খেলাধুলো

ডঃ তমোঘ্নী মান্না
খেলাধুলার প্রতি মানুষের আকর্ষণ বহুদিনের। আর এই খেলাধুলা যখন প্রতিযোগিতামূলক হয় তখন তা হয় আরও আকর্ষণীয়। ভারতবর্ষের মতো বিরাট দেশ খেলাধুলার ক্ষেত্রে এখনও অনেক পিছিয়ে। এখনও আমাদের অনেক পথ দৌড়োতে হবে।
খেলোয়াড়দের দক্ষতা বিচার
প্রাথমিকভাবে, খেলোয়াড় নির্বাচন করা হয়, শারীরিক গঠন দেখে। উনিশশো সাতষট্টি সালে বিজ্ঞানী হিথ এবং কার্টার শরীরের দৈর্ঘ্য, ওজন, চামড়ার নীচের চর্বির পরিমাণ, হাড়ের পরিমাপ এবং শরীরের নানা অংশের পরিধির উপরে নির্ভর করে তিন ধরনের শারীরিক গঠনের কথা বলেছেন। যেমন, endomorph বা চর্বিসম্পন্ন গোলাকার শরীর, Mesomorph বা লম্বা, সুঠাম, পেশীসম্পন্ন বড়-সড় চেহারা। আর, ectomorph হল পাতলা গড়নের অপেক্ষাকৃত রোগা চেহারা।
শরীরের আকার ও আয়তনের ওপর খেলাধূলায় দক্ষতা অনেকটাই নির্ভর করে। দূরপাল্লার দৌড়ে সাফল্য শরীরের VO2Max বা সর্বোচ্চ অক্সিজেন ব্যবহারের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। শরীরের আয়তন বেড়ে গেলে সর্বোচ্চ অক্সিজেন ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাও বেড়ে যায়। অথচ সর্বোচ্চ অক্সিজেন ব্যবহারের ক্ষমতা সেই হারে বাড়ে না। তাই, বড়ো আয়তনের শরীর আর অল্প অক্সিজেন ব্যবহারের ক্ষমতা নিয়ে দূরপাল্লার দৌড়ে সফল হওয়া প্রায় অসম্ভব। সে তুলনায় ছোটোখাটো শরীর দূরপাল্লার দৌড়ের জন্য উপযুক্ত। ফুটবলের মতো খেলা যেখানে শারীরিক সংযোগ অনিবার্য, সেখানে রক্ষণভাগে বড়-সড় চেহারার খেলোয়াড় থাকলে অনেক সময় সুবিধাই পাওয়া যায়। আমাদের দেশে খেলোয়াড়রা অনেকেই আসে নিম্নবিত্ত এমনকি আদিবাসী পরিবার থেকে। অনেকেরই দু'বেলা ঠিকমতো খাবার জোটেনা। সেই অবস্থা থেকে যখন তারা কোনও প্রতিযোগিতায় প্রাথমিকভাবে সফল হয়, তখন তাদের ওপর নজর পড়ে। এদেশে এভাবেই উঠে এসেছে বহু খেলোয়াড়। ভারতীয় ফুটবলে পাহাড় থেকে আসা ছেলেরা এখন দারুণ খেলছে। দেখা গেছে তাদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের অক্সিজেন পরিবহনের ক্ষমতা সমতলের ছেলেদের থেকে তুলনামূলকভাবে বেশী। কাজেই, শারীরিক গঠন, পরিশ্রম করার ক্ষমতা, মানসিকতা, সব দিক বিবেচনা করে, খুব ছোটবেলাতেই বেছে নিতে হবে, ভবিষ্যতের ভালো খেলোয়াড়।
খেলাধুলায় প্রশিক্ষণ এবং চোট আঘাত
খেলাধুলায় সাফল্যের জন্য সবসময়ই নিজেকে নিঙড়ে দিতে হবে, তা একদমই ঠিক না। সঠিকভাবে অল্প ও দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। খুব ধীরে-ধীরে মাত্রা বাড়িয়ে ওভারলোড ট্রেনিং দেওয়া প্রয়োজন। কারণ, খুব বেশি ট্রেনিংয়ের বোঝা একজন খেলোয়াড়ের অনেক ক্ষতি করতে পারে।
প্রায় সব খেলাতেই চোট আঘাত লাগতে পারে। আগেই সে বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। তুলনামূলকভাবে বাস্কেটবল ও ভলিবলের খেলায় গোড়ালিতে আঘাত লাগার সম্ভাবনা বেশী। সম্ভাব্য গোড়ালির আঘাত কমানোর জন্য বেশ কয়েকটা ব্যালেন্স বা ভারসাম্য-ক্ষমতা বাড়ানোর ব্যায়ামের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এইসব ব্যায়াম গোড়ালিতে অসম্ভব চাপবৃদ্ধি প্রতিরোধ করে। দেখা গেছে, পুরুষদের তুলনায় মহিলা খেলোয়াড়দের গোড়ালির আঘাত পাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশী। স্পোর্টস্ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং স্পোর্টস্ ফিজিওথেরাপিষ্টেরা, নানা পরীক্ষার মাধ্যমে গোড়ালির শক্তির পরীক্ষা করেন। সেই সঙ্গে, গোড়ালির শক্তি বাড়ানোর প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকেন।
খেলার আগে অবশ্যই একজন খেলোয়াড়কে ওয়ার্মআপ বা গা ঘামিয়ে নিতে হয়। তারপর কুলডাউন বা ঠাণ্ডা হতে হয়। না হলে হঠাৎ করে পেশিতে টান লেগে যেতে পারে। গাঁটের লিগামেন্টে সমস্যা হতে পারে। ফুটবল, ক্রিকেট বা অন্যান্য সব খেলার খেলোয়াড়দের সবাইকেই তাদের দরকারি পেশি এবং লিগামেন্টকে মাঠের যুদ্ধের জন্য তৈরি রাখতে হয়। একজন দক্ষ ফিজিওথেরাপিস্ট এ বিষয়ে সঠিক পরামর্শ দিতে পারেন। খেলতে গিয়ে লিগামেন্টে চোট লাগা এক সাধারন ব্যাপার। তবে, MRI পরীক্ষা করে যদি দেখা যায়, লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেছে, তখন হয়ত অপারেশন করতে হতে পারে।
খেলতে গিয়ে আঘাত নানা রকমের হতে পারে। যেমন, 'টেনিস এলবো'। এতে হাতের এক্সটেন্সর টেন্ডন-গুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে, কনুইয়ের বাইরের দিকে ব্যথা হয়। টেনিস খেলোয়াড়দের ব্যাকহ্যান্ড স্ট্রোক নেওয়ার সময় এই আঘাত বেশি হয় বলে এই নামকরণ করা হয়েছে। অন্যদেরও এটা হতে পারে। আবার, গলফ খেলোয়াড়দের হাতের ফ্লেক্সর টেন্ডন-গুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য কনুইয়ের ভেতরের দিকে ব্যথা হয়। । একে বলে, গলফার এলবো।
ভারোত্তোলনের সময় মেরুদণ্ডের ওপর হঠাৎ বেশি চাপ পড়ে। গলফ বা ব্যাডমিন্টন খেলার সময়ও মেরুদণ্ড মোচড় খায়। এ সব থেকে, পিঠের নিচের লাম্বার অংশে প্রচণ্ড ব্যথা হয়।
বাস্কেটবলের মতো খেলায় শক্ত জমির ওপর বারবার লাফাতে হয়। ফলে, গোড়ালিতে মারাত্মক ব্যথা হয়। যাকে বলে 'জাম্পারস নী'। আর, বারবার লাফানোর ফলে, হাঁটুর প্যাটেলার টেন্ডন অংশে চোট লাগে। একে 'প্যাটেলার টেন্ডনাইটিস' বলে। দৌড়বিদরা যখন দৌড়ান তখন তাদের উরুর হাড়, ফিমার এবং প্যাটেলাতে বারবার ঘষা লাগে। বেশ ব্যথা হয়। একে, 'রানার্স নি' বলে। এছাড়া হাড় ভেঙ্গে যাওয়া বা সরে যাওয়া তো আছেই।
