গল্প

কে বা কারা যেন...



প্রদীপ্ত সামন্ত


পিসির বাড়ি। বেশ কয়েক মাস হল পিসেমশাই মারা গেছেন। রোড অ্যাক্সিডেন্টে। তারপর থেকে পিসিরা খড়্গপুরের কোয়াটার্স ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে। পিসিরা বলতে পিসি আর তার ন'বছরের মেয়ে তিন্নি। ক্লাস ফোর-এ পড়ে। আমি ক্লাস সেভেন-এ। আমার থেকে তিন বছরের ছোট। আমরা পিঠোপিঠি হওয়ায় দুজনের মধ্যে যেমন মিল, তেমনি ঝগড়া মারপিট। পিসি পিসেমশাই দুজনেই আমাকে খুব ভালোবাসে। ছুটি পড়লেই আমার যাওয়ার ঠিকানা তিন্নিদের খড়্গপুরের কোয়াটার্স। বেশ খোলামেলা, সামনে মাঠ, দোকান, ঘরগুলোও বেশ বড় বড়। দু'চারদিনের ছুটি কখন যে কেটে যেত বুঝতেই পারতাম না। পিসেমশাই মারা যাওয়ার পর এই প্রথম বাবা-মায়ের সঙ্গে মাঠঘাট পেরিয়ে ওদের গ্রামের মাটির বাড়িতে এলাম। বেশ মোটা দেওয়াল, অন্ধকার, ঘুপচি।আলো বলতে জানালা দরজা খুলে দিলে একটু আসে আর কি! না হলে একশো পাওয়ারের বাল্ব।

আসার পর থেকে তিন্নি আমার সঙ্গ আর ছাড়ে না। গল্পগুজব, নানারকম খেলার মাঝে পিসেমশাইয়ের কথা প্রায়ই উঠে এসেছে। হরেকপদ দিয়ে খাওয়া দাওয়ার পর তিন্নির বায়নাতেই আমি আর তিন্নি একটা খাটে শুলাম। পাশের ঘরে আর সবাই। গভীর রাত। খাটে এপাশ-ওপাশ করছিলাম। হঠাৎ যেন মেঝে থেকে উঠে এলো আওয়াজটা, "ক্যাঁচর ক্যাঁচ..."। নতুন জায়গা, ঘুম আসছিল না। সারাদিন পিসেমশাইয়ের কথা শুনতে শুনতে তাঁর মুখটা প্রায়ই ভেসে আসছিল। আধোঘুমে হঠাৎ দেখলাম দুড়দাড় শব্দে কি বা কারা যেন মেঝের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছোটাছুটি করছে। আমিও ভয়ে জড়োসড় হয়ে খাটে এপাশ ওপাশ করছি - আর ততই ক্যাঁচর ক্যাঁচ শব্দটা আরও জোরালো থেকে জোরালোতর হচ্ছে। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি কারা যেন আলোর লন্ঠন হাতে ঘরে ঢুকছে আর বেরুচ্ছে। যেন কত দূরের জগতে পৌঁছে গেছি। সব প্রাণী যেন কত ছোট ছোট! গায়ে তাদের ছোট ছোট সাদা কাপড়। ভয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত। গলা শুকিয়ে আসছে...। অবস্থাকে বাগ মানাতে উপুড় হয়ে বালিশে মুখ চেপে ধরলুম। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়ালও নেই।

সকালে তিন্নির ঠেলায় ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে দেখি পা'টা আর নাড়াতে পারছি না। বেশ ফুলে গেছে। তিন্নি জিজ্ঞেস করে - "অনিদা, তোমার কি হয়েছিল? তুমি ঘুমের ঘোরে কেমন বিড়বিড় করছিলে আর হাত পা ছুঁড়ছিলে"?

"না, কিছু হয়নি তো"! বলতে তিন্নি আমাকে আরও প্রশ্নবাণে বিব্রত করায় আমি কালকের রাতের সব ঘটনা খুলে বললাম। তিন্নি পাক্কা গিন্নির মত বলল - "হুঁম"! বাবা মারা যাওয়ার এই ক'দিনে তিন্নি বেশ পরিণত হয়ে গিয়েছে। ছেলেমানুষিটুকুও নেই। বলল - "অনিদা সবই তোমার ভ্রম; চোখের ভুল - কি স্বপ্ন দেখতে কি স্বপ্ন দেখেছো! আমাদের এই গ্রামের বাড়িতে প্রচুর নেংটি, ধেড়ে ইঁদুরের উৎপাত। আর রাতে জানালা খোলা থাকলে জোনাকিরা সব ঢুকে পড়ে"। সাথে পিসিও তিন্নির কথায় সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়লে আমি থেমে গেলাম। কিন্তু ঘোর গেল না। বহুদিন পর্যন্ত এর ঘোর ছিল। ইঁদুর আর জোনাকির দোহাই দিয়ে সেদিন বিষয়টা এড়িয়ে গেলেও আমি জানি বিষয়টা কিন্তু আদপেই ওরকম ছিল না।

পরিচিতি: কবি ও প্রাবন্ধিক, বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত।