ধানবাদ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পায়চারী করতে করতে সুপ্রকাশ ঘন ঘন ঘড়ি দেখছিল। হাওড়া থেকে আসার সময় আধঘন্টা পেরিয়ে গেছে, এখনও ট্রেনের দেখা নেই। আজ গুড ফ্রাইডে, সেকেন্ড স্যাটারতে আর রোববার মিলে টানা তিনদিনের ছুটি, তার সঙ্গে এক আধদিন যোগ করে ওর ছেলেবেলাকার তিন বন্ধু এই টানা সপ্তাহান্তের ছুটিতে ওর বাড়ি বেড়াতে আসছে। সেই ক্লাস ওয়ান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ওরা একই সঙ্গে শৈশব আর কৈশোর পেরিয়েছে তার পর কলেজ জীবনে যে যার মতো ছিটকে গিয়েছে।
সুপ্রকাশ মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার, বিভিন্ন খনি ঘুরে ও এখন ধানবাদের কাছেই সুদামদি কোলিয়ারির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। আর বছর দুয়েক চাকরি আছে। গিয়েছে। এখানে বিরাট বাংলো টাইপ কোয়ার্টার। রিটায়ারমেন্টের পর সল্টলেকের ডুপ্লেক্সে চলে যাবে।
তপন ইংরাজী নিয়ে পড়েছে। কলকাতার কাছেই একটা কলেজে অধ্যাপনা করে। ওখানেই বাড়ী।
সুদীপ্ত ডিফেন্সে আছে। সারাজীবন ক্ল্যারিকাল পোস্টে থেকে এই বছর দুয়েক হল সেকশন অফিসার হয়েছে।
নীলাংশু ওদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী। ও নীলরতন থেকে ডাক্তারি পাস করে জমিয়ে প্র্যাকটিস করছে। নামকরা অর্থোপেডিক সার্জন। লেক গার্ডেন্সে বিশাল বাড়ি, গাড়ি।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলেও ওদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। বছরে একবার করে ওরা এক একজনের বাড়িতে মিট করে। কিন্তু দূরত্বের জন্য সুদামদিতে আর তিনজনের আসা হয়নি। সুপ্রকাশের আর মাত্র বছর দুয়েক চাকরি আছে তাই বহুকষ্টে এতদিনে ওদের রাজী করানো গেছে। আজই ওদের আসার কথা।
ঘণ্টাখানেক লেট করে ট্রেন স্টেশনে ঢুকল। প্রতিবারের মতো এবারেও দেখা হতেই চারবন্ধু গোল করে একমাথা হয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল। আবেগটা একটু হালকা হতেই ওরা সুপ্রকাশের গাড়ি চেপে চেপে রওনা দিল। বাড়িতে আসতেই ওর বউ মালবী আর মেয়ে সুদর্শনা হৈ চৈ জুড়ে দিল। একপ্রস্থ চা জলখাবার খেয়ে সবাই স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে নিল। দুপুরে এলাহি আয়োজন দেখে ওরা আঁতকে উঠল। চারদিন ধরে এরকম অত্যাচার চললে আমরা সুস্থ অবস্থায় ফিরতে পারবো তো? সুদর্শনা হাসতে হাসতে বলে তোমরা বোধহয় ভুলে গেছ এখানে দু দুজন ডাক্তার আছে, নীলাংশুকাকু আর আমি। সবাই সমস্বরে হো হো করে হেসে উঠল।
ওরা রোজই কাছাকাছি জায়গাগুলোতে বেড়াতে যাচ্ছে। সিন্ধ্রি ফার্টিলাইজারে আজ যাবে। ফিরে এসে প্রতি বিকালে ওরা জম্পেশ আড্ডা দেয়। রোজই কোনও না কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পরে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে চলে যায়। কখনও ছেলেবেলার স্মৃতি। তারপর রাজনীতি, ক্রিকেট, ধর্ষন... এভাবে প্রসঙ্গ বদলাতে থাকে। সুদীপ্ত বলে মনে আছে, আমাদের পন্ডিতমশাই ক্লাসে ঢুকেই কাউকে দাঁড় করিয়ে লতা বা নর-এর শব্দরূপ ধরতেন। সে নর নরৌ নরা: বলতে বলতেই তীব্র নাসিকাগর্জন। একদিন পল্টু আস্তে করে ওঁনার টিকিতে ফড়িং বেঁধে দিয়েছিল? তপন চেঁচিয়ে ওঠে, হ্যাঁ হ্যাঁ সেই ফড়িংটা ফড়ফড় করে মাথায় সুড়সুড়ি দিতে শুরু করল। উনি ধড়ফড়িয়ে উঠে তুমুল চিৎকার - বল কোন মর্কট এটা করেছে? আজ তারই একদিন কী আমারই একদিন! আমরা সব ভিজে বেড়াল। উনি বেত দিয়ে প্রত্যেকের হাতে সজোরে একঘা দিয়ে চললেন। নিখিলের তো হাত কেটে রক্তারক্তি।
