মেঘালয়ের 'শিলং' পাহাড়টির পর্যটনপ্রিয়তার এই যে সুবিশাল ব্যাপ্তি, তার অনেকটা কৃতিত্বের ভাগীদারই কিন্তু এখানকার 'উমিয়ম' নামের হ্রদটি।স্থানীয় মানুষজন আদর করে এর নাম দিয়েছেন 'বড়া পানি লেক', যা কিন্তু আদৌ কোনো প্রাকৃতিক হ্রদ-ই নয়।মেঘালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ যে 'শিলং পিক', তার বুক চিরে বয়ে চলেছে উমিয়ম নদী। নদীটি পৃথুলা নয়; আবার শীর্ণকায়া-ও নয়।এই মাঝারিগড়ন মধ্যযৌবনা রূপসী নারীর মত শান্ত নদীটির বেশ কিছুটা জলধারাকে ১৯৬০ সালের শুরুর দিক নাগাদ বেঁধে ফেলা হল, যাতে মেঘালয় আর অসমে জলজ বিদ্যুৎ সরবরাহ করার কাজটি সহজ হয়।সাথে, শিলং পাহাড় আর তার আশপাশের এলাকার মানুষের জল নিয়ে দুর্ভোগও কিছুটা কমে! আর সেইমতই, নদী বেঁধে সৃষ্টি হল এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড়, হ্রদাকৃতি, কৃত্রিম এই জলাধার - 'উমিয়ম লেক'।
উমিয়ম লেক, শিলং, মেঘালয়।
অবস্থানগত দিক থেকে লেকটি মূল শিলং শহর থেকে মোটামুটি ১৫ কিলোমিটার মত উত্তরদিকে। চারপাশে এর সবুজ সবুজ ঢেউখেলানো টিলা আকৃতির অনেক হিলস্। এই হিলস আবার 'কনিফেরাস' বৃক্ষময় এক চিত্রবৎ অরণ্যভূমি!' ড্রোন' দিয়ে দেখলে তাই সত্যিই মনে হয়, এই হিলস আর বনভূমি যেন 'উমিয়ম' নামের সুবিশাল স্বচ্ছ জলের এই হ্রদ তথা জলাধারটিকে কার্যতঃ-ই ঘিরে আগলে রেখেছে।তাই উমিয়ম সত্যিই যেন ঐশীরূপে অপরূপ... বিশেষতঃ সূর্যাস্তের কুসুমলালে!
যারা নিভৃতি ভালবাসেন কিংবা যারা নিজেদের মধুচন্দ্রিমাযাপনকে বাড়তি কিছু নান্দনিকতায় মুড়ে রাখতে চান, উমিয়ম লেক তাদের জন্যে আদর্শ। এই লেক এবং তার পার্শ্ববর্তী পাহাড়ি বনাঞ্চলটিকে ঘিরে বেশ কিছু অভিজাত রিসর্ট তৈরি হয়েছে। চাইলে ক'টা দিন সেখানে নিশ্চিন্তে কাটিয়েই যেতে পারেন তারা।
লেকটির এ' প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ভালো দেখা যায় না, এর এতোটাই কভারেজ। মোটামুটি ২২১ স্কয়ার কিলোমিটার মত এরিয়া জুড়ে এই জলাধার বনাম লেক । উমিয়মে বহু মানুষ (স্থানীয় এবং পর্যটক ...সব মিলিয়ে) বেড়াতে আসেন এর প্রাকৃতিক শোভা আর লেকের রকমারি মাছ দেখতে। এই মাছের কিয়দংশ লোকাল বাজারে বিক্রিও হয়। সে মাছের নাকি বড় মিষ্টি সোয়াদ!
