মধ্যপ্রদেশ থেকে সংগৃহীত অপ্সরার ১২ শতকের বেলেপাথরের মূর্তি। এটি বর্তমানে নিউ ইয়র্ক শহর স্থিত 'মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্ট'-এ সংরক্ষিত রয়েছে।
বর্গা ছিল স্বর্গের এক অপ্সরা এবং ধনপতি কুবেরের প্রেয়সী। একদিন সে তার চার সহচরী সৌরভেয়ৈ, সমীচী, বুদ্বুদা ও লতার সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্রের ভবনে গিয়েছিল। আকাশপথে ফেরার সময় তারা অধ্যয়নরত পরম রূপবান নির্জনবিহারী এক ব্রাহ্মণকে দেখতে পেল। তাঁর তেজ ও তপস্যার প্রভাবে সমস্ত বনাঞ্চল যেন আলোকিত হয়ে উঠেছিল। ওই রূপবান তপস্বী ব্রাহ্মণকে দেখে তাদের মনে দুষ্টবুদ্ধি জাগল। তারা ওই ব্রাহ্মণের তপস্যায় বিঘ্ন সৃষ্টি করার জন্য সেখানে অবতীর্ণ হল। তারা নাচ-গান হাসি-ঠাট্টা ইত্যাদির সাহায্যে ওই তপস্বীকে প্রলোভিত করার চেষ্টা করল, কিন্তু তিনি কোনও কিছুতেই ভ্রূক্ষেপ না করে, ধ্যানমগ্ন রইলেন। ওই পাঁচ অপ্সরা নানা ভাবভঙ্গী দেখিয়ে ব্রাহ্মণের অন্তরে কামের সঞ্চার করতে চেষ্টা করল, কিন্তু তিনি বিচলিত তো হলেনই না, উপরন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বর্গা প্রভৃতি ওই পাঁচ অপ্সরাকে অভিশাপ দিলেন যে তারা কুমিরের রূপ-ধারণ করে জলে বাস করবে।
অভিশাপগ্রস্ত ও দুঃখিত অপ্সরাগণ রূপ, যৌবন ও কামমদে মত্ত হয়ে ব্রাহ্মণের কাছে যে অপরাধ করেছিল, তার জন্য তাঁর শরণাপন্ন হয়ে ক্ষমা চাইল। ব্রাহ্মণ তো মহাত্মা ও ধার্মিক, অতএব তিনি নিশ্চয়ই জানেন, শ্রীলোকেরা অবধ্যা, তাদের প্রতিহিংসা করে কি তাঁর স্বধর্মপালন হবে? তারা বলল, ব্রাহ্মণই সর্বজীবের বন্ধু (সর্বভূতেষু মৈত্রো ব্রাহ্মণ উচ্যতে), একথা যেন নিতান্ত অমূলক না হয়। শরণাগতকে আশ্রয়দান করাই তো সাধুদের কাজ, সেইজন্য তারাও তাঁর শরণাপন্ন হয়ে ক্ষমা চাইল। তারা বলল,
"ব্রাহ্মণেরা শান্তশীল সর্বশাস্ত্রে জানি।
দয়ায় শাপান্ত অবজ্ঞা কর মহামুনি৷৷"
(কাশীরাম দাস)
সুন্দরী নারীদের স্তুতিবাক্যে কে না প্রসন্ন হয়? ব্রাহ্মণও অপ্সরাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে অভিশাপের potency-টা একটু কমিয়ে দিলেন। তিনি বললেন জলের মধ্যে কুমিররূপে বাস করার সময় যদি তারা কোনও ব্যক্তির পা ধরে টানে এবং যদি সেই ব্যক্তি তাদের টেনে জল থেকে তুলতে পারে, তাহলে তারা আবার তাদের নিজরূপ ফিরে পাবে।
আর তারা যে তীর্থে বাস করবে, তখন থেকে তা পবিত্র নারীতীর্থ বলে লোকমুখে বিখ্যাত হবে। তারা ব্রাহ্মণকে সম্মান জানিয়ে প্রণাম করে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ও দুঃখিত চিত্তে ভাবতে লাগল কবে কোন মহাত্মা তাদের স্থলে আকর্ষণ করে তাদের পূর্বরূপ ফিরিয়ে দেবেন। তারা এই ব্যাপারে চিন্তা করছিল, এমন সময় তারা দেবর্ষি নারদের সাক্ষাৎ পেল। দেবর্ষিকে দেখামাত্র তারা তাঁকে অভিবাদন করে লজ্জানম্রমুখে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে রইল। নারদ তাদের দুঃখের কারণ জিজ্ঞাসা করলে বর্গা প্রভৃতি অপ্সরাগণ আদ্যোপান্ত সমস্ত ব্যাপার নিবেদন করল।
সব শুনে নারদ একটা সুব্যবস্থা করে দিলেন। কাশীরাম দাসের ভাষায় নারদের উক্তি:
"নারদ বলেন নাহি হইও বিমন।
পঞ্চতীর্থে গ্রাহরূপে থাক পঞ্চজন ৷৷
তীর্থযাত্রা হেতু যে আসিবে ধনঞ্জয়।
