অনেকদিন আগের কথা। আমি তখন পাঁচ-ছয় বছরের শিশু মাত্র। বাবার কাছে অনেক ডাকাতের গল্প শুনেছি। বাবা ছিলেন চুঁচুড়ার জেলা আদালতের জুরি। তখনও এদেশে জুরির বিচার ছিল।
কিন্তু এখানে যাদের কথা বলব তাদের আমি চোখে দেখেছি। যুগল হাড়ি এবং তার দু-ভাই সুবল ও বাদল এরা তখন আমাদের অঞ্চলে কুখ্যাত ডাকাত।
তাদের ভয়ে শিশুরা মায়ের গলা জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। মুখে মুখে তাদের ডাকাতির রোমহর্ষক কাহিনি ফিরত।
বাবার কাছে শুনেছি, যুগল ছিল স্বদেশি ডাকাত। জেলও খেটেছে অনেকবার। দেশ স্বাধীন হবার পরও তার সেই স্বভাব রয়ে গেছে। তার সাগরেদ হয়েছে কনিষ্ঠ দু-ভাই, সুবল ও যুগল।
তবে তারা সাধারণ গৃহস্থ বাড়িতে ডাকাতি করত না। কুখ্যাত মহাজন যারা গরিব মানুষের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে তাদের গহনাগাটি ভিটে মাটি সামান্য অর্থের বিনিময়ে অপহরণ করত, তাদেরই বাড়িতে তারা ডাকাতি করত। তারপর সেই ডাকাতির অর্থে কোনো কন্যাদায়গ্রস্ত গরিব পিতার মেয়ের বিয়ে দিত। রোগ-ব্যাধি, আপদ-বিপদে মানুষকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করত।
তাই আমাদের অঞ্চলে গরিব মানুষের কাছে তারা বৃন্দাবনের বিপত্তারণ রাখাল রাজার মর্যাদা পেত।
কোচবিহারের মহারাণী সুনীতি দেবী রচিত 'Bengal Decoits and Tigers' বইয়ের 'A Child's Experience' গল্প থেকে নেওয়া গৃহস্থ বাড়িতে একটি ডাকাতির ঘটনার ছবি।
আগেই বলেছি, তখন আমি বছর পাঁচেকের শিশু মাত্র। মায়ের সঙ্গে মামাবাড়ি থেকে ফিরছি। চাউলি-গম্ভীরনগরে আমার মামার বাড়ি। বৈশাখ মাস। রোদ একটু পড়তে, বিকেলে বের হয়েছি আমরা। ঝুমি নদীর পাড় ধরে, বাঁধা রাস্তা দিয়ে আসছি। কখন বায়ুকোণে কালবৈশাখী মেঘ জমেছে তা আমরা খেয়াল করিনি। সন্ধে হয় হয়, আমরা সবে খাসবাড়ের নদী পার হয়েছি, ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল। সঙ্গে সঙ্গে প্রবল ঝড় বৃষ্টি। আমরা ভিজে একশা হয়ে একটি চালাঘরে মাথা গুঁজলাম।
বৃষ্টি আর থামেই না। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। টিপ্ টিপ্ বৃষ্টি পড়ছে। মা আমার হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে চালা থেকে বের হল। সেখান থেকে আমাদের বাড়ি, বসন্তবাটি, দু-কিলোমিটারের বেশি পথ। হঠাৎ আমাদের চোখে তীব্র টর্চের আলো পড়ল। আমরা থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম।
আমাদের সামনে যমদূতের মতো দাঁড়িয়ে তিনজন লোক। আমি ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। কাঁদার সাহসটুকুও নেই।
হঠাৎ তাদের একজন বলল, "মা-ঠাকরন তুমি! বাপের ঘর গেছিলে বুঝি"?
মায়ের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে সেই যমদূত বলল, "ভয় পেও-নি মা-গো, আমি সুবল ডাকাত"। তারপর আরও দু-জন যমদূত মা'কে প্রণাম করল।
তারপর তাদের মধ্যে একজন আমাকে ঝপ্ করে কাঁধে তুলে নিয়েই দে-ছুট্।
আমি ভয়ে কাট হয়ে গেছি। চিৎকার করে কাঁদতে চাইছি, কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না।
তারপর বোধহয় জ্ঞান ছিল না। যখন জ্ঞান হলো তখন আমি আমাদের বাড়িতে, বাবার কোলে।
কিছুক্ষণ পরে আমার মা সুবল ডাকাতের সঙ্গে গুটি গুটি পায়ে এসে পৌঁছলো।
বাবাকে গড় হয়ে প্রণাম করে সুবল বলল, "ছোটোবাবু খুব ভয় পেয়েছে বুঝি"?
তারপর সে চকিতে বিদায় নিল।
আজ যখন টিভিতে নেতা মন্ত্রীদের চুরি-ডাকাতি-রাহাজানির রোমহর্ষক দৃশ্য দেখি তখন সুবল ডাকাতের কথা মনে পড়ে।
তফাৎটা চোখে পড়ে। সেদিনের ডাকাতদেরও একটি নীতি ছিল, কিছু মূল্যবোধ ছিল - যা এখনকার শিক্ষিত নেতা মন্ত্রীদের মধ্যে অমিল।
লেখক: চিকিৎসক, কবি ও গল্পকার, সাংস্কৃতিক সংগঠক।