বিবিধ

মহারাজা নন্দকুমার সম্বন্ধে কয়েকটি জ্ঞাতব্য বিষয় (অপ্রকাশিত)



শ্রী শৈলেশ চন্দ্র রায়


নন্দকুমারের পিতার নাম পদ্মনাভ রায়। 'রায়' তাঁহাদের প্রকৃত উপাধি নহে, 'চক্রবর্তী'-ই তাঁহাদের প্রকৃত কুলক্রমাগত উপাধি। নন্দকুমার বাসুদেব শাস্ত্রী-র নিকটে দীক্ষিত হইয়াছিলেন। নন্দকুমারের স্ত্রীর নাম 'ক্ষেমঙ্করী'। ক্ষেমঙ্করীর গর্ভে এক পুত্র ও তিন কন্যা জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। রাজা গুরুদাস (স্ত্রীর নাম জগদম্বা), সম্মানী বা সোনামণি (স্বামীর নাম জগশ্চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়) আনন্দময়ী ও কিনুমণি (আলোকমণি)। জ্যেষ্ঠ জামাতা জগশ্চন্দ্র (জগৎ চন্দ্র) নন্দকুমারের বিরুদ্ধে ইংরাজদিগের সহিত যোগ দিয়াছিলেন, এই হেতু নন্দকুমার তাঁহার প্রতি বিরূপ ছিলেন। আনন্দময়ীর সম্বন্ধে কিছুই জানিতে পারা যায় না। ভাটপাড়া নিবাসী রাজারাম বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের পুত্র রাধাচরণের সহিত উক্ত কিনুমণির (আলোকমণির) বিবাহ হইয়াছিল। এই রাধাচরণের নবাব-দত্ত উপাধি 'বাবু' ও 'রায়'।

ইনি মুর্শিদাবাদের নবাব মোবারক-উদ দৌল্লা-র উকিল ছিলেন এবং কলিকাতায় ইংরাজ দরবারে গিয়া তাঁহার দৌত্য কার্য্য করিতেন। নন্দকুমারের স্ত্রী, কনিষ্ঠ জামাতা রাধাচরণকে অত্যন্ত ভালোবাসিতেন। কলিকাতার উত্তর প্রান্তবর্তী ভাটপাড়ায় রাধাচরণের বাস ছিল। নন্দকুমার হুগলির ফৌজদার ছিলেন; হুগলি হইতে গঙ্গাপারে গিয়া ভাটপাড়ায় মধ্যে মধ্যে তাঁহাকে দরবার করিতে হইত। রাধাচরণ বিলক্ষণ সচ্চরিত্র, কৃতবিদ্য, কার্য্যপটু ও সদ্বশজাত ছিলেন। নন্দকুমার তাঁহাকেই জামাতারূপে নির্বাচন করিয়া তাঁহার হস্তে কনিষ্ঠা কন্যা কিনুমণিকে (আলোকমণিকে) অর্পণ করিয়াছিলেন। কিনুমণির (আলোকমণির) একমাত্র পুত্র নবকুমার। নবকুমারের দুইটি পুত্র ছিলেন, তারকনাথ ও দ্বারকানাথ। তারকনাথের প্রথম পক্ষীয় পুত্র মহেন্দ্র, কন্যা কৃষ্ণভাবিনী ও পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র, দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র গোপাল ও কন্যা পরমেশ্বরী। মহেন্দ্রের পুত্র সতীশ চন্দ্র পরম পূজনীয় স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সরস্বতী মহাশয়ের ভগিনী হেমলতাকে বিবাহ করেন, তাঁহার পুত্র শ্রীশ চন্দ্র ও বঙ্কিম চন্দ্র। কৃষ্ণভাবিনীর পুত্র হরিকিশোর, রঘুকিশোর, দেবকিশোর ও ব্রহ্মকিশোর।

উক্ত কৃষ্ণচন্দ্রই হিন্দু ও হেয়ার স্কুলের সুপন্ডিত হেডমাস্টার ছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্রের দ্বিতীয় পুত্র মহেশ চন্দ্র (জন্মান্ধ ছিলেন), ভবেশ চন্দ্র, রমেশ চন্দ্র, সুরেশ চন্দ্র, কুঞ্জ বিহারী ও বিপিন বিহারী। ভবেশ চন্দ্রের চারি পুত্র - শৈলেশ চন্দ্র [১], প্রবোধ চন্দ্র, সুবোধ চন্দ্র ও প্রভাস চন্দ্র। ডাক্তার রমেশ চন্দ্র কৃতবিদ্য ও সহৃদয় পুরুষ এবং চিকিৎসা বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী। ইঁহার একমাত্র পুত্র রাধারমণ। সুরেশ চন্দ্রের দুই পুত্র শৈল-জনার্দন ও রামচন্দ্র। কুঞ্জ বিহারীর দুই পুত্র সুধীর কুমার ও ক্ষীরোদ বিহারী। বিপিন বিহারীর দুই পুত্র - অজিত কুমার [৩] ও কানাইলাল।

Extracts from "*****" left by Babu Krishna Chandra Roy *** **** Hindu and Hare School.

1. "...It is a pity that no one knows precisely what the Maharaja's patronise was. Some people say, he was a Chakraborty...".

2. There was a beautiful specious hall at our Bhatpara house, with ornamental wood-works is it and the floor quite like polished marble. It was *** and to us, where we were young, as the place where the Maharaja held his Durbar.

3. My great grandfather, Babu Radha Chandra Roy... held the past of Vakil ambassedor of the Nawab Mobarak-Ud-Dowla of Murshidabad. I can force no precise idea of the nature of his duties as such; but most probably, he acted as the representative of the Nawab in his dealings with the English in Calcutta, and had also something to do with the Imperial Court, Delhi; where from he obtained the title of 'Ray Rayan' The sanad conferring this title with the Imperial seal on it (Badshahi Panja) was in my father's possesion for same reason or other, it was sent by him to the Governor-General's agent at Murshidabad, who never returned it.

মহারাজ নন্দকুমার, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করিতেন। যখন নন্দকুমার লক্ষ ব্রাহ্মণের পদধূলি লইবার নিমিত্ত মহা সমারোহে একটি কার্য্য করিয়াছিলেন, তখন তিনি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কর্মাধ্যক্ষ এবং রাণী ভবানীর ভান্ডারী দয়ারামকে স্বীয় ভান্ডারগৃহের রক্ষক করিয়া রাখিয়াছিলেন।


কৃষ্ণচন্দ্র রায়-এর [২] জীবন চরিত
জন্মঃ ১৫ই চৈত্র ১২৪৪ সন। ইং ১লা এপ্রিল ১৮৩৮ সাল।
মৃত্যুঃ ৫ই কার্ত্তিক ১৩১৯ সন। ইং ২১শে অক্টোবর ১৯১২ সাল।

কৃষ্ণচন্দ্র রায় যে বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, সে বংশের নাম বাঙ্গালার ইতিহাসে বিশেষ পরিচিত। হেস্টিংসের চক্রান্তে যে নন্দকুমারের ফাঁসি হয় - যাঁহার বিচারকে কোনো ইংরাজ লেখক 'Judicial Murder' বলিতেও কুন্ঠিত হয়েন নাই, কৃষ্ণচন্দ্র সেই নন্দকুমারের দৌহিত্ৰের পৌত্র। মহারাজা নন্দকুমারের এক পুত্র ও তিন কন্যা ছিলেন। পুত্র রাজা গুরুদাস অপুত্রক থাকিয়া শোকলীলা সম্বরণ করেন; কন্যা আনন্দময়ীর অবিবাহিত অবস্থায় মৃত্যু হয়। কন্যা সোনামণির সহিত জগৎচন্দ্রের ও কিনুমণির সহিত রাধাচরণের বিবাহ হয়। জগৎচন্দ্রের বংশধরগণ কুঞ্জঘাটার রাজা বলিয়া পরিচিত। কৃষ্ণচন্দ্র রাধাচরণের প্রপৌত্র।

নন্দকুমার যখন হুগলির ফৌজদার তখন রাধাচরণ মুর্শিদাবাদের উপকণ্ঠস্থিত সৈদাবাদ হইতে আসিয়া ভট্টপল্লীতে বাস করেন। তাঁহারই গৃহের মর্মরাস্তৃত বৃহৎ সুসজ্জিত ঘরে নন্দকুমারের দরবার বসিত। রাধাচরণ নবাব মোবারক-উদ দৌল্লা-র উকিল ছিলেন এবং পুরুষানুক্রমে 'বাবু' ও 'রায়রাঞ্চা' বলিয়া অভিহিত হইবার অধিকার পাইয়াছিলেন। তখন 'বাবু' - বর্তমান সময়ের 'বাবু' হইতে অনেক ভিন্ন প্রকারের সম্মান ছিল। ভট্টপল্লীতে তাঁহার জমিদারী 'বাবুর আনি'। তাঁহার বাজার 'বাবুর বাজার' তাঁহার পল্লী 'বাবুর পাড়া' নামে এবং তমলুকে (তাম্রলিপ্ত) তাঁহার জমিদারী দোরো পরগণা 'রায়রাঞ্চা' নামে প্রসিদ্ধ।

রাধাচরণের পৌত্র তারকনাথ স্বধর্ম্মপরায়ণ লোক ছিলেন। তিনি প্রতিদিন বেলা ১০টা হইতে ২টা পর্যন্ত গঙ্গায় দাঁড়াইয়া পূজা করিতেন। তাঁহার পুত্রদিগের শিক্ষার প্রতি বিশেষ নজর ছিল এবং বহু আত্মীয়-স্বজনের আপত্তি সত্বেও পুত্র গোপাল চন্দ্রকে মেডিকেল কলেজে পড়িতে পাঠান। সন ১২৮০ সালে ১৫ই ভাদ্র তারিখে হাওড়ায় তাঁহার দেহান্ত হয়।

কৃষ্ণচন্দ্র পিতার দ্বিতীয় পুত্র - ১২৪৪ সালে ১৫ই চৈত্র তারিখে মাতুলালয় মামবাটি হালিশহরে তাঁহার জন্ম হয়, জন্মের সাড়ে সাত মাস পরেই কৃষ্ণচন্দ্র মাতৃহীন হন। প্রতিবেশিনী কায়স্থ ভদ্রমহিলা মাতৃহীন ব্রাহ্মণ সন্তানকে লালন পালন করেন।

সাত বৎসর বয়সে গ্রামের পাঠশালায় পাঠ শেষ করিয়া কৃষ্ণচন্দ্র চুঁচড়ায় হরচন্দ্র রায়ের ইংরেজী স্কুলে পাঠ আরম্ভ করেন। তিনি যে সময় এই স্কুলের ছাত্র; সেই সময় (১৮ই মে, ১৮৪৯) মিস্টার লজ স্কুল পরিদর্শনে আসিয়া কৃষ্ণচন্দ্রকে ও রসিক চন্দ্র নিয়োগীকে সর্বোৎকৃষ্ট ছাত্র বলিয়া স্থির করেন। তিনি বালক কৃষ্ণচন্দ্রের আবৃত্তিতে বিশেষ প্রীত হয়েন ও তাঁহাকে হুগলি কলেজে বিনা বেতনে পাঠের অধিকার দেন। এই কলেজে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি মাসিক ৮্ টাকা 'জুনিয়র' বৃত্তি লাভ করেন। হুগলি কলেজে তিনি, মহেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশান চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীনাথ দত্ত প্রমুখ বাঙালী ও ফার, থয়েটস, লজ প্রমুখ য়ূরোপীয় শিক্ষকের ছাত্র ছিলেন। শ্রীনাথবাবু ছাত্রদিগকে অভিধান ব্যবহার করিতে উৎসাহিত করিতেন। ঈশানবাবুর ****-র '******' পড়াইতে ছয় মাস লাগিয়াছিল। মিস্টার ফার এক বৎসরে '******' শেষ করিয়াছিলেন। সবগুলিই ক্ষুদ্রায়তন কবিতা। অতএব দেখা যাইতেছে খুঁটিনাটি লইয়া সময় কাটাইয়া শিক্ষা স্থায়ী ফলপ্রদ করিবার অভ্যাস কৃষ্ণচন্দ্রের গুরুদত্ত সম্পদ।

কৃষ্ণচন্দ্র ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজ স্থাপিত হইলে তথায় আইসেন। কবি হেমচন্দ্র ও সুধী শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁহার সতীর্থ। কলিকাতায় তখন "রেতে মশা, দিনে মাছি"। এই অস্বাস্থ্যকর স্থানে বাস করিয়া ভগ্নস্বাস্থ্য কৃষ্ণচন্দ্রকে পাঠত্যাগ করিয়া গৃহে যাইতে হয়।

১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্র মাসিক ৫০্ টাকা বেতন পাওয়ায় নিকটস্থ শর্ষা স্কুলের হেডমাষ্টার নিযুক্ত হয়েন ও অল্পদিন পরেই বারাসতে আসিয়া স্যার অ্যাসলি ইডেনের স্কুল সংস্থাপিত করেন। ইহার পর তিনি পুলিশ দারোগা হয়েন, কিন্তু সে কার্য্যে ভালো না লাগায় ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে পুরী জিলা স্কুলের হেডমাষ্টার হইয়া যান। তখন পথের অবস্থা এরূপ ছিল যে, ভট্টপল্লী হইতে পুরী যাইতে তাঁহার দেড় মাস লাগিয়াছিল।

১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বহরমপুরে বদলি হন। তখন সাঁইথিয়া পর্যন্ত রেলপথ সংস্থাপিত হইয়াছে; ১ মাসে তিনি পুরী হইতে বহরমপুরে পৌঁছান। বহরমপুরে তাঁহাকে স্কুলে শিক্ষাদান ছাড়াও জিলার জজের অনুবাদকের কার্য্য করিতে হইত। অথচ এই দুই কার্য্যের ভিতর অবসরকালে "ভারতবর্ষের ইতিহাস" রচিত হয় (১৮৬০)। বরিশালের স্কুলের হেডমাষ্টারের কার্য্য করিতে অস্বীকৃত হইয়া তিনি **** স্কুলে বদলি হয়েন। তখন মিঃ মারে স্কুল পরিদর্শন করিয়া কৃষ্ণচন্দ্রের কার্য্য নিপুনতায় বিশেষ প্রীত হয়েন। তখন অভিধান প্রণেতা ডাকার ফ্যাশন তথায় ইন্সপেক্টর, তাহার সহিত মনোমালিন্য ঘটায় কৃষ্ণচন্দ্র চাকরী ত্যাগ করেন। কিন্তু পাবলিক ইন্সট্রাক্টর মিস্টার অ্যাটকিনসন তাঁহার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করিয়া পুনরায় বহরমপুরে বদলি করেন। ইহার পর ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁহাকে সাব-রেজিস্ট্রার হইয়া উড়িষ্যার বালেশ্বর যাইতে হয়। উড়িষ্যার দুর্ভিক্ষে বহু সম্পত্তি হস্তান্তরিত করার কার্য্য বাকি পড়িয়া গিয়াছিল। সেই কার্য্য শেষ করিয়া দিয়া কৃষ্ণচন্দ্র পুনরায় বহরমপুরে আইসেন। তিনি ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু স্কুলের ও ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু ও হেয়ার স্কুলের হেডমাষ্টার হইয়া ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে কার্য্য হইতে অবসর গ্রহণ করেন।

