খেলাধুলো

কলকাতা ময়দানে নিরালা বারপুজো



শুভ্রাংশু রায়


বারপুজো। বাংলা ক্যালেন্ডারে বছরের শুরুর দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখে বারপুজোর মতো অভিনব পুজো পৃথিবীর কোনো প্রান্তে হয় বলে জানা নেই। যে খেলাকে কেন্দ্র করে এই পুজোর আয়োজন সেই ফুটবল কিন্তু একটি গ্লোবাল গেম। সেই খেলায় গোলপোস্টকে পুজো করার রীতিই বারপুজো নামে পরিচিত। আচ্ছা বার দেবতা বা দেবী বলে কিছুর অস্তিত্ব আছে? যদি না থাকে ঠিক কি মন্ত্র পড়া হয় এই বারপুজোয়? এ প্রশ্নের উত্তরে পুরোহিতদের তরফে মেলে নানা ধরনের প্রত্যুত্তর। কেউ বলেন লক্ষ্মী মন্ত্র। কারো মতে বিশ্বকর্মা পুজোর মন্ত্র। আসলে হিন্দু আচার মুখ্য নয়। মুখ্য বোধহয় পারস্পরিক দেখা সাক্ষাৎ, ভাবের আদানপ্রদান। আর সোশ্যাল মিডিয়ার আমলে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সেলফি তোলার আগ্রহ। ইতিহাস বলে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বাঙালির ওতপ্রোত যোগ আছে। যার সঙ্গে একটি লিবারেল হিন্দুত্বের যোগ ছিলই। তাহলে ময়দানের বারপুজো কি সেই যোগসূত্রের প্রকাশ্য ইঙ্গিত আজও বহন করে চলে! এটা কি বাঙালির নিজস্ব হিন্দুয়ানার প্রতীক? বারপুজোয় যখন অন্য ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষজন ও ক্লাবকর্তাদের অনায়াস যাতায়াত দেখি তখন কেমন যেন মনে বাঙালির একমাত্র 'সেক্যুলার' উৎসবের দিনে ফুটবলের সঙ্গে মিলিয়ে এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান আসলে বহু চেনা ছককেই পাঁচ গোল মেরে দেয়।

পয়লা বৈশাখ এবং বারপুজো নিয়ে লিখতে বসে নিজের মনে এই প্রশ্নগুলি ঘুরপাক খায়। একটি অভিজ্ঞতার কথা প্রথমেই মনে পড়ল। সেইসঙ্গে আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগে শ্রীরামপুর উত্তরপাড়া অঞ্চল থেকে সেই সময় খেলা দেখতে আসা এক প্রবীণ মোহনবাগান সদস্যের মুখে শোনা এক অদ্ভুত কবিতা। হ্যাঁ মোহনবাগান। এবং যেহেতু আমি একজন ব্যক্তিগতভাবে মোহনবাগান সমর্থক, সেই কারণেই প্রাথমিক অনুষঙ্গ হিসেবে মোহনবাগান মাঠের ঘটনা মনে চলে আসা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। তবে তাই বলে ভেবে বসবেন না কেবলমাত্র মোহনবাগান মাঠের ঘটনা শুনিয়েই সময় পার করে দেব। মনের ঝুলি থেকে কী বেরোবে, তার জন্য আমাদের সকলকেই একটু ধৈর্য ধরতে হবে।


ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে বারপুজো।


১৯৮১ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের বারপুজোতে ময়দানের বাদশা মজিদ বাসকার-এর সঙ্গে উপস্থিত দুই ইরানিয়ান সতীর্থ জামসেদ নাসিরি এবং খাবাজি।

