বিবিধ

অধরা মাধুরী



সুমিতা চৌধুরী


রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র ও বহুমুখী প্রতিভার মধ্যে তাঁর গান নিয়ে লিখতে বসে দশ বছর পিছিয়ে গেলাম। কয়েকদিন আগে বাবা চলে গেছেন। কিচ্ছু ভালো লাগে না, এক গভীর শূন্যতায় ডুবে থাকি অহরহ। মনের মধ্যে বেজে যায়, "সে চলে গেল, বলে গেল না -/ সে কোথায় গেল ফিরে এল না।" মৃত্যুর আগে এই গানটাই বাবা বারবার শুনতেন, "আমার প্রাণের 'পরে চলে গেল কে..."। মনে মনে ভাবতাম, আজ যা অমোঘ সত্য, কাল কি অবহেলায় তা গভীর অতলে হারিয়ে যায়! আবার ভাবি, অন্তহীন এই আসা যাওয়ার মধ্যে, পুরোটাই কি চলে যাওয়া যায়? কিছু রেশ তো তার থেকেই যায়, যে অহরহ মধুর ধ্বনি বাজিয়ে হৃদয় কমল বনে কিছুটা হলেও ছুঁয়ে থাকে।

আমি রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ নই, এটুকু বুঝি, সুর আর কথার অসামান্য ম্যাজিকে তিনি যা সৃষ্টি করে গেছেন, তা বুঝতে গেলে এক জন্ম যথেষ্ট নয়। সীমার মাঝে তাঁর যে এই বারবার অসীমকে জানার চেষ্টা, সেইজন্যই বোধহয় তাঁর গান সুখ-দুঃখের সীমানা ছাড়িয়ে আমাদের নিয়ে যায় এক অমৃতলোকে।

আমি আমার মতো করে রবীন্দ্রনাথকে বুঝি, আমার মনে হয় প্রত্যেকেই তাই। আর এক্ষেত্রে আমার উপলব্ধি, আমার জীবনের সব মুহূর্তকে সঙ্গী করে যে বিপুল গানের ডালি তিনি সাজিয়ে গেছেন, তা শুধু গান নয়, আমাদের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার এক দিকনির্দেশও বটে। তাই তো তিনি লেখেন, "যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি বিশ্বতানে/ মিলাব তাই জীবনগানে।" - জীবন দেবতার পায়ে নিজেকে উৎসর্গ করার এই আকুতিই যেন হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে এসে পথের গন্তব্য নির্দেশ করে। আর এখানে এসে আমার মনে হয়, কোথাও গিয়ে 'গীতবিতান' আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ 'গীতা'র সাথে একাত্ম হয়ে গেছে। "আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ..." বা "বিপদে মোরে রক্ষা কর" অথবা "পাদপ্রান্তে রাখ' সেবকে" এই গানগুলো তো গীতার শ্লোকেরই নির্যাস! তাই 'গীতবিতান'-এর গান নিছক গান হয়ে থাকে না, এ এক অমোঘ শক্তি, যা সমস্ত তুচ্ছতা, ক্ষুদ্রতার সীমা অতিক্রম করে আমাদের নিয়ে যায় এক অপার আনন্দলোকে আর এই গান আমাদের দৈনন্দিন যাপনের সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে তা বুঝতে সংসারের ঊর্দ্ধে ওঠার দরকার হয় না।

বলতে দ্বিধা নেই, যত বয়স বাড়ছে, যত অনিবার্যতার দিকে এগোচ্ছি, মনে হচ্ছে এই জানা কোনওদিন ফুরোবে না। যে গান বহুবার গেয়েছি, শুনেছি নিজের মতো করে অর্থ অনুধাবন করেছি, আজ সেই সব গানই অন্য রকম ব্যঞ্জনা নিয়ে আসে। মনে হয় - এ তো আমারই গান! এই গানই তো আমার যাত্রাপথে ছড়িয়ে ছিল। বস্তুত 'গীতবিতান'-এর পাতায় পাতায় তো জীবনেরই গান। আমি শুধু সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে তা খুঁজে নিতে পারিনি।

শুরু করেছিলাম বাবার মৃত্যুর পরবর্তী আমার মনের অস্থিরতা নিয়ে। সে সময় ঘরে সব সময় বাজত তাঁর গান। আস্তে আস্তে গভীর ক্ষতে প্রলেপ পড়ছিল। গহীন অন্ধকার থেকে বিচ্ছেদ কাতর মনকে আলোর স্পর্শে সজীব করে তুলেছিলেন তিনি। সেই ছন্দময়, গীতিময় কথার ঐশ্বর্যে মন শান্ত হয়েছিল। সত্যিই তো, দিন সকলেরই একদিন ফুরোবে, ক্ষীণ আলোয় ক্লান্ত পথ চলাও একদিন থেমে যাবে। কিন্তু অনন্ত আনন্দধারা তো নিরন্তর বহমানই থাকবে! ঝরা ফুলের মধ্যে থেকেও নতুন কুঁড়ি আলোর ধারায় স্নাত হয়ে আরও সজীব হয়ে উঠবে! তরঙ্গ মিলিয়ে যাবে, আবার নতুন তরঙ্গ উঠবে... কিন্তু পৃথিবীতে প্রাণের স্পন্দন যতদিন থাকবে, জীবনের সব মুহূর্তকে সাথে নিয়ে তিনি এভাবেই আমাদের মধ্যে প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন।

অঙ্কনশিল্পীঃ মনীষ দেব

লেখিকা: কলকাতার নিউটাউনবাসী, বর্তমানে হোম-মেকার। বিবিধ বিষয় নিয়ে লেখালেখি, গান, কবিতা আবৃত্তি করতে ভালোবাসেন। আর ভালোবাসেন দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে, বিভিন্ন দেশের মানুষের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে।