প্রবন্ধ ও নিবন্ধ

অপ্রাসঙ্গিকতার অন্দরমহল



অভিজিৎ রায়


আন্দোলন ততক্ষণ অরাজনৈতিক হতেই পারে যতক্ষণ আন্দোলনকারীরা ক্ষমতা দখলের প্রার্থী নন। যখন তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য লড়াই করবেন তখনই তা একমাত্র রাজনৈতিক আন্দোলন।

'অরাজনৈতিক' শব্দটা ঠিক তাদেরই গায়ে বিঁধছে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নেমেছেন। আসলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এখনও সাধারণ মানুষের ডাকে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেবার এই ব্যাপারটা মেনে নিতে বা মানিয়ে নিতে পারছেন না। দৈনিক মজুরি দিয়ে ব্রিগেড ভরানোই হোক বা ডিম্ভাত দিয়ে, তার সঙ্গে এইসব সভায় উপস্থিত মানুষের যে বিস্তর ফারাক তা বুঝেই রাজনৈতিক দলগুলির এই 'অরাজনৈতিক' শব্দটির প্রতি প্রভূত ঘৃণা সম্প্রচারিত হচ্ছে। ক্ষমতাসীন বা প্রাক্তন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা নেতৃত্বের প্রতি মানুষের ক্ষোভ বা ঘৃণার ফারাক খুঁজতে যাওয়া এই সময়ে অর্থহীন।

রাজনৈতিক ক্ষমতার বাইরে থাকা মানুষ অন্য একদল মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রের যোগ্য উত্তরণের জন্য লড়াই চালিয়ে গণতন্ত্রকে গর্বিত করে তুলছে এই অস্থির সময়ে এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে নিজের বক্তব্য রাখছে - এটাই বাঙালির বা বাংলার নতুন সংস্কৃতি। এর প্রতি শ্রদ্ধা হারালে বাংলার রাজনৈতিক দলগুলিকে শুধুমাত্র দুষ্কৃতি ও দাঙ্গা নির্ভর ক্ষমতায়নের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকার উপায় খুঁজে বেড়াতে হবে। ডানপন্থা বা বামপন্থার আলোচনা তখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়াবে।

ধর্ষণ থেকে নারী নির্যাতন, সামাজিক সমস্ত ব্যধিকেই যারা রাজনৈতিক ব্যধিকরণ বলে চিহ্নিত করছেন তাদের মনে রাখতে হবে, সেই সূত্র ধরে বলাই যায় তৃণমূলকে ক্ষমতার আনার দায়ও তাদের সেই রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতার ঘাড়ে নেওয়ার সময় এসেছে। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে ধর্ষণের ঘটনা যে কোনও রাজনৈতিক দলের সময়েই যে কোনও রাজ্যে ঘটে থাকে, ঘটেছে এবং ঘটবেও। কিন্তু ঘটনার পরবর্তীতে শাসকদলের দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করে এই সামাজিক ব্যধির শেকড় ঠিক কত গভীরে প্রবেশ করতে পারে। শাসক তার শাসনের অভিমুখ কতটা শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে দেবে অথবা কতটা দুর্নীতি বা স্বজনপোষণ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে তার উপরই পরবর্তী বেশ কিছু দশকের সামাজিক ব্যধির প্রসার নির্ভর করে।

সেই দিক দিয়ে বিচার করলে তৃণমূলের পাশাপাশি তার পূর্বতন শাসক সিপিএমের দায়ও কিছু কম নয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলির সমস্যা সব একই ধরনের। এরা দায়িত্ব নিতে যত উদগ্রীব, দায় নিতে মোটেই উৎসাহ দেখায় না। কাজেই, দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পর দায় কার এই নিয়ে বিতর্কের মাঝে ঘটনা লঘু হয়ে পড়ে এবং জনগণের স্মরণ অযোগ্য স্মৃতিতে সেইসব ঘটনার আস্তাকুঁড় লক্ষ্য করা যায়। আর, তখন কিছু ধান্দাবাজ ঘন্টাখানেক বিতর্কে নিজের ধান্দার বীজ রোপন করতে নির্লজ্জের মতো এর দোষ ওর ঘাড়ে দিয়ে ভেসে থাকার চেষ্টা করে। এর উপর রয়েছে দলবদলের মতো এক কুরুচিকর আইন। যার ফাঁক দিয়ে গলে গিয়ে একই ধান্দাবাজ, সমাজবিরোধী নানা দলের প্রতিনিধি হয়ে আমাদের গণতন্ত্রকে কালিমালিপ্ত করছে এবং কোনও বিরোধী দলই এই নীতির বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে কোনও জনস্বার্থ মামলা করছে না। পুঁজিবাদের অর্থে পুষ্ট গণতন্ত্রের চেহারা এর থেকে ভাল কী হবার কথা ছিল সে অন্য প্রসঙ্গ। সে নিয়ে অন্যদিন লেখা হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এইসব ঘটনার দায় কার? সমাজের না কি রাজনীতির?