হ্যাঁ আবার ফেরত আসা যাক সেই ঘটনা এবং অদ্ভুত কবিতা প্রসঙ্গে। ঘটনাকাল পয়লা বৈশাখ, ১৪০৯। ইংরেজি ১৫ এপ্রিল, ২০০২। সময়কাল বিকেল সাড়ে পাঁচটার আশপাশে। মাথা খেয়ে বলছি নেহাৎ দিনটি পয়লা বৈশাখ না হলে বাংলা সন তারিখ ঝট করে মাথায় চলে আসত না। অসংখ্য শরীরের ভিড় মোহনবাগান টেন্টে বা মাঠের টানেলের মধ্যে। শরীর বললাম কারণ সবার মন পড়ে গোয়ায়। চলছে মোহনবাগান-চার্চিল খেতাব নির্ণায়ক ম্যাচ। দূরদর্শনে বা অন্য চ্যানেলে নেই - সরাসরি সম্প্রচার। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তখন সোশ্যাল নেটওয়ার্ক নামক বস্তুটির কোনও অস্তিত্ব ছিল না। ইনকামিং চার্জ যুক্ত মোবাইল ছিল এক মহার্ঘ সামগ্রী। সেই মহার্ঘ মোবাইলে ততক্ষণে খবর এসে গেছে মোহনবাগান এগিয়ে। দ্বিতীয়ার্ধে বোধহয় মিনিট দশেক বাকি। কিছুটা চেপে ধরছে চার্চিল। সে কি উত্তেজনা! কিছু লোক দৌড়ল নতুন পোঁতা পুজো হওয়া বারপোস্টের দিকে। সে দলে আমিও ছিলাম। বারে মাথা ঠোকা নয়, টেনশন কাটানো। অবশ্য ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ কই? বারপোস্টে মাথা ঠুকে সবাই ইস্ট দেবতাকে ডাকছেন। সে ডাকে নবীন প্রবীণ সকলেই। ধনী মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী চাকুরিজীবী সব মিলেমিশে একাকার। হঠাৎ কানে এল ''হে আল্লাহ্ মোহনবাগান যেন গোল না খায়। আমরা যেন ট্রফি জিততে পারি।'' চমকে তাকিয়ে দেখলাম বারকে দু'হাতে আঁকরে ধরে এক প্রৌঢ় আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বা কখনও বিড়বিড় করে প্রার্থনা করে চলেছেন। অন্য সকলের থেকে তাঁর প্রার্থনার ভঙ্গি কিছুটা আলাদা। 'খেলা শেষ' টেন্টের ভেতর থেকে প্রবল উল্লাসধ্বনির মাধ্যমে আসা এই খবর পৌঁছতেই পাশের অন্য ধর্মবিশ্বাসী সমর্থকই আনন্দে আত্মহারা হয়ে জড়িয়ে ধরলেন পাশের সেই সমর্থকটিকে। তখন বুঝিনি। এখন বুঝি, ফুটবল আর নববর্ষ শ্রেণি, বর্ণের পাশাপশি ধর্মীয় ভেদকেও ফুটবল মাঠে হেলায় কিক্ আউট করে দিতে পারে।