ওরা মঙ্গলবার ভোরের ট্রেন ধরে ফিরে যে যার কাজে বেরিয়ে যাবে। রোববার রাতের আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। সুপ্রকাশের মেয়ে বউ পাড়ায় কার বাড়িতে বিয়েবাড়ি গেছে। অবশ্য ওদের জন্য নানারকম স্ন্যাকস গুছিয়ে রেখে গেছে। সুপ্রকাশ বলল, একটা জিনিস খেয়াল করেছিস? আমাদের সময় হয় জেনারেল লাইন নয়তো ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং ফিল্ডে একটু কম নম্বর পাওয়ারা গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে চাকরির পরীক্ষার জন্য তৈরী হতো। আর তেমন কোনও প্রভিশন ছিল না। অথচ দ্যাখ আমাদের ছেলেপুলেদের সামনে এখন হাজার একটা পথ। ফ্যাশন ডিজাইনিং, হোটেল ম্যানেজমেন্ট... মান্ধাতার ল' কলেজের বদলে সব ন্যাশনাল ল' কলেজগুলো থেকে পাঁচ বছরের ইন্টিগ্রেটেড কোর্স করে সব ৮০/৯০ হাজারের চাকরি করছে। তাছাড়া বিশাল কর্পোরেট দুনিয়া তো ছিপ ফেলে বসেই আছে। আমাদের সময় ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং মানেই জয়েন্টের একদম উপরের দিকের ছাত্রছাত্রীরা শুধু সরকারী কলেজেই চান্স পেত, আর এখন দ্যাখ চল্লিশ বেয়াল্লিশ হাজার রাঙ্ক করেও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ঢুকে পড়ছে। আর যারা আগেকার দিনে লোয়ার ডিভিসন ক্লার্কের চাকরি জোগাড় করতে হিমসিম খেত তারাও কোনওক্রমে একটা এমবিএ ডিগ্রী নিতে পারলেই কেল্লা ফতে। ম্যানেজমেন্ট কলেজগুলো তো এখন অজ পাড়াগাঁয়ের অলিতেগলিতেও গজিয়ে উঠছে। বাপের টাকা থাকল তো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া এখন বাঁয়ে হাতকা খেল। মুড়ি মিছরি সব একাকার। তপন বলল, না রে এখনও মেডিকেল কলেজের ডাক্তার আর শিবপুর, যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারদের আলাদা কদর আছে। আইআইটি তো ছেড়েই দিলাম।
সবাই অবশ্য এটা স্বীকার করল। তবে কম্পিউটার একটু জানলেই অজস্র কল সেন্টারে দশ পনেরো হাজারের চাকরি কোনো ব্যাপারই না।
সুদীপ্তর পায়ের তলায় সর্ষে। সে যে কোনও ছুটি ছাটায় পিঠে হ্যাভারস্যাক বেঁধে হিমালয়ের পথে পথে ট্রেকিং করে। ও বলল, তোরা জানিস এখন ট্যুরিজম নিয়ে কি চলছে? সেক্স ট্যুরিজম-এর নাম শুনেছিস?
না তো, বাকী তিনজন একটা আঁশটে গন্ধ পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল সেটা আবার কি?
এটাও একধরণের জীবিকা। দেশ বিদেশ থেকে প্রচুর ট্যুরিস্ট হিমালয়ে ট্রেক করতে আসে। আগ্রা, অজন্তা, ইলোরা, খাজুরাহোতেও অনেকেই যায়। এদের অনেকেই দল বেঁধে আসে। আবার সাহেব মেমরা অনেকে একা একাও বেড়িয়ে পড়ে। তবে শুধু ঘুরে বেড়ালে তো চলে না। ওই হিমধরা ঠান্ডায় শরীরটাও তো গরম রাখতে হবে। অতএব প্রচুর যুবক, যুবতী এদের সঙ্গী হতে এগিয়ে আসে, এদের বেড়ানোকে আরও উষ্ণ করে তুলতে। নীলাংশুটা বরাবরের ফাজিল। ও বলল, ইস... আমাদেরও সবার যদি এমন সুযোগ থাকত তবে কে আর অত খেটেখুটে ডাক্তারি পড়তে যেত। পয়সাই পয়সা, সঙ্গে ফুর্তি ফ্রি। তপন বলল, বুড়ো হতে চললি এখনও চ্যাংড়ামিটা গেল না। তোরা শুধু বড়লোক আর মধ্যবিত্তেই আটকে থাকবি? জানিস গরীব মানুষরাও কত রকমের পেশা বেছে নিচ্ছে? এই সেদিন কোলে মার্কেটে দেখি বহু মহিলা শুধু বিভিন্ন সাইজের আলু বাছাই করে চলেছে।
