বিশ্ব সাথে যোগে যেথায় বিহারো
মেয়েটি যেন রবি ঠাকুরের কল্পনার সেই 'বসুধা'রই কন্যা, সংকীর্ণ জাতি ধর্মের প্রাচীর যে বসুধাকে খণ্ড ক্ষুদ্র করে রাখেনি।
জন্মসূত্রে তাঁর বাবা, দীপক পাণ্ড্য, ভারতীয় বংশোদ্ভূত। গুজরাটের মেহসানা অঞ্চলের ঝুলাসানে তাঁদের আদি বাসস্থান। তাঁর মা, বনি জালোকর, পূর্ব ইয়োরোপের স্লোভেনিয়ার মেয়ে। দীপক ও বনির তিন সন্তান জয়, দীনা ও সুনীতার জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে। তিন মহাদেশ জুড়ে ব্যাপ্ত তাঁর অস্তিত্ব, যেখানে জাতি ধর্ম 'এক দেহে হল লীন'। তাই তিনি মহাকাশে পাড়ি দেন ভগবদ্গীতা, গণেশ মূর্তি ও ভারতীয় সামোসার সঙ্গে স্লোভেনিয় পতাকা ও সসেজ নিয়ে।
আপন হতে বাহির হয়ে
১৯৬৫ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর পাণ্ড্য দম্পতির তৃতীয় সন্তান সুনীতার জন্ম ওহায়োর ইউক্লিড শহরে। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী সুনীতার ভালো লাগে বিজ্ঞান। ভালোবাসেন পশুপাখিও। তাই তিনি স্বপ্ন দেখেন বড় হয়ে পশু-চিকিৎসক হওয়ার। দাদা জয় যোগ দিয়েছিলেন আমেরিকার নৌসেনায়। একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে মত বদলে ফেললেন সুনীতা। সেনাবাহিনীর অনুশীলন ও দুঃসাহসিক জীবনে আকৃষ্ট হয়ে স্থির করে ফেললেন যোগ দেবেন সেনাবাহিনীতে। ১৯৮৭-তে US Naval Academy-র স্নাতক হন। Naval Aviator হিসেবে দক্ষতা অর্জন করেন। ১৯৮৮-তে বিবাহ করেন সতীর্থ মাইকেল উইলিয়ামসকে।
আমি সুদূরের পিয়াসী
হেলিকপ্টার পাইলট (Naval Aviator) হিসেবে আমেরিকান সেনার একাধিক মিশনে গেছেন। সেই অভিজ্ঞতা, কষ্টসহিষ্ণুতা, অদম্য মনোবল ও পরিচালন ক্ষমতাকে পাথেয় করে শুরু হল তাঁর নতুন পথ চলা। ১৯৯৮-তে নভশ্চর হওয়ার লক্ষ্যে যোগ দিলেন [National Aeronautics and Space Administration (NASA)] ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা)-এ। কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করলেন মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার জন্য।
[International Space Station (ISS)] ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (আইএসএস) মানবসভ্যতার সব থেকে ব্যয়বহুল নিরীক্ষা। গত ২৫ বছর সব সময়েই সেখানে কোনো না কোনো মহাকাশবিজ্ঞানী উপস্থিত থেকেছেন। তাঁদের মহাশূন্যে যাতায়াত বা expedition-গুলির নির্ধারিত নম্বর থাকে। সেরকম তিন তিনটি মহাকাশযাত্রার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন সুনীতা উইলিয়ামস!
Expedition 14/15: ২০০৬-এর ৯ই ডিসেম্বর থেকে ২২শে জুন, ১৯৫ দিন কাটে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (আইএসএস)-এ। তখন তিনি Flight Engineer। সেখানে থেকে গবেষণা চালিয়েছেন, সরবরাহ করেছেন মহাকাশ সংক্রান্ত অগণিত বৈজ্ঞানিক তথ্য। চারটি spacewalk-এ কাটিয়েছেন ২৯ ঘন্টা ১৭ মিনিট। ট্রেডমিলে ম্যারাথন দৌড়ের রেকর্ড গড়েছেন, ভূপৃষ্ঠে তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়েছেন দিদি দীনা।
Expedition 32/33: ২০১২-এ দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন। এবারে তাঁর ওপর আইএসএস পরিচালনার দায়িত্ব বর্তায়। ১৪ই জুলাই থেকে ১৮ই নভেম্বর মোট ১২৭ দিন কাটে আইএসএস-এ। এবারও তিনটে spacewalk। ISS-এর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন, সঙ্গে চলে গবেষণা, শরীরচর্চা।
আকাশেতে বেড়িয়ে তারাদের এড়িয়ে
Expedition 71/72: ২০২৪-এর ৫ই জুন যখন তাঁর তৃতীয় যাত্রা শুরু হল, তার মেয়াদ হওয়ার কথা ছিল মাত্র ৮ দিন। কিন্তু হিলিয়ম লিক ও অন্যান্য যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তা হয়ে দাঁড়ায় ৯ মাসেরও বেশি (২৮৬ দিন)। পৃথিবীর থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরে, প্রায় মাধ্যাকর্ষণ শূন্য এক ভাসমান স্পেস স্টেশনে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটল মাসের পর মাস। অথচ, তাঁর আত্মবিশ্বাস অবিচল, অটুট মনোবল। উৎকণ্ঠিত পরিবারকে আশ্বাস দেন, তিনি ফিরবেনই। বিজ্ঞানের ওপর তাঁর অটল বিশ্বাস।
কিভাবে দিন কাটে সুনীতা ও তাঁর সঙ্গী বুচ উইলমোরের? প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করেছেন ১৬টি সূর্যোদয় ও ১৬টি সূর্যাস্ত। কম করে ৯০০ ঘন্টা কেটেছে গবেষণায়। শারীরবিদ্যা ও জীববিদ্যা নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চলতে থাকে। দীর্ঘ মহাকাশ প্রবাস কিভাবে শরীর, জীবজগত এমনকি জীবাণুর ওপর প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে চলে ১৫০টিরও বেশি গবেষণা। পাশাপাশি চলে শরীরচর্চা, মহাশূন্যে বাগান করার প্রয়াস। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটদানও করেন। দিওয়ালি, বড়দিন, নববর্ষে শুভেচ্ছা জানান পরিবার ও বিশ্ববাসীকে।
বিশ্বের নানা কোণের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে চলে শিক্ষামূলক আলাপচারিতা (video conference)। তাঁর বিশ্বাস, যতক্ষণ আমরা পৃথিবীর বুকে বিচরণ করি, ততক্ষণ আমাদের গতিবিধি দ্বিমাত্রিক। কিন্তু, যেই আমরা পৃথিবী ছেড়ে শূন্যে উঠি, আমাদের চলায় যুক্ত হয় তৃতীয় মাত্রা। ফলে অনেক দুরূহ সমস্যাকে সেই নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে অনেক সহজেই তার সমাধান মেলে। এ এক অনন্য 'বিশ্বরূপ দর্শন'!
ভালো লাগে আরবার পৃথিবীর কোণটি
দীর্ঘ অপেক্ষার অবসানে শেষমেশ আসে ১৮ই মার্চ, ২০২৫। SpaceX Dragon 'Freedom' Capsule-এ চেপে এবার বাড়ি ফেরার পালা। সারা বিশ্ব উন্মুখ হয়ে আছে কল্পনা চাওলার ক্ষত যে এখনও দগদগ করছে সবার বুকে। প্রতি মুহূর্তে বিশ্ববাসীকে খবর জানাচ্ছে NASA। ক্যাপসুল কক্ষপথ ছাড়ল, এবার তীব্র গতিতে ঢুকে পড়েছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্যে। ঘর্ষণে তৈরি হচ্ছে প্রচণ্ড উষ্ণতা। তার জন্য রয়েছে প্রতিরক্ষামূলক আবরণ। ১৮,০০০ ফুট উচ্চতায় খুলে গেল প্রথম প্যারাশুট, ৬,৫০০ ফুটে দ্বিতীয় প্যারাশুট। এবার ফ্লোরিডার উপকূলের কিছু দূরত্বে মেক্সিকো উপসাগরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ক্যাপসুল। Safe Landing! রুদ্ধশ্বাস পৃথিবী হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এবার পুনরুদ্ধার করবার জাহাজ পৌঁছে গেল সেখানে। ক্যাপসুল ঘিরে তখন ডলফিনের নাচ - বসুধার বীর কন্যাকে পৃথিবী স্বাগত জানাচ্ছে। এবার বহুদিন পরে বুক ভরে শ্বাস নেবার পালা। মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ।
তিনবারে তিনি মহাকাশে কাটিয়েছেন মোট ৬০৮ দিন। মহিলা মহাকাশচারীদের মধ্যে দ্বিতীয় দীর্ঘতম মেয়াদ। ৯টি spacewalk-এ কেটেছে মোট ৬২ ঘন্টা ৬ মিনিট। চার রকমের ভিন্ন ভিন্ন স্পেস ক্যাপসুলে বিচরণের বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি বিশ্বরেকর্ডও।
আমার যে সব দিতে হবে
সুনীতা উইলিয়ামস। এই মুহূর্তে তিনি সংবাদের শিরোনামে। কয়েক মাসের অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করেছেন সুনীতা ও তাঁর সঙ্গী বুচ উইলমোর। তাঁদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে (rehabilitation centre) রাখা হয়েছে ৪৫ দিনের জন্য। দীর্ঘদিন মহাকাশে মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবের বাইরে কাটানোর ফলে তাদের শরীরকে আবার পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের চাপের সঙ্গে অভ্যস্ত করতে হবে। এতগুলো মাস মহাশূন্যে ভাসমান থেকে তাদের শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। শরীরের হাড় অশক্ত হয়েছে - দেখা দিয়েছে osteoporosis জনিত ক্ষয়। মাংসপেশী দুর্বল হয়েছে, পরিবর্তন এসেছে রক্ত চলাচলে, দৃষ্টিশক্তিতেও পড়েছে কিছু অনভিপ্রেত প্রভাব। বার্ধক্য ত্বরান্বিত হয়েছে। ধীরে ধীরে সারিয়ে তুলতে হবে এই শারীরিক অসঙ্গতি। আবার সুন্দর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে নতুন করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে সমৃদ্ধ করবেন তিনি। মানবসভ্যতাকে বিজ্ঞানের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে তাঁর অবদান ও আত্মত্যাগের কথা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, আর সযত্নে রক্ষিত থাকবে বিশ্ববাসীর মনের মণিকোঠায়।
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।
পরিচিতি: প্রাবন্ধিক ও বিশিষ্ট চিকিৎসক।