'উমিয়ম' জায়গাটা পিকনিক স্পট হিসেবেও চমৎকার! সে' কারণেও আসেন বহু মানুষ।তার সাথে তো আছেই বিভিন্ন বিনোদনমূলক রাইডস - বোটিং, শ্যুটিং, ওয়াটার সাইক্লিং, স্পিড বোট রাইডস্ ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ইত্যাদি।
উমিয়ম নদী, শিলং, মেঘালয়।
এই 'উমিয়ম' শব্দটিকে ঘিরে একটি জনশ্রুতি আছে। স্থানীয় মতে, 'উমিয়ম' অর্থ 'অশ্রু জল' (Water of tears)। গল্পটি এ রকম: স্বর্গরাজ্যের বাসিন্দা ছোট্ট দুটি বোন পৃথিবীর দুঃখদৈন্য দেখে বড় ব্যথিত বোধ করে। মানুষকে তাদের যাবতীয় দুঃখতিমির থেকে মুক্তি দিতে শেষে তারা নিজেরাই প্রদীপ হাতে মর্ত্যপথে রওনা দেয়। স্বর্গ থেকে মর্ত্যের সেই সফরে হঠাৎ আসে এক ঘন মেঘছাওয়া রাজ্য (সে-ই আজকের এই মেঘালয়)। কালো মেঘের প্রবল চলাচলে এবং ঘন আস্তরণে বোন দুটির হাতের একটিমাত্র সেই প্রদীপটি যায় নিভে... একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্নও হয়ে পড়ে দু'বোন। তাদের একজন অন্য সহোদরাকে খুঁজতে খুঁজতে দিশেহারা হয়ে শেষে এসে পৌঁছায় এই উমিয়ম হ্রদ-টির কাছাকাছি। তবুও বোনটিকে সে খুঁজে পেল না আর। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে সেও প্রাণ বিসর্জন দেয় শেষটায়। সেই সাগরসম অশ্রুধারায় গড়ে ওঠে এই উমিয়ম হ্রদ!...
শিলং-এর মানুষজন এখনো সহজপ্রাণ! তাঁরা সবসময়ই প্রফুল্লচিত্ত, মানুষকে সাহায্য করতে সদাসর্বদাই তৎপর তাঁরা। মগজে কুটিল তীক্ষ্ণধী হোন কিংবা না হোন, অন্তরে তাঁরা সত্যিই অমলিন। উমিয়ম লেকের এই গল্পও ড্রাইভার অরুণজ্যোতি শুনিয়েছিল। সাথে এখানকার মানুষের সারল্যকে হাসিমুখে সম্মান জানাতেও তার ভুল হয়নি। আমি আর আমার মেয়ে উমিয়ম লেকের স্বপ্নালু মেঘ আর জলের ঘোরেই বিভোর ছিলাম বেশি! অরুণজ্যোতির কথাগুলোর পিঠে নিঃশর্তে সায়-ই দিলাম... মাহোল-ই এমন তখন!
কথা বলতে বলতে আমরা ফিরে চলেছি গাড়ির দিকে, হাঁটাপথেই! সবুজে আর ছায়ায় ঘেরা সেই রাস্তাটুকুও সত্যিই বলছি যেন এক স্বপ্নপথ!
গাড়িপথে হোটেল 'শিলং অ্যাড্রেস' পৌঁছতে আরো মিনিট কুড়ি মতো লাগল আমাদের। শিলং শহরের প্রাণকেন্দ্র 'পুলিশবাজার' এরিয়াতেই এই প্রকান্ড হোটেল। হোটেলটি শিলং -এর যথেষ্ট পরিচিত 'হোটেল পোলো টাওয়ারস্'-এর ই সাম্প্রতিকতম পরিবর্ধিত অংশ; কাজেই সে' প্রপার্টিতে পা রাখাটাও আরেক রূপকথা! তবে তাতে স্বপ্ন কম... বৈভবী জৌলুস বেশি।
'হোটেল শিলং অ্যাড্রস'-এর প্রতিটি ওয়ালপেইন্টিং, দরজা জানলা করিডরের প্রতিটি গ্লাস-আর্ট, প্রতিটি 'ইকাবানা', দু' পা ছাড়া ছাড়া রাজকীয় কারুকাজ করা মানুষ প্রমাণ সব আয়না, ঝাড়বাতিগুলোর সূক্ষ্ম নকশা, মেঝের বাহার, এমনকি লিফটের চতুর্দিকমোড়া আয়নাকাচের গোলকধাঁধা (অনেকটা সেই 'মুঘল-এ-আজম' এর 'প্যার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া!' গানের শেষাংশে আয়নার কাচে শত শত মধুবালাময় চোখধাঁধানি-র হুবহু সমান অভিজ্ঞতা), আতিথেয়তা, পালকশয্যা... শুধু এ' সব কিছুকে নিয়েই আলাদা একটা পর্ব অনায়াসেই লিখে ফেলা যায়। কিন্তু, আমরা চলেছি আরো মায়ামেদুর এক স্বপ্ন সফরে। তার কাছে পৃথিবীর শত বৈভব সত্যিই যেন জোলো... বড়ই অকিঞ্চিৎকর!
'হোটেল শিলং অ্যাড্রেস'-এর অন্দর সজ্জায় আয়নার সামনে রাখা 'ইকাবানা'।
আপাতত তাই প্রকৃতি-শিলং -এর কাছেই থাকি আমরা এই লেখার অক্ষরে, শব্দে, চোখের প্রতিটি পলকফেলায়...
পরের দিন ১০ অক্টোবর, ২০২৪।
সেদিন দুর্গাসপ্তমী। অসম এবং খোদ শিলং-এ দুর্গাপুজো যে কী ভীষণ অপেক্ষার, কী ভীষণ আন্তরিক আনন্দসমারোহে উদযাপিত এক উৎসব, তা চোখে না দেখলে লিখে বোঝানো অসম্ভব। পুরো শহরটাই এমনিতে বড় শান্তিপ্রিয়... এমনকি পুজোর দিনগুলোতেও! তাই ট্রাফিকের চূড়ান্ত ধৈর্য্যচ্যুত বিকট প্যাঁ পোঁ, কিংবা প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে তারস্বরে মাইকের চ্যাঁচানি--- কোনোটাই তেমন করে টের পেলাম না সপ্তমীর সকালে, দুপুরে কিংবা বিকেলে। সেদিনটা আমাদের আইটেন্যারি-তে সারাটা দিন ধরে ঘুরে ফিরে শুধু শিলং শহরটাকেই দেখার ছিল। এবং, বলতে নেই, দিনটা কাটলোও তেমনি শব্দউৎপাত-বর্জিত আপন মর্জিসুখে।
এলিফ্যান্ট ফলস, মেঘালয়।
সপ্তমীর প্রথম দ্রষ্টব্যটি ছিল 'এলিফ্যান্ট ফলস'; কেননা সেটিই হোটেল থেকে সেদিনের দূরতম গন্তব্য আমাদের। এই জলপ্রপাতটি মূল শিলং শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে। 'এলিফ্যান্ট ফলস' নামটি ব্রিটিশদের দেওয়া।খাসি জনজীবনে এই প্রপাত কিন্তু আগে থেকেই 'Ka Kshaid Lai Pateng Khohsiew' বা 'Three Steps Waterfalls ' নামেই পরিচিত ছিল। কারণ, এই প্রপাতের জলধারা তিনটি আলাদা আলাদা ভাগে ভেঙে ভেঙেই বইছে। এবং এটাই বাস্তব ঘটনা! কিন্তু ব্রিটিশদের পরখী চোখ এই ত্রিধারাকে অতিক্রম করেও একটি প্রকাণ্ড প্রকৃতিজাত পাথরকে সবার আগে দেখতে পেয়ে গেল, যে পাথরটি এই প্রপাতের উৎসমুখটিকে প্রাণপণে ধারণ করে ছিল। সেই পাথরটির গঠন ছিল হস্তীবৎ। আর পাথরটির সেই গড়নে মানুষের কোনোই হাত বা কারসাজি ছিল না। সেই থেকে ডাকার সুবিধার্থে এটি ' এলিফ্যান্ট ফলস'। তবে আমরা সেই পাথরটিকে আর দেখতে পাইনি। ১৮৯৭-এর ভূমিকম্পে সেই অপূর্ব প্রাকৃতিক কারুকাজটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়।তবুও পর্যটকদের কাছে এই প্রপাত আজ-ও ব্রিটিশদের দেওয়া নামেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে চলেছে।
এই জলধারার উৎসমুখের প্রথম ধারাটি তুলনামূলকভাবে শীর্ণ। ক্রমশ ক্রমশ এর জলভাগ বেড়েছে; গতি আরো ধারালো হয়েছে প্রপাতটির দ্বিতীয় অংশে এসে। সেখান থেকে তৃতীয় এবং শেষ পর্বে জলস্রোত প্রবল তান্ডবময়... বড়ই আদিম! প্রকৃতির খেয়ালে গড়ে ওঠা এমন বনজ শ্যাওলাগন্ধী ছমছমে পরিবেশ, পাখিদের কিচিরমিচির, বুনোফুলে ছাওয়া অসমান ক্ষয়া পাথরে তৈরি হাঁটাপথটি ধরে মূলধারার কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারা - সব মিলিয়ে জায়গাটার একটা আলাদা রোম্যান্টিকতা আছে, মানতেই হয়!