নেপাল, বিহার থেকে আসা লোকেরা তো মা দুগ্গার মতো দশ হাতে কাজ করছে। ভোর থেকে গাড়ী ধোয়া, বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়া, ফ্ল্যাট বাড়ীতে দারোয়ানের সাথে এই সব খুচরো কাজ করে দু' পয়সা আয় বাড়ানো আর কি। কোনো কোনো পাড়ায় পাঁচ ছ' জন বেকার ছেলে মিলে দিব্যি দুনিয়ার ভার নিজেদের মাথায় তুলে নিয়েছে। পাড়ার বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের ইলেকট্রিক, টেলিফোন বিল দেওয়া, সকালের দুধ, পাউরুটি আনা, বাজার করা, লন্ড্রির জামাকাপড় নিয়ে যাওয়া - নিয়ে আসা। যেসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কেউ নেই তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেওয়া। এককথায় বিপত্তারণ পাচন, বিনিময়ে কিছু পারিশ্রমিক।
সুপ্রকাশ বলল, অনেক রাত হয়েছে।মালবী টেবিলে সব ডিনার সাজিয়ে গেছে। ওদের আসতে বারোটা বেজে যাবে। চল মাইক্রোওভেনে গরম করে খেয়ে নিই। তোরা তো পরশুই চলে যাবি। এখানে এসেছিস আর খনির ভিতরটা দেখবি না? কাল সকালে তোদের নিয়ে যাব। আর তার সঙ্গে একটা সারপ্রাইজ। কিরে কিরে? তিনজনের উৎসাহে জল ঢেলে ও বলে, উঁহু সেটা কালকেই দেখবি।
সোমবার ভোরে উঠে চা খেয়ে ওরা চলল খনি দেখতে। ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা ওর অফিসেই মাটির অত নীচে, পাতালপুরীতে যে ভীষন কর্মকাণ্ড চলছে তা দেখে ওরা তো থ।
নীচে নামার সময় ওদের তো বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। একটু ভয় ভয়ও করছিল। নীচে গিয়ে শ্রমিকদের দেখে ওদের মনে হচ্ছিল পেটের জন্য এরা প্রাণের মায়া পর্যন্ত ত্যাগ করে। কত খনিতে তো ধসের তলায় চাপা পড়ে কত শ্রমিক যে মারা যায় তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
ভারাক্রান্ত মনে আবার উপরে উঠে এসে সুপ্রকাশের বিশাল চেম্বারে বসে ওরা এলাহি ব্রেকফাস্টের সদগতি করল। এবার বাংলোয় ফেরার পালা। সুপ্রকাশ বলল, চল এবার আমরা অন্য গেট দিয়ে বেরোবো। ওরা পিছনের গেট দিয়ে বেরোল। একটা শিফট শেষ হল। শ্রমিকরা লাইন দিয়ে বেরোচ্ছে। সামনে একটু দূরেই দুই মহিলা, এক বৃদ্ধা আর একজন বছর পঁয়তাল্লিশের হবে, চাটাই পেতে বসে আছে। দুজনের সামনেই দু' বালতি জল। শ্রমিকেরা দু'ভাগে ভাগ হয়ে ওদের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো। একজন একজন করে মহিলাদের সামনে বসছে, মিনিট থানেক পরে উঠে চলে যাচ্ছে, আবার পরের জনের পালা। ওরা পুরো ঘটনাটা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখল কিন্তু কারোরই ব্যাপারটা বোধগম্য হল না। সুপ্রকাশকে জিজ্ঞাসা করল, ওরা ওখানে কি করছে? ও বলল, একটু দাঁড়া। লাইনের শেষ জন যখন বসবে, তোদের কাছে নিয়ে দেখাবো। আরও মিনিট পাঁচেক পরে যখন শেষ দুজন বসেছে ওরা কাছে গিয়ে আঁতকে উঠল, দেখে ওই দুই মহিলাই জিভ দিয়ে ওদের দুটো চোখ চাটছে! তিন বন্ধু হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সুপ্রকাশ বলল কাল রাতে তোদের বললাম না একটা সারপ্রাইজ আছে? এই সেই চমক। এই মহিলারা কয়লা শ্রমিকদের চোখের কয়লার গুঁড়ো জিভ দিকে চেটে পরিষ্কার করে দেয়। আর প্রতিবারই ওই বালতির জল দিয়ে মুখ কুলকুচি করে। এটা রোজকার ঘটনা। বিনিময়ে ওই মহিলারা মাসকাবারি কিছু পায়। খনির মালিকই এই বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। তিনটে শিফট মিলিয়ে যা রোজগার হয় তাই দিয়েই ওদের গ্রাসাচ্ছাদন।
মানুষের অসীম দারিদ্র আর দুটো রুটির জন্য এই আজব জীবিকা দেখে ওদের চোখের কোণগুলো চিকচিক করে উঠল। ফেরার পথে কারো মুখে কোনো কথা নেই।
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।