জাম্প কাট

সেই পয়লা বৈশাখ ছিল বাংলার ১৪০০ সন। ইংরেজির খুব সম্ভবত ১৯৯৩। তখনও স্কুলে পড়ি। জীবনে প্রথমবার পয়লা বৈশাখে এক নিকট আত্মীয়ের হাত ধরে বারপুজোয় মোহনবাগান মাঠে আসা। তখনও ক্লাব তাঁবুতে পরিবেশ ভাবগম্ভীর লাগত, কারণ বয়সের নিরিখে আমি ছিলাম নেহাৎই সংখ্যালঘুর দলে। যাই হোক, যে কারণে ওই বছরের উল্লেখ সেইবার গ্যালারিতে এক প্রবীণ মোহনবাগান সমর্থকের মুখে বারপুজো নিয়ে এক অদ্ভুত কবিতা শুনেছিলাম। কবিতার নামটা আজ মনে আছে। "দূর শালা বারপোস্ট"। মনে আছে বেশ দুলে দুলে মুখে একগাল হাসি নিয়ে প্রবীণ সমর্থক বেশ সুর করে করে কবিতাটি আওড়াচ্ছিলেন। আর পাশে বসা বেশ কিছু সদস্য সমর্থক "ক্যায়া বাত... ক্যায়া বাত..." মুখভঙ্গি নিয়ে তাকিয়েছিলেন। লাইনগুলি ঠিক মনে নেই, তবে বারপোস্টকে হৃদয়ভাঙা প্রেমিকা বা তরল শূন্য বোতল ধরনের কিছু উপমা সহযোগে বলা হয়েছিল। মফস্বলের আমি সবে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ ছাত্র। 'শালা' শব্দ সহযোগে কবিতা কোনও বয়স্ক মানুষ প্রকাশ্যে, বিশেষ করে মোহনবাগান তাঁবুতে বসে আওড়াতে পারেন, সেটা ধারণার বাইরে ছিল। ওনার কবিতা পাঠের শেষে জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম "জেঠু কার কবিতা এটা?" পাশের আরেক জেঠু উত্তর দিয়েছিলেন, "শক্তি চ্যাটুজ্জে"। এই উত্তরে হালকা হাসির রোল উঠল বটে কিন্তু পাশে একজন - ''তোমরা যাই বলো ভাই বারপোস্ট বিরূপ হলে কিন্তু চাপ আছে। সেই যে সেবার..." আলোচনা অন্য খাতে বয়ে গিয়েছিল সেদিন। কিন্তু আমার মনের খচখচানি আজও মেটেনি।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এক সময় মোহনবাগান মাঠে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ফুটবল খেলাকে অনুষঙ্গ করে ওঁনার বেশ কিছু কবিতাও পড়েছি। মনে পড়ে মোহনবাগান ক্লাবের শতবর্ষে ওঁনার এক অসাধারণ কবিতা 'ফলাফলে সুখ দুঃখ হয়' প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকার বিশেষ ক্রোড়পত্রে। সেই শক্তি চট্টোপাধ্যায় এই 'দূর শালা বারপোস্ট' কবিতার লেখক! একি সত্যিই নাকি নিছক মজা করে বলা? আজও প্রতিবার বারপুজোর দিন ময়দানে গেলে কৌতূহল নিরসনের ব্যর্থতার বিষয়টি মনে আলতো খোঁচা দেয়।


মোহনবাগান ক্লাবে বারপুজো।

মোহনবাগান ১৩৬ বছরের ক্লাব। ময়দানে তার প্রবলতর প্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গল ক্লাব একশো পেরিয়েছে। ময়দানে একশো উত্তীর্ণ ক্লাবের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। ফলে বারপুজোর গল্পের শেষ নেই। বাঙালির হালখাতার দিনের ময়দানি গল্পের স্মৃতি হালখাতা খুললে কত রাত কাবার হয়ে যাবে, তার ইয়ত্তা নেই। তবে ২০০৭ পয়লা বৈশাখে তৎকালীন ফিফা সভাপতি ব্লাটার সাহেবের ময়দানে আগমন বেশ মনে আছে। সেই নববর্ষের দিনে বাঙালির দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল মহারণে মেতেছিল ফিফা সভাপতির সামনে। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে।

কবে থেকে এই বারপুজোর প্রচলন হল, তার কোনও ঐতিহাসিক সুনির্দিষ্ট তথ্য এখনও খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনিতেই বড় থেকে ছোট অফিস থেকে সামাজিক ক্লাব কারোরই তেমন ইতিহাস নথিভুক্ত করার বিষয়ে আগ্রহ নেই। ফলে বারপুজোর ইতিহাস খুব পরিষ্কারভাবে তেমন পাওয়া যায় না। সবই সেই আঁখো দেখা হাল। ফলে ষাটের দশক থেকে বারপুজোর বিবরণ মেলে। বিবরণকারীদের জানতে জানতে চাইলে "সে অনেক পুরনো" বলে এমন ভাবগম্ভীর মাখা উত্তর আসে যেন শুরু থেকেই এই পুজোর প্রচলন ছিল। প্রশ্ন জাগে, শিবদাস ভাদুড়ীরা যখন গোরা দলগুলোকে হারিয়ে শিল্ড জয় করেছিল তখন কি এই বারপুজোর চল ছিল? খুব সম্ভবত না। তাহলে ঠিক কবে থেকে? ময়দানেই প্রথম নাকি কোনও পাড়ায় আগে এই পুজো শুরু হয়েছিল, সেখান থেকে ময়দানে এই পুজোর চল শুরু হয় তাও জানার উপায় নেই। ময়দানের গণ্ডি পেরিয়ে কলকাতার অন্যত্র এমনকী জেলা শহরেও বারপুজোর চল আছে জানি। কিন্তু ময়দানের বারপুজো সত্যিই নিরালা।