ফলস্ ঘুরে, ফিরতি পথে আবার প্রধান প্রবেশদ্বার অবধি খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বেশ মালুম হচ্ছিল, জীবনের ছায়া সত্যিই এবার দীর্ঘ হচ্ছে। একটু হাঁপ ধরছে বুকে, পায়ের পেশীগুলোও টনটনাচ্ছে! মেয়েরও এমন বোধ হচ্ছিল কিছুটা বৈকি; তবে কম। তার সেসব অস্বাচ্ছন্দ্যের বেশিটাই হল খাড়াই চড়ার শহুরে অনভ্যাসজনিত। ফলত আমার থেকে মিনিট পাঁচেক এগিয়ে প্রবেশমুখে পৌঁছে গেল মেয়ে এবং পৌঁছেই খুব তাড়া দিতে লাগল সে," জলদি এসো! দেরি হয়ে যাবে যে! বাকিগুলো কখন আর দেখব তবে!"
তিনি আজকের মেয়ে। ঢের হিসেবী!টোটাল কভারেজেই মন বেশি এ' জমানার। দেরি সইবে কেন তারুণ্য!
আমার যে আদৌ কোনো তাড়া নেই!এমন নির্জন আলোআঁধার, ফলসের শেষজলের আছড়ে পড়ার ঐ তীক্ষ্ণ বন্য শব্দটুকু আমি মন থেকে যে আদৌ সরাতে চাইছিই না, ওকে বলা গেল না।
ফলসের বাইরে পসরা সাজিয়ে বসে আছে বেশ কিছু দোকানী। পছন্দসই কিছু হ্যান্ডি ক্রাফ্টস্ কিনে সেদিন গাড়িতে উঠে বসলাম আবার।
এবার ফিরছি শিলং শহরে।
পুরো ট্রিপে গাড়ি চালিয়ে, নানান স্থানীয় গল্প বলে, গান শুনিয়ে মাতিয়ে রেখেছিলেন মানুষটি। অরুণজ্যোতি রায়।
এখনো ঘুরে দেখার আছে ওয়ার্ড'স লেক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বাটারফ্লাই মিউজিয়াম আর ডন বসকো মিউজিয়াম। সপ্তমীর সূর্যটা তখন ঠিক মাথার সমান সমান। পূর্ণ তেজে। কিন্তু আমাদের কাছে সেই রোদ্দুর সেদিন বড় আরামের! মাসটা অক্টোবর বলে গায়ে কোনো গরম জামা বা জ্যাকেট চাদর - কিস্যু লাগছে না! দিব্যি ফুরফুরে'টি হয়ে ছুটে চলেছি আমরা; সাথে শিলং অভিমুখী সেদিনের মধ্যদিনটিও...
এও তো আভিধানিক মুক্তি'র অনুভবের রূপ! সেটুকুই বা মন্দ কি!
(ক্রমশ)
আলোকচিত্রঃ লেখকের কাছ থেকে প্রাপ্ত।
পরিচিতি: লেখক।