আর. জি. করের ডাক্তারের ধর্ষণ এবং খুনের দায় যদি দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির হয়, তবে জয়নগর, পটাশপুর বা ফারাক্কার ঘটনা অবশ্যই সামাজিক ব্যধির কারণে। এই সামাজিক ব্যধির গভীর শিকড়ের পরোক্ষ কারণ রাজনৈতিক হলেও, শিক্ষাক্ষেত্রে সরকার ও জনগণের চরম উদাসীনতা, ভিক্ষাবৃত্তিতে প্রস্তুত হয়ে সমাজের মানসিকতা এবং তাতে রাজনৈতিক ইন্ধন সব সময়ে সব পক্ষের রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের ছিল, আছে, থাকবে। এখান থেকে মুক্তির পথ জনগণের নেই। যারা ভাবছেন এই অন্ধকার সময়ে বিকল্প শাসক খুঁজে বের করা জরুরি তারা আরও নিবিড়ভাবে ভাবলেই বুঝতে পারবেন যে এই বাংলায় নিজেদের শোষক নির্বাচনে শিক্ষিত জনগণের হাতে কোনও বিকল্প নেই। জয়-পরাজয়ের ভোট ব্যাঙ্কের পুরোটাই নির্ভর করবে এক বিশাল সংখ্যক অশিক্ষিত, গরীব জনগণের উপর। তাই, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় সবাই এই অশিক্ষিত গরীব জনগণকে আরও অশিক্ষিত, আরও গরীব বানানোর চক্রান্তে ব্যস্ত থাকে। নেতাদের ভুল বোঝানো বা মিথ্যা ভাষণ এবং সরকারের ভর্তুকিই যেখানে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ বেঁচে থাকার অভ্যাসে সেই অবলম্বন হারিয়ে ফেলার ভয়ে স্বৈরাচারী শাসককে ভোটে জেতাতেই থাকে এবং সমাজে শিক্ষিত জনগণের কদর কমতে থাকে। দুর্নীতিবাজ নেতানেত্রী এবং রাজনৈতিক দলের কাছে তাই এইসব নির্বোধ, অশিক্ষিত জনগণই তুরুপের তাস।

শিক্ষক, ডাক্তারদের আন্দোলন, অনশনে সরকারের হেলদোল নেই। এখনও উপেক্ষার রাজনীতিতে আন্দোলনকারীদের মনোবল ভাঙার খেলা চালানো হচ্ছে সরকারের তরফে। তবে, হার্ডকোর বামপন্থীরা যে এই আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছেন তা বোধহয় সম্ভব নয়। এই আন্দোলনের পরিধি, ক্ষেত্রফল এখনও অরাজনৈতিক। হ্যাঁ, সেই পুরনো শব্দেই ফিরতে হলো। যাঁরা পথে নেমেছেন, আন্দোলনকারী বা অনশনকারীদের সমর্থনে মিছিল, মানববন্ধন, সভা বা জমায়েত করছেন তাদের অনেকেই এখনই বামেদের ক্ষমতায় ফেরানোর ব্যাপারে নিজেরাই নিশ্চিত নন। তাছাড়া আরও একটা জিনিস মনে রাখতে হবে। সামাজিক অবক্ষয় মাঝপথ থেকেই নিজেকে শুধরে নিয়ে সমাজকে নতুন আলো দেখাতে সক্ষম হয়নি কোনওকালেই। এই বাংলায় আরও অনেক সামাজিক অবক্ষয় দেখা বাকি আমাদের। সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষের আরও আরও অবক্ষয় এবং আরও আরও ক্ষয়ক্ষতির পর বিপ্লবের বহ্নিশিখা বদল আনতে পারে এই রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের। তার আগে এই দ্রোহ, এই কার্নিভাল শুধুমাত্র আমাদের সুনির্দিষ্ট পথের দিশা দেখাতে পারে। আর ততদিন অরাজনৈতিক আন্দোলনের ভরসা জোগানোই রাজনৈতিক শিক্ষার প্রাসঙ্গিক কর্মসূচি হয়ে ওঠার চেষ্টার মধ্যেই গণতন্ত্রের জয় সুনিশ্চিত হবে।

[লিখিত বক্তব্যের দায় সম্পূর্ণরূপে লেখকের নিজস্ব।]

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।