আঘাত যে শুধু খেলার সময় লাগে তা নয়, ট্রেনিং নেওয়ার সময়ও লাগতে পারে। তাই, খেলোয়াড়দের নিয়মিত এক্সরে, রক্ত ও অন্যান্যা পরীক্ষা করা হয়। এ ছাড়াও করা হয় ডোপ-টেস্ট। খেলতে নামার আগে, খেলোয়াড়দের মূত্র ও রক্ত পরীক্ষা করে ধরা হয়, কেউ ড্রাগ নিয়েছে কিনা। টেস্টে ধরা পড়ে অনেক বিজয়ীকে যেমন পদক খোয়াতে হয়েছে, তেমনি, আজীবন নির্বাসিত হতে হয়েছে খেলার দুনিয়া থেকে। কেউ কেউ আবার গবেষণা চালাচ্ছেন, কীভাবে, কোনও উপায়ে বিশেষ কিছু রাসায়নিক দিয়ে একে লঘু করা যায় কিনা; যাতে ওই ড্রাগগুলো ধরা না পড়ে। এখন সেই রাসায়নিকগুলো নেওয়াও অপরাধের কবলে পড়ছে।
ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ আমরা সুষম খাবার থেকেই পেয়ে থাকি। কিন্তু, অনেক খেলোয়াড়কেই বেশী ভিটামিন খাওয়ানো হয়। যা তাদের বিপদেই ফেলে। অনেক সময় বিশেষ কিছু হেলথ ড্রিঙ্ক দেওয়া হয় খেলোয়াড়দের। এগুলোর মধ্যে এমন অনেক গোপন রাসায়নিক থাকে যা ড্রাগের পর্যায়ে পড়ে। সবাইকেই এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
খেলাধুলায় মানসিক বিকাশ
দক্ষতা ও শারীরিক সক্ষমতা থেকেও অনেক সময়ই প্রতিযোগিতার আসল সময়ে সফল হতে পারেন না অনেকেই। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ, ২০২৩-এর বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সব ম্যাচ জিতেও শেষের একমাত্র ম্যাচ, ফাইনালে হেরে যাওয়া। এর কারণ, খেলার সময়, খেলা-সংক্রান্ত বিষয়ে মন না দিয়ে, খেলার ফলাফল কী হবে তাই নিয়ে চিন্তামগ্ন থাকতে গিয়ে খেলায় মনোযোগ হারানো। আবেগ ও উত্তেজনার নিয়ন্ত্রণেরও প্রয়োজন ভীষণ। বিফলতার ভয় তাড়া করে বেড়ায় একজন সফল খেলোয়াড়কেও। এটা আসলে এক খুব বাস্তব সামাজিক ভীতি। অনেকেরই ধারনা, "বেশী আশা করা ভালো নয়, অল্পেই খুশি থাকা উচিৎ"। এই ধরণের বিশ্বাস একবার মনে গেঁথে গেলে, তা শুধু হতাশাই তৈরি করতে পারে। সবসময় মনে রাখা প্রয়োজন, খেলায় জয় এবং পরাজয়, দুটোই হতেই পারে। দু'অবস্হাতেই স্বাভাবিক থাকতে পারা একান্তই প্রয়োজন। ক্রীড়া মনোবিদরা একজন খেলোয়াড়কে এইরকম বিষয়ে সাহায্য করতে পারেন। সারা বিশ্বজুড়ে ভারতীয় যোগা, ধ্যান এরকম কিছু পদ্ধতি অনেকদিন ধরেই এই কাজে খুবই উপযোগী। দেখা গেছে, নিয়মিত ব্যায়ামের ফলে আমাদের মস্তিষ্কে এন্ডরফিন নামে বিশেষ এক হরমোন বার হয়, যা দুশ্চিন্তা কমাতে ও মনমেজাজ ভাল রাখতে সাহায্য করে, ক্রোধ কমায়, খিদে, স্মৃতিশক্তি ও কর্মক্ষমতা বাড়ায়।
ইউরোপ, আমেরিকা সমেত অনেক দেশের খেলোয়াড়রা আমাদের থেকে হয়তো শারীরিকভাবে অনেক বেশী এগিয়ে। তা সত্ত্বেও আমাদের ছেলেমেয়েরা এগিয়ে চলেছে। দেশের জন্য আনতেই হবে একটা পদক - এই মনের জোরে। কোচেরাও প্রাণপাত করছেন। খেলাধুলার মঞ্চে ভারতের বিজয় পতাকা বারবার দুলে উঠুক। স্বপ্ন নয়। অচেনা বাস্তবের সেই দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকব আমরা।
[লেখিকা একজন ক্রীড়া বিজ্ঞানী।]