তাঁহার শরীর বহুদিন হইতেই অসুস্থ ছিল। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দ হইতে তিনি বহুমূত্র রোগে ভুগিতেছিলেন। মধ্যে মধ্যে তাঁহার রক্তামাশায় হইত। গত মহাপঞ্চমীর দিন তাঁহার রক্তামাশায় দেখা দেয় এবং সেই রোগেই একাদশীর দিন তাঁহার জীবনান্ত হয়। তাঁহার সাধ্বী পত্নী পতির ৭ বৎসর পূর্বে লোকান্তরিতা হইয়াছিলেন।

শিক্ষাদানেই কৃষ্ণবাবুর কৃতিত্ব, শিক্ষালাভেই তাঁহার আনন্দ ছিল। শেষ ব্যাধির পূর্ব পর্যন্ত তিনি প্রত্যহ রাত্রি ১২টা হইতে প্রাতঃকাল ১০টা পর্যন্ত পাঠ করিতেন। ইহার মধ্যে কেবল প্রত্যুষে ভ্রমণে এক ঘন্টা ব্যায়িত হইত। আবার অপরাহ্নে ৩টা হইতে ৪টা পর্যন্ত অধ্যয়ন চলিত। এ অধ্যয়ন কেবল জ্ঞানার্জনের জন্য। তিনি যে পুস্তকই পাঠ করিতেন তাহা বিশেষ যত্ন সহকারে করিতেন - পুস্তকের মধ্যে নানাবিধ রেখায় সে অধ্যয়ন চিহ্ন থাকিত। আবার যখন যাহা পড়িতেন তাহার আবশ্যক অংশ - সুপ্রযুক্ত শব্দাদির ব্যবহার নিদর্শন খাতায় লিখিয়া রাখিতেন। তিনি সমস্ত জীবন এই কার্য্য করিয়া গিয়াছেন। তিনি মৃত্যুর ছয় দিন পূর্বে লেখনী ত্যাগ করিয়া শয্যায় আশ্রয় লইয়াছিলেন - সেই শয্যাই তাঁহার শেষ শয্যা। তাঁহার "Phrases and Idious"-এর পরিচয় দিতে যাওয়া ধৃষ্টতা। উহার প্রকাশের পর ওই প্রকারের বহু পুস্তক প্রকাশিত হইয়াছে। কিন্তু কেহই উহার সমকক্ষ নহে। "Middle Class Reader"-এর সংগ্রহে গ্রন্থকারের অগাধ পান্ডিত্যে বিস্মিত হইতে হয়। ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থকারের রচনা হইতে আদর্শ চরিত্র কথা বাছিয়া এই সংগ্রহ। অথচ রচনা প্রণালীতে বৈষম্য অত্যাধিক নহে। এ সংগ্রহে যে নিপুনতার পরিচয় আছে তাহা বাঙ্গালীর কেন, বহু ইংরাজের কৃত সংগ্রহেও দেখিয়াছি বলিয়া মনে হয় না। তাঁহার "Higher Class Reader" উল্লেখযোগ্য। তাঁহার "ভারতবর্ষের ইতিহাস" ও "ভারতবর্ষের ভূবৃত্তান্ত" সরল ভাষায় লিখিত। তিনি "Lord Curzon's Work in India"-য় লর্ড কার্জনের কৃতকর্মের বিশ্লেষণ করিয়াছিলেন।

কৃষ্ণচন্দ্র হুগলি কলেজে B.A. পরীক্ষায় ইংরাজী সাহিত্যে সর্বোৎকৃষ্ট ছাত্রের জন্য একটি ও নদীয়া জিলায় ন্যায় পরীক্ষায় সর্বোৎকৃষ্ট ছাত্রের জন্য একটি মেডেল দিবার ব্যবস্থা করিয়া গিয়াছেন। প্রথমটি তাঁহার পিতা তারকনাথ রায়-এর নামে ও দ্বিতীয়টি তাঁহার পত্নী বিরাজমোহিনী দেবীর নামে প্রদত্ত হইয়াছে।