তাহার পরশে মুক্ত হইবে নিশ্চয়।"
দক্ষিণ মহাসাগরের কচ্ছদেশে পঞ্চতীর্থ নামে যে পবিত্র ও রমণীয় স্থান আছে, ওইখানে গিয়ে নারদ তাদের বাস করতে বললেন এবং আশ্বাস দিলেন এক সময় তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন ওখানে গিয়ে তাদের দুঃখমোচন করবেন। তখন থেকে ওই পাঁচজন অপ্সরা প্রত্যেকে এক একজন করে সৌভদ্র, অগস্ত্য, পৌলোম, কারন্ধম ও ভারদ্বাজ - এই পঞ্চতীর্থে জলমধ্যে বাস করতে লাগল।
এদিকে অর্জুন তো নিতান্ত নিরুপায় হয়ে তাঁদের পঞ্চপান্ডবের পত্নী দ্রৌপদীর সঙ্গলাভ সংক্রান্ত যে বিধি তাঁরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে প্রবর্তিত করেছিলেন, সেই বিধি ভঙ্গ করে বারো বৎসরের জন্য বনবাস যাত্রা করলেন। আগেই গন্ধর্বরাজ অঙ্গারপর্ণের কাছে অর্জুন জেনেছিলেন যে কোনও উদ্দেশ্যে কোথাও যেতে হলে সঙ্গে ব্রাহ্মণ রাখতে হবে। তাই তাঁর বনগমনের সময়ে বেদ, বেদাঙ্গ ও অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রবিদ্ ব্রাহ্মণগণ, সূতগণ, কথকগণ ও বনবাসী সন্ন্যাসীসমূহ তাঁর অনুগমন করলেন। ওই সব মহাত্মাগণ পরিবৃত হয়ে অর্জুন নানা রমণীয় অরণ্য, নদী ও বিভিন্ন দেশস্থ পুণ্যতীর্থ সকল দর্শন করতে লাগলেন। সমগ্র মহাভারতে তীর্থপর্যটনের অনেক বিবরণই আছে। বনপর্বে দেখি, ধার্মিকশ্রেষ্ঠ মহাত্মা ভীষ্ম পিতৃকৃত্য করার জন্য মুনিগণের সঙ্গে হরিদ্বারে গিয়েছিলেন এবং বেদবিধি অনুসারে দেব, ঋষি ও পিতৃগণের তর্পণ করে ওই স্থানে কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। তারপর তিনি ঋষিশ্রেষ্ঠ পুলস্ত্যের পরামর্শানুসারে অন্যান্য তীর্থসকল পর্যটন করেছিলেন। ওই বনপর্বেই দেখা যায়, অর্জুন যখন অস্ত্রলাভের আকাঙ্ক্ষায় ইন্দ্রলোকে গিয়েছিলেন, সেই সময় অর্জুনবিহীন হয়ে বাকি চারজন পাণ্ডব ও দ্রৌপদীর কাম্যকরণে বাস বেশ নিরানন্দ হয়ে উঠেছিল। তখন তাঁদের কুলপুরোহিত ধৌম্যের পরামর্শে তাঁরা তীর্থযাত্রায় বের হবেন বলে স্থির করলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা লোমশ ঋষির তত্ত্বাবধানে ভারতবর্ষের তাবৎ তীর্থস্থল পরিভ্রমণ করেছিলেন। উদ্যোগপর্বে দেখা যায় কৃষ্ণের অগ্রজ বলরাম কৌরব-পাণ্ডবের আসন্ন যুদ্ধে উভয়পক্ষের কোনও পক্ষই অবলম্বন না করার বাসনা করে ঋত্বিক, অন্যান্য ব্রাহ্মণ ও আরও সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বিয়াল্লিশ দিন তীর্থ পর্যটন করেছিলেন। এই তীর্থভ্রমণ সংক্রান্ত সমস্ত রচনাই ব্রাহ্মণ্য রচনা।
বেনারসের এক মন্দিরে অপ্সরাদের মূর্তি, ১৯১৩।
অর্জুনের কথায় ফিরে আসি। তিনিও তাঁর পিতামহ ভীষ্মের মতোই প্রথমে গেলেন হরিদ্বারে। সেখানে অর্জুন যখন বাস করছিলেন, সেই সময় তাঁর সঙ্গে আগত ব্রাহ্মণগণ স্থানে স্থানে অগ্নিহোত্র আরম্ভ করলেন। একদিন অর্জুন স্নান ও পিতামহগণের তর্পণ করার জন্য গঙ্গায় নেমেছিলেন এবং অগ্নিকার্য করার জন্য যেমনি তিনি জল থেকে উঠতে যাচ্ছেন, অমনি নাগরাজকন্যা উলূপী তাঁকে জলমধ্যে আকর্ষণ করে নাগরাজভবনে নিয়ে গেল। সেখানে অর্জুন নাগরাজকন্যার বাসনা চরিতার্থ করার জন্য তাঁকে বিবাহ করে তাঁর সঙ্গে এক রাত্রি যাপন করলেন এবং পরদিন উলূপী নিজেই তাঁকে হরিদ্বারে ফিরিয়ে এনেছিলেন। তখন উলূপী অর্জুনকে বরও দিয়েছিলেন যে সমস্ত জলচর প্রাণীই তাঁর অধীন থাকবে। তারপর তিনি বশিষ্ঠ পর্বত, ভৃগুতুঙ্গ, গয়া প্রভৃতি পুণ্যতীর্থ পর্যটন করলেন এবং ব্রাহ্মণদের প্রচুর গোরু দান করলেন। এইভাবে নানা দেশ পর্যটন করে যখন তিনি কলিঙ্গে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন, সেই সময় তাঁর সঙ্গী ব্রাহ্মণগণ ফিরে গেলেন। অর্জন কলিঙ্গের নানা তীর্থ দর্শন করে মহেন্দ্র পর্বত হয়ে সমুদ্রের ধার দিয়ে চলতে চলতে মণিপুরে গেলেন। সেখানে মণিপুর-রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে বিবাহ করে তিন বৎসর বাস করলেন।
তারপর অর্জুন সেখান থেকে দক্ষিণসাগরে পঞ্চতীর্থে গমন করলেন। ওই পঞ্চতীর্থে আসে প্রচুর তপস্বীর সমাগম হত, কিন্তু অর্জুন যখন গেলেন, তখন সেই সমস্ত তীর্থ প্রায় জনশূন্য। সেই তীর্থসমূহের মুনিঋষিরা সমুদ্রে স্নান করতেন না। অর্জুন জিজ্ঞাসা করে জানলেন যে সেখানকার জলে বড় বড় কুমির আছে, জলে কেউ নামলেই তারা মেরে খেয়ে ফেলে। তপস্বীরা বাধাপ্রদান করলেও অর্জন সৌভদ্রতীর্থে গিয়ে জলে নেমে স্নান করতে লাগলেন। যথারীতি এক ভয়ঙ্কর কুমির এসে তাঁর পায়ে কামড় দিল।
কাশীরাম দাসের ভাষায়:
"সৌভদ্র নামেতে তীর্থ পশি ধনঞ্জয়।
স্নান করিলেন বীর নিঃশঙ্ক হৃদয়।।
শব্দ শুনি কুম্ভীরিণী আইল নিকটে।
অর্জুনের পায়ে ধরে দশন বিকটে।।"
অর্জুন সেই কুমিরকে বলপূর্বক টেনে ডাঙায় তুললেন। উলূপীর বর খুব কাজে লেগে গেল। কিন্তু তখনই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। সেই কুমির তৎক্ষণাৎ এক সুন্দরী অপ্সরাতে পরিণত হল। ওই অপ্সরাই হল বর্গা। বর্গার অনুরোধে অর্জুন অগস্ত্য, পৌলোম, কারন্ধম ও ভারদ্বাজ তীর্থে গিয়ে বাকি চার অপ্সরাকেও শাপমুক্ত করে দিলেন। তারা জল থেকে উঠে পূর্বের চেহারা ফিরে পেয়ে শোভা পেতে লাগল। এইভাবে অর্জুনের চেষ্টায় ওই পঞ্চতীর্থই ভয়শূন্য হয়ে গেল।
যৌবনমদমত্তা অপ্সরাগণ একান্তচারী অধ্যয়নরত ব্রাহ্মণের বিরক্তি উৎপাদন করে শাপগ্রস্তা হয়েছিল এবং আবার তাঁরই দয়ায় তারা শাপ থেকে মুক্ত হতে পেরেছিল। এখানে এই শিক্ষাই পাওয়া গেল যে ব্রাহ্মণ সর্বজীবের বন্ধু এবং শরণাগতকে রক্ষা করার চেয়ে আর বড় ধর্ম নেই। আরও জানা গেল যে প্রাচীন ভারতে তীর্থ-পর্যটনে বা যে কোনও শুভকাজে কোথাও যেতে গেলে সঙ্গে শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ রাখতে হত এবং তাঁরাই পুণ্যকামীকে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করতেন।
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।
লেখক পরিচিতি: জন্ম হুগলি জেলার অন্তর্গত, রাজবলহাটের সন্নিকটস্থ মুকুন্দপুর গ্রামে। প্রথম জীবনে প্রবল দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে মেধাবী ছাত্র হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে শিক্ষকতা জীবনের শুরু। উচ্চতর বিদ্যার্জন চলতে থাকে তারই সঙ্গে। হাওড়া জিলা স্কুল, হুগলি কলিজিয়েট স্কুল ও উত্তরপাড়া গভর্নমেন্ট স্কুলে শিক্ষকতা ও প্রধান শিক্ষকতা করে অবসর গ্রহণ করেছেন। ইংরেজি, বাংলা এবং সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেন। দর্শনশাস্ত্র, মনস্তত্ত্ব ও ইতিহাসেও কিঞ্চিৎ ব্যুৎপত্তি আছে। সৎসাহিত্য ও সংবাদপত্র পাঠ, উদ্যানচর্চা ও ভ্রমণ প্রিয় শখ।