বাঙালির জীবনে বারপুজোর মাহাত্ম্য বেড়েছিল দলবদলের সময় থেকে। ষাট ও সত্তর দশকে চৈত্র মাসের আগে শেষ হতো দলবদল। ক্লাবে নতুন মরশুমের কাঠি পড়ত বছরের প্রথম দিনটিতে। পুরোনো খবরের কাগজ এবং খেলার ম্যাগাজিনগুলি ঘাঁটলে বোঝা যায় সত্তরের দশকে ইস্টবেঙ্গলের সাফল্যের দিনগুলিতে বারপুজোর দিনে এক অন্য উন্মাদনার সৃষ্টি হতো ময়দানে। সেই সময়ে ইস্টবেঙ্গলের বারপুজোতে উপস্থিত মানুষজনদের চোখে ঐ সময়ের বারপুজো নিয়ে স্মৃতিচারণ করার সময়ে চোখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতার ছাপ আজও নজরে পড়ে। সত্তর দশকের পরের দিকে মোহনবাগানের সাফল্যের পথে ফিরে আসার সময় থেকেই পুনরায় বারপুজোয় ভিড় বাড়তে থাকে। ক্রমশঃ নতুন অধিনায়কের বার ছুঁয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে সংকল্প করার প্রথা জনপ্রিয় হয়ে উঠে। মাসের প্রথম দিনে ক্লাব টেন্টে পুজোর পর সদস্য সমর্থকদের লাইন দিয়ে লুচি, বোঁদে, পান্তুয়া খাওয়ার লাইনে ঢল নামার ট্র্যাডিশন দীর্ঘ বছর অবধি চালু ছিল। মাঝে করোনার কারণে ময়দানে ঘোষিতভাবে বারপুজো হয়নি। মোহনবাগান ক্লাবের সরকারী ফেসবুক পেজ অনুসারে সেই দু'বছর পুজো হয়েছিল। কিন্তু সরকারী নিষেধাজ্ঞা মেনে। সদস্য সমর্থক মায় প্রায় কর্মকর্তা শূন্য অবস্থায়। ময়দানের অন্য ছোট ছোট ক্লাবে কি আদৌ বারপুজো হয়েছিল তা জানার উপায় ছিল না সেই লকডাউনের বাজারে।

এবারের বারপুজো অবশ্যই মোহনবাগান ক্লাবের জন্য নিরালা। ফুটবল ও হকির দুনিয়ায় সাফল্যের পরে বারপুজোয় নতুন করে উৎসাহের ঢল নামবে তাতে সন্দেহ নেই। অন্য দিকে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সদস্য সমর্থকরা বারপুজোর দিন ক্লাব টেন্টে উপস্থিত হবেন পুরোনো ব্যর্থতাকে ঝেড়ে ফেলে আগামীদিনের সাফল্যকে ফিরে পেতে। ময়দানে আরও অনেক ক্লাব সেদিন বারপুজোয় অংশ নেয়। নতুন সংকল্পের মাধ্যমে জন্ম হয় নতুন নতুন স্বপ্নের। ময়দানের খেলোয়াড়রা ঘেরা বা খোলা মাঠে সারা বছর ধরে সেই স্বপ্নের পিছনে দৌড়াতে থাকে 'টিল দ্য গোল ইজ রিচড'।

চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত।

পরিচিতি: অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক।