরকারি সামগ্রী সব এখান থেকেই কিনে নিয়ে যেতে হবে। ফার্মাসিস্ট অশোকবাবু আমার অবস্থাটা বিবেচনা করে বললেন, "আপনার (যদিও সেটা আমার অনুরোধে পরে 'তুমি'তে পর্যবসিত হয়েছিল) দরকারি যদি কিছু নেবার থাকে মিনারেল ওয়াটার বা অন্যকিছু এখান থেকে নিয়ে নিন। ওখানে কিন্তু কিছুই পাবেন না"। আমার কিডব্যাগে মোটামুটি সবই ছিল। তাই নতুন করে আর কিছু নেবার ছিল না। তাই টোটোতেই বসে রইলাম। কিছুসময় পর সবাই আবার একত্র হলে রউফ মিঞা টোটো ছেড়ে দিলেন। প্রায় আধঘন্টা পর আমরা পৌঁছলাম লেবুখালি ফেরিঘাটে। এবার নদী পেরোতে হবে।


লেবুখালি ফেরিঘাট।

আগে এই জলপথে যন্ত্রচালিত নৌকা (ফেরি) চলাচল করত না। দাঁড় বওয়া নৌকোয় ডাঁসা, কালিন্দী আর রায়মঙ্গল নদীর সঙ্গম পেরিয়ে অন্যপাড়ে দুলদুলি ফেরিঘাটে পৌঁছতে হতো। তাই আগে বলা হতো খেয়াঘাট। সেখানেই জানলাম আমরা ইতিমধ্যেই যে ডাঁসা নদী, কাটা খালের ওপর দিয়ে কংক্রিটের সেতু পেরিয়ে এসেছি, আগে নাকি 'সুজন'-এ যাবার সময় ডাক্তারবাবুরা সেই নদী দুটিও খেয়া পারাপার হতেন! একসময় ফেরি এসে ঘাটে লাগলো। ফেরি খালি হতেই আমরা মালপত্র সমেত উঠে পড়লাম। দেখলাম অনেকে সাইকেল নিয়েও উঠেছেন। নদী পারাপার করতে মিনিট পনেরো সময় লাগল। নদীপথে যেতে যেতে দেখলাম নদীর দু'ধারে জলের উপর নুইয়ে পড়া গাছ। সুন্দরবন ধীরে ধীরে তার ঘোমটা সরাচ্ছে।


দুলদুলি ফেরিঘাট।

দুলদুলি ফেরিঘাটে পৌঁছে দেখলাম অল্পকিছু দোকান সমেত একটা ছোট বাজার বসেছে। বাজারে কিছু মুদিখানা আর একটামাত্র মিষ্টির দোকান রয়েছে। ঘড়িতে দেখলাম পৌনে এগারোটা বাজে। তৎক্ষণাৎ আমরা স্ট্যান্ড থেকে একটা টোটো নিয়ে সাহেবখালির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। একমাত্র ডাক্তারবাবু গেলেন আগে থেকে ঠিক করে রাখা একটা বাইকে। কারণ ওদিকে বহু রোগী ওঁনার পথ চেয়ে বসে রয়েছে। তাই ওঁনার তাড়াতাড়ি 'সুজন'-এ পৌঁছনোটা সর্বাগ্রে দরকার। দেখলাম রাস্তায় কাজ চলছে। রাস্তা খুব একটা চওড়া নয়। আমাদের টোটো তাই ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। দু'পাশে দিগন্তবিস্তৃত ক্ষেত। এসময় শুকিয়ে গেছে। প্রায় আধঘন্টা পর আমরা রায়পাড়ার সাহেবখালিতে 'সুজন' এসে পৌঁছলাম। টোটো থেকেই দেখতে পেলাম বহু রোগী 'সুজন'-এর বাইরে অপেক্ষারত। ইতিমধ্যেই 'সুজন'-এর প্রাণপুরুষ রোগীদের চিকিৎসা পরিষেবা দিতে তাঁর চেম্বারে বসে গেছেন। ওদিকে ফার্মাসিস্ট অশোকবাবু লেগে পড়লেন তাঁর মেডিসিন বিভাগ সামলাতে। ব্যাঙ্কের অশোকবাবু আর শম্ভুদা বসে পড়লেন প্রেসক্রিপশন দেখে রোগীদের ওষুধ বিতরণের কাজে। আমি একপাশে কাউন্টারে বসে দেখতে থাকলাম রোগীরা কীরকম সুশৃঙ্খলভাবে কাউন্টারে নাম লিখিয়ে টোকেন সংগ্রহ করছেন। বাইরে তখন ৭০-৮০ জন অপেক্ষারত রোগী ও তাদের সঙ্গে আসা মানুষেরা। বুঝলাম এখনও সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যাদের দেখানো হয়ে গেছে তারা প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র বুঝে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। আবার নতুন রোগীরাও এসে অপেক্ষা করছেন। তবে একটা ব্যাপার দেখে অবাক হলাম এক জায়গায় এতো মানুষ থাকা সত্ত্বেও সেখানে কোনো কোলাহল নেই। শুধু তারা নিজেদের মধ্যে নিম্নস্বরে কথাবার্তা বলছেন। দীর্ঘক্ষণ বসে অপেক্ষা করলেও করোর মধ্যে কোনো বিরক্তির উদ্রেক হচ্ছে না। বাইরে শুধুই হরেক রকমের পাখির কূজন। উপলব্ধি করলাম মানুষ কোনো চিকিৎসা পরিষেবায় কতটা সন্তুষ্ট হলে এরকম আচরণ করে। কলকাতার কোনো হসপিটালের আউটডোরের সঙ্গে 'সুজন'-এর আউটডোরকে মেলাতেই পারছিলাম না।

'সুজন'-এ ডাক্তারবাবুর বেশ কয়েকজন সহকারী রয়েছেন তাঁরা হলেন শম্ভু চক্রবর্তী (মেডিসিন), সঞ্জিত রায় (মেডিসিন), কমলেশ মণ্ডল (স্টোর), রত্না মণ্ডল (স্টোর), শঙ্কর মণ্ডল (রিশেপশন), কৌশিক রায় (রিশেপশন)। ইত্যবসরে ডাক্তারবাবু সহ অন্যান্যরা একটা ছোট বিরতি নিলেন। সঞ্জিতদা সকলের জন্য এনে দিলেন লেবুর সরবত। আমাদের সকলেরই তাতে প্রাণ জুড়োল। ডাক্তারবাবু আমাকে বললেন একটু বিশ্রাম নিয়ে নিতে। হাজার হোক কলকাতা থেকে সেই কাকভোরে বেরিয়ে এতটা রাস্তা আসার ধকল। কিন্তু বিশ্রামের কথা আমি তখন ভাবতেও পারছি না। একে তো সুন্দরবন তার ওপর এরকম একটা শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ সর্বোপরি আমার থেকে বয়সে বড় সবাই পরিষেবা দেবার কাজে যুক্ত থাকবেন আর আমি নেবো বিশ্রাম। তা হয় না। যাই হোক আমি ধন্যবাদ জানিয়ে ওখানেই বসে রইলাম। বসে বসে চাক্ষুষ করলাম চিকিৎসা পাবার পর অসহায় রোগীদের সন্তুষ্টি। তারা যেন বলছেন, "মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ..."। কত যত্নে তারা ওই ঔষধগুলো বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন। আসছে শনিবার অবধি এগুলোই তাদের বাঁচার রসদ। অনেককে হয়ত আর দেখাতে আসতে হবে না। সুস্থ হয়ে যাবেন। একটি বাচ্চা ছেলের ডানহাতের হাড়ে চিড় ধরেছে। ডাক্তারবাবুর পরামর্শ অনুযায়ী তাকে সঙ্গে সঙ্গে একটি অত্যাধুনিক হ্যান্ড রেস্ট দিয়ে দেওয়া হল। অশোকবাবু তার বাবাকে ওষুধ বোঝানোর অবসরে খানিক ভয় পেয়ে যাওয়া ছেলেটিকে মজা করে বললেন, "পরেরবার আরেকটা হাত ভাঙতে হবে কিন্তু। জানিস ছোটবেলায় আমার কতবার হাত ভেঙেছে?..." সেকথা শুনে ছেলেটির আর হাসি ধরে না। বুঝলাম এইবার তার চিকিৎসা সম্পূর্ণ হল। এক বয়স্ক মহিলাকে দেখলাম তিনি তার শাড়ির খুঁটের মধ্যে তাকে দেওয়া ওষুধগুলো দু'তিনটে গিঁট দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিচ্ছেন। কারণ এই অঞ্চলে কাছাকাছির মধ্যে কোনো ওষুধের দোকান নেই। কোনো ওষুধ হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে তাকে অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী শনিবারে ডাক্তারবাবু আসা অবধি। এই হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর সুন্দরবন। আজ আমরা গর্বের সাথে ৭৮তম স্বাধীনতা দিবস পালন করছি!

(ক্রমশ)

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।