গতবছর, ৯ অক্টোবরের খুব ভোর তখন। দিনটা দুর্গাষষ্ঠীর। ভোরের আজানেই সেদিন ঘুম ভেঙেছে আমাদের। 'আমাদের' বলতে আমার আর আমার একমাত্র কন্যে'র। সামনের পাঁচ পাঁচটা দিনের জন্যে সেদিনই যে 'শিলং' যাব আমরা, মায়েতে-মেয়েতে মিলে বেড়াতে! জীবনে প্রথমবার! এবারের ট্যুর প্রোগ্রাম খুব হঠাৎ করেই, মাত্র তিনদিন আগেই স্থির হয়েছে। তাই ফ্লাইটের টিকিট পাব, কি, পাব না; ভালো এবং নিরাপদ লোকেশনে আমাদের হোটেল-বুকিং হবে তো! — এইসব নানান উদ্বেগের ওঠাপড়ায় উঠতে নামতে, নামতে উঠতে উঠতে যখন রওনা হওয়ার ভোরটা এসেই পড়ল, তখন যাবতীয় টেনশনকে গা ঝাড়া দিয়ে মাথা থেকে নামালাম সবার আগে। আর ঝটপট রেডি হওয়ার দিকেই মনটাকে দ্রুত পাঠালাম। তৈরি হচ্ছি,আর জানলার বাইরে সেদিনের আশ্বিনের ভোররাতটাকে দেখছি! আমাদের পুরো নিউটাউন এলাকা তখনো গভীর ঘুমে। ব্যাগপত্তর বেশিরভাগটাই আগের রাতে গুছিয়ে রাখা ছিল। শুধু ফিনিশিং প্যাকিং-টুকু ক্ষিপ্র হাতে মিটিয়ে, কলকাতা এয়ারপোর্টের দিকে এবার শুধু রওনা হওয়া! তখনো ঘুম ঘুম চোখে সদ্য আড়মোড়া ভাঙছে দেবীপক্ষের সকাল; আর হাওয়ায় কি আরামের এক শুচিকর্পূর শীতলতা!
এবার স্ট্রেইট উড়ান 'স্কটল্যান্ড অফ দ্য ইস্ট' — অভিমুখে।
শিলং আগেও একবার গেছিলাম — সেই কবে মধুচন্দ্রিমাযাপনে! সেবারের সফরে চেরাপুঞ্জির মেঘগুলোকে লুকিয়ে মন দিয়ে এসেছিলাম। এবারে মেয়ের হাত ধরে (এবারের ট্রিপে গৃহকর্তা সবিশেষ ব্যস্ত ছিলেন বলে সঙ্গে যাননি) সেই মেঘগুলোকেই যেন আবার দেখতে যাব! কিছুটা বা পরখ করতে, আমি তো ভুলিনি! ওরা-ও কি আমাকে একইভাবে মনে রেখেছে এতদিনের এই দীর্ঘ অদর্শনের পরেও!
আমাদের এবারের ফ্লাইট-টা ছিল সকাল আটটা পাঁচে। সেই মতো মা-মেয়ে খুব সিরিয়াসমুখে ডোমেস্টিক এয়ারলাইন্স বোর্ডিং ফর্মালিটিগুলো মেটালাম। তারপর এয়ারপোর্টের ফুড কোর্টে স্যান্ডউইচ আর কফি সহযোগে ঝটপট ব্রেকফাস্টটা মিটিয়ে নিয়েই বোর্ডিং গেট অভিমুখে দ্রুত পা চালালাম। হাঁটছিলাম না বোধহয়! উড়ছিলাম — এক স্বাধীন ভ্রমণের উল্লাসে। মনে একটানা বেজে চলেছে, "পঞ্ছি বনু উড়তা ফিরুঁ মস্ত গগন মে,/ আজ ম্যায় আজাদ হুঁ দুনিয়াকি চমন মে" — আর ফ্লাইটের নির্দিষ্ট আসনে পৌঁছে সেফটি বেল্টটিকেও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কষে বেঁধে নিয়েছি। মনের ভেতরে একটা অচিন রোমাঞ্চ! চোখদুটো দ্রুত ছুটে চলা আমাদের 'স্পাইস জেট' বায়ুযানের জানলার বাইরের ট্রোপোস্ফিয়ারীয় মেঘপুঞ্জে।
গুয়াহাটি বিমানবন্দরে পৌঁছে, লাগেজ-বেল্ট থেকে লাগেজ কালেক্ট করে, যখন এয়ারপোর্টের বাইরেটায় এসে পৌঁছেছি, তখন বেলা প্রায় দশটা, সোয়া দশটা মত। ট্রাভেল এজেন্সির পূর্ব নির্ধারিত ক্যাব যথাসময়ে আমাদের পিক আপ করে এবার এগিয়ে চলল শিলং পাহাড় অভিমুখে।
গুয়াহাটি থেকে শিলং যাবার পথে।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মোটামুটি ১,৯৬৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এই 'শিলং' নামের শৈলশহর হল উত্তর-পূর্ব ভারতের ক্ষুদ্রতম রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম, মেঘালয়ের রাজধানী। ইস্ট খাসি হিলস ডিস্ট্রিক্টের হেডকোয়ার্টার্স, এই শিলং শহর আক্ষরিক অর্থেই যেন পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের বাড়ি; যার চারিপাশে আজ-ও ব্রিটিশ কলোনিয়াল ভাইব্-টি খুব স্পষ্ট। বছর দশ পনেরো আগেও, যখন বিশ্ব উষ্ণায়নের করাল থাবা এত বিভৎস হয়ে ওঠেনি সারা পৃথিবী জুড়ে, সে সময়টায় এই হিল স্টেশনটিকে 'No-fan station' নামে গরব করে ডাকত ওখানকার স্থানীয় মানুষজন। কারণ জায়গাটা ভারি মনোরম এক শীতের আদর মেখে থাকত তখন সারাটা বছর। শুধু শিলং-ই নয়; গোটা মেঘালয় রাজ্যটাই যেন মেঘচাদরে ঢাকা থাকত সেসব দিনে। আর যখন তখন রিমঝিমিয়ে নামত আদুরে বৃষ্টিরাণী। শিলং সহ গোটা মেঘালয় তখন সবুজে সবুজে ছয়লাপ। কিন্তু নানাবিধ রাজনৈতিক ইশারায় পরবর্তীতে খাসি হিলসের বনভূমিতে ক্রমাগত এবং যথেচ্ছ বৃক্ষনিধন পর্ব শুরু হতে থাকে। একই সাথে ডিনামাইট দিয়ে খাসি পাহাড়টাকে দীর্ণ বিদীর্ণ করে গুঁড়িয়ে উড়িয়ে, হোটেল, রিসর্ট, রাস্তাঘাট, জমজমাট জনবসতিও গড়ে উঠতে থাকে খুবই অল্প সময়ের ব্যাবধানে। ফলে চিরপরিচিত সেই ঐশ্বরীয় সৌন্দর্যভূমি শিলং পাহাড়ের বুকে নেমে আসে সমূহ সর্বনাশের ভবিষ্যৎ। বড় আক্ষেপের সুরে কথাগুলো একটানা বলে গেল, আমাদের এবারের শিলং ট্রিপের গাড়িচালক অরুণজ্যোতি রাই। বড় মিশুক, ঝকঝকে আর চৌকস এক অসমিয়া যুবক, এই অরুণজ্যোতি। সে বাংলা বোঝে ভাল-ই। কিন্তু বলতে লজ্জা পায়। তাই আমাদের যাবতীয় গল্প বা কথোপকথন চলতে লাগল শুদ্ধ হিন্দিতে।
শিলং-এর হোটেল অবধি পৌঁছে দিতে দিতে অরুণজ্যোতি শুনিয়েছিল আরো অনেক তথ্য। ওঁর কাছ থেকেই জেনেছি, মেঘালয়ে কোন রেলপথ নেই। একমাত্র সড়ক পথেই গুয়াহাটি মারফত যা কিছু প্রয়োজনীয় 'সামান্' (সে ইট কাঠ বালি সিমেন্ট-ই হোক, কিংবা খাবারদাবার, ওষুধ যাকিছু অত্যাবশ্যকীয় কমোডিটি-ই হোক!) শিলং এবং মেঘালয়ের বাকি গ্রাম এবং জনপদে পৌঁছায়। 'শিলং' আসলে এক মালভূমি-শহর, যেটি আদতে দাক্ষিণাত্য মালভূমি থেকে একাধিক ভৌগোলিক কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া একটা 'আপল্যান্ড'-বিশেষ এবং গোটা পূর্ব ভারতের মধ্যে এই শিলং শহর-ই হল প্রাকৃতিকভাবে গঠিত সব চাইতে উঁচু ভূখণ্ড। সেভাবে দেখতে গেলে, শিলং নামের এই পার্বত্য শহরটি 'শিলং মালভূমি'র ঠিক মাঝ বরাবর গড়ে উঠেছে, যার চারিপাশে ছোট বড় নানান ঢেউখেলানো পাহাড়মালা। এদের মধ্যে Lum Sohpetbneng, Lum Diengiei আর Lum Shillong — এই তিনটে ছোট পাহাড় আবার 'খাসি' জনগোষ্ঠীর পরম্পরাগত ঐতিহ্যে বিশেষভাবে পূজিত। শিলং শহরটাকে ঘিরে এই যে ঢেউ-এর মত নানান আকৃতির পাহাড়, তার সাথে সাথে এখানকার শীতল জলবায়ু — এই সবটুকুর কারণে প্রাক-স্বাধীন ভারতের ব্রিটিশ- শাসকগোষ্ঠী এই 'শিলং' শহরে বেড়াতে এলে, শিলং-এর সঙ্গে তাদের 'স্কটল্যান্ড'-এর ভূমিরূপে সাজুয্য খুঁজে পেত। আর, সেই থেকে-ই শিলং পাহাড়ের ডাকনাম 'Scotland of the East'। ইতিহাস বলে, ডেভিড স্কট নামের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন সিভিল সার্ভেন্ট নর্থ ইস্ট ফ্রন্টেয়ার-এর তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল পদে ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি ছিলেন। প্রথম ইঙ্গ-বার্মীয় যুদ্ধকালে সিলেট এবং অসম রাজ্যের মধ্যে সংযোগসাধক একটি সড়কপথের বড় অভাব বোধ করে যখন ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী, তখন এই ডেভিড স্কট খাসি জনগোষ্ঠীর দলপতির সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে আলোচনায় বসেন এবং নিজের বুদ্ধিমত্তার গুণে ঈশ্বর জ্ঞানে পূজিত 'খাসি পাহাড়' চিরে নতুন রাস্তা বানানো নিয়ে খাসি-দের তীব্র বিরোধিতাকে সুকৌশলে সামলিয়ে দলপতির অনুমতি আদায় করতে সক্ষম হন। শেষপর্যন্ত খাসি এবং জয়ন্তিয়া পাহাড়দুটির বক্ষভেদ করে নির্মিত হয় নতুন রাস্তা, যেটি সিলেটের সঙ্গে অসম-কে এবং পরবর্তীতে ভারতের অন্যান্য প্রান্তগুলোকেও এক তারে বাঁধে যোগাযোগে, বাণিজ্যে। তখনো এই শিলং নামের পর্যটন নগরী গড়ে ওঠেনি। নবনির্মিত এই সড়কপথের কল্যাণে একটু একটু করে খাসি আর জয়ন্তিয়া হিলস্-এ বাড়তে থাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পদস্থ কর্মকর্তাদের সমাগম। দূরদর্শী ইংরেজজাতির উদ্যোগে ১৮২৯ সাল নাগাদ খাসি হিলে গড়ে ওঠে ব্রিটিশদের স্বাস্থ্যভ্রমণের নব-আবিস্কৃত ডেরা — শিলং হিল স্টেশন।
শিলং-এর পথে।
যেতে যেতে অরুণজ্যোতিকে প্রশ্ন করেছিলাম, 'শিলং' নামটির নেপথ্য কাহিনী কি? অরুণ জানায়, এর একাধিক কারণ। শিলং নামের জনপদ আসলে মেঘালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ 'শিলং পীক্'-এর ঠিক নীচেই গড়ে উঠেছে, যার থেকে জায়গাটার নাম হয় 'শিলং'। অন্য প্রবাদ অনুযায়ী, 'শিলং' নামটা এসেছে 'ইউ শিলং' নামের এক মহামানব থেকে, যিনি পুরাকালে জন্ম নেন 'লির' নামের এক কুমারী মায়ের গর্ভে। আজকের শিলং থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে 'বিস্সি' নামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে লির বসবাস করত। এক খুব সাধারণ সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে হঠাৎ করেই এই লির ভূমিষ্ঠ করে এক অপূর্বকান্তি জ্যোতির্ময় মৃত পুত্র সন্তানকে। অথচ লির-এর শারীরিক কুমারিত্ব তখনো অটুট — সে একদিনের জন্যেও সন্তানসম্ভবনার কোনোরকম লক্ষণ-ই ধরে নি নিজের শরীরে। ভীষণ অবাক লির অনন্যোপায় হয়ে, সেই সদ্যোজাত মৃত শিশুকে নিজের বাগানেই সমাধিস্থ করে। এরপর অনেকগুলো বছর পার হয়। একদিন গভীর রাতে লিরের ঘুম ভাঙে বাড়ির বাইরে জনতার কোলাহলে। দরজা খুলে লির দেখে, এক দীর্ঘদেহী সুদর্শন যুবা তার ঘরে প্রবেশ করে তার সামনে নতজানু হয়ে বসে বলছে, "মা, আমি তোমার সেই সন্তান, যাকে তুমি বাগানে সমাধিস্থ করেছিলে। তুমি আমার পার্থিব জননী। আমি তোমার স্বয়ম্ভূ সন্তান। আমি এসেছি সাম্য আর শান্তির গণতন্ত্র গঠন করব বলে — মানুষকে ন্যায়ের পথে চালিত করব বলে"। কথিত আছে, এই 'ইউ শিলং'-এর হাতেই শিলং পরবর্তীতে একটি ধর্মরাজ্যে পরিণত হয়। অঞ্চলটি সুখে, শান্তিতে এবং সমৃদ্ধিতে ভরে ওঠে। — মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিলাম শিলং-এর নেপথ্যের ইতিহাস। কথায় কথায় কখন আমাদের ক্যাব এসে পৌঁছেছে 'উমিয়াম লেক'-এর প্রবেশদ্বারে, খেয়াল করিনি। এবার মনের সুখে 'উমিয়াম লেক' ঘুরে দেখব আমি আর আমার মেয়ে। তারপর পৌঁছব আমাদের হোটেল 'শিলং অ্যাড্রেস'-এ।
(ক্রমশ)