তিনি আহারে, ব্যবহারে, বেশে আড়ম্বরশুন্য ছিলেন। তাহার পরিচ্ছন্নতা ও উদ্ভিদপ্রিয়তা অসাধারণ ছিল। তিনি স্বহস্তে বৃক্ষপত্রাদি রোপণ করিতেন ও সময় সময় গৃহসম্মুখস্থ রাজপথের ফুটপাথেও ঘাস বসাইয়া জল দিতেন।


নন্দকুমারের ফাঁসি - শুনে বুক ফাটে

বাঙ্গালা এগারো শত বিরাশির সালে
একুশে শ্রাবণ শনিবার প্রাতঃকালে
যে কান্ড হইয়াছিল আলিপুর ধামে
বাঙ্গালীর হৃদকম্প হয় তার নামে।
কুশী বাজারের কাছে যে ময়দান ছিল,
তাহার উপরে বধ-মঞ্চ বাঁধা হ'ল।

*  *  *  *  *  *  *  *  *  * (১)

লোকারণ্য হ'ল মাঠ দেখিতে দেখিতে,
সমবেত সব লোক লাগিল কাঁদিতে।

*  *  *  *  *  *  *  *  *  *

কিবা ধনী জন , কিবা ধনহীন জন,
হাহাকার রব তুলি ফাটায় গগন।
মহারাজ বলিলেন, শরিফে তখন, -
"মোর শব বয় যেন এ তিন ব্রাহ্মণ।
মৃতদেহ নাহি স্পর্শে যেন আর কেহ,
ব্রাহ্মণ-সন্তান আমি, - পুণ্য এই দেহ"।
নিজ পাল্কিখানি তিনি বর্জন করিয়া
বধ-মঞ্চ-স্থানে যান চরণে চলিয়া।
কোথায় ফ্রান্সিস, ক্লেভারিং, মন্ সন্?
কোথা মোর গুরুদাস, হৃদয়ের ধন?
সম্মানী, আনন্দময়ী, কোথা কিনুমণি?
কোথায় রহিলি মাগো! আদরের মণি!
এইসব কথা মনে ভাবিতে ভাবিতে
শেরিফেরে ডাকিলেন নিকটে আসিতে।

*  *  *  *  *  *  *  *  *  *

ফ্রান্সিস, ক্লেভারিং, মন্ সন্
আমার পরম বন্ধু, - জানে সর্বজন।
ব'ল তাঁরা যেন মোর পুত্র গুরুদাসে
নিজ পুত্র বলিয়াই সদা ভালোবাসে।
শেরিফ গেলেন তাঁর মুখ আরবিতে,
নিষেধ করেন রাজা এ কার্য্য করিতে।
বধ-মঞ্চে উঠিলেন শ্রীনন্দকুমার,
কি হ'ল, কি হ'ল - সবে করে হাহাকার।
জল্লাদ আদেশ পেয়ে কাঁদিতে কাঁদিতে
গেল নন্দকুমারের গলে ফাঁসি দিতে।
পরম প্রশান্ত-চিত্ত শ্রীনন্দকুমার,
বিকারের চিহ্ন নাই বদনে তাঁহার!
রাজা, মহারাজ আর ওমরাহ-গণ
পড়িয়া রহিত যাঁরা দ্বারে অনুক্ষণ!
যাঁহার দর্শন লাভ করিবার তরে
পথে ঘাটে দাঁড়াইতো লোক থরে থরে;
যাঁহার কোথায় মীর-জাফর নবাব
সাহসী না হইতেন করিতে জবাব।
সে নন্দকুমার আজ পড়িয়া ফাঁপরে
গল-দেশ সঁপে দিলা জল্লাদের করে।
জল্লাদ রুমালে বাঁধে হাত দুটি তাঁর,
পা দুটি রহিল খোলা, - ইহাই নিস্তার।
দেখিতে দেখিতে নন্দকুমারের প্রাণ
পঞ্চভূতে মিলাইল করিয়া প্রস্থান!
শ্রীনন্দকুমার আজ যাইলা চলিয়া,
সমগ্র বঙ্গের ভূমি উঠিল কাঁপিয়া।
এই পাপ দৃশ্য চক্ষে মানুষ দেখিয়া
ক্ষালন করিল পাপ গঙ্গায় পড়িয়া।
গঙ্গার অপর পারে বালি গ্রাম রয়,
অনেক ব্রাহ্মণ তথায় লয়েন আশ্রয়।
সে অবধি আর তাঁরা কলিকাতা-পারে
কিছুতে না আসিলেন জনমের তরে।
ধন্য হে হেস্টিংস তুমি, ধন্য ইফো আর,
নির্দোষ ব্রাহ্মণে আজ করিলে সংহার।
লক্ষ ব্রাহ্মণের পদধূলি যাঁর শিরে,
হেন পরিণাম তাঁর এতদিন পরে।
ব্রাহ্মণের শিরোমণি যে নন্দকুমার,
পরিণামে এ দুর্গতি হইল তাঁহার।
অদ্যাপি কাঁদিয়ে কত লোক মাঠে-ঘাটে,
নন্দকুমারের ফাঁসি শুনে বুক ফাটে।

(১) ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে ৫ই আগস্ট তারিখে অর্থাৎ ১১৮২ বঙ্গাব্দে ৩১শে শ্রাবণ শনিবার প্রাতঃকালে নন্দকুমারের ফাঁসি হইয়াছিল।

______________________________
সূত্রঃ
[১] শ্রী শৈলেশ চন্দ্র রায়, শ্রীমতী তনিমা মুখোপাধ্যায় (রায়)-এর পিতা। এঁনার সাথেই শিবপুর নিবাসী রেণুকা মুখোপাধ্যায় (রায়)-এর বিবাহ সম্পন্ন হয়। শিবপুরের বাড়িটি 'বাঘ বাড়ী' নামে খ্যাত। অপ্রকাশ মুখোপাধ্যায় (শ্রীমতী রেণুকা রায়-এর ঠাকুর্দা। অনাদিনাথ মুখোপাধ্যায়-এর পিতা।) স্টিবেটর ছিলেন। তিনি এই বাড়ি তৈরী করেন প্রায় ১৫০/২০০ বছর আগে। সিপাহী বিদ্রোহেরও আগে।

হাওড়ার শিবপুরের মন্দিরতলায় অনাদিনাথ মুখোপাধ্যায়-এর তৈরি করা শিবমন্দিরটি এখনও বর্তমান।

[২] কৃষ্ণচন্দ্র রায় ছিলেন শ্রীমতী তনিমা মুখোপাধ্যায় (রায়)-এর পিতার ঠাকুরদাদা।

[৩] এই অজিত কুমার-এর পুত্র অমিতাভ রায় একসময় কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন।


বিশেষ আবেদনঃ
উপরের লেখাটির কিছু জায়গা তারকাচিহ্নিত (স্টারমার্ক) করা আছে। কারণ মূল পাণ্ডুলিপি থেকে টাইপ করার সময় উক্ত জায়গাগুলি পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। যাঁরা পড়ছেন তাঁদের কাছে অনুরোধ রইল, আগ্রহী কেউ সম্ভব হলে যদি আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন তাহলে আমরা তাঁকে লেখাটির মূল পাণ্ডুলিপি দেখাতে পারি। যেখান থেকে উক্ত অংশগুলি পাঠোদ্ধার করে তিনি সাহায্য করতে পারেন। ধন্যবাদ।